ভাবছেন, এত কিছু থাকতে বিলিয়নিয়ারদের সকালের রুটিন নিয়ে পড়লাম কেন? কারণ ওই যে কথায় আছে, 'মর্নিং শোজ দ্য ডে'। অর্থাৎ সারাটা দিন কেমন কাটবে, তার পূর্বাভাস সকালবেলায়ই পাওয়া যায়। দিনের শুরুটা যদি ভালো কাটে, তাহলে বাকি দিনটাও ভালো কাটার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। কিন্তু যদি গোড়াতেই গলদ থেকে যায়, তাহলে পুরো দিনে ভালো কিছু ঘটার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে যায়। তাই সকালটা আমরা কীভাবে কাটাব, কিংবা বলা ভালো কীভাবে কাটানো উচিত, এ ব্যাপারে আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন আছে।
আপনার হয়তো একেবারেই নিজস্ব কিছু অভ্যাস আছে সকালবেলা কৃত কাজের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেগুলো আসলেই কি আপনার জন্য উপকার বয়ে আনছে? নাকি আপনার উচিত আরো ভালো কোনো দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা? সফল ব্যক্তিরা কীভাবে দিনের শুরু করেন, সেখান থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করা? এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়ভার আপনার নিজের উপরই বর্তায়, কারণ জীবনটা যে আপনারই। তবে সফল ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত আপনার সামনে তুলে ধরা হলে, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারায় হয়তো পরিবর্তন আসলেও আসতে পারে।
সফলতার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই ঠিকই, তারপরও নিজ প্রচেষ্টায় বিপুল অর্থের মালিক হওয়া বিলিয়নিয়ারদেরকে সফল বলে ধরে নেয়া যেতেই পারে। তাহলে চলুন পাঠক, জেনে নিই এমন বিখ্যাত কিছু বিলিয়নিয়ার সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কী করেন।
অপরাহ উইনফ্রে
অপরাহ উইনফ্রের সকালটা খুবই কর্মব্যস্ত কাটে। ঠিক সকাল সাতটার সময় বিছানা ছেড়ে উঠে সবার আগে তিনি দাঁত ব্রাশ করে নেন। এরপর তার পাঁচটি কুকুর নিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রাতঃভ্রমণে। বাড়ির ফিরে এসপ্রেসো কফি তৈরির ফাঁকেই চোখ বুলিয়ে নেন তার '৩৬৫ গ্যাদার্ড ট্রুথস' বক্স থেকে তোলা একটি কার্ডে। এরপর তিনি মোবাইল হাতে নিয়ে একটি অ্যাপ থেকে প্রতিদিনের 'বোল অব সাকি' পড়ে নেন। পরবর্তী এক ঘণ্টা যাবত তিনি বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে ওয়ার্ক-আউট করেন।
এলন মাস্ক
এলন মাস্কের পক্ষে অপরাহর মতো সকালবেলা নিজের জন্য সময় বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তিনিও সাতটা বাজতেই ঘুম থেকে ওঠেন বটে, কিন্তু এরপরই তাকে পেশাদারী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। আধঘণ্টা বসে কফি পান করতে করতে তিনি প্রয়োজনীয় সব মেইল চেক করেন। ব্যস্ততার কারণে সকালের নাস্তা করার ফুসরত মেলে না তার। পাঁচ পুত্রকে স্কুলে পাঠিয়ে তিনি শাওয়ার নিতে ঢোকেন। এরপর নিজেই গাড়ি চালিয়ে কর্মস্থলে পৌঁছান। অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। সপ্তাহে ১২০ ঘণ্টা কাজ করা মানুষটির সকালের রুটিন তো এমন হওয়াই স্বাভাবিক!
