Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘কতটুকু জমি দরকার?’: টলস্টয়ের যে গল্প জীবনবোধকে জাগ্রত করে

“একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর
রে মন আমার
কেনো বান্ধ দালান ঘর, 
রে মন আমার
কেনো বান্ধ দালান ঘর”

বাংলাদেশের পালাগানের একজন বিখ্যাত শিল্পী লতিফ সরকারের একটি গানের প্রথম কয়েকটি কথা। যার সার হচ্ছে- অনন্তকাল টিকে থাকতে পারেনা প্রকৃতির কোনো প্রজাতিই। মানুষও প্রকৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে পারেন না। ফলে একটি নির্দিষ্ট সময় এই ভূমিতে কাটিয়ে তারপর জীবনাবসান ঘটে। এতকাল চারিপাশে এত মানুষের বিচরণের পরিবেশ থেকে তাকে সরে যেতে হয়। থাকতে হয় একা। মাঝে তাকে অভিজ্ঞতা নিতে হয় ‘মৃত্যু’ নামক এক বিষাদময় অধ্যায়ের। 

তাকে ছেড়ে যেতে হয় পৃথিবীতে তার নিজের সবকিছুকে। তার আপনজন, নিজের হাতে গড়া বাড়ি-ঘর, জায়গাজমি কিংবা আরও সম্পদকে সে মৃত্যুর পর সাথে করে নিয়ে যেতে পারে না। মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু সে জানে সেখানে জীবনের কিছুই নিয়ে যাওয়া যাবে না। এমনকি তার নিজের দেহটাও মাটিতে মিশে যায়।

এসব জেনেও অনেকেই জীবনের অন্যতম ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন সবকিছু আহরণ করাকে। তাদের কাছে ভোগের নামই প্রকৃত সুখ। লোভের মোহে তারা ভুলে যান এই জগতের কিছুই তার মৃত্যুর পর কাজে আসবে না। আর সেই মৃত্যু যেকোনো সময়ই তাকে আক্রমণ করতে পারে। কখন তার মুখোমুখি হতে হবে তা মানুষ জানে না।

বাস্তব এই সত্যের পরেও আমাদের সমাজের অনেকেরই সবকিছু নিজের করে নেয়ার লোভটা থেকেই যায়। দুনিয়ার সবকিছু চাওয়া লোকটা মৃত্যুর পর যা পাবে তার মূল্য কানাকড়িও না। এসব জেনেও যারা দুনিয়ায় লোভ-লালসাকে টিকিয়ে রেখেছেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয় রচনা করেন গল্প ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ এ ম্যান নীড?’ বা ‘কতটুকু জমি দরকার?’ গল্পটি ১৮৮৬ সালে রচনা করেন তিনি। সেই বছরের আগের বছর ১৮৮৫ সালে রচনা করেন আরও একটি বাস্তবধর্মী গল্প ‘তিনটি প্রশ্ন’ বা ‘থ্রি কোয়েশ্চনস’।

‘সাহিত্য হবে জীবনের জন্য’

তবে টলস্টয় বিখ্যাত হয়ে আছেন তার রচিত তিনটি বিখ্যাত রচনা ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আন্না কারেনিনা’ ও ‘ রেজারেকশন’ এর জন্য। তবে এগুলোর মধ্যেও ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ তার সেরা সৃষ্টিকর্ম। রাশিয়ান সাহিত্যে লিও টলস্টয় ছিলেন দস্তয়ভস্কি, পুসকিন, গোগল, চেখভ, গোর্কি প্রমুখের চেয়েও অনেক বেশি সমাদৃত। এমনকি তাকে বিশ্ব সাহিত্যেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের থেকে একটি বড় জায়গায় তিনি ছিলেন বেশ আলাদা। বাস্তবধর্মী সাহিত্য রচনা ছিলো তার অন্যতম লেখার মাধ্যম। তার সাহিত্যকর্মের কোথাও অবাস্তব কল্পনার মিশেল থাকতো না।

তার চারপাশে বসবাস করা মানুষের চিরায়ত কামনা, শান্তির অন্বেষাই টলস্টয়ের সাহিত্যকে আরও বেশি জনপ্রিয়তা এবং অমরত্ব দান করেছে। দেখা যায় তার প্রতিটি সাহিত্য জীবন ও নীতিবোধ নিয়ে গড়ে উঠেছে। জীবন ও নীতিবোধ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিষ্কার ধারণা গড়ে ওঠার পরই লেখায় হাত দিয়েছেন।

জীবনে চলতে কি সব জমিই লাগবে? Image Source: Amiable Language Services

কতটুকু জমি দরকার?

