Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফর্সা গায়ের রঙের প্রতি আমাদের আচ্ছন্নতার কারণ কী?

কিছুদিন আগে বলিউডের অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর একটি টুইট নিয়ে বেশ শোরগোল উঠেছিল। নওয়াজ টুইট করেছিলেন “আমাকে এটা বোঝানোর জন্য ধন্যবাদ যে, ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম হিরোদের সাথে আমাকে কাস্ট করা যায় না। কারণ আমি কালো চামড়ার আর দেখতে খারাপ।” নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বর্তমানে বলিউডের সবচেয়ে গুণী অভিনেতাদের একজন। কিন্তু কেবল গায়ের রঙ কালো বলে তার মতো একজন অভিনেতাকেও এমন টুইট করতে হয়।

শুধু নওয়াজউদ্দিন বা বলিউড নয়। ভারত ও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনেই এ বর্ণবাদী ধারণা গেঁথে আছে। গায়ের রঙের ক্ষেত্রে এ দুই দেশের মানুষদের মধ্যে যথেষ্ট বৈচিত্র্য বিদ্যমান। তবে অধিকাংশ মানুষের কথা বিবেচনা করলে তামাটে বা শ্যামলা রঙকেই সাধারণের গায়ের রঙ ধরা যায়। কিন্তু আমরা নিজেদের ত্বকের রঙটাকে ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারি না। অবচেতনভাবেই ফর্সা আর সুন্দরকে গুলিয়ে ফেলি। আমাদের কাছে কারো গায়ের রঙ ফর্সা হওয়া মানে সে সুন্দর বা আকর্ষণীয়। আর কালো ত্বক মানে গায়ের রঙ ‘ময়লা’।

এ কারণেই আমাদের বিনোদন জগতের তারকা হন কেবল ফর্সারাই। বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে শোবিজের সব জায়গায় কেবল ফর্সা চেহারা ভেসে ওঠে। যদিও কোনো জরিপভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত নেই, তবুও একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, যেসব চাকরিতে স্মার্ট, হ্যান্ডসাম বা সুন্দরীদের দরকার হয়, সেখানে ফর্সা চামড়ার মানুষদেরই প্রাধান্য বেশি। একজন কালো চামড়ার মানুষ যতই গুণী হন না কেন এই নিয়ে কটুক্তি তার পিছু ছাড়ে না।

নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী; source: scroll.in

মেয়েদের ক্ষেত্রে তো এ বৈষম্য আরো প্রকট হয়ে ওঠে। ছোটবেলা থেকেই একটা মেয়েকে নিজের ফর্সা চেহারা ধরে রাখার জন্য নানান উপদেশ শুনতে হয়। আর ত্বক কালচে হলে তো আর রক্ষা নেই। এটা ব্যবহার করো ওটা ব্যবহার করো, ত্বক ফর্সা না হলে বিয়ে করবে কে? এমন হাজারো তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন মুরব্বি শ্রেণীর আত্মীয়ারা। এসব কারণে শুরু হয় ত্বক ফর্সা করার প্রতিযোগিতা। কালচে ত্বকের কারণে অনেকের মনেই জায়গা করে নেয় হীনম্মন্যতা। মানুষজন হামলে পড়ে প্রসাধনীর ওপর। আর এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ফটো এডিটিং সফটওয়্যার তো আছেই।

যা-ই হোক, আমাদের আজকের লেখার উদ্দেশ্য এই ফর্সা চেহারার প্রতি আচ্ছন্নতা উচিত নাকি অনুচিত, তা তুলে ধরা নয়। এ আচ্ছন্নতার কারণ অনুসন্ধান করা। ভারত-বাংলাদেশের মানুষের ফর্সা ত্বকের প্রতি এ আকর্ষণ কি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল? না হলে কীভাবে এটি গড়ে উঠলো? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা।

প্রাচীন ভারত ও গায়ের রঙ

একটু প্রাচীন ভারতবর্ষের দিকে তাকানো যাক। আদ্যিকাল থেকেই ভারত নানান বিদেশী জাতির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। সেই আর্যদের থেকে শুরু করে, দিল্লী সালতানাত, মুঘল, সবশেষে ব্রিটিশরা শাসন করেছে ভারত। এ সবগুলো জাতিই সাদা চামড়ার অধিকারী ছিল। একদম শুরুতে ফর্সা আর্যদের সাথে কালো চামড়ার স্থানীয়দের যুদ্ধ লেগেই থাকতো। তবে এ যুদ্ধে ত্বকের রঙের ভূমিকা ছিলো না। এছাড়া সে সময়ের কালো চামড়ার অনেক নায়কোচিত ব্যক্তিত্বের কথাও পাওয়া যায় ইতিহাসে।

