Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পুরুষতন্ত্র রুখতে নারীদের আলাদা সাহিত্য পুরস্কার কতটা সফল হবে?

প্রতি বছর আমরা নতুনভাবে যে সকল আন্তর্জাতিক লেখকদের সাথে পরিচিত হই, তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে আমজনতার পাদপ্রদীপের আলোর নিচে আসেন। খুব বেশি সাহিত্যানুরাগী না হলে আমরা হয়তো বলতে পারব না, আগামী বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য কে কে মনোনয়ন পেতে পারেন। সাহিত্য পুরস্কারের বড় একটি গুরুত্বের জায়গা এটিও।

অন্য সকল বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয় মূলত ওই ব্যক্তির অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য; এতে তার মিডিয়া পরিচিতি বাড়ে বটে কিন্তু তার অর্থনৈতিক অর্জন তুলনামূলক কম থাকে। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে। পুরস্কার বিজয়ী লেখকের বইয়ের কাটতি বহু গুণে বেড়ে যায়। লেখক অধিক রয়্যাল্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়। তার বই প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফাও বহুগুণে বেড়ে যায়। এজন্যই বিশ্বব্যাপী সাহিত্যের রাজনীতিতে পুরস্কার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। 

এসব পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও বর্ণ বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে বটে; কিন্তু এবারের অভিযোগ খানিকটা ভিন্ন। আর তা হলো লিঙ্গ বৈষম্যের অভিযোগ।

একদল নারী অধিকারকামী সাহিত্যিক বলছেন, বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কারে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। ফলে নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু কীভাবে এই অভিযোগটি দানা বেঁধে উঠল, তা জানতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে ফিরে যেতে হবে।

১৯০৯ সালে প্রথম নারী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পান সেলমা লেগারলিফ; Image Source: Wikimedia

প্রায় আট বছর আগের ঘটনা। কানাডিয়ান ঔপন্যাসিক সুসান সোয়ান ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি নিবিড় অনুসন্ধান শুরু করেন। তিনি বোঝার চেষ্টা করেন বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কারে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীরা কতটা সমানভাবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। অনুসন্ধানে নেমেই বড়সড় ধাক্কা খেলেন। দেখতে পেলেন বড় ধরনের বৈষম্যের চিত্র

তিনি দেখলেন, অধিকাংশ প্রসিদ্ধ সাহিত্য পুরস্কারগুলোর প্রাথমিক তালিকায় নারীদের বই রাখাই হয় না। আবার প্রাথমিক তালিকায় থাকলেও অবহেলার সাথে রিভিউ না করেই সেগুলো বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়। যেগুলো কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যায় না; অনেকটা বাধ্য হয়ে শুধুমাত্র সেগুলো মনোনয়নের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়। অর্থাৎ, মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচকদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করে।     

তার এই গবেষণার বাস্তবতা ফুটে ওঠে ভিডা (VIDA) নামক একটি নারীবাদী সাহিত্য সংগঠনের অনুসন্ধানেও। সংগঠনটির তথ্যমতে, গত তিন বছরে কানাডা ও আমেরিকায় পুরুষেরা যত সংখ্যক উপন্যাস রচনা করেছেন, নারীরাও প্রায় সমান সংখ্যক উপন্যাস রচনা করেছেন। কিন্তু পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারীদের অনেক পিছিয়ে রাখা হয়েছে।

এছাড়া নারীদের বই প্রকাশ করার ব্যাপারেও অধিকাংশ প্রকাশনী অনীহা প্রকাশ করে থাকে। এজন্য ভিডার অন্যতম কার্যক্রম হলো নারী লেখকদের বই প্রকাশ করা। কিন্তু বই প্রকাশই যে সব সমস্যার সমাধান নয়!

