Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলাদেশে কচুরিপানা: ব্যবহারে শৈল্পিক বৈচিত্র্য

বাংলাদেশের ডোবা-নালায় কিংবা খাল-বিলের মতো বদ্ধ জলাশয়ে অবাধ ভাসমান একটি গুল্ম, যার নিচে থাকে একথোকা লম্বা গুচ্ছমূল, আর উপরে খর্বিত কান্ডে একথোকা স্পঞ্জি পাতার দেখা মেলে তা হলো কচুরিপানা। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে দৃষ্টিনন্দন ছয় পাপড়িবিশিষ্ট বেগুনি ফুলের নির্মল শোভা যেন নোংরা ডোবাকেও স্বর্গীয় করে ফেলে। এই আগাছাটির ভাল-মন্দ নানা দিক মিলিয়ে এক রকমারি বৈশিষ্ট্যের উদ্ভিদ প্রজাতি।

বাংলাদেশে কচুরিপানার বিস্তৃতি

এই বহুল পরিচিত কচুরিপানা কিন্তু এ দেশের প্রজাতি নয়। এর আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অর্কিডপ্রেমী এক পর্যটকের কাছে কচুরিপানার ফুলগুলো এতটাই ভাল লাগে যে তিনি ব্রাজিল থেকে এই দেশে আসার সময় সাথে করে আনেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশ এর বিস্তারের জন্য একেবারে উপযুক্ত আবাসস্থল বলা চলে। তাই কচুরিপানা অত্যন্ত বিস্তৃত হতে থাকে সারা দেশে। ১৯২০ সাল নাগাদ প্রায় নদী-নালাসহ প্রায় নব্বইভাগ জলাশয় কচুরিপানায় ছেয়ে যায়!

ব্রাজিলিয়ান পর্যটক এই অর্কিড-সদৃশ কচুরিপানা ফুলে মুগ্ধ হয়ে এ দেশে এনেছিলেন; source: wikimedia commons

সুন্দর মনোহরা ফুল দেখার বাসনায় হাজারো সমস্যার সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই কচুরিপানা। কচুরিপানার প্রাদুর্ভাবে নৌ-চলাচল ব্যাহত হতে থাকে। উপরের পানিপৃষ্ঠ ঢেকে দেওয়ায় সূর্যালোক না পেয়ে পানির নিচের জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি মারা যায় এবং অক্সিজেন ঘাটতির কারণে মাছ মারা যেতে থাকে। কচুরিপানা শুধুমাত্র জলাশয়গুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, নিচু জমিতে ধান এবং পাটের আবাদস্থলে এর দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতির হাল বলার অপেক্ষা রাখে না।

কচুরিপানা প্রাদুর্ভাবে নৌ-চলাচল ব্যহত হয়, source: flickr.com

এই কচুরিপানা নিয়ন্ত্রণে সেই সময়ে হাতে নেওয়া হয় বেশ কিছু আইন সংশোধনীর, যেগুলোর মধ্যে বেঙ্গল জলপথ বিধি, বেঙ্গল মিউনিসিপ্যালিটি, স্থানীয় সরকার আইন এবং স্থানীয় গ্রাম সরকার আইন উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ১৯৩৬ সালে ‘কচুরিপানা আইন’ জারি করে বাড়ির আশেপাশে কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণার পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতায় কচুরিপানা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

যেকোনো নির্বাচনী ইশতেহারে সমসাময়িক আলোচিত সমস্যা সমাধানের কথা উল্লেখ থাকে তা সকলেই জানেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেও সকল দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানা মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই নির্বাচনে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পরপরই ‘কচুরিপানা  উৎখাত কর্মসূচি’ হাতে নেন। এই কর্মসূচী সফল তো হয়েছিলই, এর সাথে সাথে উন্মুক্ত হয় এক নতুন সম্ভাবনা। উৎখাতের সময় স্তুপীকৃত পচা কচুরিপানাকে ঠিকঠাক করে সাজিয়ে ফসলের জন্য চমৎকার সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

