Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ওইজা বোর্ড: আত্মা নামানোর মিথ্যে বিদ্যা

‘ওইজা বোর্ড’ শব্দটি মাথায় এলে হুমায়ূন আহমেদের ‘ওইজা বোর্ড’ নাটকটির কথা মনে পড়ে যায়। মামা বিদেশ থেকে একটি ওইজা বোর্ড নিয়ে আসে ভাগ্নের জন্য। বারণ করা সত্যেও ভাগ্নে রাতে বোর্ডটা নিয়ে বসে যায় মৃত আত্মা নামানোর আশায়। চারদিকে এক ভয়ার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরক্ষণেই এক খিল খিল হাসিতে সকলে ভয় পেয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে বোর্ডটি খাটের নিচে ছুঁড়ে দিয়ে এক ভৌতিক আবহে শুতে চলে যায়। ওদিকে দেখা যায় পাশের ঘরে তাদের বাবা কোনো একটি বিষয়ে হেসে ওঠেন আর সেই হাসির আওয়াজ শুনেই তারা আত্মা এসেছে বলে ভয়ে কাঁপতে থাকে সবাই!

গোসাইপুরে সরগরম ছবির পোস্টার; ছবিসূত্রঃ youtube.com

সত্যজিত রায়ের ‘গোসাইপুরে সরগরম’ গল্পেও আত্মা নামানোর রহস্যের সমাধান করেন ফেলুদা। সেখানে আত্মারাম বলে এক তান্ত্রিক যোগবলে আত্মা নামাতেন। বলা বাহুল্য, গল্পের শেষদিকে ধরা পড়ে যায় তার সকল জারিজুরি। এছাড়াও কত শত ভৌতিক গল্প রয়েছে এ আত্মা নামানোর কৌশল নিয়ে। আর তেমনি এক কৌশল হলো ওইজা বোর্ড। অনেকে একে প্ল্যানচেট বলে থাকে।

চাকা সম্বলিত কলমযুক্ত প্ল্যানচেট; ছবিসূত্রঃ etsy.com

প্ল্যানচেট হলো ওইজা বোর্ডের আগের সংস্করণ যেখানে হার্ট আকৃতির একটি বোর্ডের সাথে একটি কলম বা পেন্সিল যুক্ত থাকতো। আর আত্মা যখন কোনো মাধ্যমের উপর ভর করতো, তখন তার হাত দিয়েই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর লিখত। কিন্তু পরবর্তীতে এই বোর্ডের আধুনিক রূপ হয়ে উঠল ওইজা বোর্ড। তবে এই বোর্ডের সাথেও যুক্ত আছে হার্ট আকৃতির কাঠের বা প্লাস্টিকের টুকরো, যেটিকে মূলত প্ল্যানচেট বলা হয়ে থাকে। আমরা মূলত আত্মা নামানোর পুরো কৌশলটাকেই বর্তমানে প্ল্যানচেট বলে থাকি। বিভিন্ন গল্প-সিনেমাতে একেই প্ল্যানচেট বলা হয়।

ওইজা বোর্ড; ছবিসূত্রঃ theshaderoom.com

ওইজা বোর্ডকে স্পিরিট বোর্ড বা টকিং বোর্ডও বলা হয়ে থাকে। সমতল এই কাঠের বোর্ডে ইংরেজি বর্ণমালা, ০-৯ সংখ্যা, ইয়েস, নো এবং কিছু চিহ্ন সংযুক্ত থাকে। প্ল্যানচেটের উপর হাত রেখে একটি গোল টেবিলের চারপাশে বসে একত্রে কোনো আত্মাকে ডাকা হয়। ঘরে আত্মার উপস্থিতি টের পাওয়া গেলে প্ল্যানচেটটি আত্মার নির্দেশ মতো বিভিন্ন বর্ণ নির্দেশ করে আর সেই সকল বর্ণ যোগ করে প্রশ্নের উত্তর সাজানো হয়।

ওইজা বোর্ডের উপর প্ল্যানচেট; ছবিসূত্রঃ youtube.com

ছোটবেলা থেকেই প্ল্যানচেটের প্রতি আগ্রহ ছিল বেশ। শখ ছিল একটা ওইজা বোর্ডের। সেই শখ কখনো পূরণ না হলেও আগ্রহ রয়ে গেছে ঠিকই। ক্রমেই জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে লাগলো। আসলেই কি প্ল্যানচেটে আত্মা নামানো সম্ভব?