ক্যারল শিল্ডস পুরস্কারের অন্যতম উদ্যোক্তা সুসান সোয়ান ও তার লিখিত একটি বই; Image Source: Youtube

এজন্য কানাডিয়ান লেখিকা সুসান সোয়ান এবং তার বান্ধবী, টমাস অ্যালেন অ্যান্ড সন লিমিটেডের প্রকাশক জেনিস জাওয়ার্বনি সাহিত্য জগতে নারীদের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির লড়াইয়ে নেমেছেন। ২০২২ সাল থেকে তারা নারীদের জন্য আলাদা একটি সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতি বছর একজন শ্রেষ্ঠ ফিকশনধর্মী লেখককে এ পুরস্কার দেওয়া হবে। পুরস্কারটির মূল্যমান হবে ১ লক্ষ ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলার, মার্কিন মুদ্রামানে যা প্রায় ১ লক্ষ ১৩ হাজার ডলার। 

শুধুমাত্র নারীদের জন্য ঘোষিত এই পুরস্কারের মূল্যমান যে কারো মাঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। যেখানে ফিকশন জগতের প্রসিদ্ধ পুরস্কার ‘দ্য বুকার’-এর মূল্যমান ৫০ হাজার পাউন্ড বা প্রায় ৬৫ হাজার ডলার। আরেক প্রসিদ্ধ সাহিত্য পুরস্কার ‘পুলিৎজার’-এর মূল্যমান মাত্র ১৫ হাজার ডলার। অপরদিকে ‘ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড’-এর মূল্যমান মাত্র ১০ হাজার ডলার।

যদিও নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের বিষয়টি ব্যতিক্রম। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পুরস্কার পেয়ে থাকেন। কিন্তু অন্য যেকোনো সাহিত্য পুরস্কারের তুলনায় সুসান সোয়ানদের ঘোষিত পুরস্কার সকলের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। তারা এই পুরস্কারের নাম দিয়েছেন ‘ক্যারল শিল্ডস পুরস্কার’। পুরস্কারের বিষয়ে সুসান সোয়ান বলেন,

আমরা খুব বড় পরিসরে শুরু করতে চাই, যাতে এটা মানুষের মাঝে দ্রুত প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।  

সোয়ান জানান, প্রধান পুরস্কারের পাশাপাশি ফাইনালে উত্তীর্ণ আরও চারজন লেখককে পুরস্কৃত করা হবে। তাদের প্রত্যেককে সাড়ে ১২ হাজার কানাডিয়ান ডলার বা প্রায় ৯ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার প্রদান করা হবে।

সোয়ানের বিশ্বাস এতে ওই লেখকদের বই বিক্রির পরিমাণ বাড়বার পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যে নারী লেখকদের মর্যাদা সমুন্নত হবে। ক্যারল শিল্ডস পুরস্কারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বলতে গিয়ে সোয়ান বলেন,

আমি মনে করি, এই পুরস্কার জীবিত নারী লেখকদের অনন্য উচ্চতা ও সফলতার দিকে নিয়ে যাবে। কেননা, এটা তাদের উপার্জনকে অনেকগুণ বৃদ্ধি করবে এবং তাদের প্রোফাইলকে ভারি করবে।

আরেক উদ্যোক্তা ও টমাস অ্যালেন অ্যান্ড সন লিমিটেডের প্রকাশক জেনিস জাওয়ার্বনি; Image Source: THE CANADIAN PRESS/HO

তবে এই পুরস্কার শুধুমাত্র আমেরিকা ও কানাডায় সীমাবদ্ধ থাকছে। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের পাশাপাশি স্প্যানিশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখিত বইয়ের ইংরেজি অনুবাদও পুরস্কারের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।

মনোনয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে, ফিকশন লেখককে আমেরিকা বা কানাডার যেকোনো একটি দেশে কমপক্ষে পাঁচ বছর নাগরিকত্ব সহকারে বসবাস করতে হবে। বিজয়ী ও ফাইনালে উত্তীর্ণদের মনোনয়ন দেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী বিচারক প্যানেল গঠন করা হবে। বিচারক প্যানেলে আমেরিকা থেকে একজন, কানাডা থেকে একজন এবং এই দুই দেশ ব্যতিরেকে একজন- সর্বমোট তিনজন সাহিত্যিককে বিচারক হিসেবে রাখা হবে।

ক্যারল শিল্ডস পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী প্রখ্যাত কানাডিয়ান ঔপন্যাসিক ও গল্পকার ক্যারল শিল্ডস-এর নামানুসারে। তিনি ২০টির অধিক বই রচনা করেছেন। এর মধ্যে ‘দ্য স্টোন ডাইরিস’ নামক উপন্যাসটি ১৯৯৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করে।

