Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তিন গোয়েন্দার গোয়েন্দাগিরি

টাইপরাইটারের খটাখট শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে জিনিসটার উপর দিয়ে ছোটখাট একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৫ সালের ঘটনা, সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে নিজেই যেচে গিয়েছিলেন কিশোরদের জন্য একটা সিরিজ শুরু করার। কাজী আনোয়ার হোসেনের উত্তর, “তবে আপনিই শুরু করে দিন না।” যেই ভাবা সেই কাজ, রবার্ট আর্থার জুনিয়রের বিখ্যাত “থ্রি ইনভেস্টিগেটরস”-এর আদলে লেখা শুরু করে দিলেন। আগেও অনুবাদের কাজ করেছেন, নিজের প্রথম প্রকাশিত গপ্পোটাই তো ব্রাম স্টোকারের “ড্রাকুলা”!

গল্পটার শুরুটা এরকম,

“রকি বীচ, লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া। সাইকেলটা স্ট্যান্ডে তুলে রেখে ঘরে এসে ঢুকল বব অ্যানড্রুজ। গোলগাল চেহারা। বাদামী চুল। বেঁটেখাট এক আমেরিকান কিশোর।”

ওহহো, বব অ্যানড্রুজ এখানে আসবে কোথেকে! রবিন মিলফোর্ডের মতো গালভরা নাম কি এত সহজে ভুলে গেলে চলবে? তবে রকিব হাসান নাম ভুলে না গেলেও বেশ কয়েক জায়গায় ভুলে গিয়েছিলেন অন্য কিছু। “রবিন মিলফোর্ডের চুলের রং কী? বাদামী না সোনালী?” প্রশ্নটা করলে থতমত খেয়ে যাবেন পাড় তিন গোয়েন্দা ভক্তও। আর্থার জুনিয়রের ছোটখাট চেহারার গোলগাল নথি রকিব হাসান রূপ দিলেন লম্বা, সোনালী চুলের কেতাদুরস্ত হ্যান্ডসাম রবিন মিলফোর্ডে। চশমাটাও খুলে ফেলে দিলেন, সাথে যোগ করে দিলেন সামান্য আইরিশ ফ্লেভার। ব্যস হয়ে গেল পুরোদস্তুর চলন্ত জ্ঞানকোষ রবিন মিলফোর্ড।

রকিব হাসান – “কিশোর-মুসা-রবিন”-এর স্রষ্টা

পাথুরে সৈকত! প্রশান্ত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা রকি বীচের নামটাও কি বাংলায় অনুবাদ করতে হবে নাকি কিশোর পাশার? নাহ, কিশোর পাশাটা আবার কে? গল্পের মূল নায়কই যদি বাঙালিই না হয়, তাহলে তো সমস্যা। তাই “থ্রি ইনভেস্টিগেটরস”-এর জুপিটার জোনস ছদ্মবেশ নিল কিশোর পাশার। খরগোশের মতো দাঁত বের করা ফগরফ-টগরফ-গাট নয়, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর কোঁকড়া চুলের নিচে লুকিয়ে থাকা অতিরিক্ত ব্যবহার করা মাথার অধিকারী ‘কিশোর পাশা’।

“দরদর করে ঘামছে মুসা আমান।” খাইছে, মুসা আবার দরদর করে ঘামবে কেন? কারণ, কার্ড ছাপানোর মতো শারীরিক পরিশ্রমের কাজটা তার মতো ব্যায়ামবীরের পক্ষেই মানানসই। আর্থার জুনিয়রের পিট ক্রেনশ রকিব হাসানের মুসা আমানের মতোই অ্যাথলেটিক। বাস্কেটবল কি দৌড়, রকি বীচের কার সাধ্য আছে মুসা আমানকে হারানোর? আর খাওয়ার কথা নাই বা বললাম, যে ছেলের খাওয়ার বহর দেখে দোকানদার টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাকে আরও কয়েক বোতল সোডা বিনামূল্যে দেওয়া উচিত।

রকি বীচের পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড, আলপিন থেকে রেলগাড়ির আস্ত বগি সবই পাওয়া যাবে। শুধু পাওয়া যাবে না, তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার। কেন? “জরুরী এক”, “সবুজ ফটক এক”, “দুই সুড়ঙ্গ”, “সহজ তিন”, “গোপন চার” আর “লাল কুকুর চার” এর মতো ছয় ছয়টা গোপন পথ তো সবই আমাদের জানা। মেরি চাচী না জানতে পারে, কিন্তু আমরা তো জানি কিশোর কোন ডার্করুমে ছবি ওয়াশ করে কিংবা ফাইল-ডকুমেন্টগুলো রবিন কোথায় রাখে।

