Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়…

১৯ শে জুলাই, ২০১২ সাল। নিউইয়র্ক সময় দুপুর ১টা ২৩ মিনিট, নীরবে-নিভৃতে প্রস্থান।

আজ বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার হুমায়ূন আহমেদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচারের ২৯ দিনের মাথায় নিম্ন রক্তচাপের কারণে চিকিৎসকেরা বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন আমাদের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে। প্রায় তিন সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে থাকার পর কিছু না বলেই চলে গেলেন বাংলা ভাষার কিংবদন্তী এ লেখক।

হুমায়ূন আহমেদ; Source: কল্লোল

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যে মানুষটা হাসতে হাসতে অবলীলায় বলতেন মৃত্যু নিয়ে রসাত্মবোধক গল্প, সেই মানুষটিই কিছু বলে যেতে পারেননি, কিছু লিখে যেতে পারেননি শেষ মুহূর্তে প্রিয় পাঠকদের জন্য। শেষের দিকে মুখে বলতে না পারলেও লিখে জানতে চেয়েছিলেন- কবে তার শরীর থেকে এসব যন্ত্রপাতি খোলা হবে? কবে তিনি আরোগ্য লাভ করে বাসায় যাবেন?

তারপর আর ঘরে ফেরা হয়নি, বিদায় নিতে হয়েছে নিঃশব্দে। চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন তার প্রিয় নুহাশ পল্লীর লিচুতলায়।

আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। প্রথম উপন্যাস দিয়েই বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান করে নেন তিনি। তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনিই একমাত্র বাঙ্গালী লেখক যার প্রতিটি বই সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। প্রায় দু’শতাধিক বই লিখেছেন তিনি, বাংলা সাহিত্যে রাজত্ব করেছেন প্রায় চল্লিশ বছর। তৈরি করেছেন এক একটি অনবদ্য চরিত্র যা আজীবন বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবে। প্রতিটি চরিত্র লেখক বেশ সময়ের সাথে তৈরি করেন এবং একই চরিত্র নিয়ে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হওয়ায় পাঠকের আছে চরিত্রগুলো বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। হিমু, শুভ্র, রূপা, মিসির আলী এই চরিত্রগুলো পাঠকের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

নব্বইয়ের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত একুশের বইমেলায় তার লেখা বই ছিল সর্বোচ্চ বিক্রীত। এখন আর একুশের বই মেলায় হুমায়ূন আহমেদের নতুন কোনো বই আসে না। তার প্রস্থানের পর এই শূন্যতা পাঠক সমাজকে প্রতিনিয়ত ব্যথিত করছে।

হিমু আর কত কাল হাঁটবে? রূপার অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে? আচ্ছা, মিসির আলী কি আর কোনো রহস্য নিয়ে আসবেন না?এগুলো এখন শুধুই কিছু প্রশ্ন।

হিমু এবং রুপার; Source: উন্মাদ অয়ন

বাংলা সাহিত্যের উপর পশ্চিমা লেখকদের প্রভাব অগ্রাহ্য করা যাবে না। বলতে গেলে বাংলা সাহিত্য এক উচ্চ শ্রেণীর সাহিত্যে রূপান্তরিত হয়েছে তাদের হাত ধরেই। কিন্তু সেই হাত বদল হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের কাছে এসে। তিনি তার লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম-ভালোবাসা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, একাকীত্ব, বন্ধুত্বকে তুলে ধরেছেন অনন্য ভঙ্গিমায়, সাহিত্যে দিয়েছেন আধুনিকতার ছোঁয়া, সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য কিছু চরিত্র। তিনি তার লেখনীতে নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের এক অকৃত্রিম অনুভব দেন। বৃষ্টি, জোৎস্না এবং সমুদ্র নিয়ে বিলাসিতা তার লেখনীতে যেন আরও প্রাণবন্ত হয়েছে।

মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে, একঘেয়ে কান্নার সুরের মতো সে-শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে জামগাছের পাতায় সরসর শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা-হা করে উঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কী বিপুল বিষণ্নতাই না অনুভব করি। জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবেছি।

আধুনিক জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিগুলোকে তিনি শুধু উপন্যাসেই নয়, বরং স্বরচিত নাটক এবং টেলিফিল্মগুলোতেও সেগুলোকে সুনিপুণভাবে ফ্রেমবন্দী করেছেন। এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, তারা তিনজন, উড়ে যায় বকপক্ষী  সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক তৈরী করে গিয়েছেন তিনি।