গল্পটি রাশিয়ার এক লোভী লোক পাহমকে নিয়ে। যার জমি কেনার দিকে ঝোঁক বেশি। কারো কাছে জমির কথা শুনলেই তার চোখ চকচক করে উঠে। কম দামে জমি বিক্রি হলে তিনি তা কিনতে মরিয়া হয়ে পড়েন। জমির জন্য ছুটে যান এখানে সেখানে। সস্তায় যেখানে জমি পাওয়া যায় সেখানেই গিয়ে পরিবারসহ হাজির হন পাহম। জীবনযাপন শুরু করেন।

এভাবে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকা ঘুরতে ঘুরতে পাহম এমন এক এলাকার সন্ধান পান যেখানকার মানুষ খুবই সহজ-সরল। তাদের থেকে খুবই কম দামে জমি কেনা যায়। তারাও খুব আন্তরিক। পাহম তার পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেন। সেখানকার উর্বর জমি থেকে তার আয় দিন দিন বাড়তেই থাকে। কিন্তু জমি নিজের করে নেয়ার যে লোভ, তা থেকে তিনি বেড়িয়ে আসতেই পারেন না। ক্রমেই চক্রে পড়ে যান। আরও জমি লাগবে তার। জমির চিন্তা তাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না।

এমনই চিন্তার সময় তার কাছে খবর আসে অনেক দূরে উর্বর এক এলাকা রয়েছে। সেখানে জমির দাম এখানকার থেকেও অনেক অনেক সস্তা। ফসলও বেশ ভালোই ফলবে। এতে করে আরও আরামে থাকতে পারবে পাহম। জমি নিয়ে তার এত দুশ্চিন্তাও থাকবে না। অনেক চিন্তাভাবনা করে পাহম সিদ্ধান্ত নেন সেখানে পাড়ি জমাবেন। জমি তার দরকার।

সেখানে গিয়ে কথা হয় কর্তৃপক্ষের সাথে। জমির দাম একদিনে মাত্র এক হাজার রুবল। কিন্তু হিসাবটা বুঝে উঠতে পারে না পাহম। দিনের হিসাবে কী করে জমি বিক্রি করা হয় তা তার জানা নেই। তখন তিনি জানতে পারেন, একদিনে তিনি যতদূর জমি ঘুরে আসতে পারবেন ততদূর জমিই তার হবে! এর জন্য তাকে দিতে হবে মাত্র এক হাজার রুবল। তবে যেখান থেকে শুরু করেছে সেখানে এসেই শেষ করতে হবে যাত্রা। এবং তা সূর্য ডুবে যাবার আগেই।

আনন্দে আত্মহারা হয় পাহমের মন। এতদিনে তিনি মনের মত কম দামে জমি পাচ্ছেন। রাতে ঘুমাতে পারেন না তিনি। প্রফুল্ল মন শুধু আনন্দ করতে চায়। জমি পাওয়ার সময়ের জন্য তার তর সইছে না। ভোরে তন্দ্রার মতো আসে। সেখানে স্বপ্নে তিনি নিজের মরদেহই নিজের চোখের সামনে দেখতে পান। ভড়কে যান পাহম। কিন্তু এসব ভেবে এখন কোনো লাভ নেই। সকাল শুরু হয়ে যাচ্ছে।

