
আয়োডিনের কথা আমরা সকলেই কমবেশি শুনেছি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এটি আসলে কী, বা আমাদের শরীরের জন্য এটি কেন এত জরুরি।
"আয়োডিন ও লবণ রিসার্চ সেন্টার" এর গবেষকদের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬ কোটি মানুষই আয়োডিন স্বল্পতার শিকার। আর ৩ কোটি মানুষ জানে না, তারা আয়োডিন ঘাটতির শিকার হয়ে স্বল্পবুদ্ধি ও শিখন ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ নানা জটিল রোগে ভুগছে।
তাই শুরুতেই আমরা জেনে নিতে পারি, আয়োডিন কী। আয়োডিন হলো একটি মৌলিক পদার্থ, যার সংকেত I (আই), পারমাণবিক সংখ্যা ৫৩। পৃথিবীতে আয়োডিনের প্রধান উৎস হলো মহাসাগর এবং সমুদ্রের পানি, যেখানে দ্রবণীয় অবস্থায় আয়োডিন পাওয়া যায় আয়ন I− রূপে। অন্যান্য হ্যালোজেনের ন্যায় মুক্ত আয়োডিন দ্বিপরমাণুক।
কিন্তু আয়োডিন কীভাবে স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত হলো? শুধু বাংলাদেশই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই কেন আয়োডিনের ঘাটতি খুব বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো? কেন আয়োডিনের অভাবে দেখা দেয় নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যা?
আমাদের থাইরয়েড হরমোন ও হজমের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আয়োডিন। এর অভাবে শারীরিক বৃদ্ধি বা গঠনে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। অনেকেই মনে করেন, আয়োডিনের অভাবে বুঝি কেবল ঘ্যাগ বা গলগণ্ড রোগই হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আয়োডিনের অভাবে সৃষ্ট সমস্যার তালিকা অনেক বড়।
গর্ভবতী মায়ের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতির ফলে গর্ভপাত কিংবা বিকলাঙ্গ সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়াও স্নায়বিক দুর্বলতা, বধিরতা, বাকশক্তিহীনতা, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, বামনত্ব, বিভিন্ন শারীরিক ত্রুটি এবং শিশুর স্বাভাবিক মস্তিষ্ক গঠন ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় আয়োডিন ঘাটতির ফলে।
মাথার চুল কমে যাওয়া, পড়াশোনায় মন না বসা, স্মরণশক্তি হ্রাস পাওয়া, বারবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটা, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদির পেছনেও দায় রয়েছে আয়োডিন ঘাটতির।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এসব শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থেকে নিস্তার পেতে দরকার আমাদের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি পূরণ। কীভাবে তা সম্ভব? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন গ্রহণ করা উচিৎ। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে সেটি সর্বোচ্চ ৩০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্তও হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, কোথা থেকে পাবো আমরা প্রয়োজনীয় আয়োডিন? সামুদ্রিক মাছ (তাজা/শুঁটকি), সামুদ্রিক আগাছা প্রভৃতিতে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন পাওয়া যায়। সমুদ্রের পানির এ আয়োডিন কিন্তু রোদের কারণে বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে চলে যায়, এবং তারপর বৃষ্টির পানির মাধ্যমে মাটিতে মিশে মাটিকে আয়োডিন সমৃদ্ধ করে। পানি ও মাটিতে পর্যাপ্ত আয়োডিন থাকলে উদ্ভিদজাত ও প্রাণিজ খাবার থেকেও প্রয়োজনীয় আয়োডিন পাওয়া যায়।
কিন্তু সমস্যার বিষয় হলো, ভূমিবেষ্টিত এলাকায় সব সময় সমুদ্র ছুঁয়ে আসা বৃষ্টি হয় না। আবার যারা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল, তারাও সব খাবারে আয়োডিন পায় না। এরকম ঘটনা ঘটে থাকে আল্পস, পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকাগুলো কিংবা ইতালি, রাশিয়া, মধ্য আফ্রিকার পাহাড়ি এলাকাগুলোয়।
