Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কফি হাউজের সেই ‘বিষ্ণু দে’ কে?

“কখনো বিষ্ণু দে, কখনো যামিনী রায় এই নিয়ে তর্কটা চলতো”

কফি হাউজের আড্ডায় নিখীলেশ-সুজাতারা নিয়মিত তর্কে মেতে উঠতেন বিষ্ণু দে’কে নিয়ে। এই গানের সুবাদে হয়তো অনেকের কাছেই বিষ্ণু দে খুব পরিচিত একটি নাম। তবে শুধু নামটিই তার পরিচয় পেয়েছে, তিনি কিংবা তার কবিতাগুলো দূরেই রয়ে গেছে। খুব বেশি পরিচিত কবির তালিকায়ও তার নাম পাওয়া যাবে না।

তবু কফি হাউজের গানটি শুনতে গিয়ে কখনো না কখনো আপনার মনেও নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছিলো- “কে এই বিষ্ণু দে?”

রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের যে কবিরা রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত হয়ে কবিতা লেখার কলম ধরেছিলেন, তাদেরই একজন বিষ্ণু দে। কল্লোল যুগের পঞ্চপান্ডব কবি রবীন্দ্রবেষ্টনীর মধ্যেই সীমিত থাকলেও বিষ্ণু দে নিজেকে সেই সীমায় আটকাননি। তিনিই প্রথম খোলাখুলিভাবে বলতে পেরেছিলেন,

“রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হতে না পারলে বাংলা কবিতার উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই।”

বাংলা কবিতায় আধুনিকতার আনয়নে তার অনেকটাই ভূমিকা ছিলো। প্রচন্ড প্রগতিশীল ভাবধারার এই কবি কবিতা ছাড়া গদ্যেও বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন, কিন্তু কবিসত্ত্বাটিই তার সমস্ত কিছু ছাড়িয়ে প্রবল হয়ে ওঠে। এজন্য বিষ্ণু দে’কে জানতে হলে তার কবিতাকে জানাই যথেষ্ট। তার মতাদর্শ, জীবনবোধ, তাড়না, বাস্তববাদিতা সবকিছুরই দেখা মেলে তার কবিতায়। যা কখনো বিশ্বাস করেননি তা তার কবিতায় তিনি লেখেননি, কোনো মিথ্যে বিশ্বাস কবিতায় রেখেও যাননি।

ব্যক্তি বিষ্ণু দে নিয়ে কিছু কথা

বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুলাই (২রা শ্রাবণ, বঙ্গাব্দ ১৩১৬) বিষ্ণু দে কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতা অবিনাশচন্দ্র দে ও মাতা মনোহারিণীর পঞ্চম সন্তান। তার পরিবার বংশগত দিক থেকে কলকাতার আদি বাসিন্দা ছিলো না। হাওড়া জেলার পাঁতিহাল গ্রাম থেকে আগত তার পূর্বপুরুষ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতায় বসবাস করতে আসেন। উনিশ শতকীয় বঙ্গীয় জাগরণের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সম্পর্ক ছিল বলে স্বদেশ আন্দোলনের একটা ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। দ্বান্দ্বিক এই কবি ১৯৮২ সালের ৩রা ডিসেম্বর কলকাতায়ই মৃত্যুবরণ করেন।

প্রেমকে তিনি দিয়েছেন ক্ষণিকত্বের সংজ্ঞা

তার কবিতাগুলো কখনো ফ্যান্টাসিতে হারিয়ে যাওয়ার মতো কিছু নয়, যা আমরা কবিতা বললেই ভাবতে শুরু করে দিই- অবাস্তব, কল্পনার ভাষা! তিনি বাস্তব জগতকে যেমনি দেখেছেন তেমনি লিখেছেন, হয়তো কোথাও অনেক উপমাও দিয়েছেন। কিন্তু দিনশেষে বিষ্ণু দে’র কবিতা বাস্তব সমস্যাগুলো কিংবা যা আছে যা হচ্ছে-হয়েছে, তাকেই নির্দেশ করে। তার কবিতাগুলো একই সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সমন্বয়কারী। তিনি বস্তুনিষ্ঠভাবে চোখে রঙিন চশমা না লাগিয়ে কবিতায় তুলে এনেছেন তখনকার বাস্তবতাকে এবং পরক্ষণেই বিষয়নিষ্ঠ হয়ে বাস্তববাদিতার মধ্য দিয়েই যে একটা বিপ্লব দরকার, মুক্তির জোয়ার আসা দরকার- তা তিনি খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

