Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একাকী মায়েদের (সিঙ্গেল মাদার) অনুপ্রেরণা এবং কিছু সাফল্যের গল্প

বাবা জানো? আমাদের বাড়িতে যে ময়না পাখিটা আছে
সে আজ আমার নাম ধরে ডেকেছে;
আর এই কথাটা মা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।
তুমি আজ বাড়িতে এসে মাকে অবশ্যই বকে দেবে…

বিজ্ঞাপনে বাবার কাছে ছোট্ট মেয়ের আদুরে অভিযোগ যেন সাধারণ বাঙ্গালীর প্রতিটি ঘরের কাহিনী। শিশু জন্মের পর তার বাবা-মাকে কেন্দ্র করেই বড় হয়। মা-বাবার আদর, ভালবাসা, শাসন প্রতিটি শিশুর জন্মগত অধিকার। আর সামাজিক জীবনে বেড়ে উঠতে দুইজনের সমান সহযোগিতাই শিশুকে দিতে পারে নিরাপদ ও সুন্দর জীবন। কিন্তু কখনো কখনো সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কালো মেঘ এসে ভেঙে দেয় সাজানো সংসার। আবার অনেক সময় দুর্ঘটনায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় একটি পরিবার। যে কারণেই হোক, মানুষকে দুঃসময় কাটিয়ে নতুন করে শুরু করতে হয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লড়াই। সংসার ভাঙ্গনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের গুরুদায়িত্ব বহন করতে হয় তার মাকে। সন্তানকে বড় করার জন্য তাকেই হয়ে উঠতে হয় বাবা-মা দুই-ই। একইসাথে সামাজিক ও পারিবারিক চাপ কাটিয়ে একা এগিয়ে চলা বেশ কঠিন।

আজকের সমাজে এমন সিঙ্গেল মাদার বা একক মায়েদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও নেহায়েত কম না। দিনে দিনে পরিবার ভাঙ্গনের সংখ্যাটাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প যাদের সন্তানকে পৌঁছে দিয়েছে খ্যাতির শীর্ষে, আজকে তেমন কিছু মায়েদের গল্প শুনবো।

মায়ের আঁচল ছায়ায় সন্তান; Source: commons.wikimedia.org

অ্যান ডানহ্যাম (বারাক ওবামা)

কেনিয়ানিবাসী বারাক হুসেইন ওবামা (সিনিয়র) এবং মার্কিন অ্যান ডানহ্যামের পরিচয় হাওয়াই মানোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালে। তৎকালীন আমেরিকায় সাদা-কালোর বর্ণভেদ অতিক্রম করে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গীর এই ভালবাসাকে সম্পর্কের রূপ দিতে কম গঞ্জনা শুনতে হয়নি। মুসলিম পিতা ও খ্রিস্টান মায়ের সংসারে একমাত্র পুত্র বারাক ওবামা (জুনিয়র) এর জন্ম। ওবামার যখন মাত্র ২ বছর বয়স তখন ওবামা (সিনিয়র) মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে স্ত্রী অ্যান ও পুত্রকে রেখে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি চলে যান। যাওয়ার আগে সংসারিক মনোমালিন্য ও ডিগ্রি অর্জনে তাদের ছেড়ে যাওয়ার মতবিরোধের কারণে ডিভোর্স নেন ওবামা ও অ্যান ডানহ্যাম দম্পতি। পরবর্তীতে পুনরায় ইন্দোনেশীয় লোলো সুতোরোকে বিবাহ করেন অ্যান ডানহ্যাম এবং কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি।

১০ বছর বয়স থেকেই ওবামা তার নানা-নানীর সহচার্যে বেড়ে উঠেছেন। জ্ঞানত ওবামা তার বাবাকে মাত্র একবার দেখেছেন। ওবামা ও তার বোন মায়াকে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে অ্যান একাকী তাদের মনোবল ও সাহস দিয়ে গেছেন আমৃত্যু। তার সহযোগিতা ও অনুপ্ররণায় পুত্র ওবামা আজ পৃথিবী জুড়ে সকল সংগ্রামী মানুষের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদ অতিক্রম করে তিনি আমেরিকার ইতিহাসে দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মায়ের স্মৃতিচারণে তিনি তার আত্মজীবনী ‘Dreams from My Father‘ বইয়ে বলেন-

“আমার মধ্যে আজ যা কিছু ভালো, সবই তাঁকে দেখে শেখা, তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। আমি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ, চিরঋণী।”

মা, বাবা ও বোনের সাথে ওবামা; Source: nyadiff.org, theblaze.com, reguhtimur.com.(anti-clockwise)