ভাবতে অবাক লাগে, দেশ বিদেশের সংস্কৃতিতে আত্মা নামানোর এই প্রাচীনতম পন্থাটি আজও অকপটে চলে আসছে বেশ আড়ম্বরপূর্ণভাবেই। শুনেছি ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। কিন্তু বিজ্ঞানে বিশ্বাসী মন এত সহজে মানবেই বা কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজ ওইজা বোর্ড সম্পর্কে জানার চেষ্টা।

প্রাচীনকালে ওইজা বোর্ড; ছবিসূত্রঃ lunaticoutpost.com

ওইজা বোর্ডের ধারণা অনেক পুরনো। এর অস্তিত্ব বহু দিনের হলেও মূলত ১৮৪০ কিংবা ১৮৫০ সালের দিকে এটি স্পিরিচুয়ালিস্টদের মাধ্যমে আধুনিক মানুষদের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেতে শুরু করে। যারা আত্মা নামানোর কাজটি করে থাকেন, তাদেরকেই স্পিরিচুয়েলিস্ট বলা হয়ে থাকে।

ওইজা বোর্ডের মাধ্যমে মানুষজন তাদের প্রিয় মৃত মানুষদের সান্নিধ্য পেতে স্পিরিচুয়ালিস্টদের শরণাপন্ন হতে থাকে। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যে সকল সৈনিক ঘরে ফিরে আসেন নি, তাদের সাথে একটিবার সংযোগ স্থাপন করতে তাদের পরিবারের সদস্যরা মরিয়া হয়ে ওঠে। আর তখন ভুঁইফোঁড়ের মতো গজিয়ে ওঠে আত্মা নামানোর ব্যবসা।

আত্মা নামানোর প্রক্রিয়ায়; ছবিসূত্রঃ lynncinnamon.com

প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আত্মা নামানোর প্রক্রিয়াটি প্রথম দেখা যায় চীনে। সেখানে একে বলা হতো ‘ফুজি’। এটি মূলত ছিল এক ধরনের জাদুবিদ্যা, যার মাধ্যমে মৃত আত্মাদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা যেত।

এলিজাহ বন্ড ছিলেন একজন আমেরিকান উকিল এবং উদ্ভাবক। তার হাত ধরেই প্রথম ওইজা বোর্ডের ধারণার বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়। ১৮৯০ সালের ২৮ মে টকিং বোর্ডের স্বত্বাধিকার কিনে নেন বন্ড। এই কোম্পানির এক কর্মকর্তা উইলিয়াম ফুল্ড পরবর্তীতে ১৯০১ সাল থেকে ‘ওইজা’ নামে অনুরূপ ধরনের বোর্ড উৎপাদন শুরু করেন। ফুল্ডের মতে ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান শব্দের মিলবন্ধনে ‘ওইজা’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে যার অর্থ ‘হ্যাঁ’। অনেক চড়াই উৎরাই পার করে ১৯৯১ সালে এর স্বত্বাধিকার আসে ‘হাসবো ইনকরপোরেশনে’র কাছে। সেই থেকে ‘ওইজা বোর্ডে’র সকল ট্রেডমার্ক এবং প্যাটেন্ট এই কোম্পানির কাছেই সীমাবদ্ধ।

এলিজাহ বন্ড; ছবিসূত্রঃ findagrave.com

ওইজা বোর্ডের অনেক ধরনের সংস্করণ রয়েছে। মিডিয়ামের ভিত্তিতে আত্মা নামানোর প্রক্রিয়ার ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। তবে জনপ্রিয় এই বোর্ডের কাজ করার ব্যাপারটি খুবই সহজ। আজও আত্মা নামানোর এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী মানুষ শরণাপন্ন হন স্পিরিচুয়ালিস্টদের কাছে। তবে বিজ্ঞান তো আর যুক্তি-তর্ক ছাড়া শুধু বিশ্বাসে গা ভাসাতে পারে না। তাই দেখা দরকার বিজ্ঞানের চোখে এই প্ল্যানচেটের ধারণাটি কি?