দ্রৌপদীর উল্লেখ আছে কৃষ্ণবর্ণ ও অসাধারণ সুন্দরী হিসেবে source: inmarathi.com

সনাতন ধর্মের প্রাচীন শাস্ত্র পড়লেও কৃষ্ণবর্ণের দেব-দেবীদের সন্ধান মেলে। হিন্দুদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামের অর্থই কালো। এছাড়াও দেবতা বিষ্ণু, রামের গায়ের রঙ কালচে বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারতের বিখ্যাত চরিত্র দ্রৌপদীর উল্লেখ আছে গা কৃষ্ণবর্ণ এবং অসাধারণ সুন্দরী হিসেবে। দেবী কালীর নামের অর্থও কালো, তার শরীরও কৃষ্ণবর্ণ। এসব বিষয় থেকে সহজেই অনুমান করা যায় প্রাচীন ভারতে, কালো চামড়ার প্রতি মানুষের বিদ্বেষ গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি সাদা চামড়ার প্রতি মানুষের অমূলক আকর্ষণও।

ভিনদেশী শাসকদের ভূমিকা

ভারতের মুসলমান শাসকেরা ছিলেন মূলত আরব বা পার্সিয়ান। তাদের গায়ের রঙও ফর্সা ছিল। কিন্তু সে সময়ের ইতিহাসে গায়ের রঙের কারণে বৈষম্যের উদাহরণ তেমন একটা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া মুসলিম শাসকরা নিজেদের শ্রেষ্ঠতরও ভাবতেন না। সুলতান ও মুঘল শাসকদের দরবারের সম্মানজনক পর্যায়েও দেখা গেছে অনেক ভারতীয়দের। মুঘলদের সম্পর্কে তো বলা হয়, ভারতকে আপন করে নিয়ে তারা পুরোদস্তুর ভারতীয়ই হয়ে ওঠেছিলেন।

নিজেদেরকে উচ্চ শ্রেণীর সদস্য বলে ভাবতেন ইংরেজরা। তারা নিজেদের উঁচু জাতের এবং অধিকতর বুদ্ধিমান বলে বিশ্বাস করতেন। তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল এই নিচু জাতের, কালো চামড়ার ভারতীয়দের শাসন করার জন্যই তাদের জন্ম। সে সময়ের কিছু রেস্তোরাঁ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যেতো, “কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ।” উইনস্টন চার্চিলের কুখ্যাত সেই মন্তব্যটি থেকেও তাদের মনোভাব স্পষ্ট হয়। তিনি বলেছিলেন, “আমি ভারতীয়দের ঘৃণা করি। তারা জঘন্য একটা ধর্ম লালন করা জঘন্য সব মানুষ।

কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ; source: twitter.com

তবে বৃটিশরা সংখ্যায় কম থাকায় তাদের এ দেশীয় লোকজনকেও কাজে নিয়োগ দিতে হয়। ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে তারা গায়ের রঙের ভিত্তিতে বৈষম্য করেন। সাধারণত ফর্সা ভারতীয়দের উঁচু পদে নিয়োগ দেয়া হতো। বাজে সব কাজ ছিলো কালো চামড়ার ভারতীয়দের জন্য। উনিশ শতকের শুরুর দিকে কলকাতাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যে অংশে বৃটিশদের বসবাস ছিল তার নাম দেয়া হয় ‘হোয়াইট টাউন’, আর যে অংশে ভারতীয়দের বসবাস ছিল তার নাম হয় ‘ব্ল্যাক টাউন’।

এভাবে ইংরেজরা গায়ের রঙের ভিত্তিতে বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে। তবে আরব বা মুঘল শাসকদের পরোক্ষ ভূমিকাও রয়েছে। কারণ শতকের পর শতক ধরে এসব ফর্সা চামড়ার শাসকদের দ্বারা শাসিত হওয়ার ফলে ভারতীয়রা এই ফর্সা ত্বককে সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা, এমনকি সৌন্দর্যের সাথে মিলিয়ে ফেলতে শুরু করে।

সামাজিক মর্যাদা ও গায়ের রঙ

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে শ্রমিকশ্রেণীকে চিহ্নিত করা হতো নিচু জাতের হিসেবে। যদিও এটি পুরোপুরি বলা যায় না যে, সমাজের উঁচু পর্যায়ের মানুষরা সব ফর্সা আর শ্রমিকরা সব কালো। তবে অধিকাংশের কথা বললে এটি সত্য। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের তুলনায় শহরে আরাম আয়েশে থাকা মানুষ বেশি ফর্সা হয়। কারণ শ্রমিক শ্রেণীর মানুষকে নিয়মিত রোদে পুড়ে কাজ করতে হয়। আর সূর্যরশ্মির ফলে ত্বকে মেলানিন নামক রাসায়নিক পদার্থের উৎপাদন বেড়ে যায়, যা গায়ের রঙ কালো হওয়ার জন্য দায়ী।

