Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চেহারা দেখে ব্যক্তিত্ব বিচার করা, কতটুকু সফল?

“প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী”

পরিচিত এই প্রবাদবাক্যটি কতটুকু সত্য? বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেন, এর সত্যতা অনেকটাই। অর্থাৎ শুধু চেহারা দেখে মানুষ অনেককিছুই আঁচ করে নিতে চায়, নেয়ও। এরপর চলে বহু বিচার-বিশ্লেষণও। যদিবা এর কোনো সত্যতা না-ও থেকে থাকে, তবু লোকে পিছপা হয় না এই প্রথম দর্শনেই অনেককিছু ভেবে নেয়া থেকে!

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলেক্সান্ডার ত্রোদোভ এ বিষয়ে বলেন, “আমরা অন্যের বাহ্যিক অভিব্যক্তি থেকে তাৎক্ষণিক অনেক ধারণাই গঠন করে থাকি, এতে কিছু করার নেই”। তবে ত্রোদোভ এ ব্যাপারেও সতর্ক করে দেন যে, এই বুঝে নেয়াটুকু অনেকাংশেই ভুল হতে পারে।

তবু প্রতিনিয়ত চলতে থাকে ভেহারা নিয়ে ব্যক্তিত্ব যাচাই; source: www.haikudeck.com

মানুষের নিজের পক্ষপাতিত্ব, অন্যকে যাচাই করার প্রক্রিয়াকে কাজে লাগায় ও এর যে ফলাফল বেরোয়, তাতে পক্ষপাতিত্ব প্রবল থাকে। যেকোনো একটি আদর্শ আচরণ বা ধরনের প্রতি দুর্বলতা বা ইতিবাচক মনোভাব, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীকে শ্রেষ্ঠতর ভাবা এর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করে।

বইকে নাকি প্রচ্ছদ দেখে বিচার করতে নেই, তবু মানুষকে মানুষ অনেকাংশেই বিচার করে তার চেহারা দেখে। মানুষের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তার ব্যক্তিত্ব যাচাই করে নেবার ‘শিল্প’কে ফিজিওনোমি (physiognomy) আখ্যা দেয়া হয়। ১৯ শতকে অনেকেই ফিজিওনোমিতে বিশ্বাস করা শুরু করে। কিন্তু ২০ শতকের দিকে এসে এই ধারণাটি একটু নিচু মনমানসিকতা বা পুরনো খেয়াল বলে মনে করা হতে থাকে এবং সরাসরি এর অনুশীলন খুব একটা প্রচলনের মধ্যে থাকে না। কিন্তু মজার জিনিস, মুখে “মুখ দেখে যে যায় না চেনা” বললেও লোকজন বেশিরভাগ সময় মুখ দেখেই চেনার চেষ্টা করে এবং ভেবে নেয়, মুখ দেখে তারা চিনেও ফেলেছে!

খুব পরিচিত, আমাদের আশেপাশে পরিবেশ থেকে গৃহীত এমন কিছু ধারণা চলুন দেখে নিই,

১. আকর্ষণীয় চেহারা- শ্রেষ্ঠতর ব্যক্তি

ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়, সুন্দর চেহারা মানেই সুন্দর মন নয়। তবু হায়, সকল শিক্ষাকে ব্যর্থ করে চোখ শুধু খুঁজে বেড়ায় একটি সুন্দর মুখ! দু’চোখ গিয়ে বারবার আটকেও যায় সেই সুন্দর মুখের পানেই। এবং শুধু এ-ই নয়, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, অধিকতর আকর্ষণীয় লোকেরা অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে থাকবে। যেমন তারা অন্যের চেয়ে বেশি দক্ষ, বিশ্বস্ত, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ হবে এবং প্রথম সাক্ষাতেই এগুলো সব বলে দেয়া অসম্ভব কিছু নয়!