Image Courtesy: লেখক 

তিন গোয়েন্দার প্রেমে পড়েছে অথচ সেবা প্রকাশনীর সাড়ে চার ইঞ্চি বাই সাত ইঞ্চির ছোট ছোট বইগুলোর শেষ পৃষ্ঠার লেখাগুলো মুখস্ত নেই, এরকম আষাঢ়ে গল্প হজম করা বেশ কঠিন।

হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা-

আমি কিশোর পাশা বলছি আমেরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে, হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনও আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি। নাম

তিন গোয়েন্দা

আমি বাঙালি। থাকি চাচা-চাচীর কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান, ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো;  অন্যজন আইরিশ অ্যামিরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা। একই ক্লাসে পড়ি আমরা।

পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরোন এক মোবাইল হোম-এ আমাদের হেডকোয়ার্টার। তিনটি রহস্যের সমাধান করতে চলেছি- এসো না চলে এসো আমাদের দলে।

কিশোরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিন গোয়েন্দার দলে ভেড়া ক্ষুদে কিশোরদের সংখ্যা যে আকাশচুম্বী। আর তা কি শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ? না, নিজেদেরকে কিশোর-মুসা-রবিন ভেবে বাংলাদেশের পথ প্রান্তরে কত গোয়েন্দা দল তৈরি হয়েছে তা হাত দিয়ে গোণার কম্ম নয়। তিন গোয়েন্দার বই কত শত ছেলেমেয়েকে সান্তা মনিকার পর্বতে উঠিয়েছে, প্যাসিফিকের নোনা জল খাইয়েছে কিংবা সাহারার তপ্ত রোদে পুড়িয়েছে তা কল্পনা করাও আকাশে বাড়ি বানাবার মতো। নাহলে কি আর শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো, ফেলুদা, ব্যোমকেশদেরকে হারিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দার নাম “কিশোর-মুসা-রবিন” এমনি এমনি হয়!

Image Courtesy: লেখক

মূল “থ্রি ইনভেস্টিগেটরস”-এর ৪৩টি বই, লিখেছিলেন ৫ জনে মিলে। আর্থার জুনিয়র শুরুটা করেছিলেন ১৩টা গল্প দিয়ে, উইলিয়াম আর্ডেন আর মেরি ভার্জিনিয়া টেনে নিয়ে গেলেন বহুদূর, আরও ২৮টা গল্প উপহার দিয়েছিলেন। তারপর শুরু হল আরও একটা যুগের, “দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস ক্রাইম বাস্টার্স” সিরিজ। দুই বছর পর থামল নতুন ১১টা গল্প সংযোজনের মাধ্যমে। কিন্তু এত কম গল্প দিয়ে কি আর সন্তুষ্ট করা যায়? রকিব হাসান ধার করলেন আরও একটা সিরিজের কাহিনী, “ফেমাস ফাইভ।” এনিড ব্লাইটনের “ফেমাস ফাইভ”-এর “জর্জিনা কিরিন” ওয়েলসের উত্তাল সাগরে ডুব দিল, উঠল গোবেল বীচে জর্জিনা পার্কার হয়ে। তার সাথে যোগ দিল অস্বাভাবিক চোখা কানের মংগ্রেল কুকুর “রাফিয়ান”।

“ফেমাস ফাইভ”-এর ২১টা বইও শেষ! এখন কি করা? এনিড ব্লাইটনের আরও একটা সিরিজ ধার করা হল, নাম “সিক্রেট সেভেন”। এই গল্পগুলো নিয়ে আগেই “গোয়েন্দা রাজু” লেখা হয়েছিল, তারপরও তিন গোয়েন্দায় চালিয়ে দেওয়া হলো। তিন গোয়েন্দা হয়ে গেল সাতজন, দলের নাম “লধশ”। কিশোর-মুসা-রবিনের সাথে যোগ হল বব, মিশা, অনিতা আর ডলি। রকিব হাসান তার তিন গোয়েন্দা যুগ শেষ করলেন “হার্ডি বয়েজ” দিয়ে। শেষ হল ১৯ বছরের এক অবিস্মরণীয় ক্যারিয়ার।

“দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস” এর মূল বই; Image Courtesy: pinterest

২০০৩ সালে রকিব হাসান যুগের পর তিন গোয়েন্দার হাল ধরলেন “শামসুদ্দীন নওয়াব” নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কাজী আনোয়ার হোসেন, যার হাত থেকে তৈরি হয়েছে আরেক কালজয়ী “মাসুদ রানা” সিরিজ। তবে শামসুদ্দীন নওয়াব তিন গোয়েন্দাকে খানিকটা পরিবর্তন করলেন, কিশোর “থ্রিলার” হয়ে গেল কিশোর “চিলার”! আর্থার জুনিয়রের ডিটেকটিভ-ক্রাইম গল্পগুলো রূপ নিল ক্রিস্টোফার পাইকের ভৌতিক-আধাভৌতিক, ফিকশন আর ভ্যাম্পায়ারের গল্পে! তবে এর মাঝেও দুই-একটা থ্রিলার প্রায়ই উঁকি মারতে দেখা যায় রকিব হাসান আর শামসুদ্দীন নওয়াবের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়।