ত্বকের যত্ন নেয়ার মতো বিলাসিতা করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর এ কারণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাদের সন্তানদের গায়ের রঙ কালো হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেশি থাকে। আমাদের সামাজিক মর্যাদার সাথে ফর্সা রঙকে মিলিয়ে ফেলার এটাও একটা কারণ। একজন কালো চামড়ার মানুষ ধনী বা ক্ষমতাশালী হতে পারেন এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু শত শত বছরের ঐ ধারণা আমাদের অবচেতন মনে ভালোভাবেই গেঁথে আছে। এ কারণে ফর্সা গায়ের রঙ আমাদের মনে উঁচু সামাজিক মর্যাদার ভাব সৃষ্টি করে।

মার্কেটিং পলিসি

বলিউড অভিনেত্রী কাজল, পূর্বে ও বর্তমানে; source: dailyhunt.in

এ যুগে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয় মিডিয়া। আপনি নিজেই ভাবুন যে দেশের অধিকাংশ মানুষই শ্যামবর্ণ, সেখানে ক’জন অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের এ রঙ নিয়ে পর্দায় আসতে দেখেন? উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলিউডের কথাই ধরুন। কয়জন গ্ল্যামারাস নায়ক আছেন যারা কালো চামড়ার? আর নায়ক হাতে গোনা কয়েকজন থাকলেও নায়িকা তো খুঁজেই পাওয়া যায় না। যারা কালো বা শ্যামবর্ণের আছেন তারাও মেক-আপ, মেক-ওভারের মাধ্যমে তা দূর করে দেন।

আর আজকাল টিভি খুললেই চোখে পড়ে ফেয়ারনেস ক্রীমের বিজ্ঞাপন। দেখা যায়, তাদের ক্রীম ব্যবহারের ফলে একজন মডেলের চেহারা ধীরে ধীরে কালো থেকে ফর্সা হয়ে উঠছে। আর এই ফর্সা হয়ে ওঠার ফলে সে জীবন এবং ক্যারিয়ারে সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। বিখ্যাত সব তারকাদের দেখি আমরা এসব ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন করতে। প্রতিনিয়ত এসব বিজ্ঞাপন আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, ফর্সা ত্বক হচ্ছে সফলতার প্রতীক। এগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যকার বর্ণবাদকে উস্কে দিচ্ছে। আর অন্যদিকে গড়ে তুলছে কোটি কোটি টাকার ফেয়ারনেস ক্রীমের ইন্ডাস্ট্রি।

মডেলের চেহারা ধীরে ধীরে কালো থেকে ফর্সা হয়ে উঠছে; source: change.org

এক অদ্ভুতুড়ে উদাহরণের কথা বলে লেখাটা শেষ করা যাক। এ থেকে বুঝতে পারা যাবে এ বর্ণবাদ কতটা গভীরে পৌঁছে গেছে। দু’জন পর্যবেক্ষক গিয়েছিলেন দিল্লীতে ভারতের জাতীয় যাদুঘর পরিদর্শনে। যেখানে সেই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে শুরু করে উনিশ শতক পর্যন্ত তৈরি করা হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি সাজানো আছে। এটা জানা কথা যে, আগে থেকেই হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তিদের রঙ কালো রঙের। এ সকল মূর্তিগুলোও তেমনই ছিল।

কিন্তু সেখানে দর্শনার্থীদের ক্রয়ের জন্য তৈরি করা স্মারকের দোকানে অদ্ভুত বিষয় দেখা গেল। দেখা গেল, প্রায় সব মূর্তিই এর আসল রঙের বদলে ফর্সা করে তৈরি করা। এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে সেখানের একজন জানান, ক্রেতারা কালো রঙের মূর্তি কেনার চেয়ে ফর্সা রঙের মূর্তি কিনতেই বেশী পছন্দ করে। তাই এভাবে তৈরি করা হয়েছে। সমাজে বর্ণবাদের শেকড় কতটা গভীরে প্রোথিত হলে এমনটা ঘটতে পারে।

তথ্যসূত্র: Neha Mishra, India and Colorism: Te Finer Nuances, 14 Wash. U. Global Stud. L. Rev. 725 (2015)

ফিচার ইমেজ: theodysseyonline.com

Related Articles