অবশেষে ১৯৪৭ সাল নাগাদ নিয়ন্ত্রণে আনা গেল কচুরিপানা। তবে বিলুপ্তি ঘটে নি। যেটুকু আছে তাতে তেমন সমস্যার সৃষ্টি হয় না বলে পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটানোর ব্যবস্থাও আর নেওয়া হয় নি। এর বিকল্প নানা ব্যবহারও আবিষ্কৃত হচ্ছে দিন দিন।

কচুরিপানার সাধারণ ব্যবহার

জৈব সার হিসেবে কচুরিপানার ব্যবহার লক্ষণীয়। কচুরিপানার সাথে খড়কুটা, ঝরা পাতা, আগাছা, আবর্জনা, ফসলের অবশিষ্টাংশ মিশিয়ে পচানো হয়, যা থেকে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট মানের মিশ্র সার। দুই প্রকারে এ সার প্রস্তুত করা যায়। যেমন-

  • অতিবৃষ্টি বা বন্যাদুর্গত এলাকায় বসতবাড়ির আশেপাশে বা বন্যার পানি দাঁড়ায় না এমন স্থানে মাটির উপর ৩ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১.২৫ মিটার প্রস্থ ও উচ্চতার স্তুপ তৈরি করে রেখে চালা দিয়ে রাখতে হবে যেন রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়। তবে স্তুপ করার আগে কচুরিপানাকে টুকরো করে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এরকম স্তুপ পদ্ধতিতে উন্নতমানের সার তৈরি হতে ৩ মাসের মতো সময় লাগে।

স্তুপ পদ্ধতিতে কচুরিপানা থেকে মিশ্রসার প্রস্তুতি; source: satoyama-initiative.com

  • কম বৃষ্টিপাত এলাকায় শুকনো মৌসুমে গাছের ছায়ায় বা গোশালার পাশেই ১.২৫ মিটার প্রস্থ, ১ মিটার গভীর এবং ২.৫ মিটার দৈর্ঘ্যের গর্ত করে গর্তের তলায় বালু বা কাঁকর বা খড় দিয়ে কচুরিপানা, আখের ছোবড়া, গোবর, কলাপাতা মিশিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে প্রত্যেক স্তরের উপর ইউরিয়া সার দিয়ে তারপর মাটির প্রলেপ দিয়ে গর্ত ভরে দিতে হবে। এভাবে ৩ মাস রাখার পর এই সার ব্যবহার উপযোগী হবে।

কচুরিপানা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য; source: langviethand

এছাড়াও গো-খাদ্য হিসেবে, ব্যাগ, দড়ি এবং আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে এই কচুরিপানা। তৈরি হচ্ছে লেখার বা ডিজাইনার রঙিন কাগজও। খুব সম্প্রতি কচুরিপানা থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়েছে।

কচুরিপানার আকর্ষণীয় ফার্নিচার তৈরি

কচুরিপানার এক অভিনব ব্যবহার হলো ফার্নিচার তৈরি। এই ফার্নিচারগুলো যেমন পরিবেশ-বান্ধব তেমনই আকর্ষণীয়। প্রথম দেখায় কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ফার্নিচারগুলোকে প্রথম দেখায় বেতের ফার্নিচার মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো বেতের তুলনায় অনেক বেশি নরম, নমনীয়, স্থিতিস্থাপক এবং অন্দরে বেশ আধুনিকতার প্রকাশ ঘটায়।

কচুরিপানায় ফার্নিচার; source: michaelburtstonsr.com

তৈরি প্রক্রিয়া

কচুরিপানা ব্যবহার করে ফার্নিচার তৈরিতে বড় বড় মেশিন কিংবা বড় বড় যন্ত্রপাতিরও প্রয়োজন পড়ে না। একেবারেই সাদাসিধে প্রক্রিয়ায় অসাধারণ সব ফার্নিচার তৈরি হয়। যেমন-