জ্যাক ডরসি
জ্যাক ডরসির পরিচয় হলো, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারের প্রতিষ্ঠাতা। ভোর পাঁচটার সময়ই তিনি দিন শুরু করেন। ৩০ মিনিট মেডিটেশন করার পর পালাক্রমে তিন দফা ওয়ার্ক-আউট করেন। প্রতিবার ওয়ার্ক-আউটের সময়কাল সাত মিনিট করে। এরপর সকালের কফি পান করে টুইটারে চেক-ইন করেন তিনি।
ওয়ারেন বাফেট
ঘুমাতে ভালোবাসেন ওয়ারেন বাফেট। সাধারণত রাতে পুরো আট ঘণ্টা ঘুমান তিনি। তবে তাই বলে 'লেট রাইজার' নন তিনি। উঠে পড়েন ভোর ৬.৪৫ বাজতেই। ঘুমের পাশাপাশি তার অন্য ভালোবাসার কাজটি হলো পড়া। তাই ঘুম থেকে উঠে দিনের শুরুটাও তিনি করেন পড়ার মাধ্যমেই। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং ইউএসএ টুডে'র মতো সংবাদপত্রগুলো তিনি সকাল সকালই পড়ে শেষ করেন।
জেফ বেজোস
আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের কাছেও ঘুম সবচেয়ে মূল্যবান। তাই ঘুমকে প্রায়োরিটি লিস্টে সবার উপরে রাখেন তিনি। তবে মজার ব্যাপার হলো, বেজোসকে ঘুম থেকে জাগার জন্য কোনো অ্যালার্ম সেট করে রাখতে হয় না। নিজে থেকেই উঠে পড়তে পারেন তিনি। এবং গুরুত্বপূর্ণ, 'হাই আইকিউ' মিটিংগুলো তিনি সকালবেলা ঠাণ্ডা মাথাতেই সেরে ফেলতে পছন্দ করেন। দশটা থেকে শুরু করে লাঞ্চের আগেই সব মিটিং শেষ করেন তিনি।
মার্ক জাকারবার্গ
মার্ক জাকারবার্গের সাথে অনেকেই হয়তো নিজেদের মিল খুঁজে পাবেন। কারণ জাকারবার্গও প্রতিদিন সকাল আটটার সময় চোখ মেলেই প্রথমে মোবাইল হাতে ফেসবুকে ঢুকে পড়েন, নিউজফিড ঘেঁটে জেনে নেন বিশ্বের কোথায় কী উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলো। এরপর তিনি মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ চেক করেন। তবে একটি ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না, অন্যদের কাছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ স্রেফ শখের বা অভ্যাসের বস্তু হলেও, জাকারবার্গের কর্মজগৎ কিন্তু এগুলোকে কেন্দ্র করেই! আরেকটি বিষয় হলো, জাকারবার্গ ছোটখাট সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে সময় নষ্ট করতে একদমই পছন্দ করেন না। এ কারণে প্রতিদিন তিনি একই ডিজাইনের পোশাক পরে কাজে যান। এছাড়া তিনি চেষ্টা করেন প্রতিদিন সামান্য সময়ের জন্য হলেও ওয়ার্ক-আউট করতে বা একটু দৌড়ে আসতে।
আনাস্তাসিয়া সোয়ারে
আনাস্তাসিয়া সোয়ারে হলেন বিশ্ববিখ্যাত মেক-আপ ব্র্যান্ড আনাস্তাসিয়া বেভারলি হিলসের প্রতিষ্ঠাতা। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে ওঠেন তিনি, এবং জাকারবার্গের মতো তারও দিনের প্রথম কাজই হলো মোবাইল হাতে নেয়া। সবার আগে তিনি যে অ্যাপটিতে ঢুঁ মারেন, সেটি হলো ইনস্টাগ্রাম। এরপর তিনি পরপর দু'কাপ ব্ল্যাক কফি পান করেন, এবং মেইল চেক করতে করতে হালকা নাস্তা সারেন। বেশিরভাগ দিনই তার ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক তার বাড়িতে আসেন, যিনি তাকে ঘণ্টাখানেক শরীরচর্চা করান। এবং অবশ্যই, ভ্রূ ঠিক না করে তিনি কখনো বাড়ির বাইরে পা রাখেন না।
বিল গেটস
দিনের শুরুটাই বিল গেটস করেন শরীরচর্চার মাধ্যমে, বিশেষত কার্ডিও এক্সারসাইজ করে। অন্তত এক ঘণ্টা তিনি ট্রেডমিলে কাটান। তবে ওই সময়টুকুতে শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্কও যেন কাজে লাগানোর মতো কিছু রসদ পায়, সে লক্ষ্যে শিক্ষামূলক ডিভিডি দেখতে থাকেন তিনি। তার নিজের দাবি, শরীরচর্চা শেষে তিনি কোকোয়া পাফস সিরিয়াল খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু তার স্ত্রী মেলিন্ডার অভিযোগ, আজকাল তিনি সকালে নাস্তা করেনই না!
