Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বোহেমিয়ান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়

সাহিত্যজীবনের শুরুটা কবিতা নয়, গদ্য দিয়ে শুরু হয়েছিলো। ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসই তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। ১৯৫৬-৫৭ এর দিকে এটি রচিত হয় এবং ১৯৬১ সালে প্রকাশিত। প্রথমদিকে তিনি উপন্যাস লিখে অর্থ রোজগারের চিন্তা করলেও পরে তার সমগ্র সত্ত্বাই যেন ঝুঁকে পড়ে কবিতার দিকে। এই উপন্যাসটির নায়ক নিরুপমকে শক্তির পরবর্তী বেশ কিছু উপন্যাসেও দেখা যায়, তবে প্রথমবারের মতো ওঁর প্রবলতা থাকে না তাতে। হয়তো বা মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু কাব্যের দিকে সরে এসেছিলো বলেই উপন্যাসে তার সাহিত্যিক তীব্রতায় ভাঁটা পড়ে।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বহড়ু গ্রামে ১৯৩৩ সালের ২৫শে নভেম্বর জন্ম নেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তার পিতা ছিলেন বামানাথ চট্টোপাধ্যায়, যিনি শক্তির মাত্র চার বছর বয়সেই পরলোকগমণ করেন। তার মা কমলা দেবী। বাবার মৃত্যুর পর মাতামহই তার অভিভাবকরূপে অবতীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালে শক্তি যখন অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হলেন কাশিমবাজার পলিটেকনিক বিদ্যালয়ে, তখনই এক শিক্ষকের কাছে মার্ক্সবাদের প্রথম পাঠ পেলেন। এরই সূত্র ধরে ১৯৫৩ সালে তিনি যোগ দেন কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) তে। বাণিজ্য বিষয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হলেও পরীক্ষায় না বসার কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।

স্ত্রী মীনাক্ষী ও সন্তানদের সঙ্গে কবি; Source: Anandabazar.com

১৯৫৬ সালে বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপা হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা- ‘যম’। এরপর তিনি কৃত্তিবাস সহ অন্যান্য সাহিত্যপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। বুদ্ধদেব বসুর আমন্ত্রণেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের পর একটি কোর্সে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু অনাগ্রহের দরুন সেটাও শেষ করতে পারেননি। শিক্ষাজীবনে তিনি প্রচুর ভ্রাম্যমাণ ও অগোছলাপনার পরিচয় দিয়েছেন। পরবর্তী কর্ম ও রাজনৈতিকক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। ১৯৫৮ সালে তাই সিপিআই-এর সাথে পাট চুকানোটা তেমন অসম্ভব ঠেকে না। দায়বদ্ধতা তাকে তেমন আকর্ষণ করতো না, ছুটে বেড়ানোতেই জীবন খুঁজে পেতেন বলেই হয়তো! অনিয়ন্ত্রিত গতির মধ্য দিয়েই তার অগতানুগতিক ভাবনা প্রকাশ পেতো শক্তিময় লেখনীতে। লাগামহীন জীবন আর মদ্যপান- এই ছিল তার নিত্যসঙ্গী।

“ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাব

যা খায় গরীবে, তা-ই খাব বহুদিন যত্ন করে”

যার সব আবেদন নগণ্য হয়ে যায় ভালোবাসার কাছে, তেমনই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তার জীবনে প্রেম এসেছিলোও অত্যন্ত সরব উপস্থিতি নিয়ে। মলয় রায়চৌধুরীর দাদা সমীর রায়চৌধুরীর শ্যালিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমে পড়েন তিনি। একসাথে অনেকটা সময়ও কাটান তারা। শীলা কলেজে গেলে বাইরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন শক্তি। ধারণা করা হয়, সেই অপেক্ষারই ফসল ছিল ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো। সমীর রায়চৌধুরী চাকরিজনিত কাজে বাইরে গেলে বাড়িতে মাঝেমাঝে শক্তিকে রেখে যেতেন এবং বলাই বাহুল্য যে এ কাজটি তিনি বেশ আগ্রহের সাথেই করতেন! একবার তো এতদিন থেকে গিয়েছিলেন যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার খোঁজে গিয়ে বলেন, “তুই এখানে ইস্টিশান পুঁতে ফেলেছিস ?” কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে প্রেম পরিণয় পর্যন্ত গড়ায়নি এবং এই ব্যর্থতা তার জীবনে বেশ গভীর দাগ কাটে। সাহিত্যজীবনেও এর বেশ প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এ নিয়ে তার লেখা ‘কিন্নর ও কিন্নরী’ উপন্যাসটি প্রকাশ পায় ১৯৭৭ সালে। এটি ছাড়াও ‘অম্বা ও দেবব্রত’, ‘রামচন্দ্র ও শর্বরী’, ‘সোম ও তারা’, ‘অর্জুন ও উত্তরা’ নামক  চারটি ব্যর্থ প্রেমের উপন্যাস তিনি উপহার দেন বাংলা সাহিত্যকে, যার উৎসও মনে করা হয় তার নিজের জীবনে প্রেমের ব্যর্থতাকেই। উল্লেখ্য, এই উপন্যাসগুলোর সবগুলোই পৌরাণিক চরিত্র কেন্দ্রিক।

