ভেগানিজম: সুস্থ জীবনযাপনের জন্য রক্ষাকবচ, নাকি হুমকি?

পহেলা নভেম্বর, বিশ্ব ভেগান দিবস। দিনটি এমন সব মানুষদের জন্য, যারা মাছ-মাংস তো দূরের কথা ডিম, পনির, মেয়োনেজ, মধু, ঘুল থেকে শুরু করে প্রাণীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত সব রকমের জিনিস খাওয়া থেকে বিরত থাকে। এমনকি, পশুর চামরা, ওল এবং সিল্ক দিয়ে তৈরি পরিধানযোগ্য সামগ্রী, মুক্তা দিয়ে তৈরি গয়না, হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি পিয়ানোসহ পশুসামগ্রী দিয়ে তৈরি সব রকমের জিনিস পরিহার করে। ১৯৪৪ সালে, কাঠমিস্ত্রি ডোনাল্ড ওয়াটসনের হাত ধরে ‘ভেগান সোসাইটি’ শুরু হওয়ার পঞ্চাশ বছর পরে, ১৯৯৪ সালে দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে ভেগানিজমের ইতিহাস আরো পুরনো।

ভেজেটারিয়ানিজম থেকে বর্তমানের ভেগান লাইফস্টাইল

প্রাথমিকভাবে, ভেগানিজম হচ্ছে ভেজেটারিয়ানিজমের চরমাবস্থা। যেখানে ভেজেটারিয়ানদের মাঝে ডিম, দুধসহ নানা ধরনের ডেইরি পণ্য গ্রহণ করতে দেখা যায়, সেখানে ভেগানরা পুরোপুরি সব ধরনের পশুসামগ্রী গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। তবে, মাছ-মাংস জাতীয় আহার পরিহারের ব্যাপারটি সেই প্রাচীন ভারত এবং পূর্ব ভূমধ্যবর্তী সমাজে হাজার হাজার বছর পূর্বেও প্রচলিত ছিল।

নানা নৈতিক কারণে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈনদের মাঝে উদ্ভিদভিত্তিক আহারের ব্যাপারে প্রচার করতে দেখা যেত। প্রথমদিকের জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ তার অনুসারীদের অহিংসার পথে আসার আহ্বান করেন, যা জৈন ধর্মের পাঁচটি মহাব্রতের মধ্যে অন্যতম। যেখানে নিজের কাজে এবং মননে যেন কোনো জীবের ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। এমনকি, জৈন সন্ন্যাসীরা হাতে ঝাড়ু নিয়ে পথ চলতেন এবং কোনো ছোট প্রাণী যেন তাদের পায়ের নিচে পড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে পথ চলার সময় রাস্তায় ঝাড়ু দিয়ে সামনে এগোতেন। 

জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের প্রস্তরমূর্তি; Image Source: Victoria and Albert Museum

চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে তাওয়িজম এবং চাইনিজ বৌদ্ধিজমের অনুসারী সন্ন্যাসীদের মাঝে আমিষ মুক্ত আহার গ্রহণের ব্যাপারে আদেশ করা হয়। সে সময়, জাপানী সম্রাট তেনমু সব ধরনের পশুসামগ্রী কেনাবেচার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। অন্যদিকে, সেই প্রাচীনকাল থেকেই মিশরীয়দের মাঝে প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্য পশু বলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু ফেরাউন আখেনাতেন তাতে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। তার যুক্তি ছিল, কোনো মানুষের পক্ষে প্রভু আতেনের দেওয়া প্রাণকে কেড়ে নেওয়াটা পাপের শামিল।

প্রাচীন গ্রিসেও প্রাণ আছে এমন যেকোনো জিনিস খাদ্য হিসেবে পরিহার করতে দেখা যেত। স্বয়ং গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাস মনে করতেন, প্রত্যেকটি প্রাণী অমর আত্মার অধিকারী, যারা মৃত্যুর পর পুনরায় দেহ ধারণ করে পৃথিবীতে আসবে। তিনি পশুদের আঘাত করা থেকে শুরু করে, ডিম খাওয়া পর্যন্ত পরিহার করেন। নিওপিথাগোরিয়ান দার্শনিক অ্যাপোলোনিয়াস পিথাগোরাসের ধারণার উপর জোর দিয়ে পশু অধিকার আন্দোলনও শুরু করেন। দার্শনিক প্লোটোনাস পশুসামগ্রী দিয়ে তৈরি ঔষধও এড়িয়ে চলতেন।

গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাসও পশু হত্যার বিরুদ্ধে ছিলেন; Image Source: AZ QUOTES

নির্দিষ্ট কিছু গোত্র, ধর্মের মাঝে আমিষ জাতীয় খাবারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভেজেটারিয়ানিজম টার্মটি সমাজের সাধারণ পর্যায়ে পৌঁছতে লম্বা সময় লেগেছে। আধুনিক যুগে প্রথম ভেজেটারিয়ান সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৭ সালে, ইংল্যান্ডে। তার মাত্র তিন বছর পর, গ্রাহাম ক্যাকার্সের উদ্ভাবক সিলভেস্টার গ্রাহাম ‘আমেরিকান ভেজেটারিয়ান সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেসবিটারিয়ান মন্ত্রী হওয়ায় তার অনুসারীর সংখ্যা ছিল অনেক। সে সুবাদে আমেরিকা সহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বেশ দ্রুতই ভেজেটারিয়ানিজমের জয়জয়কার শুরু হয়।

এরপর প্রায় এক শতাব্দী পর, ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ডের কাঠমিস্ত্রি ডোনাল্ড ওয়াটসন ‘ভেগান সোসাইটি’ নামের নতুন একটি সংস্থা তৈরি করেন। ওয়াটসনের মতে, যেকোনো আমিষ জাতীয় খাবারই শরীরের জন্য খারাপ। কিন্তু ভেজেটারিয়ানরা মাছ, মাংস না খেলেও দুধ, ডিমের মতো ডেইরি পণ্যগুলো আহার করে আসছে। মাত্র এক বছর পূর্বে ব্রিটেনের ডেইরি ফার্মগুলোতে প্রায় ৪০% শতাংশ গরু যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়, যা ওয়াটসনকে নিজের টার্মটি আরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।

ভেগান সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডোনাল্ড ওয়াটসন; Image Source: foodsforlife.org.uk

ভেগান সোসাইটি প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন মাস পর ওয়াটসন একটি নিউজ-লেটার প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি শব্দটির উচ্চারণ ‘ভেজান’ না, বরং ‘ভেগান’; সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন। এরপর ধীরে ধীরে ভেগান সোসাইটি সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ছড়াতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় ভেগানরা শুধুমাত্র আমিষ জাতীয় আহার থেকে বিরত থাকতো। পরবর্তীতে তাতে যোগ হয়, পশু-পণ্য বর্জন।

ভেগানিজম যে কারণে জনপ্রিয়

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন কমানো, হৃদরোগ, ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে ভেগান ডায়েটের বিকল্প নেই। ২০১৫ সালের গল-আপের একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৩২ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করে, পশুদের মানুষের মতো অধিকার উপভোগ করার বৈধতা রয়েছে। অন্যদিকে, ইউনাইটেড ন্যাশন’স ফুড এন্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাসের ১৫ শতাংশ খামারজাত পশুর কারণে তৈরি হয়।

ভেগানদের স্বাস্থ্য চিন্তা, পশু-প্রাণীদের প্রতি মানবিক আচরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অবস্থানসহ নানা বিষয় বেশ চিত্তাকর্ষক, যার কারণে দিন দিন ভেগান ডায়েটের প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়ছে; Image Source: peta.org.uk

সব দিক বিবেচনায়, ভেগানদের স্বাস্থ্য চিন্তা, প্রাণীদের প্রতি মানবিক আচরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অবস্থানসহ বিষয়গুলো বেশ চিত্তাকর্ষক, যার কারণে দিন দিন ভেগান ডায়েটের প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়ছে। বর্তমানে ইংল্যান্ডে ভেগানদের সংখ্যা প্রায় তিন মিলিয়ন, আমেরিকাতে তার কয়েক গুণ বেশি। স্কটল্যান্ড, কানাডা সহ ইউরোপ, আমেরিকার নানা দেশে দিন দিন ভেগানদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

এশিয়াতেও তাদের সংখ্যা বিশাল। মুভি-স্টার, জিমনাস্টিক, স্পোর্ট-ম্যান থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররাও তাদের ভেগান লাইফস্টাইলকে সামনে আনছেন, প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে নানা স্তরের মানুষের মাঝে ভেগানিজমকে প্রসিদ্ধ, স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, ভেগান ডায়েট কতটুকু স্বাস্থ্যকর? এবং মানুষ যেসব বিষয় বিবেচনা করে ভেগানিজমের দিকে ঝুঁকছে, সেগুলো কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?

ভেগান ডায়েট কতটুকু স্বাস্থ্যকর?