পাহম পাহাড়ে থাকা লোকদের কাছে গিয়ে হাজির হন। তার মাথায় থাকা টুপিতে এক হাজার রুবল রেখে যাত্রা শুরু করেন তিনি। যাত্রার শুরু থেকেই বেছে বেছে ফসলের জন্য উপযোগী জমিগুলোতে চিহ্ন দেন। মাঝে কিছুটা বিশ্রাম নিলেও তখন বসে পড়েন না তিনি। বসে পড়লে যদি ঘুম পায় তখন সব শেষ হয়ে যাবে। জমির লোভে এগোতেই থাকেন পাহম। একটার পর একটা জায়গা তার নিজের জন্য চাই।

জমির লোভে ছুটে চলছে পাহম। Image Source: youtube

কিন্তু হায়! সূর্য তো অস্ত যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন তাকে ফিরতেই হবে। কিন্তু দৌড়েও টুপিটার কাছে ফিরতে পারবেন না বলে মনে হয় তার। তাই কষ্ট করে হলেও জোরে পা চালান পাহম। এতে তার প্রচুর কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না তার। অবশেষে সবার উৎসাহ পেয়ে শুরুর জায়গায় এসে পড়ে যান পাহম। সবাই বাহবা দিতে থাকে তাকে। অনেক জমি পেয়েছে সে। যা অনেকটাই কল্পনাতীত।

কিন্তু তার মুখ তুলে দেখা যায় মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। মারা গেছে পাহম। এত জমি আর তার কাছে গেলো না। তার তখন জায়গা হলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাটির জায়গা অর্থাৎ মাত্র ছয় ফুট। 

মূল বার্তা আসলে কী ছিলো? 

গল্পটির নাম হতে পারতো ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। কিন্তু টলস্টয় মানুষকে পাপের গল্প বলতে চাননি। তিনি মানুষকে নিজস্ব চিন্তা দিয়ে যাচাই করার সুযোগ দিয়েছেন। যাতে করে তারা কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারে সেজন্যই জমি নিয়ে মানুষের কাছে গল্পের টাইটেলেই প্রশ্ন। আমরা মূলত কোনো প্রশ্ন পেলেই তার উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। খুঁজে বের করতে পারলে বিমলানন্দ অনুভব করি এবং যে উত্তরটা নিজের চেষ্টার মাধ্যমে খুঁজে পাই কিংবা আগ্রহ থেকে বের করি তার বার্তাটা টিকে থাকে বহুদিন।

জীবনে এত চাওয়া কেন? এতটুকু জায়গা ছাড়া আর কিছু কি পাবেন?  Image Source: eNotes

এছাড়াও সাহিত্যিকের অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের মধ্যে এই বার্তা পৌঁছে দেয়া যে, আমরা যারা সম্পদের পেছনে ছুটছি তাদের সম্পদ আর কত দরকার? যতই সম্পদ আহরণ করা হোক না কেন, সেগুলো মৃত্যুর পর সাথে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নিজের মরদেহ শোয়ানোর জন্য মাত্র ছয়-কিংবা সাত ফুটের মতো জায়গা পাওয়া যাবে। সেটিও আমাদের দেহকে নিজেদের করে টেনে নেবে। দেহকে পচিয়ে তার ভিতর নিয়ে যাবে মরদেহকে আশ্রয় দেয়া সেই ছয় ফুট মাটি।

গল্পের ভাষায় বাস্তবতাকে টলস্টয় প্রকাশ করেছেন নরম সুরে। পাঠককে ব্যক্তির প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে ঘটনার মূল বার্তাটি দেয়াই ছিলো তার মূল উদ্দেশ্য। এর ফলে চিরায়ত অন্যান্য গল্প যেখানে পরনিন্দা কিংবা পরচর্চা শেখায়, সেখানে টলস্টয়ের গল্পটি পাঠককে ভাবতে শেখায়। জীবনের হিসাব নিয়ে পাঠক দ্বিতীয়বার হলেও চিন্তা করবে। এখানেই ‘কতটুকু জমি দরকার?’ গল্পটির সার্থকতা।

This article is about a story titled 'How much land does a man need?'. This is a story of famous Russian Writer Leo Tolstoy. 

Feature Image Source: Goodreads

Related Articles