২. শিশুসুলভ চেহারা মানেই সহজ-সরল

শিশুসুলভ চেহারা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি একটু বড় বড় চোখ, গোলগাল মুখ, চিবুকের সাথে ঘাড়ের একটু কম দূরত্ব ইত্যাদি। তো এই শিশুসুলভ চেহারার ব্যক্তিদের ভাবা হয় অনেক সহজ-সরল, দুর্বল প্রকৃতির। তারা খুব দয়ালু, সৎ, আন্তরিক হবে এবং অপরের অধীনতা সহজেই মেনে নেবে এমনটাই ভেবে নেয়া হয়। এবং এসব বৈশিষ্ট্যানুসারে, কোনো খলনায়ক তো শিশুসুলভ চেহারার অধিকারী হতে পারবেনই না, বরং এমন চেহারার লোকেরা সারাজীবন ঠকে গেলেই স্বস্তি হবে এই ধারণা পোষণকারী লোকেদের। শিশুসুলভ চেহারার কারো কাছ থেকে বিচক্ষণ কোনো মন্তব্য এলে মন্তব্যের প্রশংসার বদলে অবাক চোখই বেশি দেখা যায়।

৩. লিঙ্গভিত্তিক ধারণা

সাধারণত মেয়েদের চেহারা ছেলেদের চাইতে বেশি কমনীয় বলেই ধরা হয়। সমাজের প্রচলিত ধারণানুযায়ী, মেয়েরা কম নেতৃত্ব দেবে, সবসময় আবদার করবে, ছেলেদের উপর নির্ভর করবে। তাই যখন কোনো ছেলের মধ্যে এমন কমনীয়তা বা নমনীয়তা দেখা যায়, তখন সে হয়ে ওঠে ‘মেয়েলি চেহারার পুরুষ’। তাকে অন্য ছেলেদের চাইতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ভাবা হয় এবং তাকে প্রতিটি ক্ষেত্রে একটু বেশিই প্রমাণ করে দেখাতে হয়। আবার মুদ্রার অপর পিঠে, যে মেয়েদের চেহারা অতটা নরম-সরম নয়, তারা অন্য মেয়েদের চাইতে কম ‘মেয়েলি’ এবং তাদের মধ্যে ‘পুরুষালি’ ভাব ফুটে ওঠে। এরা অন্য মেয়েদের মতো নির্ভরশীল না হয়ে নিজেরাই বেশি সক্ষম হবে বলে ভাবা হয়!

লিঙ্গভিত্তিক কিছু ভ্রান্ত ধারণাও রয়েছে এক্ষেত্রে; source: Ittefaq

৪. বয়স্কদের (নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত!) অভিজ্ঞতা বেশি

যদিও তারুণ্যই সকল আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে তোলে, যৌবনেরই জোয়ারে ভেসে যায় সকল বাধা-বিপত্তি, তারপরও কম বয়সীদের কেন যেন অনেক কাজেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করা হয় না! বয়স কম, রক্ত গরম- এই কথা বলে অনেক সিদ্ধান্তেই তরুণদের পাত্তা দেয়া হয় না। মুখে থাকা বয়সের বলিরেখা, অপেক্ষাকৃত বেশি গাম্ভীর্যকে নির্ভরতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার পরিমাপক ভাবতেও পিছপা হন না অনেকেই।

৫. শারীরিক দক্ষতা বিচারে পুরুষালি চেহারা ও গাঢ় স্কিন টোন এগিয়ে

অপেক্ষাকৃত ফর্সা রঙের ব্যক্তিরা অত ভারি কাজ পারবেন না বা করে অভ্যস্ত নয়, এমনটাই সাধারণ ধারণা। অপরদিকে গাঢ় স্কিন টোন থাকা ‘পুরুষালি’ চেহারার লোকেরা অনেক বেশি দক্ষ হবেন শারীরিক দিয়ে এটাও ভেবে নেয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

৬. বর্ণবাদ

যুগে যুগে মানুষ দেখেছে বর্ণবাদের উত্থান ও পতন। গায়ের রং দ্বারা শুধু একজন ব্যক্তিকেই নয়, একটি পুরো জাতিকে নিগৃহীত কোরার একটি সুপরিচিত ধারণা হচ্ছে ‘বর্ণবাদ’। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ ও বর্ণোবাদবিরোধী আন্দোলন তো সারাবিশ্বে একনামে পরিচিত। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে শূধুমাত্র গাত্রবর্ণের পার্থক্যের কারণে চলে আসা একটি অযৌক্তিক বৈষম্যই সেই বর্ণোবাদের ইতিহাস। নেলসন ম্যান্ডেলা এই আন্দোলনটির নেতৃত্ব দেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হন। আন্দোলনটির সাথে থাকার জন্য দীর্ঘ ২৭ বছর তাঁকে রোবেন দ্বীপে নির্বাসন কাটাতে হয়।