আমেরিকান বায়োকেমিস্ট এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যে পুষ্টিকর খাবারের প্রভাব নিয়ে গবেষণায় নিয়জিত টি. কলিন ক্যাম্পবেল তার বই ‘দ্য চায়না স্টাডিস: ফ্যাক্ট এন্ড ফিকশন’-এ উল্লেখ করেছেন, ভেগান সংস্কৃতির মানুষেরা সর্বভোজীদের থেকে ভালো স্বাস্থ্য উপভোগ করে থাকে। শুধু কলিনই না, একই কথা আরো কয়েকজন গবেষণাকারীরও।

সর্বভোজীদের তুলনায় ভেগানরা কম সুসিক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরল গ্রহণ করে এবং ভিটামিন সি, ই, ফাইবার, ফলিক এসিড, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যারটিনয়েড ও ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো সাইটোক্যামিকাল বেশি গ্রহণ করে। যার ফলে তাদের শরীরে এলডিএল কোলেস্টেরল, ব্লাড পেশার, বডি মাস ইনডেক্স অন্যান্যদের তুলনায় কম, যা দীর্ঘমেয়াদী রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা হ্রাস করার মাধ্যমে দীর্ঘায়ু থাকতে সাহায্য করে।

যদিও এখনো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের স্বল্পতার কারণে কীভাবে ভেগান ডায়েট দীর্ঘায়ু থাকতে সাহায্য করে, তা জানা যায়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভেগান ডায়েটের কার্যকারিতা সুস্পষ্ট। যেমন- হৃদরোগ প্রতিরোধ।

প্রায় ৭৬,০০০ অংশগ্রহণকারীর সাহায্যে পাঁচটি বড় আকারের গবেষণায় দেখা গেছে, সর্বভোজীদের থেকে হৃদরোগে ভেগানদের মৃত্যুর হার গড়ে প্রায় পঁচিশ শতাংশ কম। অক্সফোর্ডের ‘ইউরোপ প্রসপেক্টিভ ইনভেস্টিগেশন ইনটু ক্যান্সার এন্ড নিউট্রিশন (EPIC-অক্সফোর্ড)’ এর ৬৫,০০০ অংশগ্রহণকারী নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই হার প্রায় ১৯ শতাংশ।

বিভিন্ন শষ্য ও শিম জাতীয় সবজি; Image Source: health.harvard.edu

শস্য ও শিম জাতীয় খাবারে উচ্চমাত্রার ফাইবার থাকার কারণে সেগুলো ধীরে ধীরে পরিপাক হয়, যা রক্তে স্যুগারের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত রাখে। দ্রবণীয় ফাইবার কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে। অন্যদিকে, বাদামে গ্লাইসিমেক ইন্ডেক্সের পরিমাণ কম এবং অ্যান্টোডক্সিন, ভেজিটেবল প্রোটিন, মিনারেল, স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি এসিড থাকায় এগুলো হৃদপিণ্ডের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।

নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধেও ভেগান ডায়েট সাহায্য করে। তবে তা ততটা নয়। এমনকি, শুধুমাত্র রেড মিট আহার থেকে বিরত থেকেও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো যায়। এছাড়া, টাইপ-টু ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভেগান আহার বেশ কার্যকর।

তবে, ভেগানদের চরমপন্থি ডায়েটের ফলে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

প্রথমেই আসা যাক প্রোটিন স্বল্পতার দিকে। রিকমেন্ডেড ডায়েটারি অ্যালাওয়েন্স (RDA) এর মতে, মানব শরীরের ওজনের প্রত্যেক পাউন্ডের জন্য শূন্য দশমিক চার গ্রাম প্রোটিনের প্রয়োজন, যা খুব সহজেই স্বল্প পরিমাণ দুধ, ডিমের মতো ডেইরি সামগ্রী থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু যেহেতু শাকসবজি জাতীয় খাবারগুলো প্রাণীজ প্রোটিনের চাইতে আলাদা, সেহেতু ভেগানদের ক্ষেত্রে শরীরের প্রত্যেক পাউন্ড ওজনের জন্য শূন্য দশমিক পঁয়তাল্লিশ শতাংশ প্রোটিন জোগানের প্রয়োজন। এছাড়াও, শরীরের জন্য পর্যাপ্ত অ্যামিনো এসিডের জন্য ছোলা, মসুর, ওটস, বার্লি, ব্রাউন রাইস, সয়া ছাড়াও নানা রকমের শিম প্রত্যেকদিনের খাদ্য তালিকায় প্রয়োজন, যেগুলো একাধারে ব্যয়বহুল হওয়ার সাথে সাথে নিয়মিত খাদ্যতালিকায় না থাকাও অস্বাভাবিক না। কিন্তু চাইলেই পর্যাপ্ত অ্যামিনো এসিড খুব সহজেই প্রাণীজ প্রোটিনে পাওয়া যায়। 