ভালোবাসার আবেদনই সবচেয়ে বড় তার কাছে; Source: Facebook

১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি হাংরি বুলেটিনে শক্তির কবিতা বেরুতো এবং তিনি এ আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তার ডাকেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার প্রমুখ। কিন্তু পরে আন্দোলন থেকে তার দূরে সরে যাওয়া এমনকি নিজেকে নিরাপদে রাখতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তার কিছু কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়। তিনি যে নিজেকে পুরোপুরি এ আন্দোলন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন, তার প্রমাণ করতে তিনি পুলিশের কাছে আন্দোলনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যও দেন। এবং তখন তার ডাকে যোগদানকারীরাও আন্দোলন থেকে পিছু হটে।

হাংরি আন্দোলনের সহযোদ্ধা মলয় রায়চৌধুরীর ভাষ্যমতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এ আন্দোলন ত্যাগ করার পেছনেও একটি প্রধান কারণ ছিল এই ব্যর্থ প্রেম। শীলার সাথে বিচ্ছেদের পর তার মনে হয় যে জীবনে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হতে পারলেও শীলার পিতা তাকে মেনে নিতেন এবং অর্থচিন্তা তখন তাকে অনেকটাই পেয়ে বসে। এরপর ১৯৬৩ সালে একটি সংবাদপত্রে চাকরির প্রস্তাব পান শক্তি। কিন্তু চাকরির শর্ত ছিল, তাকে হাংরি আন্দোলন ছাড়তে হবে। এ কারণেই হাংরি আন্দোলনের প্রতি অতীতের বহু সংযুক্তির পরও তা থেকে শক্তি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বলেই মনে করেন মলয় রায়চৌধুরী। মলয় রায়চৌধুরীর কথায় শক্তির প্রতি সরাসরি ক্ষোভ ও অভিযোগ ঝরে পড়ে।

বোহেমিয়ান এক সত্ত্বা সবসময়ই প্রবল হয়ে থাকতো সংসারী শক্তির ক্ষেত্রেও; Source: Deshiblitz.com

স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ছিল তার ছদ্মনাম। নিজের কবিতাকে তিনি ‘পদ্য’ বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন।

তার কিছু কাব্যগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো,

  • এ প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (১৯৬২)
  • ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৭)
  • সোনার মাছি খুন করেছি (১৯৬৮)
  • প্রভু নষ্ট হয়ে যাই (১৯৭২)
  • ঈশ্বর থাকেন জলে (১৯৭৫)
  • অস্ত্রের গৌরবহীন একা (১৯৭৫)
  • জ্বলন্ত রুমাল (১৯৭৫)
  • ছিন্নবিচ্ছিন্ন (১৯৭৫)
  • সুন্দর এখানে একা নয় (১৯৭৬)
  • কবিতায় তুলো ওড়ে (১৯৭৬)
  • ভাত নেই পাথর রয়েছে (১৯৭৯)
  • যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮৩)
  • আমাকে জাগাও (১৯৮৯)
  • ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে (১৯৯১)
  • সকলে প্রত্যেকে একা (১৯৯৯)

সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কারসহ তিনি বেশ কিছু পুরষ্কার পান।

সকলের সাথে চেনাজানা সম্পর্কের বাইরে নিজের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে বড্ড কষ্ট পেতে হতো শক্তিকে। দিনশেষে কুড়ে খাওয়া নিঃসঙ্গতাকে তিনি অস্বীকার করতে পারতেন না। কখনো না কখনো অন্যের সাথে তার আচরণেও প্রকাশ পেতো দীর্ঘশ্বাস।

