Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নাইকি স্পোর্টস হিজাব নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

নিউ জার্সির চ্যাম্পিয়ন ফেন্সার ইবতিহাজ মুহাম্মাদকে রেফারি অনেকবার ভুল সময়ে শুরু করার জন্য কার্ড দেখিয়েছেন। হেলমেটের নিচে কানের ওপর হিজাব থাকায় স্পষ্ট শুনতে পেতেন না তিনি। বারবার রেফারিকে বলতেন যে তিনি কী বলছেন তা শুনতে পাচ্ছেন না। মুহাম্মাদ ২০১৬ রিওতে আমেরিকার হয়ে ব্রোঞ্জ জেতেন। তাকে সবসময় পরে থাকতে হয়েছে জর্জেটের দ্বিস্তরী হিজাব। খেলার সময় ঘামে ভিজে গিয়ে ভারি হয়ে যায় এই হিজাব। তারপর তা মাথায় নিয়ে খেলা, রেফারির নির্দেশ শুনতে পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। খেলার সময় তার পোশাকের সাথেও প্রচলিত হিজাব পরতে সমস্যা হতো। গলার নিচে সেফটিপিন দিয়ে বাকি অংশকে পোশাকের ভেতরে আটকে রাখতে হতো, যেন খুলে না যায়।

মুহাম্মাদ বলছিলেন- “হ্যাঁ এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে, কিন্তু আমার পুরো খেলার ক্যারিয়ার আমি এটা পরেই কাটিয়েছি!” প্রচলিত হিজাব পরে খেলা করা কষ্টকর হলেও মুহাম্মাদের কাছে এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। খেলার উপযোগী সঠিক ধরনের হিজাব খুঁজে পাওয়া বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল । তিনি আরো বলেন “প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা অল্প কিছু হিজাবের কথা আমার মনে আছে, যেগুলো পরে আর খুঁজে পাওয়া যেত না”। হিজাবের নির্দিষ্ট কোনো ব্র্যান্ড ছিল না। তার উপর হিজাবকে ভুল বোঝা হতো অনেক ক্ষেত্রেই। স্কুলে থাকার সময় স্থানীয় ইমামের কাছ থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে যেতে হতো যাতে লেখা থাকত যে খেলা করার সময় আমার জন্য ধর্মীয় পোশাক পরা নিরাপদ। আমার প্রশিক্ষকেরা সবসময় আমার সুবিধার জন্য এমন চিঠি নিয়ে ঘুরতেন।

ইবতিহাজ তার পুরো খেলার ক্যারিয়ার কাটিয়েছেন বিভিন্ন সমস্যার সাথে; Souce: Feminisa

ইবতিহাজ একমাত্র নারী নন যাদের হিজাব বেছে নিতে, এই পোশাকে খেলতে অসুবিধা হয়েছে। এমন অনেকেরই সহ্য করতে হয়েছে কঠোর সমালোচনা। মুসলিম নারীদের খেলায় অংশগ্রহণ বাড়লেও তাদের পরিহিত হিজাব বা স্কার্ফ সাধারণ মানের হওয়ায়, খেলার সময় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো তাদের। তাদের কথা মাথায় রেখে নাইকি বাজারে নিয়ে আসে ‘প্রো হিজাব’। এটি একধরনের বিশেষ স্পোর্টস হিজাব, যা আগের হিজাবের থেকে অনেক হালকা ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। মুসলিম নারীদের পোশাককে খেলাধুলার সময় পরার যোগ্য করে তোলার ফলে অনেক মুসলিম নারীই খেলায় আগ্রহী হবেন। কিন্তু এই একই কাজ নাইকিকে করেছে বিতর্কিত।