সারা ব্লেকলি
অনেকেই হয়তো কফি ছাড়া দিন শুরু করার কথা ভাবতেই পারেন না। কিন্তু স্প্যাংক্সের প্রতিষ্ঠাতা সারা ব্লেকলি শুধু সকালে কেন, কখনোই কফি পান করেন না। তার দাবি, জীবনে কখনো এক কাপ কফি পান করেননি তিনি! তাহলে সকালে তিনি কী পান করেন? স্মুদি। এবং সেই স্মুদি তৈরি হয় ফ্রোজেন ওয়াইল্ড বেরি, ডার্ক চেরি, পাতা কপি, খেজুর, দারুচিনি, পালং শাক, সিলান্ট্রো, ফ্রেশ মিন্ট, লেবু, পানি, বরফ, চিয়া ও আখরোট সহযোগে। এরপর তিনি চেষ্টা করেন বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার আগে ৬.৩০-এ খানিকক্ষণের জন্য যোগব্যায়াম করে নিতে, যদিও প্রতিদিন তা করা হয়ে ওঠে না।
স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন
ইংলিশ বিজনেস ম্যাগনেট স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়েন। তার কাছে, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়া এমন একটি অভ্যাস যা সবসময় নিজের মধ্যে ধারণ করা উচিৎ। দীর্ঘ ৫০ বছরের ব্যবসায়ী অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলে প্রতিদিন অনেক বেশি কাজ করা যায়, ফলে সামগ্রিকভাবে জীবনেও অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করা যায়। তাই তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন না কেন, সেখানকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী ভোর পাঁচটায় উঠে কিছুক্ষণ শরীরচর্চা করে নেন, এবং তারপরই প্রাত্যহিক পেশাদারী কাজ শুরু করে না দিয়ে খানিকক্ষণ পরিবারের সাথে কাটান। এতে করে তার মন প্রফুল্ল থাকে, বাকি সারাদিন কাজ করার জন্যও অফুরন্ত মানসিক শক্তি পেয়ে যান।
শেষ কথা
এতক্ষণ উপরের আলোচনা থেকে আমরা বিখ্যাত বিলিয়নিয়ারদের সকালের রুটিন সম্পর্কে কয়েকটি সাধারণ বিষয় জানতে পারলাম:
- তারা সকালে দ্রুত ঘুম থেকে ওঠেন;
- কিন্তু তারা ঘুমকেও সর্বাধিক গুরুত্ব দেন, যে কারণে পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য তারা রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় যান;
- অধিকাংশ বিলিয়নিয়ারই সকালে উঠেই পেশাদারী কাজ শুরু না করে নিজেকে কিছুটা সময় দেন;
- বেশিরভাগ বিলিয়নিয়ারই সকালে উঠে প্রথমেই মোবাইল হাতে নেন না, বরং শরীরচর্চা, মেডিটেশন, পড়া প্রভৃতি আত্মোন্নয়নমূলক কাজ করেন;
- দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সব বিলিয়নিয়ারই সকালে অন্তত হালকা নাস্তা হলেও করেন;
- প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও দিনের শুরুতে নিজের কাজগুলো তারা নিজেরাই করেন;
- দিনের বাকি সময়গুলো কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে বলে তারা সকালবেলাটাকেই পরিবারের পেছনে ব্যয় করার উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন।
তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন, সফল হওয়ার মন্ত্র হিসেবে এতদিন যেসব গৎবাঁধা উপদেশ আপনি শুনে এসেছেন, সেগুলোর কোনোটিই কিন্তু অমূলক নয়। আজ যারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং একই সাথে সফলও, তারা নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমেই এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন, যা তাদের সকালের রুটিন থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায়। সুতরাং এখন বল আপনার কোর্টে। আপনিই ভেবে সিদ্ধান্ত নিন, সফল হওয়ার লক্ষ্যে আপনিও আপনার দিনের শুরুটাকে এভাবেই সাজাবেন, নাকি প্রতিদিন শেষ মুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে, চোখ মুছতে মুছতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মস্থলের দিকে পা বাড়াবেন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
This article is in Bengali language. It is about what the most famous billionaires of the current world do in the morning. Necessary links have been hyperlinked inside,
Featured Image © Wired