
চলছে পবিত্র মাহে রমজান। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে সিয়াম সাধনার অংশ হিসেবে এ মাসে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরকে সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকতে হয় যাবতীয় পানাহার থেকে। ফলে বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে রোজাদারদের খাবারের সময়সূচিতে আসে বড় ধরনের পরিবর্তন। রোজা রাখলে খাদ্যগ্রহণের আদর্শ নিয়ম মেনে দিনে তিন বেলা অর্থাৎ সকাল, দুপুর ও রাতে খাওয়া সম্ভব হয় না। বরং রাতের খাবারের পাশাপাশি অন্য দুটি খাবারের সময় হিসেবে আবির্ভূত হয় ভোররাতের সেহরি এবং সন্ধ্যার ইফতার।
যেহেতু বছরের বাকি ১১ মাসের খাদ্যসূচি আর রমজানের খাদ্যসূচি একেবারেই আলাদা, তাই সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে এ মাসে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায়ও কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসা খুবই জরুরি। আড়ম্বরপূর্ণ ও ভারী খাবারের বদলে এ মাসে যথাসম্ভব সহজপাচ্য ও স্বাভাবিক খাবারের উপর গুরুত্বারোপ করার কথাই মূলত বলেন পুষ্টিবিদরা। তবে এটাও খেয়াল রাখতে হয় যেন কোনোভাবেই ব্যালান্সড ডায়েট বা সুষম খাবারে ব্যত্যয় না ঘটে।
রমজানে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেন গুরুত্বপূর্ণ?
স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রমজানে এর গুরুত্ব বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
দিনের বেলা রোজা থাকা অবস্থায় আমরা কোনো কিছু খেতে বা পান করতে পারি না। কিন্তু দৈনন্দিন শারীরিক কার্যকলাপ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমাদের শরীরের তো শক্তির প্রয়োজন। এই শক্তি সে কোথায় পাবে? এজন্য আগের দিনের খাবার থেকে প্রাপ্ত ক্যালরি যখন সব শেষের পথে থাকে, তখন শরীর যকৃত ও পেশীতে মজুদকৃত কার্বোহাইড্রেট ও স্নেহ ব্যবহার করতে শুরু করে।
এদিকে আমাদের শরীর কিন্তু খুব বেশি পানিও মজুদ রাখতে পারে না। মূত্রের সাথেই শরীর থেকে অধিকাংশ পানি বের হয়ে যায়। এদিকে আবহাওয়া গরম থাকলে তো কথাই নেই, ঘামের সাথেও বের হয়ে যায় পানি। শরীরের মাঝে কেবল কিডনিই যথাসম্ভব চেষ্টা করে পানি জমিয়ে রাখার জন্য, এবং মূত্রের সাথেও সে বেশি পানি বের হতে দিতে চায় না। তাই এক কিডনির উপরই চাপ পড়ে যায় অনেকখানি।
এ তো গেল রোজার দিনে শরীরে পানি নিয়ে কী হয় তার উদাহরণ। এমন করেই, শরীরের অভ্যন্তরে শক্তির যে স্বাভাবিক বিন্যাস ঘটে, রোজা থাকা অবস্থায় তার অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। শরীরের প্রতিটি শক্তির উৎসের উপরই বাড়তি অনেক চাপ পড়ে, ফলে সেগুলোর কর্মক্ষমতাও কমতে থাকে ধীরে ধীরে। আর এ কারণে ইফতারে রোজা ভাঙার পর আমরা যা খাব, তা যদি স্বাস্থ্যসম্মত না হয়, অর্থাৎ শরীরের শক্তির উৎসগুলো যদি সকল চাহিদা পূরণ করে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে, তাহলে আমাদের পক্ষে রোজা রেখে বেশিদিন শারীরিক সুস্থতা ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
অসুস্থতার প্রাথমিক প্রভাব হিসেবে আমাদেরকে সম্মুখীন হতে হবে পেটের সমস্যা, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, অবসাদ, আলসার, অ্যাসিডিটি, হজমের গণ্ডগোল ইত্যাদি নানান রকম শারীরিক সমস্যার। আর এসব সমস্যা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতরই হতে থাকবে। কিন্তু এমন পরিস্থিতি যেন না আসে, তা নিশ্চিত করতে চাইলে রমজান মাসে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