ধর্মীয় পোশাক হিজাব পরার ফলে খেলাতে যে ধরনের প্রতিকূলতা আসতো, তা এড়াতে নারী দিবসের দুদিন আগে নাইকি তাদের নতুন পোশাক ‘প্রো হিজাব’ এর মোড়ক উন্মোচন করে। স্পোর্টস হিজাব কিন্তু নাইকি প্রথম আনেনি, তাদের আগেও কয়েকটি কোম্পানি এমন পোশাক তৈরি করেছে। কিন্তু নাইকিকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রীড়াসামগ্রীর ব্র্যান্ড বলা যায়। প্রো হিজাব নামের পণ্যটি তৈরি করার পেছনে তাদের মহৎ উদ্দেশ্যের কারণে এটি ‘বিজলি ডিজাইনস অব দ্য ইয়ার’ এর তালিকায় মনোনীত হয়েছে। পণ্যটির প্রচারণা চলাকালে নাইকি বিভিন্ন দেশের মুসলিম নারী ক্রীড়াবিদদের সাথে নিয়ে কাজ করেছে। তাদের ভেতর আছেন মিশরীয় ম্যারাথন দৌড়বিদ মানাল এ. রোস্তম, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভারোত্তলক আমনা আল হাদ্দাদের মতো ক্রীড়াবিদেরা। তারা হিজাবের গ্রহণযোগ্যতা, ব্যবহারের সুবিধা পরীক্ষা করে দেখেছেন। নাইকির প্রচারণামূলক অভিযানেও অংশ নিয়েছেন তারা। মানাল এ. রোস্তম বলেন, “আগে যেটি ব্যবহার করতাম সেটি সাধারণ হিজাব ছিল, অনেকটা হুডি ধরনের, সুতির কাপড়ের, যা খুব একটা স্বস্তিদায়ক ছিল না।”

প্রতিটি খেলোয়াড়ের সমান সুযোগ থাকা উচিত; Source: Al Arabiya

বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন তারা এই প্রচারণার অংশ হিসেবে কাজ করছেন, কেন তারা এই প্রকল্পের সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ কী, এই পণ্যটি কেমন সাড়া জাগাবে, তারা এর মাধ্যমে কীভাবে উপকৃত হবেন আর পুরো খেলার দুনিয়ায় এর কী প্রভাব পড়বে। উভয় ক্রীড়াবিদই নাইকির ‘প্রো হিজাব’ এর ডিজাইনকে বাস্তবতা দেওয়ার জন্য খেটেছেন। তিন বছর আগে, ২০১৫ সালে নাইকির প্রো হিজাব তৈরির পরিকল্পনার কথা জেনেছিলেন রোস্তম। তিনি জানতে পারেন, এর মডেল হিসেবে নারী ক্রীড়াবিদের অভাববোধ করছে নাইকি। তিনি নাইকির সাথে কথা বলেন, আর বলেন তাদের এই বিষয়ে চিন্তা না করতে। সেই থেকে শুরু। তারপর ২০১৫ সালে নাইকির মধ্যপ্রাচ্যের প্রচারণায় তিনি প্রথম হিজাবী নারী হিসেবে কাজ করেন। ২০১৬ সালে তিনি নাইকির সদর দফতর ভ্রমণ করেন। সেখানে কর্তাব্যক্তিদের সাথে আলোচনায় তিনি স্পোর্টস হিজাবের অনুপ্রেরণার আলো জ্বালিয়েছিলেন।

নাইকি উঁচু সারির ক্রীড়াবিদদের সাথে কথা বলে তাদের প্রচলিত হিজাবের কোথায় কী সমস্যা হয় জেনে নিয়েছে প্রায় দু’বছর ধরে। খেলোয়াড়দের সাথে এসব আলোচনা ডিজাইনারদের সাহায্য করেছে নতুন ধরনের, ঝামেলামুক্ত হিজাব বানাতে। ডিজাইনারেরা সব ধরনের খেলা থেকে মুসলিম নারীদের বেছে নিয়ে তাদের জন্য হিজাব তৈরি করেছে। যেহেতু প্রতিটি খেলা ও তার জন্য নির্ধারিত পোশাক আলাদা, তাই সেসব খেলার জন্য আলাদা করে বিশেষ হিজাব বানিয়েছে। কিন্তু খেলার প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও প্রায় প্রত্যেক খেলোয়াড়ের ইচ্ছা ছিল নরম, হালকা স্বস্তিদায়ক কিছু পাওয়া।