তিন গোয়েন্দার স্বাদ পেতে পারেন একটু ভিন্নভাবেও, মুভির মাধ্যমে। “দ্য সিক্রেট অফ টেরর ক্যাসল” আর “দ্য সিক্রেট অফ স্কেলিটন আইল্যান্ড” কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে দুইটি সিনেমাও। তবে বইয়ের কাহিনীর সাথে মুভির মিল যে পাবেন না তা বলাই বাহুল্য।

“দ্য সিক্রেট অফ স্কেলিটন আইল্যান্ড”-এর মুভি পোস্টার; Image Courtesy: imdb.com

ঝামেলা! ইতিহাস বলতে গিয়ে তো আসল ঝামেলার কথাই ভুলে গেলাম। গোলগাল চেহারার ভুড়িমোটা পুলিশ কন্সটেবল হ্যারিসন ওয়াগনার উইলিয়াম ফগর‍্যাম্পারকটই তো তিন গোয়েন্দার প্রথম “ঝামেলা” ছিল। তবে টিটুর কামড় আর ক্যাপ্টেন রবার্টসনের দাবড় খেয়ে ফগ থুড়ি ফগর‍্যাম্পারকট কখনোই খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।

গ্রিনহিলসের ছোটবেলার গোয়েন্দাগিরির স্মৃতি রকি বীচে আসার পরেও তাড়া করে ফেরাতে থাকল তিন গোয়েন্দাকে। তাই শেষ পর্যন্ত রহস্য খোঁজার জন্য রেন্টাল কোম্পানির সীমের বিচি আর শোফার হ্যানসনের সহায়তায় ঢুকতে হলো ডেভিস ক্রিস্টোফারের বিশাল স্টুডিওতে। তারপর সবুজ টর্চের ভূত তাড়িয়ে জোগাড় করতে হলো পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সার্টিফিকেট। তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারল না তিন গোয়েন্দা, খোঁড়া গোয়েন্দা “ভিক্টর সাইমন”-কে জোগাড় করতে হলো দেশ-বিদেশ ঘোরার জন্য, সাথে পাইলট ল্যারি কংকলিন ফ্রি। তবে একেবারে মুফতেও বলা যাবে না, রহস্য পাওয়ার জন্য মুসাকে চড়া মূল্য দিতে হলো নিসান জাং কিমের আজব সব রেসিপি খেয়ে!

ঝড়ের বেগে গোয়েন্দাগিরি চলছে, কেউ বাগড়া বাঁধাবে না তা কি হয়? তাই শুঁটকি টেরিও তার স্পোর্টসকার নিয়ে ঝড়কে টেক্কা দিতে যায় প্রতিবার। কিন্তু বিধি বাম, স্পোর্টসকারের পিছনে থাকা টাকি-কডির গুঁতোগুঁতিতে নিয়মিতই খাদের নিচে পড়তে হয়। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে যেতে হবে ক্যারিবিয়ানের দ্বীপে, প্রশান্ত মহাসাগরের অশান্ত জলে কিংবা রৌদ্রতপ্ত মরুভূমিতে। এমন সময় পুরোনো এয়ারক্র্যাফট নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন আরব বেদুইন ওমর শরীফ।

“দ্য সিক্রেট অফ টেরর ক্যাসল” মুভির শুটিং চলাকালীন সময়ে টেরর ক্যাসলের অভ্যন্তরে “নিক প্রাইস – মুসা” (বাম), “চ্যান্সেলর মিলার – কিশোর” (মধ্য) এবং “ক্যামেরন মোনাঘান – রবিন” (ডান); Image Courtesy: Jatishwor

সব ভাল জিনিসের শেষ আছে, তাই জেনারেল উইলিয়াম ব্রন ডুগানের ভুঁড়ির গুঁতো, ডক্টর মুনের ইঞ্জেকশন আর শোঁপার চাটি খেয়েই বিদায় নিতে হচ্ছে। তবে তিন গোয়েন্দার গল্পগুলো কি হারিয়ে যাবে? না, এখনো হয়ত রাস্তার মোড়ে নীল চক দিয়ে আঁকা প্রশ্নবোধক চিহ্ন চোখে পড়বে, ঘটাং ঘটাং এর বদলে নিঃশব্দে প্রিন্টারের নিচে প্রিন্ট হবে একগাদা সাদা রঙের কার্ড আর ভূত-থেকে-ভূতের তাড়া খেয়ে নিজেই থানায় আত্মসমর্পণ করবে কোনো অপরাধী।

This article is in Bangla. It is about

Featured Image: egiye-cholo

Related Articles