কোথাও কেউ নেই নাটকের দৃশ্যে; Source: dhakatribune.com

তার সৃষ্ট একেকটি চরিত্র দর্শককে যেভাবে মোহবিষ্ট করেছে সেটি অতিক্রম করা পরবর্তীকালীন লেখকদের জন্য বিশাল বড় এক চ্যালেঞ্জ। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের জন্য সারা বাংলাদেশে মিছিল, ঢাকার অলিতে গলিতে পোস্টারিং- এগুলো না হয় ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গল্পই হয়ে থাক।

শিল্পের আরেক অঙ্গন সিনেমা যেখানে হুমায়ূন আহমেদের পদার্পণ মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। একজন সফল চলচ্চিত্রকার এবং পরিচালক তিনি। আধুনিক প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও তৎকালীন অত্যাচারের সাথে তিনিই পরিচয় করিয়ে দেন, চিন্তার দৃষ্টিকে উন্মোচিত করতে সাহায্য করেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ ছাড়াও ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে অন্যতম। তার ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি ২০০৬ সালে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তার পরিচালনায় নির্মিত সর্বশেষ সিনেমা ছিল ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। তার প্রতিটি চলচ্চিত্রে আমাদের সমাজের অন্যায়-অবিচার এবং সীমাবদ্ধতাগুলো অত্যন্ত মর্মস্পর্শী রূপে তুলে ধরেছিলেন তিনি।

গল্প, নাটক, ধারাবাহিক, চলচ্চিত্র ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ আমাদের বিমোহিত করেছিলেন তার গান দিয়ে। খুব বেশি গান তিনি রচনা করতেন না। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে গান তিনি খুবই ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বেশ ভক্ত ছিলেন হুমায়ূন। সারাদিনের পরিশ্রমের মধ্যে সেটাই ছিল তাঁর বড় আশ্রয়ের জায়গা। এমনকি সেই গান দিয়ে দ্বার খুলেছিলেন শাওন। আরো ভালো হয় এই বললে যে, তিনি খোলেননি, দরজা খুলে গিয়েছিল নিজ হতেই।

হুমায়ূন আহমেদ এবং মেহের আফরোজ শাওন; Source: bdmorning.com

শাওন বলেছেন,

সেই ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই তো ওনার নাটকে অভিনয়, গান করি। ইউনিটের কেউ যদি গান জানতেন, উনি রিহার্সালের পর তাঁর কাছে শুনতে চাইতেন। সেইভাবে আমার কাছেও অনেকবার শুনতে চেয়েছেন। আমি খুব চটপট গান তুলে নিতে পারতাম বলে আমার নাম দিয়েছিলেন ‘টেপ রেকর্ডার’!”

সেই ‘টেপ রেকর্ডার’ যে নিরবচ্ছিন্নভাবে কবে থেকে বাজতে শুরু করল হুমায়ূনের জীবনে, আজ আর তার সঠিক ঠাহর পান না শাওন। হয়তো গানের প্রতি সেই মারাত্মক ভালোবাসা থেকেই তিনি অনেক যত্নে গান বানাতেন। তার গানগুলো যেন জীবনের চাওয়া পাওয়ার অসংখ্য প্রশ্ন-উত্তরের মেলবন্ধন।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা গানের অংশবিশেষ; Source: youtube.com

সংগীতের ক্ষেত্রে তিনি হাছন রাজাকে করেছেন পুনরাবিষ্কার। এক যে আছে সোনার কন্যা, ও আমার উড়ালপঙ্খী, বরষার প্রথম দিন, আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা, চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়, যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো, কে পরাইল আমার চোখে কলঙ্ক কাজল – এই অসাধারণ গানগুলোর কারিগর তিনি।

মানুষ আসলে এক জীবনে বেশি কিছু চায় না, চায় শুধু একটু যত্ন একটু মায়া।

সেই মায়ার কি অভাব ঘটেছিল একটা সময়ে পৌঁছে? অজস্র অমর চরিত্রের এই জাদুকর কি মধ্যজীবন পার করে নিজেই হয়ে উঠছিলেন নিঃসঙ্গ কোনো চরিত্র?

সাহিত্যের যে অঙ্গনে তিনি কলম ধরেছিলেন, সেখানেই পরশ পাথরের মতো জাদু করেছিলেন এই জাদুকর। তার প্রস্থান লেখক ও পাঠক সমাজে এক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। বাংলা সাহিত্যে আজ বইছে এক বিষণ্নতা। কবে আবার সাহিত্যে সেই জাদু ফিরে আসবে তা আজ বলতে পারে না কেউই।

তবু বলতে হয়-

যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়…

ফিচার ইমেজঃ buzzdhk.com

Related Articles