দ্বিতীয়ত, পারনেসিয়াস অ্যানিমিয়া হচ্ছে একধরনের রক্তস্বল্পতা, যা ভিটামিন বি-১২ এর অভাবে তৈরি হয়। উপলব্ধ চিকিৎসা না থাকার কারণে এই রোগকে প্রাণঘাতী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রাণঘাতী রক্তস্বল্পতা রোধে অবশ্যই আপনাকে ভিটামিন বি-১২ গ্রহণ করতে হবে, নয়তো আপনার শরীর পর্যাপ্ত সুস্থ লাল রক্ত কণিকা তৈরিতে অক্ষম হয়ে পড়বে। আর ভিটামিন বি-১২ শুধুমাত্র পশুজাত খাদ্য থেকেই পাওয়া সম্ভব। যদিও নির্দিষ্ট কিছু সয়া, রাইস বেভারেজ এবং ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল এবং সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে এই ভিটামিনের স্বল্পতা কিছুটা লাঘব সম্ভব। কিন্তু সেগুলো ব্যয়বহুল হওয়ার পাশাপাশি সব জায়গায় না পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। পারনেসিয়াস অ্যানিমিয়া ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের স্নায়বিক সমস্যা রোধে ভিটামিন বি-১২ এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

তৃতীয়ত, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা ভেগানরা শাকসবজি, শস্যদানা থেকে সর্বভোজীদের সমান পরিমাণ আয়রন পেয়ে থাকে, যা নন-হেম আইরন হিসেবে পরিচিত। শাকসবজি ফলমূলে থাকা ভিটামিন সি এবং নির্দিষ্ট কিছু এসিড আয়রনের শোষণকে বৃদ্ধি করলেও, মটরশুঁটি, ডাল, বাদামসহ আরো কিছু দানা জাতীয় খাদ্যে থাকা ফাইটিক এসিড এতে বাধা দিয়ে থাকে। মাংস থেকে আগত আয়রন শরীর খুব সহজেই শোষণ করতে পারে। অন্যদিকে, শস্যদানা থেকে পাওয়া ফাইটিক এসিড আয়রনের পাশাপাশি জিঙ্কের শোষণেও বাধা প্রদান করে।

পশ্চিমা ভেগানরা শাকসবজি, শস্যদানা থেকে সর্বভোজীদের সমান পরিমাণ আয়রন পেয়ে থাকে; Image Source: healthline.com

চতুর্থত, মানুষের শরীরে দুই ধরনের ফ্যাটি এসিড রয়েছে। প্রথমটি, সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড, যা শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে ধমনীর ভেতরে লেগে থাকে এবং ধীরে ধীরে ধমনীর ব্যাস কমিয়ে দেয়। ফলাফলস্বরূপ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ সমস্যাসহ অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি থাকে। অপরটি, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড, যা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হিসেবে পরিচিত। শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, ধমনীতে রক্ত বাধা প্রতিরোধ করা, ট্রাই-গ্লিসারাইড হ্রাস করা, ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি কমানোসহ সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের ভূমিকা অনন্য। আর শরীরের জন্য পর্যাপ্ত ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সহজেই মাছ জাতীয় খাদ্যে পাওয়া যায়। ব্রোকলি, আখরোট, মটরশুঁটি, সতেজ সয়াবিনে ওমেগা-৩ এর উপস্থিতি থাকলেও তা শরীরের প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম।

আহার হিসেবে অতিরিক্ত আলু গ্রহণ খুব দ্রুতগতিতে রক্তে স্যুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়; Image Source: naturalcomfortkitchen.com

অন্যদিকে, অধিকাংশ ভেগানরা সহজলভ্য এবং সস্তা বিধায় ভাত, সাদা আটা এবং প্রচুর পরিমাণ আলু প্রত্যেকদিনের প্রাথমিক খাদ্য তালিকায় রাখে। কিন্তু এ ধরনের খাবারগুলো খুব দ্রুতগতিতে রক্তে স্যুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে হার্ট অ্যাটাকসহ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বিপদজনক হারে বেড়ে যায়। এছাড়াও নানা কারণে কিছু কিছু জায়গা থেকে ভেগান ডায়েট অনুসরণ করা সম্ভব নয়।

চাইলেই কি যথাযথভাবে ভেগানিজম অনুসরণ করে প্রত্যেকের সুস্থ থাকা সম্ভব?

