ফ্যাশন জগতের সাথে পরিচিত সকলেই পোশাকের দুটি শ্রেণীর সম্পর্কেও বেশ পরিচিত: রেডি-টু-ওয়্যার (যার আরেক নাম প্রেট-অ্যা-পোর্টার) আর হ্যত কুতুর। 'ডিজাইনার কালেকশন' বলতে আমরা সাধারণত যে পোশাকটির কথা বুঝিয়ে থাকি, তা প্রথম শ্রেণীর পোশাক, যা বিভিন্ন সাইজে বড় আকারের ক্রেতা গোষ্ঠীর জন্য তৈরি করা হয়। প্রতি বছর দুটি ফ্যাশন উইকের কারণে এই রেডি-টু-ওয়্যার ক্যাটাগরি সম্পর্কে সকলেই মোটামুটি জানে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর পোশাকের বিষয়ে ফ্যাশন পেশার সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত মানুষদের বাইরে খুব কম মানুষই জানেন। আর এই শ্রেণীটির একাধিক বিশেষত্ব রয়েছে।
হ্যত কুতুর কী?
অত্যধিক আকর্ষণীয় পোশাকের চেয়েও 'হ্যত কুতুর' নামের তাৎপর্য অনেক বেশি। এতটাই যে, এই নামের ব্যবহার বিধি ফরাসি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আক্ষরিক অর্থে এই নামটি 'হাই স্যুইং' বা 'হাই ফ্যাশন' বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের শুধুমাত্র একটি পূর্ণ পোশাক তৈরির জন্য কর্মীরা ৭০০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে থাকে। আর এই পোশাকের ক্রেতার সংখ্যাও খুবই সামান্য। সর্বসাকুল্যে ২,০০০ ফ্যাশন সচেতন নাগরিক হ্যত কুতুর স্বীকৃত পোশাকের ক্রেতা। কোনো পোশাকের গায়ে যদি 'হ্যত কুতুর' এর তকমা লাগানো থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে সেই নির্দিষ্ট পোশাকটি কোনো একজন ক্রেতার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং এক ডিজাইনের একটিই পোশাক তৈরি করা হয়েছে।
ফ্যাশন জগতে প্রবর্তন
যদিও 'হ্যত কুতুর' ফরাসি শব্দ এবং ফরাসি আইন অনুসারেই ফ্যাশনের এই ক্ষেত্রটি পরিচালিত, কিন্তু এই নামটির ও এই ধরনের ফ্যাশনেবল পোশাকের মূল প্রবর্তক চার্লস ফ্রেডরিক ওয়ার্থ নামক একজন ইংরেজ। ১৮৫৬ সালে প্যারিসে এসে, 'গ্যাগেল' নামক একটি কাপড়ের দোকানে তিনি পোশাক তৈরি করে বিক্রি করার ব্যবস্থা চালু করেন। এর ফলে এই দোকানে আগে যেখানে শুধু কাপড় বিক্রি হতো, সেখানে এরপর থেকে একেবারে পোশাক তৈরি করিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হয়। এভাবে ধীরে ধীরে ক্রেতাদের মধ্যে ওয়ার্থের কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপরে ১৮৫৮ সালে তিনি রু দে লা পেই-তে 'ওয়র্থ এহ বোবার্গ' নামে নিজের একটি বুটিক শপ তথা তৈরি পোশাকের দোকান স্থাপন করেন। এই সময় থেকেই সাধারণ দর্জির পরিবর্তে 'ফ্যাশন ডিজাইনার' নামটিরও প্রবর্তন শুরু হয়।
ওয়ার্থের একজন ক্রেতা ভ্যালেরি ফিউলের পরনে লাইলাক রঙের সিল্ক আর লিলি ফুলের ডিজাইনের একটি পোশাক দেখে সম্প্রতি ৩য় নেপোলিয়নের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর প্রিন্সেস ইউজিন তার ডিজাইনের ভক্ত হয়ে যান। তারপর থেকে ওয়ার্থ ইউজিনের সকল প্রকার পোশাকের ডিজাইন করতে শুরু করেন। তিনি শুধু এভাবে বিশেষ ধরনের ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ধরনের পোশাক তৈরির কাজই করেননি, তিনি তার তৈরি পোশাকের প্রদর্শনীও করেছিলেন। সেটাই ছিল প্রাথমিক যুগের ফ্যাশন শো। আজকের যুগে 'ফেডারেশন দে লা হ্যত কুতুর এহ দে লা মোড' এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য প্রত্যেক ডিজাইনারকে এই ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করতে হয়। সেই সাথে অন্যান্য শর্তাবলীও মেনে চলতে হয়।
হ্যত কুতুর পরিচালনা ও ফ্যাশন উইক
১৮৬৮ সালে 'লু শম্বরে সিণ্ডিক্যাল দে লা হ্যত কুতুর' প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাশন জগতের বিভিন্ন ধরনের নিয়ম কানুন মেনে কার্যপরিচালনা নিশ্চিত করাই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য। উপরোক্ত ফেডারেশন ও এই সিণ্ডিক্যাল একত্রে, হ্যত কুতুর হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে ফ্যাশন হাউস ও ডিজাইনারদের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন তৈরি করে। ১৯৪৫ সালে এই নিয়মগুলো কার্যত লিপিবদ্ধ করে প্রচলন করা হয়। কী সেই নিয়ম? সেই আলোচনার আগে, আরও কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন।
উপরোক্ত নিয়মগুলো বিখ্যাত ফ্যাশন হাউস শ্যানেল, জিভনশী এবং সেসকল প্রতিষ্ঠান যারা শুধুমাত্র কুতুর পোশাক ডিজাইন করে থাকে। যেমন- শিয়াপ্যারেলি, জন পল গতিয়ে- তাদের বিশেষত্ব বজায় রাখার জন্যই প্রবর্তিত হয়েছে। সর্বমোট ১৪টি ফ্যাশন হাউজ এই মর্যাদা অর্জন করেছে। কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, 'জুসি কুতুর' কীভাবে কুতুরের মর্যাদা পেল? কারণ সাধারণ সোয়েট প্যান্টের সাথে কুতুর পোশাকের কোনো রকম সম্পর্কই নেই।
বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা, কুতুর মানেই হাতে তৈরি পোশাক। ব্যাপারটা আসলে ততটাও সোজাসাপ্টা নয়। কুতুরের মর্যাদা অর্জন করার যে শর্তগুলো মেনে চলতে হয় সেগুলো হলো, প্রতিটি ফ্যাশন হাউসের প্যারিসে একটি শোরুম থাকতে হবে, শোরুমে কমপক্ষে ১৫ জন কর্মী থাকতে হবে এবং কমপক্ষে ২০ জন কর্মী থাকতে হবে পোশাক তৈরির কারখানাতে, যেন প্রতিটি ক্রেতার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় এবং পৃথক পৃথক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। সেই সাথে প্রতিটি ব্র্যান্ডকে, প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফ্যাশন উইকে কমপক্ষে ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন পোশাক প্রদর্শন করতে হবে। উল্লেখ্য, এই ফ্যাশন উইক বছরে দুবার অনুষ্ঠিত হয়- জানুয়ারি ও জুলাই মাসে।
নিয়মিত উঁচুদরের ডিজাইনার পোশাকের ক্রেতা মানেই যে কুতুর পোশাকের ক্রেতা নয়, তা উপরের আলোচনা থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে। হাতে গোনা ক্রেতা থাকার পরেও ফ্যাশন হাউসগুলোকে এই মর্যাদা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতি বছর দেদার অর্থ ও সময় বিনিয়োগ করতে হয়। আর তাই কুতুর ডিজাইনের একটি পোশাকের মূল্য অনায়াসেই ২০,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বা আরও বেশি হয়ে থাকে। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, সমাজের কোন শ্রেণীর মানুষ এই পোশাকের ক্রেতা। কুতুর উইকে আসা ক্রেতারা মূলত চেক বই হাতে নিয়েই শো দেখতে বসেন, যেন যখনই কোনো পোশাক তাদের পছন্দ হয় সাথে সাথেই তারা সেই পোশাকটি কিনে নিতে পারেন।
হ্যত কুতুর পোশাকের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ক্রেতা হলেন গিনেস রেকর্ডের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ব্রিটিশ সোস্যালাইট ডেফানে গিনেস, বিলিওনেয়ার অ্যালেক্সান্ডার লেবেদেভের স্ত্রী এলিনা পার্মিনোভা, শেখ হামিদ বিন খলিফা আল থানির দ্বিতীয় স্ত্রী শেখ মোজাহ বিনতে নাসের আল-মিসনেদ এবং জর্ডানের রানী রানিয়া। এদের মধ্যে কুতুর পোশাক ক্রয়ের জন্য ডেফানে এতটাই প্রসিদ্ধ যে, তিনি নিজের সংগ্রহে থাকা কুতুর পোশাকের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।
প্রতি বছর এই কুতুর ফ্যাশন উইকের জন্য ফ্যাশন হাউসগুলো যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে, তার বিনিময়ে পোশাক বিক্রি করে সে পরিমাণ মুনাফা তো হয়ই না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই ডিজাইনারদের লোকসানও গুনতে হয়। কিন্তু তারপরেও ডিজাইনারেরা এই ধরনের পোশাক তৈরি করেন এবং বছরে দুবার এর প্রদর্শনীও করে থাকেন।
প্যারিস ফ্যাশন উইকের কুতুর প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য শুধু পোশাক বিক্রিই নয়। এটা হলো ফ্যাশন জগত ও সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ধনী ব্যক্তিদের এক মিলনমেলা। এখানে প্রদর্শনীর স্থানটিও পোশাকের মতোই বিশেষভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে। প্রয়াত ফ্যাশন ডিজাইনার কার্ল লগারফেল্ড এক্ষেত্রে একাধিকবার অন্যতম উল্লেখযোগ্য সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। হ্যত কুতুর মূলত ফ্যাশন ডিজাইনারদের সৃজনশীলতা প্রদর্শনের একটি ক্ষেত্র। এর মাধ্যমেই জানতে পারা যায় কোন ডিজাইনার কতখানি সৃজনশীল।
আধুনিক কালের ফ্যাশন হাউসগুলো খরচ কমানোর জন্য পোশাক তৈরি কাজের অনেকটাই এশীয় দেশগুলোতে করিয়ে থাকে। তাতে খরচও কম হয়, মুনাফাও বেশি হয়। আবার এই হাউসগুলো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আরও অধিক সংখ্যক শোরুম স্থাপনের জন্যও চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু প্যারিসের মতো শহরে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর্মীদের নিয়োগের মাধ্যমে কুতুর হাউস পরিচালনা করা সকল ডিজাইনারের সামর্থ্যে নেই। অন্যদিকে মুনাফার আশায় এবং ব্যবসায়িক সাফল্য ধরে রাখার জন্যও ডিজাইনারেরা সৃজনশীলতার চেয়ে পোশাক বিক্রির দিকেই বেশি আগ্রহী। তাই ফ্যাশন জগতের প্রবৃদ্ধি নিয়মিতভাবে ঘটলেও হ্যত কুতুরের মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্র্যান্ডের সংখ্যা সেভাবে বাড়ে না।
This Bengali article is written based on online research. Required sources of information are linked inside the article.
Feature image: popsugar.co.uk