কেউ যদি ভেবে থাকেন যে আমাদের বাংলাদেশের পাশেই যেহেতু রয়েছে বঙ্গোপসাগর, তাই আমাদের দেশের মাটিতে আয়োডিনের ঘাটতি নেই, তাহলে খুব বড় ভুল করছেন। আমাদের দেশের মাটিতে আয়োডিন ঘাটতির প্রধান কারণ হলো বন্যা। দেশের বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে বন্যার পানি মাটির আয়োডিন ধুয়ে নিয়ে যায়, ফলে সেসব অঞ্চলে উদ্ভিদজাত কিংবা প্রাণিজ খাবারে আয়োডিন পাওয়া যায় না। বস্তুত আমাদের দেশের কোনো অঞ্চলকেই পুরোপুরি আয়োডিনের ঘাটতিমুক্ত বলা যাবে না। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল তথা রংপুর, দিনাজপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে আয়োডিনের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
কিন্তু দৈনন্দিন আহার্য খাবারে আয়োডিনের ঘাটতি থাকায় কি আমাদের দেহ প্রয়োজনীয় আয়োডিন থেকে বঞ্চিত হবে? তাহলে তো আমাদের বড় ও শিশুদেরও বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সেজন্য সম্ভব হলে বেশি বেশি সাদা মাছ ও ঠাণ্ডা দুধ খাওয়া যেতে পারে, কারণ সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণ আয়োডিন আছে।
তবে এসব খাবার খেয়েও যে আয়োডিনের ঘাটতি দূর করা সম্ভব হবে, সেরকম কোনো নিশ্চয়তা কিন্তু দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া অর্থনৈতিক কারণে সবার পক্ষে নিয়মিত এসব খাবার খাওয়া সম্ভবও নয়। আবার অন্যান্য নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণেও অনেক মানুষের দুধ, মাংস প্রভৃতি খাবার খাওয়া বারণ থাকতে পারে। এবং তারা যদি মাছ বা শাকসবজি থেকেও পর্যাপ্ত আয়োডিন না পায়, সেক্ষেত্রে কী করণীয়?
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেহেতু এসব সমস্যার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাই এদেশে মানুষের শরীরে পর্যাপ্ত আয়োডিনের যোগান নিশ্চিত করার সবচেয়ে সহজ, সুলভ ও কার্যকরী উপায় হলো আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করা। যেহেতু প্রতিদিনের খাবার তালিকায় লবণ অবধারিতভাবে থাকে, তাই লবণের সাথে যুক্ত করা আয়োডিন গ্রহণের মাধ্যমেই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যাগুলো থেকে রক্ষা পেতে পারে।
আগেই বলা হয়েছে, আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে আমাদের দেশ। দেশের অধিকাংশ মানুষই আয়োডিনযুক্ত লবণ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের প্রকৃত উপায় সম্পর্কে অবগত নয়, যার ফলে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করার পরও অনেকের শরীরের প্রয়োজনীয় আয়োডিনের ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে।
সকলের জেনে রাখা প্রয়োজন, লবণে মিশ্রিত আয়োডিন হলো একটি উদ্বায়ী পদার্থ। তাই লবণ খোলা বাতাসে রাখলে আয়োডিন উড়ে যায়। ফলে বাজারে যেসব খোলা লবণকে আয়োডিনযুক্ত লবণের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়, সেগুলোতে আদতে আয়োডিন থাকে না বললেই চলে। তাই প্রকৃত আয়োডিনযুক্ত লবণ পেতে হলে অবশ্যই প্যাকেটজাত লবণই কিনতে হবে।
দোকান থেকে প্যাকেটজাত, প্রকৃত আয়োডিনযুক্ত লবণ কিনলেই যে দায়িত্ব শেষ, তেমনটিও কিন্তু নয়। সেই লবণ সঠিকভাবে সংরক্ষণ হলো পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। অনেকেরই লবণ খোলা অবস্থায় রেখে দেয়ার অভ্যাস রয়েছে। এমনটি করা হলে লবণের উদ্বায়ী আয়োডিন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাতাসে হারিয়ে যায়। তাই লবণ কিনে আনার পর, প্যাকেট থেকে ঢেলে সেটিকে কোনো ঢাকনাওয়ালা কৌটা বা বয়ামে সংরক্ষণ করতে হবে, এবং প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করে সেটির মুখ পুনরায় ভালো করে আটকেও রাখতে হবে। কৌটা বা বয়ামটিকে চুলার খুব কাছে রাখা ঠিক হবে না। দূরে রাখতে হবে জলীয় বাষ্প, সূর্যের আলো এবং উচ্চ তাপমাত্রা থেকেও।
ঘরেই লবণের আয়োডিন পরীক্ষার জন্য নানারকম পরীক্ষা আছে, শিশুরা বেশ মজা পাবে সেগুলোতে। এই পরীক্ষাগুলো শিখিয়ে দিন শিশুদের, শেখাতে শেখাতে তাদের জানান আয়োডিনের গুরুত্বের কথা, যাতে ভয়ঙ্কর সব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।

This article is on the necessity of iodine consumption for human bodies.
Featured Image Source: WallpaperUP