প্রতিদিন অফিসে যেতে আর কত ভালো লাগে?
কত আর এই বাদুড়ঝোলা হয়ে, ঘামে ভিজে অফিসে যাওয়া?
প্রতিদিনের এই একই রুটিন, ধ্যাত, আর সহ্য হয় না।
ইশ, সপ্তাহের প্রতিটা দিন যদি বাসায় থেকেই কাজ করা যেত!
আহা, নিজের বাসাটাই যদি অফিস হয়ে যেত!
কী? বক্তব্যগুলো পরিচিত লাগছে তো? কয়েকমাস আগেও কিন্তু কর্মজীবী মানুষেরা প্রতিদিন সকালে উঠে গোসল সেরে, নাস্তা করে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অফিসের পথে রওনা হতেন। কেউ গণপরিবহনে, কেউ উবার বা পাঠাও’র মতো রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে আর কেউ হয়তো নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে করে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া-আসা করতেন। এরপর পৃথিবীতে এলো করোনা মহামারি আর কর্মক্ষেত্রের ধরন বদলে গেল রাতারাতি। ‘বাসায় বসে কাজ করা’ বা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’, যার অস্তিত্ব ছিল কেবলই মানুষের স্বপ্নলোকে আর অধরা ইচ্ছার দুনিয়াতে সেটিই একদম বাস্তব হয়ে ধরা দিল।
কোভিড-১৯ এর কারণেই মূলত বাসায় বসে কাজ করার ধারণাটির স্বপ্ন থেকে মূলস্রোত হয়ে ওঠা। সারা বিশ্ব জুড়ে এখন বাসায় বসে কাজ করার ধারণাটিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য না দিয়ে উপায় নেই। খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান ফুজিতসু এবং টুইটার ইতোমধ্যে 'ঘরে বসে করি কাজ'কে পেশাদার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, তারা এটিকে স্রেফ মহামারির সময়ে একটি বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছেন না বরং মহামারি শেষ হয়ে যাওয়ার পর, লকডাউন শিথিল হয়ে যাওয়ার পরেও এটিকেও কর্মীদের জন্য একটি পছন্দ হিসেবে রাখতে ইচ্ছুক। অফিস কিংবা বাসা যেকোনো কর্মীর স্বাধীনতা থাকবে তার পছন্দানুযায়ী একটিকে বেছে নেওয়ার।
নিকোলাস ব্লুম। ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, 'ঘরে বসে করি কাজ'-এর ভালো-মন্দ নিয়ে। চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ উদ্যোগে তিনি একটি গবেষণা পরিচালনা করেন ২০১৩ সালে। তার সাথে ছিলেন জেমস লিয়াং- চীনের ট্রাভেল এজেন্সি ট্রিপ ডট কমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে চীনের সর্ববৃহৎ ট্রাভেল এজেন্সি হিসেবে পর্যটকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ট্রিপ ডট কম এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সম্মিলিত প্রয়াসে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়।
ট্রিপ ডট কমে কর্মরত ১,০০০ কর্মীকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাই করে জন্মতারিখ অনুসারে দু’টি দলে ভাগ করে দেওয়া হয়। যাদের জন্মতারিখ ছিল জোড় সংখ্যা, তাদেরকে সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসের মাঝে চারদিন 'ঘরে বসে করি কাজ'-এর জন্য নির্বাচন করা হয় আর বিজোড় তারিখে জন্ম নেওয়া কর্মীদেরকে কাজ করতে হয় প্রথাগতভাবে অফিসে বসে প্রতিদিন। এভাবে করে দুই দলই টানা নয়মাস তাদের জন্য নির্ধারিত কাজ করে যায়।
অফিস কর্মীদের চেয়ে বাসায় বসে কাজ করা কর্মীরা ১৩ শতাংশ বেশি কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থাৎ নয়মাসের ব্যপ্তিতে সপ্তাহের পাঁচটি কর্মদিবসের মাঝে চারদিনই বাসায় বসে কাজ করার ফলাফল হিসেবে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ১৩ ভাগ। স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত এই ১৩ শতাংশ কর্মদক্ষতার ৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছিল তুলনামূলক কম বিভ্রান্তির কারণে। অর্থাৎ, 'ঘরে বসে করি কাজ'-এর ক্ষেত্রে কেউ কেউ তাদের বাসার পরিবেশকে অফিসের তুলনায় অধিকতর পরিপাটি বোধ করেছেন।
বিভ্রান্তির (distraction) উপস্থিতি কমে আসায় এসব কর্মীদের মিনিট প্রতি কাজের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৯ শতাংশের পেছনে ছিল অন্যান্য কর্মীদের শিফট প্রতি অধিক মিনিট কাজের পেছনে ব্যয় করার প্রবণতা। অর্থাৎ কর্মদক্ষতার ১৩ শতাংশ বৃদ্ধির পুরোটা কিন্তু একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল না। 'ঘরে বসে করি কাজ', কর্মীদেরকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করলেও চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে সেটি কর্মদক্ষতার বৃদ্ধিকেই এনে দিয়েছিল।
এবারে গবেষকরা একটি ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের নয়মাসের কাজের ফলাফল অত্যন্ত ইতিবাচক হওয়ায় ট্রিপ ডট কম, পরীক্ষার বিষয়বস্তুকে এবার প্রতিষ্ঠানের নিয়ম বানিয়ে ফেলল। 'ঘরে বসে করি কাজ' দলে যারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তারা আবার এই একই নিয়ম অনুসরণ করতে লাগলেন, তবে এবার প্রতিষ্ঠানের নীতি হিসেবে, গবেষণার স্বার্থে নয়। দলটির মাঝে এবার একটি চমকপ্রদ ফলাফল দেখা গেল- তারা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেলেন। এক দল বলল যে, তারা দীর্ঘ সময় ঘরে বসে কাজ করার দরুন নিজেদেরকে নির্বাসিত মনে করছেন; বিষয়টি তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তবে আশ্চর্য করার মতো কিছু তখনও বাকি ছিল। অবশিষ্টরা এবারে কর্মদক্ষতায় ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখাতে সক্ষম হলেন।
