Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভাতের মাড় ফেলে দেন রোজ? জেনে নিন এর গুণাগুণ 

“দেখা হয় নাই শুধু চক্ষু মেলিয়া

ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটা ঘাসের শিষের ডগায়

একটা শিশির বিন্দু”

ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক সময় নিজের দেশের দর্শনীয় অসাধারণ জায়গাগুলো না দেখে মানুষ ছুটে বেড়ায় বিদেশের এখানে সেখানে, খরচ করে কাড়ি কাড়ি টাকা। তবে কি শুধু ভ্রমণের ক্ষেত্রেই এমন হয়? অন্যান্য আরো অনেক বিষয়েই দেখা যায় আমাদের হাতের কাছেই থাকে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি, ঘরেই খুঁজে পাওয়া যায় বা বানিয়ে নেওয়া যায় দরকার মতো উপকারী উপাদান অথচ আমরা হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরি পুরো বাজার, এ দোকান থেকে সে দোকান। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণটা বোধ হয় দেওয়া যায় স্বাস্থ্যরক্ষা আর সৌন্দর্যচর্চার ক্ষেত্রে। অনেক টাকা খরচ করে সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষী মানুষ বিভিন্ন উপকারের আশায় নানা কৃত্রিম প্রসাধনী ব্যবহার করে। অথচ ঘরে তাদের হাতের কাছেই থাকে সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি উপকারী নানা প্রাকৃতিক উপাদান, যেগুলো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই দেয় কাঙ্ক্ষিত ফল। কিন্তু এসব প্রাকৃতিক উপাদানের উপকারিতা ও ব্যবহার আমরা অনেকেই জানি না। ভাতের মাড়ের কথাই ধরুন না। ঘরে ঘরে এদেশে তিন বেলা ভাত হয়, রোজ তিন বেলা ঘরে ঘরে ভাতের মাড় ফেলে দেওয়া হয়। অথচ আমরা অনেকেই জানি না কত ভালো স্বাস্থ্যগুণ আর সৌন্দর্যগুণে ভরপুর অতি সাধারণ এই ভাতের মাড়!

এদেশের প্রতি ঘরে রোজ চুলায় ভাতের হাঁড়ি তো ওঠেই; source: greatbritishchefs.com

সাধারণ এই ভাতের মাড় দেহের তাপমাত্রার তারতম্য রোধ করতে বেশ উপযোগী। বিশেষ করে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে এই তরল গ্রহণ করলে উপকার পাওয়া যায়। এশিয়ার অনেক দেশেই তাই জ্বরের প্রাথমিক দেখাশোনায় রোগীকে ভাতের মাড় খাওয়ানো হয়।

যেকোনো ধরনের চাল থেকেই পাওয়া যায় মাড়; source: coach.nine.com.au

শরীরের বিপাক ক্রিয়ার সহায়তাকারী অন্যতম সাধারণ ও ফলদায়ক খাবার হলো ভাতের মাড়। বদহজম ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কমাতেও কাজ করে। তবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর জন্য একটি অতি পরিচিত তরল হলো ভাতের মাড়। শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়া সারাতে ও ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতা রোধ করতে ভাতের মাড়ের ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করা হয়। ‘ওরাল রিহাইড্রেশন সল্যুশন’ বা ‘ওআরসি’র করা এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, যে সকল শিশুরা নিয়মিত ভাতের মাড় তরল হিসাবে গ্রহণ করে, তারা আন্ত্রিক সমস্যাতে কম আক্রান্ত হয়। সেইসাথে এই তরল বলকারক ও শরীরে বেশি সময় পানি ও শক্তি ধরে রাখতে পারে বলে ডায়রিয়া রোগীর জন্য এটি একইসাথে তরল ও ভারি খাবার হিসাবে কাজ করে। তবে শুধু রোগীর জন্য নয়, সাধারণ তরুণ থেকে মধ্যবয়সী, বিশেষ করে কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্ত মানুষদের জন্যও এই শর্করাসমৃদ্ধ তরলটি একটা স্বাস্থ্যসম্মত শক্তিবর্ধক পানীয়। বাজারের কৃত্রিম ‘এনার্জি ড্রিংকের’ ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচতে এবং শরীরে শক্তির যোগান দিতে ভাতের মাড় কিন্তু দারুণ সমাধান।