বিজ্ঞানের চোখে পুরো ব্যাপারটিই হলো মনস্তাত্ত্বিক। অর্থাৎ মনের চালনায় পুরো ব্যাপারটি হয়ে থাকে বলে বিজ্ঞানের বিশ্বাস। সাইকোলজির ভাষায় একে বলা হয় ‘ইডিওমোটর ফেনোমেনা’

ইডিওমোটর ফেনোমেনা; ছবিসূত্রঃ medchrome.com

এটা হচ্ছে সেই অবস্থা যখন ‘অটোসাজেশান’ ক্ষমতার প্রভাবে আমাদের অবচেতন মন বিভিন্ন আদেশ বা নির্দেশ গ্রহণ করতে শুরু করে এবং সেই সাজেশন অনুযায়ী অবচেতন মন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নড়াচড়া করতে নির্দেশ দেয়। এই নড়াচড়া অবচেতন মনের নির্দেশে হয় বলে এর নিয়ন্ত্রণ কারও নিজের হাতে থাকে না।

ইডিওমোটর ইফেক্ট; ছবিসূত্রঃ adrianlilly.com

প্ল্যানচেট শুরুর আগেই মিডিয়ামের যে আত্মা নামানো হবে, তার সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকে। কাঠের যে নির্দেশিকা আসরের ‘মিডিয়াম’ ধরে রাখে, তার পেশীর অনৈচ্ছিক নড়াচড়ার কারণেই অবচেতন মন থেকে কাল্পনিক সব নির্দেশ পেয়ে সে বানান করে করে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে নির্ভুলভাবে।

যারা প্রফেশনাল স্পিরিচুয়ালিস্ট, তারা খুব সতর্কতার সাথে এই কাজ করে থাকে যাতে করে আসরের সকলকে একই দিকে কেন্দ্রীভূত রাখতে পারেন। প্ল্যানচেটের ক্ষেত্রে পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিবেশ যথাযথ হলে মনকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই ওইজা বোর্ডের পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন প্রকার আয়োজন; যেমন মোমবাতি জ্বালানো, ধোঁয়ার সৃষ্টি করা, নিরিবিলি পরিবেশ ইত্যাদি।

প্ল্যানচেটের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ; ছবিসূত্রঃ youtube.com

ধর্মীয়ভাবে এই ওইজা বোর্ডের ব্যবহারকে অনেকবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মতে আত্মার সাথে স্পিরিচুয়াল যোগাযোগ শুধুমাত্র যিশু খ্রিস্টের আহ্বানেই সম্ভব। তাদের মতে প্ল্যানচেট এক ধরনের কালো জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের উপাসনা। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় এটি নিষিদ্ধ করা সহ পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। আর যেসকল ধর্মে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই, সেসব ধর্মও এ ধরনের প্রক্রিয়াকে স্বীকৃতি দেয় না।

ওইজা বোর্ড জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা; ছবিসূত্রঃ nydailynews.com

এই ওইজা বোর্ড বা প্ল্যানচেটের ধারণা আমাদের যুগে যুগে ভূতের ভয় পাওয়ার খোরাক জুগিয়ে এসেছে। কত সাহিত্য, ভূতের গল্প, সিনেমা, নাটক তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে এই বিষয় নিয়ে। অমাবস্যার নিশুতি রাতে ছাদে উঠে ভাই-বোনদের নিয়ে প্ল্যানচেট করার বাসনা আমাদের কতজনেরই না হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই দলের কেউ না কেউ ভয় পেয়ে প্রতিবাদ করে উঠেছে। কারণ অবচেতন মনে এক ধরণের বিশ্বাস সবসময় লুকিয়ে থাকেই, এই বুঝি আত্মা এসে কথা বলে উঠবে!

ফিচার ইমেজ: cornucopia3d.com

Related Articles