“হঠাৎ হাওয়ায় আসে উপবাসী মানুষের রোদনের দুয়ো,
কেটে যায় বিটোফেনী সিমফনির গন্ধর্ব বাতাস”

– (২২শে শ্রাবণ)

এভাবেই যখন সত্য ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা তার চোখে প্রবল হয়ে ধরা পড়তো, সুর কেটে যেত-ছন্দে ঘাটতি হতো। কঠিন শব্দ নয় শুধু, কঠিন ভাবকে কবিতায় এনেছেন তিনি। তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে বারবার দুর্বোধ্য মনে হয় পাঠকের, হয়তো শব্দে শব্দে থমকে যেতে হয়! কারণ সমানুভূতি না হলে বিষ্ণু দে’র কবিতা মনের খুব কাছে এনে অনুভব করা যায় না।

বন্ধু যামিনী রায়কে নিয়ে লেখা তার একটি বই

প্রকৃতি তার প্রেম পায়নি, এমন নয়। প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে তিনি কবিতায় বেশ ভালোভাবেই আনতে পেরেছেন। নিসর্গকে তিনি ভালোবেসেছেন, তবু নিসর্গের প্রেমে থেকে সাদা-কালো শহরের গায়ে থাকা কলুষতাকে রেখে তিনি প্রকৃতিপ্রেমে ডুবে যেতে পারেননি। তিনি যেন নিজেই সত্যকে যে করেই হোক কবিতায় আনতে হবে এমন পণ নিয়েছিলেন!

“আমার আনন্দে আজ আকাল বন্য প্রতিরোধ,
আমার প্রেমের গানে দিকে দিকে দুস্থের মিছিল,
আমার মুক্তির স্বাদ জানেনাকো গৃধ্নুরা নির্বোধ-
তাদেরই অন্তিমে বাঁধি জীবনের উচ্চকিত মিল”

– (২২শে শ্রাবণ)

সময় ও সংকটবোধ তার কবিতায় আধুনিক পথে যাত্রা করেছে। কবি-চেতনার প্রবল তাড়না দেখি কবিতাগুলোয়। তার কবিতাগুলোকে এককথায় প্রকাশ করলে বলা যায় ‘অ্যান্টিরোমান্টিক’। তার ব্যক্তিমনের প্রেমভাব বা অনুভূতির ওপরে উঠে তিনি স্থান দিয়েছেন প্রবল আত্মসচেতনতার। তার লেখা তাই ভাবালুতার খাদমুক্ত।

কাব্যগ্রন্থ ‘চোরাবালি’

প্রায় সব কবির মতোই প্রথম কাব্যে বিষ্ণু দেও প্রেমকেন্দ্রিক ভাবনার অনুগামী হলেও এর পর থেকেই প্রেমচেতনার সিদ্ধরস বিচূর্ণ হয়েছে তার কাছে এসে। ‘অমর প্রেম’ এর ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন বাস্তব অর্থে প্রেম বিষয়টি ক্ষণস্থায়ী একটা রূপ আছে এবং হাজার আতিশয্যেও আমরা তাকে অস্বীকার করতে পারি না। এবং তার কবিতায় দেখা যায় স্বাভাবিকভাবেই প্রেমবিষয়ক প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত ধারণার প্রতি প্রবল অস্বীকৃতি। তার দৃষ্টিতে প্রেমের গন্তব্য হচ্ছেঃ

“ভাসিয়েছি প্রেম আজ নীলিমার অন্ধকার জলে”

– (সমুদ্র)