বর্ণবাদ; source: newsnextbd.com

সমস্যা

কাউকে দেখে, তার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে অতিরঞ্জন বা অধিরঞ্জন যেকোনোটাই করলে মুখোমুখি হতে হয় বহু সমস্যার। মনে করুন, কাউকে দেখে আপনার মনে হলো সে বেশ ‘শক্ত’ চেহারার মানুষ, নিশ্চয়ই কঠিন ও ভারি কাজ করতে সে খুব সমর্থ। এই ভেবে তাকে কাজটি দিলেন, ওদিকে সাজুগুজু করা নরম-সরম চেহারার মানুষটিকে আপনি ধর্তব্যেই আনলেন না এই কাজের ক্ষেত্রে! চশমা পরা লোক দেখলেই ভেবে নিলেন সে পড়াশোনায় খুব ভালো। ওদিকে অগোছালো চেহারার কাউকে দেখে আপনার মনে হলো সে খুব অমনোযোগী ছাত্র।

নিশ্চিত করে বলা যায়, এটুকু যাচাই করা সঠিক হলো?

প্রতিনিয়ত অনেকেই অনেকবার অনেককে দেখেন এমনভাবে যাচাইকার্য চালান এবং ভুল প্রমাণিত হলে শেষমেশ বলতে বাধ্য হন, “একে দেখে মনে হয়েছিলো পারবে!”। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কায়া দেখে ভুল প্রমাণিত হবার পরও এই প্রথাটি অলিখিতভাবে সমাজে বেশ ভালোভাবেই চলে আসছে, আজও চলছে।

ভুল হতে পারে এই ক্ষণিকের যাচাই করে নেয়া! source: LinkedIn.com

চাকরি কিংবা অন্য কোনো পরীক্ষার সাক্ষাৎকারে অতি ভালো ছাত্রটিকেও বলে দেয়া হয় ফিটফাট হয়ে যেতে, চেহারা-ছবিতে আরো একটু আকর্ষণীয় হতে, একটু ভালো কাপড়চোপড় পরতে। এর মানে সে বাছাই হবে কিনা এই প্রশ্নের তার মেধাই শুধু মাপকাঠি হবে না। মেধা কিংবা দক্ষতা প্রমাণ করে দেখালেই হবে না, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে একটি অতি প্রত্যাশিত ‘মুখোশের’, যা আদতেই সে নয়।

আর ঠিক এই প্রত্যাশার মুখোশ পরতে গিয়ে বহু মেধাবী মুখোমুখি হন পরাজয়ের এবং শুধু তার মেধা হয়তো তাকে এনে দিতে পারে না প্রাপ্য ফলাফল।

এর পেছনে মূল কারণ কী? বাহ্যিক কিছু বৈশিষ্ট্যকে ‘আদর্শ’ মেনে নিয়ে তার প্রতি চির আকর্ষণ পোষণ করা। এই সমাজে তা-ই ঘটে আসছে এবং এখানে ‘এ সমাজ’ বলতে নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা জাতিকে নির্দেশ করা হয়নি। পৃথিবীর সকল প্রান্তেই ‘সুন্দর চেহারা’ বলে বেশ কিছু আদর্শ পরিমাপক স্থাপন করা আছে, যা অনেকক্ষেত্রেই মানুষের দক্ষতা ও মেধাকে অতিক্রম করে প্রকাশ পায় ও অন্যেরা তা সাগ্রহে গ্রহণ করে। আমাদের মস্তিষ্ক এই ‘স্ন্যাপ জাজমেন্ট’ করে নিতে অনেক অভ্যস্ত এবং প্রথম দেখার ধারণাটি দূর করতে অনেকদিন লেগে যায়, কখনো কখনো তা দূর হয়ও না।

নেলসন ম্যান্ডেলা; source: History channel

Featured image: www.haikudeck.com

Related Articles