মার্শেলিন বার্ট্রান্ড (অ্যাঞ্জেলিনা জোলি)

লুইস জুন ও রোল্যান্ড এফ. বার্ট্রান্ড কন্যা মার্শেলিন বার্ট্রান্ড ছিলেন একজন মার্কিন অভিনেত্রী। ১৯৭১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন অভিনেতা জন ভটের সাথে। কিন্তু দাম্পত্য জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তাদের। কন্যা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ভট ও পুত্র জেমস হ্যাভেনের জন্মের পর ১৯৮০ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাদের। ফলে কন্যা ও পুত্রকে নিয়ে নিউ ইয়র্কের প্যালিসেডে চলে আসেন তিনি। বিবাহ বিচ্ছেদের প্রতিকূলতা কাটাতে অভিনয় ছেড়ে দিতে হয় তাকে।

পিতার কারণে বরাবরই অভিনয়ে অনিচ্ছুক জোলী শুধুমাত্র মায়ের স্বপ্ন পূরণে গ্ল্যামার জগতে পা রাখেন। ২০০২ সালে আইনগতভাবে পিতৃবংশীয় পদবী ‘ভট’ ত্যাগ করে হয়ে ওঠেন ‘অ্যাঞ্জেলিনা জোলি’। শুধুমাত্র মায়ের আঁচলে বেড়ে ওঠা জোলী তিনবার গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, দুবার স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার এবং একবার একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি তার নিজের জীবনের অনুপ্রেরণা হিসেবে মায়ের পথ অনুসরণ করে চলেন বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন।

অ্যাঞ্জেলিনা জোলির পরিবার; Source:haikudeck.com

ইরমেলিন (লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও)

১৯৯৮ সালে বিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরনের সিনেমা ‘টাইটানিক’-এ দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে সকলের মন জয় করেন অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও। অভিনয়ে পথ চলাটা অনেক ছোটবেলায়, ১৯৯০ সালে প্রথম পা রাখেন মিডিয়া জগতে। ২০১৬ সালে ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ছবিতে অভিযাত্রী হিউ গ্লাসের চরিত্রে অভিনয় করে অর্জন করেন কাঙ্ক্ষিত অস্কার। সমস্ত জয়ের পেছনে তাকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন তার মা ইরমেলিন। কমিক শিল্পী ও বই পরিবেশক জর্জ ডিক্যাপ্রিও এবং আইন সচিব ইরমেলিনের একমাত্র সন্তান লিওনার্দো। লিওনার্দোর শৈশবে দাম্পত্য জীবন থেকে বিচ্ছেদের পর মা ইরমেলিনের সাহচর্যেই বেড়ে ওঠেন তিনি। মাতৃস্নেহে বড় হলেও পিতার সান্নিধ্যেও ছিলেন তিনি। সৃষ্টিশীল মা তাকে তার ইচ্ছাপূরণে দারুণভাবে সহায়তা করে গেছেন সবসময়।

মা-বাবার সাথে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও; Source: vogue.com, moviepilot.com, keywordsuggest.com.(anti-clockwise)

ফাতিমা খান (শাহরুখ খান)

রুপে-গুণে তেজস্বিনী ফাতিমা খান ছিলেন প্রথম শ্রেণীর একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯৫৫ সালে ভারতীয় একজন স্বনামধন্য স্বাধীনতা কর্মী তাজ মোহাম্মদ খানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের সংসারে কন্যা শেহনাহ লালারুখ খান ও পুত্র শাহরুখ খানের জন্ম হয়। শাহরুখ খানের যখন মাত্র ১৫ বছর বয়স, তখন তার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তিনি প্রায় আট মাসের অধিক শয্যাশায়ী ছিলেন। তার অসুস্থতায় দেখাশোনা আর পরিবারের দায়িত্ব ফাতেমার উপর বর্তায়। স্বামীর চিকিৎসায় মাত্র ১০ দিনে পাঁচ হাজার রূপি মূল্যের ২৩টি ইঞ্জেকশনের ব্যয়ভার চালানো বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ফাতেমার জন্য। তবুও হার মানেননি তিনি। দিন-রাত কাজ করে গেছেন সংসারের দায়িত্ব পালনে। পরবর্তীতে স্বামীর মৃত্যুর পর তার ব্যবসাকে আবার নতুন করে দাঁড় করান ফাতেমা।