ইন্দ্রধনুর অস্থায়ী বর্ণবিলাসের মতো প্রেমের শিশিরধর্ম, চিরন্তন রোমান্টিক প্রেমভাবনার বিপরীত। বহুভুঞ্জিতা উর্বশীর দেহ-সৌন্দর্যের অন্তহীন আমন্ত্রণ বিষ্ণু দে’র এসে অনেকটাই প্রত্যাখ্যাত। তারপরও উর্বশীকে তিনি কিছুক্ষণ থাকতে বলছেন, প্রেমকে পুরোপুরি অস্বীকার করছেন না। একই সাথে তার ক্ষণিকত্বও বর্ণিত হচ্ছে।

“তোমার দেহের হায় অন্তহীন আমন্ত্রণবীথি,
ঘুরি যে সময় নেই- শুধু তুমি থাকো ক্ষণকাল …”

– (উর্বশী)

উর্বশী কবিতাটি

তার মনের বর্ণন করেছেন কিছুটা এভাবে,

“নদীর বাঁকের চরাই পাড়ের ছায়ে
একটি অমর করবীশাখায় ধরেছে ফুল,
সেই ফুলে দাও ত্রিপদী ছন্দে
আমার মনের উপমা”

– (ত্রিপদী)

এই কবিতায়ই জীবনের সংজ্ঞা তিনি দেন,

“জীবন যেখান আকাশে জমাট একটি নিকষ পাহাড়”

জীবনকে তিনি খুব মোহনীয় কিংবা প্রত্যাশিত কিছু হিসেবে দেখেননি। জীবন তার জন্য কোনো ‘রঙিলা নাও’ নয়, বরং একটি ‘নিকষ পাহাড়’ যা আঁধার ছড়িয়ে দিচ্ছে তার চারদিকে। কিন্তু এর একটু পরে গিয়েই তিনি মুক্তি চান এই পাহাড়সম আঁধারের কাছ থেকে।

“অনাচার দূর হোক স্মৃতি, কাজ মুক্তির খোলা প্রত্যহে”

পৌরাণিক চরিত্র (উর্বশী; লখিন্দর; আর্টেমিস) এর মধ্য দিয়ে তিনি তার কবিতার চরিত্র খুঁজে নিয়েছেন। ঋতুর নামের মধ্য দিয়ে তার সময়কে, আর প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানে তার কবিতাটুকুকে সাজিয়েছেন।

বিষ্ণু দে’র কবিতার উপজীব্য কী? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ‘জীবন’। সত্যিকারের জীবন যাতে মিশ্রণ আছে দুঃখ-সুখ, বন্ধন-মুক্তি, প্রেম-অপ্রেম, সুন্দর-কুৎসিত এর। তিনি এজন্যই দ্বান্দ্বিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন, যেকোনো এক পক্ষে যাওয়াকে তিনি বস্তুনিষ্ঠতার অভাব বলে মানতেন। যখন তার ‘তিনটি কান্না’ কবিতায় কান্নাগুলো তিনি বর্ণনা করেন, তখন আমরা কিন্তু খুব পরিচিত কিছু মুখ দেখি। এতে উপোসীর ক্ষমাহীন কান্না, বিধবার অভিশাপ কিংবা পথের ধারের ঐ ভিখারীটির “গান করে নাকি কান্না?” শুনতে পাই!

কাব্যগ্রন্থ ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’

তিনি নৈর্ব্যক্তিকতার সূত্র মেনে চলতেন। কেননা বস্তুসত্তার অনুরাগ থেকে জন্ম নেয় নৈর্ব্যক্তিকতার বীজ, এবং সেই দৃষ্টিশক্তি গড়ে ওঠে যাতে শিল্পবস্তু ও শিল্পরূপ একই সক্রিয়তার দ্বৈতরূপ বলে প্রতীয়মান হয়।