আলাদা আলাদা খেলার জন্য নাইকি বানিয়েছে ভিন্ন ধরনের হিজাব; Source: Dornob

জার্মান বক্সার জেইনা নাসার বলেন যে তার পুরানো হিজাব ঢিলা ছিল, সেটা পরে তার দমবন্ধ লাগত। সেটাকে সবখানে পিন দিয়ে আটকানো লাগত। নাইকির প্রো হিজাব পরে বলেন যে এখন আর তাকে অন্যদিকে মন দিতে হয় না, কারণ খেলার উপযোগী এই স্কার্ফ ভালোভাবে এঁটে থাকে। স্কেটার যাহরা লারী বলেছেন, আগে বরফের ভেতর জোরে ঘোরার সময় সমস্যা হত, এখন আর সেটা হয় না। নাইকি তাকে এমন হিজাব দিয়েছে, যা তিনি চেয়েছিলেন। লারী ভাবেন, নাইকি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে মুসলিম নারীরাও পিছিয়ে নেই। নাইকি যা করেছে তা এমন এক স্বপ্ন, যা কখনো বাস্তব হবে বলে ভাবেননি তিনি। ইবতিহাজের ধারণা, নাইকির এই পণ্য হিজাব ও মুসলিম নারীকে অনেক ভুল ধারণার কাছ থেকে মুক্তি দেবে, ক্রীড়াবিশ্বকে করবে একটি স্বাধীন জায়গা। গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে ইউরোপ, আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে সহজলভ্য হয় হিজাবটি। দাম ৩৫ ইউএস ডলার। মুসলিম নারী খেলোয়াড়দের এই তুমুল ইতিবাচকতার সাথেই এসেছে সমালোচনার ঝড়। নাইকির মতো বড় স্পোর্টস ব্র্যান্ডের হিজাবের মতো ধর্মীয় পোশাক উৎপাদন অবশ্য বিতর্ক ছাড়া হবে, এমন ভাবাও অস্বাভাবিক।

সারা বিশ্বে মুসলিম ও সর্বোপরি নারী অগ্রগতির জন্য এই উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও, কেউ কেউ ভাবছে নাইকির ধর্মীয় পোশাক নিয়ে এই বাণিজ্য আসলে নারীকে আরো বেশি নিগৃহীত হওয়ার দিকে ঠেলে দেবে। আবার অনেকেই ভাবছে ব্র্যান্ডকে সহজে খ্যাতি পাওয়াতে এই পথ বেছে নিয়েছে নাইকি। যদিও নাইকি মুনাফার জন্যই এই পোশাক বানিয়েছে, খেলোয়াড়রা ভাবছেন তাদের এই ছোট পদক্ষেপ বিশাল ক্রীড়া জগতে মুসলিম নারীদের সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে।

ইবতিহাজ এখন আগের চেয়ে আরো ভালো খেলতে পারবেন; Source: Nike, Inc.

হাদ্দাদ নিজের ফেসবুকে বলেন, যে তিনি হিজাব ছাড়া অথবা হিজাব সহ সব মুসলিম নারীকেই সমর্থন করেন, কারণ তারা কীভাবে পোশাক পরবেন, তা তাদের নিজেদের পছন্দের ব্যাপার। নাইকির স্পোর্টস হিজাবের সাথে নতুন প্রজন্ম খেলাকে পেশা হিসেবে নিতে উদ্বুদ্ধ হবে। পশ্চিমা কিছু মানুষ যখন ভাবছেন যে নাইকি শুধুমাত্র মুনাফার জন্য ইসলামকে নিয়ে আসছে, ঠিক একইভাবে কিছু মুসলিমও ভাবছেন, এটি নারীদের স্বাধীনতা ও সমঅধিকার দেওয়ার আরেকটি পদক্ষেপ।

শেষ করি হাদ্দাদের কিছু কথা দিয়েই-

“আমি এমন একটা দিনের স্বপ্ন দেখি, যেদিন গণমাধ্যম ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে খেলায় সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি বাদ দিয়ে আমাদের যোগ্যতা, ইচ্ছাশক্তি, মানবিক শক্তি নিয়ে কথা বলবে। খেলা বলতে পারে না আপনি মুসলিম, ইহুদী, খ্রিস্টান, আরব, আফ্রিকান-আমেরিকান, অথবা আপনার যৌনতা কী। এটি শুধু প্রতিভা বোঝে, আপনি খেলতে পারেন কিনা। এই বিষয়টিই খেলার সৌন্দর্য।

ফিচার ইমেজ- Nike, Inc.

Related Articles