নিউট্রিশন এন্ড ফিজিক্যাল ডিজেনারেশন’ বইয়ের লেখক ড. ওয়েসটন প্রাইস পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরে লক্ষ্য করেছেন, খাদ্যাভ্যাস ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। পাশাপাশি ভৌগলিক অবস্থান, রাষ্ট্রের খাদ্যতালিকাগত আইন, পরিবেশসহ নানা বিবেচনায় খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতা অনেক। যেমন- আফ্রিকার মাসাই গোত্রের মানুষেরা একচেটিয়াভাবে আমিষ জাতীয় আহার গ্রহণ করে। প্রাণীর মাংস, দুধ থেকে শুরু করে রক্ত পর্যন্ত তাদের খাবারের তালিকায় রয়েছে। এরপরেও তারা বেশ ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী। তাদের হারের গঠনও অবিশ্বাস্যভাবে মজবুত।

আফ্রিকার মাসাই গোত্রের মানুষেরা; Image Source: pilotguides.com

এছাড়াও, গ্রিনল্যান্ড, কানাডা এবং আলাস্কার সুমেরু অঞ্চলে বসবাসরত ইনুইট গোত্রের লোকজনও পুরোপুরি পশুজাত খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। প্রথমত, ভৌগলিক অবস্থান, আবহাওয়ার কারণে ঐ অঞ্চলে উদ্ভিদ জাতীয় খাদ্যের চাষাবাদ তো দূরের কথা, পশু খামারেরও ব্যবস্থা নেই। তাই গোত্রের প্রত্যেকে শিকারের উপর নির্ভরশীল। শিকারের তালিকায় সিল, তিমি, মেরু ভাল্লুক, মশক, বলগা হরিণ, বিভিন্ন রকমের পাখিসহ সিন্ধুঘোটকের মতো প্রাণীও রয়েছে। অর্থাৎ, তারা নিম্নমানের কার্বোহাইড্রেট এবং উচ্চ পর্যায়ের চর্বিজাতীয় প্রোটিন গ্রহণে অভ্যস্ত। শরীরের চাহিদা অনুযায়ী কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম এবং যা শরীরের বিদ্যমান, তা পুরোপুরি কাঁচা ও তাজা মাংস থেকে আসে। অন্যদিকে, প্রোটিন গ্লোকোনিউজেনেসিসের মাধ্যমে লিভারে যায় এবং শরীরের শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। কিন্তু তাদের গ্রহণ করা প্রোটিনের পরিমাণ অস্বাভাবিক পরিমাণে বেশি। ১৯৭০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের লিভারের আকারও অন্যান্য এলাকার মানুষের চাইতে অস্বাভাবিকভাবে বড়, যা পরিমাণের চাইতে বেশি গ্রহণ করা প্রোটিনকে শক্তিতে রূপান্তরে সাহায্য করে। 

শিকারের পর ইনুইট গোত্রের লোকজন মাংস ভাগ করে নিচ্ছে; Image Source: wikimedia.org

ইনুইট লোকজনের খাদ্যাভ্যাস পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের প্রায় উল্টো হওয়ার পরেও তারা বেশি বাঁচে। ‘ফুড এন্ড মেকিং অফ মর্ডান ইনুইট আইডেন্টিটিস’ শিরোনামে এডমোন্ড সেয়ারলেসের একটি আর্টিকেলে উল্লেখ রয়েছে, “ইনুইটদের অতিরিক্ত মাংস নর্ভর খাদ্যাভ্যাস তাদের শরীরকে উষ্ণ, শক্তিশালী, সবল এবং সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।”

এছাড়াও, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নির্দিষ্ট ঋতু ছাড়া শাকসবজিসহ মটরজাতীয় শস্য সহজলভ্য নয়। পাশাপাশি বারো মাস পাওয়া যায় এমন ফলগুলোর অধিকাংশই আসে অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি হয়ে, যার কারণে দামে চওড়া হওয়ার পাশাপাশি তাজা ফলমূল পাওয়াটা বেশ  দুষ্কর। অর্থাৎ, চাইলেই সবার জন্য ভেগান ডায়েট অনুসরণ করে সুস্থ  জীবনযাপন সম্ভব নয়।

This article is in Bangla language. It's about the veganism lifestyle for healthy living. 

References: For references check hyperlinks inside the article.

Featured Image: foodrevolution.org

Related Articles