স্বাস্থ্যকর খাবার বা পানীয়ের কথা বলতে গেলে ভিটামিনের কথা বলতেই হয়। ভাতে ও ভাতের মাড়ে থাকা ভিটামিন সম্পর্কে আমরা কয়জন জানি? অথচ ভাত কিন্তু থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, নায়াসিন ও ভিটামিন ‘বি৬’ সমৃদ্ধ এক শস্য জাতীয় খাবার। আবার এতে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। এসকল ভিটামিন শরীরের জন্য অত্যন্ত দরকারি। দৃষ্টিশক্তি ও ত্বকের জন্য রিবোফ্লাভিন উপকারী, নায়াসিন স্নায়ুতন্ত্রে কাজ ও হজম ক্রিয়ায় সাহায্য করে। আবার মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য ভিটামিন বি৬ অপরিহার্য।

চাল সিদ্ধ করার পর এই তরলেই যে এসব ভিটামিনের অধিকাংশ চলে আসে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশুদের জন্য ভিটামিনসমৃদ্ধ তরল খুঁজলে তাই প্রথমদিকেই রাখা যায় ভাতের মাড়ের কথা। বিশেষ করে শিশু যখন প্রথম মায়ের বুকের দুধ ছাড়া অন্যান্য তরল খাবারে অভ্যস্ত হতে শুরু করে, সেই সময়ে সহজ হজম ও পুষ্টিগুণ পূরণের জন্য প্রথম নরম খাবার হিসেবে ভাতের মাড়ের কথা বলে থাকেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তবে চার মাসের কমবয়সী শিশু এবং ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

শিশুদের জন্য অত্যন্ত উপকারী এই পানীয়; source: seriouseats.com

এগুলো ছাড়াও ভিটামিন সমৃদ্ধ এই তরল পানীয় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ভূমিকা রাখে। ভিটামিন ছাড়াও খনিজ পদার্থ ও অ্যামিনো এসিডের উপস্থিতির কারণে এটি শরীরের প্রদাহজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর। পেশী গঠনেও সাহায্য করে ভাতের মাড়। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ব্যবহার করা যায় এই তরল। ভাতের মাড় মিশ্রিত পানিতে গোসল শরীর ও মনের ক্লান্তি দূর করত অনেক উপকারী বলে জানা যায়।

এ তো গেল অতি সাধারণ এই তরল পানীয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক গুণাগুণ। তাই বলে সৌন্দর্যচর্চাতেও কিন্তু এর কার্যকারিতা কোনো অংশে কম যায় না। ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যের পক্ষে এর অসাধারণ উপকারিতার জন্য এশিয়ার অনেক দেশের সংস্কৃতিতেই এর ব্যাপক ব্যবহারের প্রচলন। জাপানের মেয়েদের, বিশেষ করে নারী কৃষকদের, সৌন্দর্যচর্চার অন্যতম প্রধান উপাদান এই ভাত সিদ্ধ পানি। চীনের হুয়াংলুও গ্রামের ‘ইয়ায়ো’ উপজাতির মেয়েরা তাদের অত্যন্ত ঘন, দীর্ঘ ও ঝলমলে চুলের জন্য বিখ্যাত। বলা হয়, ভাত সিদ্ধ পানি দিয়ে নিয়মিত চুল ধোয়াটাই তাদের এই মনভোলানো চুলের গোপন রহস্য। এত যার নামডাক, সৌন্দর্যরক্ষায় তার গুণাবলী জানা যাক এবার।

ত্বক ও চুলের যত্নে প্রচলিত রয়েছে এই তরলের ব্যাপক ব্যবহার; source: blackhairinformation.com