শক্তির একটি বইয়ের প্রচ্ছদ; Source: Calcutta web

রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন শক্তি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই রবিঠাকুরের প্রতি সমূহ অনুরাগ কাজ করে। এক্ষেত্রে তার একটি স্বীকারোক্তি উল্লেখ্য,

“আমি যখন মদ্যপান করতে করতে নিজের মধ্যে চলে যাই তখন রবীন্দ্রনাথের গান আমার ভিতর বাহিরকে একাকার করে দিয়ে যায়। তখন গলার সবটুকু জোর ও উদারতা দিয়ে ওঁর গান গাইতে ইচ্ছে করে”।

বোহেমিয়ান এই কবির যখন একটা আশ্রয় লাগতো, তখন হয়তো কারো দরজায় এভাবেই করাঘাত করতে চাইতেন, আবার হয়তোবা নিজের দরজার দিকেই তাকিয়ে থাকতেন একবার একটি করাঘাতের কামনায়। ভাবনা ও ভাষার বৈপরীত্যপূর্ণ সংঘাতে ভেসে ওঠে কিছু কথা,

“দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া

কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া

অবনী বাড়ী আছো?”

শক্তির সমসাময়িক সাহিত্যিক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাব্যে শক্তির কিছু বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে এবং সেইসাথে হয়তো তার রাত-বিরেতে করতে চাওয়া করাঘাতের উত্তরও মেলে,

“রাত বারোটা কি দেড়টায় কবিতার খাতা খুলতেই বাইরে

কে আমার নাম ধরে তিনবার ডাকলো?

গলা চিনতে ভুল হবার কথা নয়, তবু একবার কেঁপে উঠি

এই তো তার আসবার সময় বরাবরই তো সে রাত্রির রুটিনে

পদাঘাত করে এসেছে

দুনিয়ার সমস্ত পুলিশ তাকে কুর্নিশ করে, রিকশাওয়ালারা ঠুং ঠুং

শব্দে হুল্লোড় তোলে

গ্যারাজমুখী ফাঁকা দোতলা বাসের ড্রাইবার তার সঙ্গে এক বোতল থেকে চুমুক দেয়

উঠে গিয়ে বারান্দায় উঁকি মেরে বলি, শক্তি চলে এসো,

দরজা খোলা আছে

খাঁকি প্যান্ট ও কালো জামা, মাথার চুল সাদা, মুঠোয় সিগেরেট ধরা

শক্তি একটু একটু দুলছে, জ্যোৎস্না ছিন্নভিন্ন করে হেসে উঠলো”

নীরোদ মজুমদারের বাড়িতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে; Source: Anandabazar.com

বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথেও খুব আন্তরিক সম্পর্ক ছিল শক্তির। তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্বাতী বলেন,

“আর শক্তিকে যতটুকু দেখেছি, ওঁর পাগলামি বোহেমিয়ানিজমের বাইরেও একটা অন্য মানুষ ছিলেন। শুনেছি, শক্তি বাজার খুব ভাল করতেন। এ দিক-ও’ দিক ঘুরতেন, বাড়ি ফিরতেন না, আবার কয়েকদিন মাঝেমধ্যে খুব ভাল হয়েও থাকতেন। চান করে মাথা আঁচড়ে বসে পরিপাটি ভাত খেতেন। এই শক্তির জন্য আমার খুব আফসোস হয়”।

১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ বাংলা গদ্য-পদ্যের জগতে নির্দ্বিধায় বিচরণকারী কবি পরিচয়ে শক্তিমান শক্তি চট্টোপাধ্যায় হৃদরোগজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬১ বছর। তার পরিচিতজনদের মতে, তিনি চলে যাওয়ায় বাংলা সাহিত্যের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। তার মৃত্যুর আগেরদিনই শক্তির সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আলোচনায় স্থির করা হয় যে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সমূহ দায়িত্ব গ্রহণ করবেন শক্তি। কিন্তু তা আর হয়নি। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, শক্তি থাকলে কৃত্তিবাস অন্যরকম হতো।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে তার বাবার কথা মনে করে বলেন, তিনি শুধু কবি বা লেখকই ছিলেন না, একজন সমাজসেবীও ছিলেন। একবার তিনি তার এলআইসি ফান্ডের সম্পূর্ণ অর্থ এক রিকশাচালককে দিয়ে দেন শুধুমাত্র এই কারণে যে রিকশাচালকটি কয়েকটি কবিতা লিখেছিলো এবং বাংলা সাহিত্যে তার বেশ আগ্রহ ছিল।

ফিচার ইমেজ- alchetron.com

Related Articles