পানি পানে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব
এবারের রমজান মাসটি পড়েছে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে। দিনের বেলা প্রতিদিনই তাপমাত্রা থাকছে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। তাই এসময় শরীরে যেন পানিশূন্যতা দেখা না দেয়, তা নিশ্চিত করতে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং মৌসুমি ফল ও সবজির জুস পান করতে হবে। ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অন্তত দেড় থেকে দুই লিটার বা ৮-১০ গ্লাস পানি পান করলে ভালো হয়। তবে কার্বোনেটেড ও সুগার ড্রিংক, চা ও কফি পান করলে শরীর থেকে অধিক পানি বের হয়ে যায়। তাই রমজান মাসে কার্বোনেটেড, বেভারেজ ও সুগার ড্রিংক বা বেশি চিনিযুক্ত নানা ধরনের শরবত পরিহারই করা উচিত।
এড়িয়ে চলতে হবে তৈলাক্ত খাবার
অন্য যে জিনিসটি অবশ্যই পরিহার করতে হবে তা হলো অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার। বেশি তেল ব্যবহৃত হয়েছে এমন খাবার খেলে দেহের লিপিড প্রোফাইল খারাপ হয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। সুতরাং ইফতারে ঘটা করে প্রচুর তেলে ভাজা পেঁয়াজু, বেগুনি, ডাল ও সবজি বড়া, আলুর চপ, হালিম, বিভিন্ন ধরনের কাবাব, তেহারি, বিরিয়ানি ইত্যাদি খাওয়ার যে চল রয়েছে, মন খারাপ হলেও তা শরীরের স্বার্থে এড়িয়ে চলাই হবে উত্তম।
যা থাকা উচিৎ রোজাদারের খাদ্যতালিকায়
আমাদের পরিচিত ইফতার আয়োজনের মধ্য থেকে একজন সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান রোজাদারের জন্য যে কয়টি খাবার ভালো হবে তা হলো খেজুর, দই-চিড়া, ঘরের তৈরি বিশুদ্ধ শরবত, কচি শসা, ছোলা আর ফরমালিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইডমুক্ত মৌসুমি ফল। এখন যেহেতু গ্রীষ্মকাল তথা মধুমাস, তাই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে হরেক রকমের ফলমূল। ইফতারির খাদ্যতালিকায় এসব ফলমূলকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ, কেননা এগুলো থেকে পাওয়া যায় প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল, যা দ্রুত খাদ্য পরিপাকের মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে, কম তেল দিয়ে নুডুলস, পাস্তা ইত্যাদিও রান্না করা যেতে পারে নানান রকমের সবজি ও মাংস সহকারে।
এবার আসা যাক রাতের খাবার ও সেহরির প্রসঙ্গে। এই দুই সময়ের খাদ্যতালিকায়, বিশেষত সেহরিতে অবশ্যই থাকা চাই আমিষ, শর্করা, ভিটামিন, ফাইবার ইত্যাদির সমন্বয়ে সুষম খাবার। কেননা সেহরিতে অনেক বেশি পরিমাণ খেলেও যে তা দীর্ঘসময় পেটে থাকবে এমন নয়, কিন্তু সেসময় যদি শরীরের প্রয়োজনীয় ক্যালরির চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়, তাহলে সারাদিন না খেয়ে থাকলেও শরীর সহজে দুর্বল হয়ে পড়বে না।
হালকা ইফতারের পর এশার নামাজ ও তারাবি পড়ে রাতের খাবার খেয়ে নেওয়া উচিৎ। এসময় খাদ্যতালিকায় ভাত বা রুটির পাশাপাশি থাকতে হবে আমিষের প্রাধান্য, যেমন: মাছ বা মুরগির মাংস, ডিম, ডাল। সেই সাথে সবুজ বা মিশ্র শাকসবজি খেতে হবে অবশ্যই। ঠিকই একই নিয়ম মেনে চলতে হবে সেহরিতেও। সে সময়ের খাদ্যতালিকায়ও ভাতের সাথে মাছ বা মুরগির মাংস, ডাল, শাকসবজি, ফলমূলও রাখতে হবে। তবে কারো যদি কিডনি রোগ বা গেঁটে বাত থাকে, তার ডালজাতীয় খাবার পরিমাণে খুব কম খাওয়া উচিৎ।
