নাকে-মুখে নল নিয়ে হাসপাতালের নীল বিছানায় শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। সময় ঘনিয়ে এসেছে তার। অনেকেই বলেন, মৃত্যুর আগে এক পলকে পুরো জীবনের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কাছেই থাকা সহৃদয় নার্সের কাছে বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ যেন বলতে চাইলেন, যা চেয়েছিলাম, তার অনেক কিছুই যেন অধরা রয়ে গেল!
‘সিটিজেন কেন’ মুভিটির কথা মনে আছে? মৃত্যুশয্যায় বৃদ্ধ কোটিপতি চার্লস কেন ফিসফিসিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করেন। তা নিয়ে পড়ে যায় হইচই। অবশেষে দর্শকেরা জানতে পারেন, তিনি আসলে তার ছোটবেলার একটি প্রিয় জিনিসের কথা বলতে চেয়েছিলেন। বিশাল প্রাচুর্য তাকে অনেক কিছু দিলেও সেই অপার আনন্দ দিতে পারেনি।
মৃত্যুর আগে এমন ছোটখাট কিছু জিনিসের জন্যই অনেকের প্রাণ হাঁসফাঁশ করতে থাকে। নিজের শিক্ষা, ক্যারিয়ার, সাফল্য-ব্যর্থতা কোনো কিছুতেই তখন আর কিছু যায় আসে না। প্রিয়জনদের সাথে কাটানো দৈনন্দিন স্বাভাবিক মুহূর্তগুলোই যেন অমূল্য হয়ে ধরা দেয়। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যে বইগুলো পড়া হয়নি, যে জায়গাগুলোয় যাওয়া হয়নি, সেগুলোর কথা ভেবে চোখ ফেটে পানি আসে।
ব্রুনি ওয়্যার নামের এক অস্ট্রেলিয়ান নার্স ৮ বছর ধরে কাজ করেছেন মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের ইউনিটে। তার প্রধান কাজই ছিল শারীরিক এবং মানসিকভাবে সবার যন্ত্রণা উপশমের চেষ্টা করা। জীবনের শেষ সপ্তাহগুলো কাটানো রোগীদেরকে যথাসম্ভব সেবা-শুশ্রূষা করার চেষ্টা করতেন তিনি। একজন আদর্শ সেবিকা হবার কারণেই হয়তো মরণাপন্ন রোগীদের অনুভূতিগুলো তাকে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই স্পর্শ করতো। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে তাদের আবেগ-অনুভূতি কিংবা আক্ষেপগুলো নিয়ে ব্রুনি 'ইন্সপারেশন অ্যান্ড চাই' নামের একটি ব্লগে লেখা শুরু করেন।
সেই কথাগুলো ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। পরে তিনি নিজের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আস্ত একটি বই লিখে ফেলেন কয়েক বছর আগে, যার নাম 'দ্য টপ ফাইভ রিগ্রেটস অফ ডাইং' অর্থাৎ মৃত্যুর আগে যে ৫টি বিষয়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি আক্ষেপ থেকে যায়।
মৃত্যু যেকোনো সময়েই ঘনিয়ে আসতে পারে, কিন্তু যারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে বার্ধক্যের শেষ লগ্নে গিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেন, বইতে মূলত তাদেরই মনের কথা উঠে এসেছে। কোন আক্ষেপগুলো মানুষকে সবচেয়ে বেশি তাড়া করে? ভাবুন তো, আপনিও আপনার জীবনের কাঙ্ক্ষিত কোনো সুযোগ হেলায় হারাচ্ছেন কি না।
অন্যদের সন্তুষ্ট করার পেছনে না ছুটে নিজের ভালবাসা কিংবা পছন্দের প্রতি সৎ থেকে জীবনটা কাটানোর সাহস যদি থাকতো আমার!
ব্রুনির মতে, যেকোনো মানুষের সবচেয়ে বেশি আফসোস থেকে যায় এই ব্যাপারটি নিয়েই। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসেই মানুষ টের পায়, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার কতগুলো স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেছে। কেবলই সবার মন জুগিয়ে কাজ করতে করতে নিজের জন্য কোনো সময়ই রাখা হয়নি। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি আর।
অনেকে মনে করেন, ভবিষ্যতে নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণ করবেন। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ হয়তো আর আসে না। কারো হয়তো শখ ছিল টুকটাক লেখালেখি করবেন কিংবা গিটার বাজানো শিখবেন। কিন্তু জীবনের আসল কাজগুলোর ভিড়ে সেই ইচ্ছাগুলো হারিয়ে গেছে। আবার কারো হয়তো শখ ছিল, বনের সবুজের মাঝে অ্যাডভেঞ্চারে হারিয়ে যাবেন কিছুদিনের জন্য। কিন্তু কখনো শিক্ষাজীবন আর কখনো চাকরিজীবন সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবার চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে নিজের চাওয়াগুলো পিছিয়ে গেছে বারবার। অবশেষে যখন একটু অবসর মিললো, তখন আর সেই উদ্যম, শক্তি কিংবা সামর্থ্য নেই। স্বপ্নটা অধরাই রয়ে গেলো।
শুধু কাজ নিয়েই জীবনভর ব্যস্ত থেকে গেলাম!