এবারে গবেষণাটির দু’টি দিক- ট্রিটমেন্ট এবং কন্ট্রোলের মাঝে বিদ্যমান কিছু তারতম্যের দিকে তাকানো যাক, কারণ গবেষণাকে সর্বতোভাবে বুঝতে হলে এর নকশার দিকে নজর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একথা আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না যে, তাদের মাঝে সবচেয়ে মৌলিক পার্থক্য ছিল কর্মস্থল- অর্থাৎ ট্রিটমেন্ট দল কাজ করবে বাসায় থেকে আর কন্ট্রোল দল কাজ করবে অফিসে বসে, সেই চিরাচরিত নিয়মে। এটি ছাড়া আরও তিনটি পার্থক্য এই দু’ দলের মাঝে ছিল:
- ট্রিটমেন্ট দলের কাজে কম সময় ব্যয় করার অর্থ হচ্ছে, তারা সে সময়ে নিজেদের অথবা পরিবারের সদস্যদের যত্ন নিচ্ছেন কিংবা বাসার কোনো দায়িত্ব পালন করছেন এবং এগুলো করছেন অফিস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছুটি গ্রহণ না করেই। এই সুবিধাটি কিন্তু কন্ট্রোল দলের সদস্যরা পাননি।
- ট্রিটমেন্ট দলের সদস্যরা তাদের তত্ত্বাবধায়কদের থেকে সরাসরি কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো রকমের সাহায্য পাননি। সমস্যা যা-ই হোক না কেন, সময় নিয়ে সেটা তাদের নিজেদেরকেই সমাধান করতে হয়েছে এবং অন্যদিকে কন্ট্রোল দলের সদস্যরা যেকোনো সমস্যায় তাদের সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাহায্য সহজেই পেয়েছেন।
- সবশেষে আসে কর্মস্থলের ধরন। ট্রিটমেন্ট দলের কর্মীরা অপেক্ষাকৃত শান্ত, নীরব পরিবেশে কাজ করতে পেরেছেন, যেটি হয়তো কর্মদক্ষতাকে ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে, তবে একইসাথে তারা তাদের মানসিক প্রশান্তি বিকোতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এবারে আলোচনা করা যাক গবেষণার কিছু নেতিবাচক দিক নিয়ে। 'ঘরে বসে করি কাজ' কেন পুরোপুরিভাবে মঙ্গলজনক নয়?
দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার পরিকল্পনা সবারই থাকে। পাঁচ থেকে দশ বছর পর নিজেকে একটি উচ্চ পদের অধিকারী হিসেবে সবাই দেখতে চান। পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে 'ঘরে বসে করি কাজ' সত্যিকার অর্থে বেশ নেতিবাচক। প্রথমত, একজন কর্মী তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাহায্য, অভিভাবকত্ব, পরামর্শ ইত্যাদি থেকে প্রায় পুরোটাই বঞ্চিত হন। দ্বিতীয়ত, পেশাগত জীবনে নানা রকমের প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। 'ঘরে বসে করি কাজ'-এর আওতায় একজন কর্মী এসব প্রশিক্ষণ থেকে পুরোপুরি উপকার লাভে ব্যর্থ হন। তৃতীয়ত, সহকর্মীদের সাথে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় যে সম্মিলিত পেশাগত সাফল্য, সেটিও একজন কর্মী পান না অফিসে না যাওয়ায়।
এসব কিছুর সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে তার ক্যারিয়ার অনেক বেশি পিছিয়ে পড়ে এবং পদোন্নতি লাভের ক্ষেত্রে তার বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পায়। “চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়”- কথাটির একটি আক্ষরিক রূপায়ন যেন এই বিষয়টি। যেহেতু বাসায় বসে কাজ করলে কর্মীদের কাজের প্রতি মুহূর্তের আপডেট তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লক্ষ করতে পারেন না কিংবা সত্যিই কাজের প্রতি তাদের আন্তরিকতা বোঝাও সম্ভব হয় না, তাই একধরনের অনিচ্ছাকৃত বৈষম্য তৈরি হয়ে যায়। এ বৈষম্যের মাশুল গুনতে হয় যারা অফিসে এসে কাজ করেন না, তাদের। এছাড়াও এসব কর্মী আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতাগুলো অর্জন করতে ব্যর্থ হন, যেহেতু নানান সহকর্মীর সাথে মেলামেশা থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে থাকেন। একথা আমাদের কারোই বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হওয়ার কথা না যে, এ দক্ষতার অভাব একজন কর্মীর ব্যবস্থাপক পদে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে।
মোটের উপর 'ঘরে বসে করি কাজ' ধারণাটি এখন আর শুধু কল্পনাতে সীমাবদ্ধ নয় কোনোভাবেই। আজ হোক বা কাল, এটি ভবিষ্যতের একটি কর্মপদ্ধতি হতে যাচ্ছে। তবে এটির প্রতিষ্ঠালাভের পথে অসংখ্য উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। প্রচলিত অফিস ব্যবস্থা একেবারেই উঠে যাবে, নাকি 'ঘরে বসে করি কাজ'-এর সাথে সমান্তরালে এগিয়ে যাবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।
This is a Bengali article. It is about the changing culture of the work environment.
All the necessary references are hyperlinked within the article.
Featured Image: Unsplash