  • প্রথমে ডোবা-নালা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কচুরিপানা তুলে আনা হয়।
  • সংগৃহীত কচুরিপানাগুলোকে ভালভাবে পরিষ্কার করে ডাঁটা থেকে পাতাগুলোকে আলাদা করা হয়।
  • এরপর প্রাপ্ত কচুরিপানার ডাঁটাগুলোকে ভালমতো রোদে শুকাতে হয়।
  • শুকনো ডাঁটাগুলোর উপরের আঁশের মতো অংশটুকু সরিয়ে নিলেই ফিতার ন্যায় অংশের দেখা মিলবে।
  • এবার কাঠের বা স্টিলের তৈরি মনের মতো গঠনের ফ্রেমে প্রাপ্ত ফিতা পেঁচিয়ে এবং বুননের মাধ্যমে শৈল্পিক রূপ দেওয়া হয়।
  • শেষে চাইলে মনের মতো রঙ ব্যবহার করা হয় চকচকে ভাব আনতে।

ফার্নিচার তৈরির প্রক্রিয়া; source: giskaa.com

কাঠের ফ্রেমে কচুরিপানার ফিতাগুলো লাগানো হচ্ছে; source: gardenfurniture.co.uk

ব্যস, তৈরি হয়ে গেল পরিবেশ-বান্ধব ফার্নিচার। এভাবে আপনি সোফা, টি-টেবিল, সেন্টার টেবিল, বুকশেলফ ইত্যাদি তৈরি করতে পারেন।

কচুরিপানার ফার্নিচারের অনন্য সুবাসের ক্ষমতা

কচুরিপানা থেকে বানানো ফার্নিচারগুলোর এক ধরনের নিজস্ব সুবাস রয়েছে। এই সুবাস খুব কড়াও নয়, আবার একেবারেই বোঝা যায় না তেমনও নয়। ঘরে এই ফার্নিচারগুলো রাখলে পুরো ঘরই মোহিত হয়ে থাকে মৃদুমন্দ সুবাসে। ধরুন, আপনি সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলেন। এবার কচুরিপানায় তৈরি বিছানায় বা সোফায় আসতে করে বসুন এবং ধীরে ধীরে এলিয়ে দিন শরীরটিকে। এবার চোখটি বন্ধ করে প্রাকৃতিক সুবাস অনুভব করার চেষ্টা করুন। দেখবেন পুরো শরীরের ক্লান্তি কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে। একটি ছোটখাটো মেডিটেশনও হয়ে যাবে এতে করে। তবে হ্যাঁ, শুধুই ক্লান্ত থাকলেই যে সুবাস অনুভব করবেন তা কিন্তু নয়, সর্বক্ষণই কচুরিপানার ফার্নিচারের প্রাকৃতিক সুবাস আপনার ভেতর এক বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করবে।

কচুরিপানার সোফায় আধুনিকতার ছোঁয়া; source: made-in-china.com

কচুরিপানায় তৈরি খাট; source: art-craft.com

পরিষ্কার রাখবেন যেভাবে

কচুরিপানায় তৈরি জিনিসপত্র বা ফার্নিচার পরিষ্কার রাখা বেশ সহজ। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশ সময় ধরে তা ভেজা না থাকে। ভিজে গেলে রোদে বা ড্রায়ার দিয়ে খুব ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। শুধুমাত্র দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করেই পরিষ্কার রাখতে পারেন আপনার এই পরিবেশ-বান্ধব ফার্নিচারগুলো-

  • একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে প্রতিদিনের জমা ধুলো পরিষ্কার করে ফেলতে পারেন, পাশাপাশি নাইলনের ব্রাশ ব্যবহার করতে পারেন।
  • দাগ লাগলে বা দাগ হয়ে গেলে সামান্য একটু সাবান আর পানি দিয়ে ধুয়ে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।

শেষ কথা

জগতের সবকিছুরই ভাল-মন্দ দুই দিকই রয়েছে। ভাল দিকটিকে ফুটিয়ে তোলা চ্যালেঞ্জ। কচুরিপানা যেমন ক্ষতিকর এবং নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক, তেমনই এর উপযুক্ত ব্যবহারে সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ কচুরিপানা রপ্তানি করছে। সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো বাংলাদেশও কচুরিপানা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে।

ফিচার ইমেজ- উইকিমিডিয়া কমন্স

Related Articles