জীবনে ক্যারিয়ার, চাকরির পেছনে ছুটে অনেকেই নিজেদের মূল্যবান একটি জিনিস হারিয়ে ফেলেন। সন্তানের প্রথম হাঁটা, মুখে প্রথম বুলি ফোটা কিংবা অসুস্থ মায়ের পাশে থাকার মতো মুহূর্তগুলো পরে চাইলেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সন্তান বড় হয়ে যায়, আস্তে আস্তে সৃষ্টি হয় দূরত্ব।
যে সন্তানটি সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করতো, সে এখন কথা বলতে না পারলেই খুশি হয়। দূরত্বটি কাটিয়ে মনের কথাটা আর প্রকাশ করা হয়ে ওঠে না। ঠিক তেমনি ব্যস্ততার কারণে অনেকসময় মা-বাবার সাথে ঠিকমতো যোগাযোগটাও রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। একসময় মা-বাবা ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন। পরে যখন নিজের মতো করে একটু সময় পাওয়া যায়, তখন প্রিয়জনদের সাথে আন্তরিক সম্পর্কগুলো গেছে হারিয়ে। জীবনের ফেলে আসা সেই মুহূর্তগুলোর জন্য বুকে বারবার হাহাকার জাগে।
প্রিয় বন্ধুগুলোর সাথে যদি আরো কিছু সময় কাটাতাম!
মান্না দে'র ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’ গানটি স্মৃতিরোমন্থন করতে পারেনি, এমন কোনো মানুষ খুব কম। নিজের জীবনের এই স্বর্ণালী সময়ের মধুর সম্পর্কগুলোয় বিভিন্ন কারণে ভাটা পড়ে যায়।
শিক্ষাজীবনে কিংবা ক্যারিয়ার গড়ার পথে রেষারেষিতে কিংবা ব্যস্ততায় অনেকের সাথে হৃদ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। আগে যার সাথে কথা না বলে থাকা যেত না, পরে তাকেই রাস্তায় দেখে না দেখার ভান করতে হয়। নিজের জীবন গড়ার পথে নানা ব্যস্ততায় অনেক অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু জীবনে সবকিছু পেয়ে যাবার পরে হঠাৎ করে সেই লাগামছাড়া সময়টার কথাই মনে পড়তে থাকে।
নিজের অনুভূতিগুলো যদি ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারতাম!
অনেক মানুষই বিভিন্ন স্বার্থে ভুল মানুষের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে যান। ফলে সৃষ্টি হয় একটি তিক্ত সম্পর্কের। যেসব মানুষের সাথে সামনে এক কিন্তু পেছনে আরেকরকম কথা বলতে হয়, তাদের সাথে চলা নিজের ওপরেই পীড়াদায়ক। সোজাসাপ্টা কথা বলার সাহস থাকলে আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতি হলেও নিজের মনের ভেতরে গুমরে মরতে হতো না।
দুঃখ, হাসি, কান্নাসহ যেকোনো আবেগ-অনুভূতি চেপে রাখাই স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে মনের ভাবটা প্রকাশ না করে ফেলা তাই পরে হয়ে ওঠে আক্ষেপের কারণ।
জীবনটা যদি আরো বেশি হাসি-আনন্দে কাটাতাম!
আশ্চর্য হলেও সত্য, এই আক্ষেপটি মৃত্যুর আগে প্রায় সবাইকেই করতে দেখা যায়। অনেকেই অন্যের ওপর নির্ভর করে নিজেকে সুখী দেখতে চায়, অথচ সুখী হওয়াটা কেবল নিজেরই ওপর। অন্যকে তুষ্ট করার পেছনে যতটুকু সময় দেয়া হচ্ছে, তার থেকে কিছুটা সময় নিজেকে বিনোদিত করার পেছনে দিলেও সত্ত্বার খোরাক জোটে।
পুরনো অভ্যাস, পরিচিত পরিবেশ ফেলে আসতে চান না অনেকেই। পরিবর্তনের শঙ্কায় অনেকেই নিজেকে বোঝান যে, তারা সুখী আছেন। অথচ ভেতরে ভেতরে তাদের মন গুমরে মরছে একটু হাসি-ঠাট্টা, একটু নির্ভাবনার আশায়। আবার অনেকে সঞ্চয়ের নামে নিম্নমানের জীবনযাপন করেন, জোর করে নিজেকে খুশি করতে চান। অথচ ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে বর্তমানকে উপভোগ করলেই শেষ বয়সে পরিতৃপ্তি মিলতো।
সৃষ্টিকর্তার কৃপায় যারা এখনো সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে আছেন, চারপাশে সুখের অপার ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও সেগুলোকে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছেন, তারা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কখনো কি ভেবেছেন? ব্যস্ততায় নিত্যদিন পার করে শেষ বয়সে এসে আপনারও আফসোসের পাহাড় জমবে না তো?
This article is in Bengali Language. It is about top five regrets before dying. For references please check the hyperlinked texts in the article.
Featured Image: becomingminimalist.com