অম্লান শ্যাম (ছদ্মনাম), পেশায় লেখক, একটি স্বনামধন্য পত্রিকার উপসম্পাদক। গত এক সপ্তাহব্যাপী তিনি তার অত্যাসন্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা নিয়ে ক্রমাগত গড়িমসি করছেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল পর্যন্ত তিনি নানান অজুহাতে নিজেকে মূল কাজ থেকে সরিয়ে রাখছেন। অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, ঘরদোর গোছাচ্ছেন কিংবা সিনেমা দেখছেন। যে পদমর্যাদায় তিনি আসীন, তা যে তাকে এহেন খামখেয়ালী আচরণের বিন্দুমাত্র অধিকার দেয় না- সে বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল। তিনি জানেন, এই লেখাটি তাকে পাঠকসমাজে আরও বেশি সমাদৃত করবে, পত্রিকার প্রচার বৃদ্ধি পাবে ও জাতীয় একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হবে। অথচ কিছুতেই তিনি তার দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না।
ফাহমিদা আইরিন (ছদ্মনাম), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার কাজে ব্যস্ত। গবেষণার কাজে বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকী অনুসন্ধান করে গবেষণা প্রস্তাবনা তৈরির দায়িত্ব পেয়েছেন তত্ত্বাবধায়কের কাছ থেকে। তার যোগ্যতা, লক্ষ্য, উচ্চাশা কিছুরই কমতি নেই। অথচ তিনি দিন কাটাচ্ছেন বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থেকে, ইউটিউবে রান্নার অনুষ্ঠান দেখে কিংবা গান শুনে। তার গবেষণার কাজে যে সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই, তা জানা সত্ত্বেও তিনি শিক্ষকের নির্দেশ অনুযায়ী না চলে কর্তব্য পালনের প্রতি মনোনিবেশ করছেন না। এই অসাধারন গবেষণা কর্মটি সফলতার মুখ দেখলে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তিনি বিশ্বের সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারবেন, যা তার পরম আরাধ্য স্বপ্ন; অথচ সবকিছু জানা বা বোঝার পরও তিনি সঠিক কাজটিতে নিজেকে নিবেদন করছেন না।
একজন অম্লান অথবা একজন ফাহমিদাকে খুঁজে পেতে চাইলে আমাদের কারোই খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। আমাদের চারপাশেই এরকম অসংখ্য মানুষের বসবাস। বলা ভালো যে, আমরা নিজেরাই অহরহ এই কাজগুলো করে থাকি। প্রায় সময়ই আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব, কাজের ভার, সময়সীমা, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার হাতছানি, সুনাম, খ্যাতি, পদবী হারানোর ভয় কোনো কিছুই যেন আমাদের কর্মমুখী করে তুলতে পারে না। সবকিছু জানা-বোঝার পরও গড়িমসি করার এই অভ্যাস আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কমবেশি এসেছে। হয়তো কাজটি আমাদের পছন্দসই নয়, কাজটিতে আগ্রহোদ্দীপক কিছু নেই, কাজটি জটিল, ব্যর্থতার বিশাল সম্ভাবনা এরকম নানা কারণেই কাজের প্রতি আমাদের বিতৃষ্ণা এসে থাকে।
তখন কাজের প্রতি আমাদের যতই বাধ্যবাধকতা থাকুক না কেন, আমরা তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাই। অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদী সন্তুষ্টি লাভের আশায় অবশ্যম্ভাবী ফলাফলকে ভুলে থাকার এক নিরন্তর যাত্রা। আমরা কেন দায়িত্ব থেকে ক্রমাগত পালিয়ে বেড়াতে চাই বা প্রোক্র্যাস্টিনেট করি? প্রোক্র্যাস্টিনেশন বা দীর্ঘসূত্রতা কোনোভাবেই সময়ের সাথে জড়িত নয় বরং আমাদের আবেগের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত!
কানাডার ক্যারলেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম পাইকাইল, যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুশিয়া সাইরয়েস এই দু'জন মনোবিজ্ঞানীর যৌথ প্রচেষ্টায় চালিত গবেষণা বলছে, যে কাজটি আমাদের করতে হবে, সেটি কোনো না কোনোভাবে আমাদের খারাপ অনুভব করার জন্য দায়ী। হয়তো কাজটি একঘেয়ে, কিংবা কাজটিতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মানসিক এই খারাপ লাগা থেকে মুক্তির জন্য আমরা এক ধরনের আশ্রয় খুঁজি। এই খারাপ লাগা থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা অন্য কিছু করতে উদ্যত হই এবং এর ফলে সাময়িক তৃপ্তি লাভ হয়। আমাদের মস্তিষ্ক আরামদায়ক অবস্থায় পৌঁছে যায়। এই বিষয়ে পাইকাইলের ভাষ্য,
যেকোনো ধরনের আত্ম পরিবর্তন চিরকালই কষ্টসাধ্য। কাজে গড়িমসির অভ্যাস বদলানোটাও সে দিক থেকে যথেষ্টই সাধনার বিষয়। বিষয়টি আয়ত্ত করাটা অনেকটা এক পা এগোলে দু' পা পেছানোর মতো বিরক্তিকর।
ওহায়োর কেইস ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘসূত্রতার আবেগীয় প্রেক্ষাপট বা ইমোশোনাল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের প্রথমেই একটি দুঃখের গল্প পড়তে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের মানসিক অবস্থাকে নেতিবাচক দিকে চালনা করা হয়। এরপর তাদের আসন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হলে দেখা যায়, তারা ভিডিও গেম বা পাজল মেলানোর মাধ্যমে তারা মূল বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এর অর্থ, তারা দীর্ঘসূত্রিতার চক্রে আবদ্ধ হওয়ার তাড়না অনুভব করছেন। এই একই দলকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরেকটি কাজ করা হয়। এই কাজের ফলাফল হিসেবে পাওয়া যায় যে লো মুড কিংবা মন খারাপ শুধু তখনই গড়িমসির প্রবণতাকে বৃদ্ধি করে, যদি মানুষ বিশ্বাস করে যে, তার মেজাজ ভালো হওয়া সম্ভব এবং পারিপার্শ্বিকতায় সে যদি উপভোগ্য কোনো কাজ খুঁজে পায়। অন্যদিকে মুড ফ্রিজিং প্লাসিবোর মাধ্যমে যদি কাউকে বিশ্বাস করানো যায় যে, তার মেজাজ ভালো হওয়ার ন্যূনতম কোনো সম্ভাবনা নেই, তাহলে আশ্চর্যজনকভাবে সেই মানুষটি আর কালক্ষেপণের প্রতি উৎসাহী বোধ করেন না। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় 'হেডোনিক শিফট', যার অর্থ হলো, তাৎক্ষণিক সুখের বিনিময়ে ক্ষণিকের জন্য ভবিতব্য বিষয়াদিকে এড়িয়ে যাওয়া।
এ পর্যায়ে ফুশিয়া সাইরয়েসের আরেকটি গবেষণা নিয়ে কথা বলা যাক। 'ক্রনিক প্রোক্র্যাস্টিনেশন' বলতে বোঝানো হয় কালক্ষেপণ বা গড়িমসি করার প্রবণতা যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়। এই ধরনের একজন মানুষ নিয়মিতভাবে, দিনের পর দিন কাজের সময় ঘনিয়ে এলেই গড়িমসি করা শুরু করেন। কোনো ব্যক্তি সার্বক্ষণিক দীর্ঘসূত্রিতায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার বেশ কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
সাইরয়েসের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ক্রনিক প্রোক্র্যাস্টিনেশন একজন ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার ভালনারেবিলিটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ, যারা কালক্ষেপণের প্রতি একটি নির্দিষ্ট মাত্রার অভ্যস্ততা তৈরি করে ফেলেছেন, তাদের বিষণ্ণতা, দুঃশ্চিন্তা, উচ্চ রক্তচাপ, ঠাণ্ডা, জ্বর ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, গড়িমসি করার সাথে এসব অসুস্থতার সম্পর্ক কোথায়? এর দু'টো উৎস রয়েছে। প্রথমত, দীর্ঘসূত্রিতার দরুন ব্যক্তিগত জীবনে লক্ষ্যে পৌঁছানো থেকে একজন মানুষ ক্রমাগত দূরে সরে আসতে থাকে। ব্যর্থতার এই উপর্যুপরি নিদারুণ কষাঘাতে তিনি গভীর হতাশায় পর্যবসিত হন এবং তিনি যতই কাজকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান না কেন, এই এড়িয়ে যাওয়া তার মস্তিষ্কে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, কালক্ষেপণের কারণে মূল কাজটি তো তার জন্য বরাদ্দকৃত সময় হারাচ্ছেই, উপরন্তু প্রাত্যহিক জীবনের অন্য অসংখ্য কাজও সঠিক সময়ে সম্পাদিত হয় না। খাওয়া-দাওয়া না হওয়া, ব্যায়াম না করা, পরিমিত পরিমাণে ঘুম না হওয়া- এসব তখন দৈনন্দিনতার অংশ হয়ে পড়ে।
এ পর্যন্ত আলোচনায় একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, কালক্ষেপণ বা গড়িমসি করার অভ্যাস কোনোভাবেই সময়ের সাথে জড়িত নয়। এটি একটি মুড নির্ভর অভ্যাস, তাই এর সমাধানও কর্পোরেট হলে চলবে না, হতে হবে মন নির্ভর। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থী দীর্ঘসূত্রিতায় অভ্যস্ত, তাদের সাইকোলজিক্যাল ইনফ্লেক্সিবিলিটি স্কোর বেশি হয়। অর্থাৎ, তারা তাদের আবেগ দ্বারা চালিত হন। ভয়, আশঙ্কা, দুঃশ্চিন্তা- এসব তাদেরকে তাদের দায়িত্ব থেকে দূরে ঠেলে দেয়। একইসাথে তাদের কমিটেড অ্যাকশন স্কোর অধিক হয়। অর্থাৎ, তারা তাদের কাজের প্রতি সত্যিকার অর্থেই প্রতিশ্রুতিশীল থাকতে পারেন না। যেকোনো ধরনের নেতিবাচক অনুভূতি দ্বারা তারা সহজেই প্রভাবিত হয়ে কাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা হারিয়ে ফেলেন।
কালক্ষেপণের এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কাজকে ক্ষুদ্রতম অংশে ভাগ করে নিতে হবে। একটি বৃহৎ কলেবরের কাজের সর্বনিম্ন যে অংশটুকু এক দফায় করা সম্ভব, সেটুকুই করতে হবে। এছাড়াও কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়ার জন্য অতীত-ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি না রেখে বর্তমান, ঠিক এই মুহূর্তের বহমানতায় ডুবে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ধ্যান একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হতে পারে!
This article is about procrastination and is written in the Bengai language.
All the necessary references are hyperlinked within the article.
Featured Image: Human Resources Online