২০০৩ সালে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি নারী-অধিকার বিষয়ে সরব ছিলেন। তার নামে পুরস্কার চালুর পেছনে আরেকটি কারণ হলো, তিনি আমেরিকা ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক ছিলেন। তার সম্পর্কে পুরস্কারের অন্যতম উদ্যোক্তা সোয়ান বলেন,

তিনি তার উপন্যাসের মধ্যে পুরুষদের প্রথাগত (নেতিবাচক) কাজের সমালোচনা করেছেন। তার সে সকল সমালোচনা সাহিত্য জগতে ‘আলোকবর্তিকা’র মতো দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। কেননা, এসকল পুরুষরা মনে করে, নারীদের শুধুমাত্র ঘরের কাজের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা করাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব।

পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী প্রখ্যাত কানাডিয়ান ঔপন্যাসিক ও গল্পকার ক্যারল শিল্ডস-এর নামানুসারে; Image Source: CNN

পুরস্কারের অর্থ যোগান দেবেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব। ইতোমধ্যে তিনি বিষয়টি ক্যারল শিল্ডস পুরস্কারের প্রধান দুই উদ্যোক্তা সোয়ান ও জাওয়ার্বনিকে নিশ্চিত করেছেন এবং চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেছেন। পুরস্কারের ধারাবাহিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক পূর্ণতার জন্য তারা এরই মধ্যে একটি ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক ও অন্যান্য খরচের জন্য তারা এখনো কিছু অর্থ সংগ্রহ করছেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বখ্যাত নারী লেখিকাদের ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন কানাডিয়ান কবি ও ঔপন্যাসিক মার্গারেট এ্যাটউড, আমেরিকান লেখিকা লুয়িস ফ্রেডরিখ, পুলিৎজার পুরস্কারবিজয়ী আমেরিকান ঔপন্যাসিক জেনি স্মিলি এবং কানাডিয়ান গল্পকার অ্যালিস মনরো প্রমুখ।

পুরস্কারের পাশাপাশি ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রতিবছর পাঁচজন তরুণ লেখককে ফেলোশিপ প্রদান করা হবে। তারা পুরস্কারবিজয়ী পাঁচজন লেখকের সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ লাভ করবেন। তাদের কাজ হবে প্রবীণ নারী লেখকদের লেখালেখিতে সহায়তা করা এবং অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করা।

ক্যারল শিল্ডস-এর  ‘দ্য স্টোন ডাইরিস’ নামক উপন্যাসটি ১৯৯৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করে; Image Source: Amazon

তবে এই লেখকদের জন্য আলাদা সাহিত্য পুরস্কারের ধারণা পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীদের জন্য এমন আলাদা সাহিত্য পুরস্কারের আয়োজন রয়েছে। যুক্তরাজ্যে ‘উইমেনস প্রাইজ ফর ফিকশন’ নামের সাহিত্য পুরস্কার রয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় ‘স্টেলা’ এবং ফ্রান্সে ‘লা প্রিক্স ফেমিনা’ নামের প্রভাবশালী সাহিত্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমেরিকা ও কানাডায় এ ধরনের বিশেষায়িত কোনো পুরস্কার নেই। অর্থাৎ, আমেরিকা ও কানাডার জন্য এটি একেবারেই নতুন একটি উদ্যোগ।

কিন্তু নারীদের জন্য এ ধরনের আলাদা সাহিত্য পুরস্কার বিশ্ব সাহিত্যের জগতে কতটা প্রভাব ফেলছে বা ফেলতে সক্ষম হবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব পুরস্কার অনেকাংশে গতানুগতিক; ফলে পুলিৎজার কিংবা নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের মতো এসবের প্রভাব নেই।

কিন্তু সেই গতানুগতিক ধারাকে চ্যালেঞ্জ করেই আসন্ন ক্যারল শিল্ডস পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। কেননা, এটা পদ্ধতিগতভাবে যেমন ভিন্ন, অর্থমূল্যের দিক থেকেও তেমনি শক্তিশালী। ফলে, এই পুরস্কারটি বিশ্বসাহিত্যে নারীদের জন্য আলাদা শক্তির জায়গা তৈরি করবে- এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

This article is in Bengali language. It is about The Carol Shields Prize.

Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image: CNN

 

Related Articles