বুর্জোয়া মতাদর্শের বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু দে’র কবিতা কথা বলে, শ্রমজীবী মানুষকে দূর হতে না দেখে শ্রমজীবীটির অবস্থানে দাঁড়িয়ে উচ্চারিত হয়। কিন্তু তারপরও, তিনি তার কবিতায় ব্যক্তিমানুষের যথাযথ প্রতিফলন ঘটান না। তিনি বরং একটি প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্রসৃজনে উদ্যোগী হন, যাতে ঠিক সেই মানুষটি না হোক- তার একটি আয়না দেখা যাক, স্বচ্ছ কাঁচের আয়না! এজন্য তাকে মার্ক্সবাদী কবিও বলা হয়, কিন্তু বিষ্ণু দে’র সবটা ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে তিনি মার্ক্সবাদের দ্বান্দ্বিক দিকটিকেই বেশি সমর্থন করেছেন। জীবনের সর্বত্র বিরাজমান যে দ্বন্দ্ব- তাকেই বিষ্ণু দে নিয়ে এসেছেন তার তীব্র লেখনীতে। তাই তাকে মার্ক্সবাদী না বলে দ্বান্দ্বিক বলাই অধিক যুক্তিসঙ্গত।

কারো কি প্রভাব কি ছিলো বিষ্ণু দে’র মধ্যে?

টি এস এলিয়টের প্রভাব প্রবল ছিলো বিষ্ণু দে’র কবিতায়

অন্যের প্রভাব এমন একটি জিনিস যা নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে জানা-অজানায়ই চলে আসে। অন্য সব কবি অথবা মানুষের মতো বিষ্ণু দে এর বাইরে যেতে পারেননি। রবীন্দ্র প্রভাবমুক্তি তার উদ্দেশ্য হলেও তিনি একেবারে প্রভাবমুক্ত ছিলেন না। নানা দেশের প্রায় ৫০ জন কবির প্রভাব পড়েছে বিষ্ণু দে’র ওপর। এর মধ্যে টি. এস. এলিয়ট এর প্রভাব সবচাইতে প্রবল। এছাড়া তার কবিতায় অতীত ও বর্তমানের বিখ্যাত যে সকল কবির ছাপ পাওয়া গেছে তারা হলেন শেক্সপিয়ার, দান্তে, গ্যেটে, শেলী, ব্লেক, লেরমন্টভ, হুইটম্যান, রিমবড, ব্যডেলেয়ার, মালার্ম, ইয়েটস, পাউন্ড, প্যাস্টেরনাক, লরকা, এলুয়ার্ড, আরাগন, ব্রেটচ, নেরুদা প্রমুখ।

তার প্রাপ্ত কিছু স্বীকৃতি

  • কল্লোল, প্রগতি, বিচিত্রা, ধূপছায়া ইত্যাদি পত্রিকায় গদ্যে-পদ্যে ও অনুবাদে তার বহু লেখা ছাপা হয়েছে।
  • ১৯৫৯ সালে বিষ্ণু দে’কে কবি-সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
  • সাহিত্য কৃতির জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন ১৯৬৬ সালে।
  • নেহেরু স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন ১৯৬৭ সালে।
  • তিনি ‘রুশতী পঞ্চশতী’র জন্য ‘সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার’ পেয়েছেন।
  • তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন।

বিষ্ণু দে’র একেকটি কবিতা মানবমনকে, ভিন্নমুখী অনুভূতিকে, এককথায় জীবনকে বর্ণনা করতে সক্ষম। তবে তার ভাষা খুব মোহনীয় না হয়ে প্রায় পাঠকের কাছেই কাঠখোট্টা মনে হুয়, কিন্তু তিনি বাস্তব আঁকতে চেয়েছেন, আর হয়তো বাস্তব এমনই কাঠখোট্টা!

কফি হাউজের সেই বিষ্ণু দে

তথ্য ও ছবি উৎস

১। বইঃ বিষ্ণু দে-র কবিস্বভাব ও কাব্যরূপ; লেখক- বেগম আকতার কামাল

২। বইঃ নাম রেখেছি কোমল গান্ধার; লেখক- বিষ্ণু দে

৩। xahin.blogspot.ca/2011/11/blog-post_8521.html

৪। amader-kotha.com/page/435448

৫। বিষ্ণু দে’র জন্মদিনে

৬। jolbhumi.blogspot.com/2012/06/blog-post_24.html

Related Articles