রমজানে আমিষের চাহিদা পূরণ
অনেকেরই একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, রমজান মাসে যেহেতু শরীর সুস্থ রাখতে ভারী খাবার এড়িয়ে চলা উচিৎ, তাহলে হয়তো মাছ মাংসও খাওয়া যাবে না। এটি একদমই ভুল ধারণা। সারাদিন না খেয়ে থাকার পর, কিংবা আবারও একটি দিন রোজা রাখার আগে শরীরে প্রয়োজনীয় আমিষের যোগান দিতেই হবে। আর মাছ-মাংসই তো আমিষের সর্বোৎকৃষ্ট আধার। সুতরাং যারা এসময় একেবারেই মাছ-মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন, তারা না জেনে-বুঝে নিজেদের শরীরেরই ক্ষতি করেন।
তবে হ্যাঁ, রমজান মাসে মাংস খাওয়াও শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি আমরা সুস্বাস্থ্যের অন্যান্য নিয়মগুলো মেনে না চলি। মাংস মানেই যে অনেক তেল-মসলাযুক্ত খাবার, সেই ধারণা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে শতভাগ। অনেক তেল-মসলা দিয়ে রান্না করলে মাংস অনেক বেশি সুস্বাদু হয় বটে, কিন্তু তাতে করে সহজেই বদহজম ও গ্যাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই মাংস রান্না করতে হবে একেবারেই পরিমিত তেল ও মসলা সহযোগে। সেহরি ও ইফতারে সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে স্বাস্থ্যকর মাংস ব্যবহার করা উচিৎ সবারই, আর এমন মাংসের জন্য ভরসা রাখতে পারেন বেঙ্গল মিটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর, যারা নিশ্চয়তার সাথে উৎপাদন করছে হালাল, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর মাংস। তাছাড়া নানারকম ব্যস্ততার মাঝে রান্নার ঝামেলা আর গরমের কষ্ট নিয়েও চিন্তা করেন অনেকে, এসবের সহজ সমাধান হিসেবে মেরিনেটেড (রেডি টু কুক) আর কোল্ড-কাট (রেডি টু ইট) মাংস তো আছেই!
মুরগির মাংস বনাম গরু ও খাসির মাংস
খেয়াল করে দেখবেন, সেহরি ও রাতের খাদ্যতালিকায় নির্দিষ্ট করে মুরগির মাংসের কথাই লেখা হয়েছে। এর কারণ হলো, সারা দুনিয়ার সকল পুষ্টিবিদই রমজান মাসে শরীরের আমিষের চাহিদা পূরণে মূলত মুরগির মাংস খাওয়ারই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাহলে কি অন্যান্য মাংস একেবারেই খাওয়া যাবে না? তা নয়। চাইলে আমরা গরু বা খাসির মাংসও খেতে পারি, কিন্তু তা অবশ্যই মাছ বা মুরগির মাংসের মতো নিয়মিত খাওয়া যাবে না। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই মুরগির মাংস বা মাছ খাওয়ার পাশাপাশি, এক বা সর্বোচ্চ দুইদিন গরু বা খাসির মাংস খাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাও অবশ্যই হতে হবে পরিমিত পরিমাণে।
সংক্ষেপে এই হলো রোজাদারের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার নিয়ে আলোচনা। বছরের বাকি দিনগুলোর চেয়ে বেশি পূণ্য অর্জনের জন্যই পৃথিবীব্যাপী মুসলমানরা সাধনা করেন এই মাসে। এই একটি মাসের জীবনাচরণও হয়ে থাকে বিশেষ ধরনেরই। মনে রাখা দরকার, শরীর ঠিক রাখতে সঠিক খাবারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই, তাই রোজার মাসে সবকিছুর মতো খাবারটাও যেন হয় বিশেষ ধরনেরই।

This article is on healthy foods and importance of protein intake in Ramadan.
Featured Image Source: