আধুনিকতার ভিড়ে ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়াটা নতুন নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেনে নেওয়া যায় না, এমনও নয়। কিন্তু এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য যদি কোনো জীবন্ত প্রাণী হয়, তাহলে তার জন্য কে বা কারা দায়ী, সেটা খুঁজে বের করে শাস্তি দিলেও কিন্তু ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। এরপরও বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে। ডাইনোসরের গল্প এখন বিজ্ঞানের গবেষণা ও কিংবদন্তির গল্পের চেয়ে বেশি কিছুই নয়। কিছুদিন আগেই জানা গেলো যে ‘রিও’ নামক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘ব্লু’ নামক নীল রঙের ম্যাকাও পাখিটি আজ শুধু চলচ্চিত্রেই আবদ্ধ, বাস্তবে তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। এরকম পরিণতিই কি রয়েছে বাংলার বাঘের ভাগ্যেও?
কিছু কিছু গবেষণার ফলাফল তো সেদিকেই ইঙ্গিত করছে! আবহাওয়ার পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন পরিবেশ দূষণজনিত কারণে বাসস্থানের অভাবেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিলুপ্তি ঘটতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। বাসস্থান সংকটের কারণে সম্ভাব্য বিলুপ্তপ্রায় ৫০০,০০০ প্রজাতির স্থলজ প্রাণীর মধ্যে বাংলার বাঘের নামটিও রয়েছে জাতিসংঘের প্রকাশিত একটি তালিকায়।
বাংলাদেশ ও ভারত জুড়ে প্রায় ৪,০০০ বর্গ মাইল বিস্তৃত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবন। শত শত প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর খাদ্য বাসস্থানের যোগান দেয় এই বন। অস্ট্রেলিয়ান ও বাংলাদেশি ১০ জন বিজ্ঞানীর প্রকাশিত একটি জার্নাল ‘সায়েন্স অফ দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ এ বলা হয়েছে, সুন্দরবনের প্রায় ৭০ ভাগ অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে মাত্র কয়েক ফুট ওপরে রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার এর ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই বনের রাজা পুরোপুরি বিলুপ্ত হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। ২০৭০ সাল নাগাদ বাংলাদেশি অংশের সুন্দরবনে কোনো রয়েল বেঙ্গল টাইগার জীবিত থাকবে না বলে তাদের মত।
বেশ কয়েক দশকের জোয়ার-ভাঁটার উচ্চতার মাত্রা নিয়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে, জোয়ারের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে সৃষ্ট নদীমাতৃকতাই এই উচ্চতা বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে বলে জানানো হয়েছে। ২০১০ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ এর প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে (সে সময় থেকে) সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ ইঞ্চির মতো বাড়লে কয়েক দশকের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা প্রায় ৯৬ শতাংশ কমে যাবে। অনেক প্রজাতির প্রাণীর ক্ষেত্রেই বাস্তবের পরিণতি গবেষণায় প্রকাশিত ফলাফলের চেয়েও ভয়াবহ প্রমাণিত হয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ছাড়াও বাঘের বাসস্থানের অভাবের অন্যান্য কারণ খুঁজতে গিয়ে, শরীফ এ. মুকুল ও তার সহকারী গবেষকেরা একটি রিপোর্টে বলেছেন, ২০৫০ থেকে ২০৭০ সালের মধ্যে উক্ত বাসস্থানের পরিমাণ ৫.৪ থেকে ১১.৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১৯০০ সাল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত বাসস্থানের অভাব, শিকার ও অবৈধভাবে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে ঘটিত বাণিজ্যের কারণে বাঘের সংখ্য ১০০,০০০ থেকে কমে মাত্র ৪,০০০ এ দাঁড়িয়েছে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ তথা বাসস্থান ও খাদ্য সংস্থানের বিভিন্ন পরিবর্তনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশীয় সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি রয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। কারণ তখন বাসস্থান ও খাদ্যের খোঁজে বাঘেরা মানুষের বসবাসের এলাকায় পাড়ি জমাবে এবং এই দুই প্রজাতির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাঘ শিকারের পরিমাণও বেড়ে যাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, সাইক্লোন ও কোনো রোগের প্রকোপেও বাঘের বাসস্থান ও খাদ্য সংস্থানের অভাব ঘটতে পারে।