তার উৎসাহে শাহরুখ প্রথম অভিনয়ে যোগ দেন এবং বলিউডে আজ সাফল্যের শীর্ষে অবস্থান করছেন। ১৯৯০ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন। একজন সফল ভারতীয় অভিনেতা, প্রযোজক, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং মানবপ্রেমিক হিসেবে শাহরুখ বিশ্বাস করেন, তার জীবনাদর্শ মায়ের থেকেই পাওয়া। মায়ের সংগ্রাম ও পরিশ্রম সবসময়ই তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

বাবা, মা ও বোনের সাথে ছোট্ট কিং খান; Source:PagalParrot

ভিনিতা লি (অপরাহ উইনফ্রে)

বিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকান-আমেরিকান সবচেয়ে ধনী ও ‘কুইন অব অল মিডিয়া‘ হিসেবে পরিচিত অপরাহ উইনফ্রের ছেলেবেলা ছিল আর দশটা শিশুর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মিসিসিপির নিভৃত পল্লী মিলওয়াকিতে এক অবিবাহিত মায়ের সন্তান হয়ে জন্ম গ্রহণ করেন অপরাহ। ফলে অপবাদ, নিন্দা আর অবহেলায় মাকে নিয়ে ছোট্ট অভাবের সংসার ছিল তার। সাথে কৃষ্ণবর্ণের এই মেয়েটিকে চেহারার  জন্য সবসময় নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে।

জন্মের ১ বছর পরই তিনি নানীর কাছে চলে যান এবং সেখানেই বড় হতে থাকেন। ৬ বছর বয়সে পুনরায় মায়ের কাছে চলে আসেন তিনি। মা ভিনিতা লি গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন এবং পিতা ভারনন উইনফ্রে ছিলেন পেশায় নরসুন্দর। পরবর্তীতে জীবনের নানা উত্থান-পতন কাটিয়ে পিতার সহায়তায় প্রথমে স্থানীয় এক রেডিওতে সংবাদ পাঠিকার কাজ পান। এরপর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি; একাধারে হয়ে উঠেছেন লেখক, অভিনেত্রী, পরিচালক আর গণমাধ্যমের সম্রাজ্ঞী।

অবিবাহিতা মায়ের সন্তান অপরাহ; Source: oprah.com

অ্যামান্ডা ডন ম্যান্ডি কর্নেটের (সেলেনা গোমেজ)

দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে শূন্য থেকে অসীমে পৌঁছানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সেলেনা গোমেজ। রিকার্ডো জোয়েল গোমেজ এবং অ্যামান্ডা ডন ম্যান্ডি কর্নেটের সংসারে তিন কন্যার অন্যতম তিনি। সেলেনার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। হঠাৎ করে সুখী পরিবার ভেঙে যাওয়ায় সেলেনা হতাশায় ভুগতেন। তাদের এমনও দিন গেছে, যখন তিনবেলা খাবার জোগাড়েই তার মা কর্নেটকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে। সংসারের খরচ চালাতে তিনটি চাকরি করতেন তিনি।

মেয়ের মন ভাল রাখতে তাকে বিভিন্ন কনসার্টে নিয়ে যেতেন। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হতেন সেলেনা । গানবাজনা আর অভিনয়ে ঝোঁক থেকেই তার কর্মজীবন শুরু। মায়ের সহযোগিতা আর সংগ্রামী জীবন থেকে তিনি সর্বদা অনুপ্রেরণা পেতেন। তার প্রকাশিত প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতের অ্যালবাম বিলবোর্ডে শীর্ষ ১০ ও ৫ এ স্থান লাভ করে। অভিনয় ও সঙ্গীত দুইদিকেই সেলেনার সমান দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।

বাবা-মায়ের সাথে সেলেনা; Source: twicsy.com, Instyle, Bilboard.(anti-clockwise)

এমন জানা-অজানা অনেক পরিবারে সন্তানেরা বেড়ে উঠে মাতৃছায়ায়। জীবনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে স্বীয় মনোবলে অর্জন করেছেন সফলতা। কার্যক্ষেত্রের দরুন অনেকেই আমাদের পরিচিত মুখ, আবার অনেকেই রয়েছে রুপালী পর্দার বাইরেও। সমাজের তীর্যক দৃষ্টি, আর্থিক অস্বচ্ছলতা সহ্য করেও যেসব মায়েরা সন্তানদের পাশে থেকে অণুপ্রেরণা দিয়ে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়ে গেছেন তারা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। জীবন সংগ্রামের চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে তাদের এগিয়ে নিতে সেসব একাকী মায়েদের অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য।

ফিচার ইমেজ- Pinterest, Bilboard, oprah.com, yourdailykarma, pisanieprac, vogue.com

Related Articles