২০০২ সালে বেলজিয়ামের ভ্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে করা এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বংশগতভাবে পাওয়া ত্বকের সমস্যা উপশমে দৈনিক দুবার ভাতের মাড় মিশ্রিত পানিতে ১৫ মিনিটের গোসল অনেক উপকারী। আবার ব্রণের প্রাদুর্ভাব কমাতেও এটি কাজ করে, দূর করে ব্রণের পরে ত্বকের লালচে ভাব। তুলার সাহায্যে আক্রান্ত স্থানে পরপর কয়েকবার ভাতের মাড় দিয়ে শুকিয়ে যাওয়ার পর ধুয়ে ফেললেই হয়। এছাড়া এটি ত্বকের লোমকূপের মুখ সংকুচিত করে, ত্বককে টানটান করে। দৈনন্দিন ত্বকের পরিষ্কারক হিসাবেও ভাতের মাড় যথেষ্ট কার্যকর।

সৌন্দর্য চর্চায় ভাতের মাড়ের ব্যবহার ত্বকে দ্রুত বয়সের ছাপ পড়া থেকে রেহাই দেয়। আবার রোদে পোড়া ভাব কমাতেও এর জুড়ি মেলা ভার। এককথায় বলা যায়, বুড়িয়ে যাওয়ার মতো ত্বকের ক্ষতি সূর্যের কড়া রোদ, পরিবেশ, দুষণ বা বয়স বৃদ্ধি যে কারণেই হোক না কেন, ভাতের মাড় হতে পারে তা উৎরানোর এক প্রাকৃতিক মাধ্যম। এই পানীয়তে বিদ্যমান থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, ফ্লাভোনয়েড ও ফেনোলিকের মতো উপাদান ত্বকের সুস্থতার জন্য কাজ করে। অন্যদিকে চুল পড়া রোধ করতে, নতুন চুল গজাতে, চুলের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং সেই সাথে ঝরঝরে-ঝলমলে চুল পেতেও দীর্ঘসময় ধরে নিজেকে প্রমাণ করে চলেছে ভাতের মাড়।

আর চুলের বৃদ্ধি দ্রুত করতে এর উপকারের কথা তো এখন চীনের ইয়াও গ্রামের মেয়েদের মাধ্যমে পৃথিবীর নানা প্রান্তে পৌঁছে গেছে। এই গ্রামের অধিকাংশ মেয়েদের চুল প্রায় পাঁচ ফুট বা তার চেয়ে বেশি দীর্ঘ। তাদের এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য এই গ্রামটির নাম গিনেজ বুকে উঠেছে সবচেয়ে দীর্ঘ চুলের অধিকারী মহিলাদের গ্রাম হিসাবে। এই গ্রামের মেয়েদের কাছে এই পানীয় অন্যতম প্রধান প্রসাধনী উপাদান। নিয়মিত তারা জমির চাল ভিজিয়ে রাখা পানিতে গোসল ও চুল ধুয়ে থাকে। তারা বিশ্বাস করে যে, এটিই তাদের দীর্ঘ চুলের সৌন্দর্যের আসল রহস্য।

ইয়াও গ্রামের নারীরা দীর্ঘ চুলের যত্নে ব্যবহার করে চাল ভেজানো পানি; source: ygamretuta.me

তবে পান করা বা সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহার- যে কারণেই ভাতের মাড় ব্যবহার করা হোক, খেয়াল রাখতে হবে যে তরলটি যেন ঠাণ্ডা বা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকে। সিদ্ধ ভাতের মাড় যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনি ১৫-২০ মিনিট পরিষ্কার ও ধোয়া চাল ভিজিয়ে রাখা পানিও ব্যবহার করা হয়। এতে সেই পানির মধ্যেও চালের অনেক পুষ্টি উপাদান চলে আসে । বায়ুরোধক বোতলে ও রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করে চার থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায় এই তরল, তবে খাওয়ার জন্য সংরক্ষণ না করাই উত্তম।

ফিচার ইমেজ : modernghana.com

Related Articles