তবে প্রতিটি বিষয়ের মতো এখানেও অন্ধকারের পাশাপাশি আলোর সহাবস্থান আছে, যদিও সেই আলোর উজ্জ্বলতা খুবই ম্লান। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফার সুগত হাজরা, গবেষণার মাধ্যমে জানিয়েছেন যে আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রাণীর বাসস্থানের অভাব নিশ্চিতভাবেই ঘটলেও, বাঘের পরিণতি ততটা ভয়াবহ না-ও হতে পারে। বাংলাদেশ বনবিভাগের একজন কর্মকর্তা জহির উদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, সুন্দরবনের অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমি ও বাঘের বাসস্থান সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে উচ্চ মাত্রার লবণাক্ত পানিতে জন্মানো সম্ভব এমন ফসলের উৎপাদন শুরু করা হয়েছে। ঝড়ের কারণে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য সরকার ঐ সকল অঞ্চলে এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধী দেয়াল গড়ে তুলেছেন। পলি ও বালির অবস্থানে আনা বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতা স্বাভাবিকভাবেই অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে ‘বেঙ্গল টাইগার কনজারভেশন অ্যাক্টিভিটি (বিএজিএইচ)’ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের বাঘ গণনা কার্যক্রম শেষে, বাংলাদেশ বন বিভাগ জানিয়েছে যে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। গত তিন বছরে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে আটটি। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। আর এ বছরে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ এর মাধ্যমে বাঘ গণনার পরে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১১৪। বন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালে ইউএসএআইডি এর ‘বিএজিএইচ’ বা ‘বাঘ’ প্রকল্পের অধীনে ক্যামেরো ট্র্যাপিং এর মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্যায়ের এই বাঘ গণনা কার্যক্রম শুরু হয়।
২৪৯ দিন ধরে পরিচালিত এই জরিপে মোট চারটি ধাপে তিনটি ব্লকের (সাতক্ষীরা, খুলনা ও শরণখোলা রেঞ্জ) ১৬৫৬ কিলোমিটার এলাকায় ক্যামেরা বসিয়ে এই গণনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে উক্ত তিনটি ব্লক জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশীয় সুন্দরবনে ৬৩টি পূর্ণ বয়স্ক বাঘ, ৪টি জুভেনাইল বাঘ (১২-১৪ মাস বয়সী) এবং ৫টি বাচ্চা বাঘ (০-১২ মাস বয়সী) এর মোট ২৪৬৬টি ছবি পাওয়া গেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এই কার্যক্রমে মোট ১১৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বর্তমানে এই প্রকল্পের অধীনে সু্ন্দরবন অঞ্চলে বাঘ সংক্রান্ত গবেষণা এবং বাঘ সংরক্ষণ ও এই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চলছে।
ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মনিরুল এইচ খান বলেন, “বাঘ গণনার ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিই সবচেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক । তাছাড়া সুন্দরবনের যেসব এলাকায় বাঘ বাস করে সেখান থেকে সঠিক তথ্য বের করতে পায়ের ছাপের চেয়ে ক্যামেরা ট্র্যাপিংই সবচেয়ে কার্যকর।” আর বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, “বাঘের সংখ্যা বেড়েছে না বলে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কথা হচ্ছে বাঘ কমে যায়নি। সুন্দরবনের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এটা কিন্তু বেশ আশার কথা। যদিও এটা ঠিক যে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি মানে একেবারে ১০৬টিই বা ১১৪টি মানে একেবারে ১১৪টিই বিষয়টি তো এমন নয়। তবে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসা এ সংখ্যাটি মোটামুটি বাস্তব সংখ্যার কাছাকাছি।”
আবহাওয়ার পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ জনিত বিভিন্ন সমস্যা এবং বন উজাড় ও বাঘের খাদ্য সংকটজনিত সমস্যার কারণে বা বাঘে-মানুষে লড়াই এর কারণে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার চেয়ে, ডক্টর খান মনে করেন যে চোরা শিকারীদের তৎপরতা এই ভয়াবহ পরিণতির সবচেয়ে বড় কারণ। তাই তার মতে, এই তৎপরতা বন্ধ করার দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। শুধুমাত্র বাঘ শিকারের কারণেই বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাবে না। বনাঞ্চলে বাঘের অন্যতম প্রধান খাদ্য হরিণ শিকারের কারণেও বাঘের খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় বাঘের সংখ্যা কমে যাবে।
বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বন। এই বন উজাড় হয়ে গেলে বাসস্থান ও খাদ্য উভয় প্রকার সংকটের কারণেই বাঘ সহ অন্যান্য প্রাণী খুব দ্রুত এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ বনাঞ্চল থেকে সরিয়ে অন্য কোনো স্থানে সংরক্ষণ করে বন্যপ্রাণীর ‘প্রতিপালন’ সম্ভব নয়। তাই এই বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরির প্রয়োজন যেমন রয়েছে, তেমনি জীবিকা নির্বাহের জন্য বাঘ বা অন্য কোনো বন্য প্রাণী হত্যা বন্ধ করতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
This article, written in Bengali, describes the effects of multiple warnings provided by scientists around the world regarding the extinction of Royal Bengal Tiger due to climate change. The sources have been hyperlinked inside the article.
Featured image: nicholasdaines.com