Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘কান্তকবি’ রজনীকান্ত সেন: বাংলা গানের এক ক্ষণজন্মা দিকপাল

যদি বলা হয়, তিনি বাংলা সঙ্গীতজগতের অন্যতম দিকপাল, তিনি কান্তকবি– তবে হয়তো চট করেই তার নামটা পাঠকের মনে আসবে না। যদি বলা হয়, তিনি ‘পঞ্চকবি’দের একজন- তবুও তার পরিচয় হয়তো অনেকের কাছেই অনন্য হয়ে উঠবে না। কিন্তু যদি বলা হয়, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন তার নাতনি—সেই সুবাদে হয়তো অনেকের কাছেই তিনি অনেকটা পরিচিত হয়ে উঠবেন। অথচ, সুচিত্রা সেন বা অন্য কারো পরিচয়ে নয়- বরং স্বমহিমাতেই তিনি চির ভাস্বর, বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের আকাশের অন্যতম নক্ষত্র শ্রী রজনীকান্ত সেন। আমরা আজকের লেখায় এই মহান কবির জীবনালেখ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

অত্যন্ত সাদামাটা ভঙ্গিতে বাংলা গানের অন্যতম দিকপাল রজনীকান্ত সেন; Source: anandabazar.com

বাংলা ভাষায় যে পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সঙ্গীত রচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদের বলা হয় ‘পঞ্চকবি’। রজনীকান্ত সেন সেই ‘পঞ্চকবি’দেরই একজন। অন্যরা হলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন। সাহিত্য সাধনায়, আরাধনামূলক অসাধারণ সঙ্গীত সৃষ্টি এবং দেশাত্মবোধক আন্দোলন সংগ্রামে মুখর এই কবির আলোচনা, প্রচারণা নিতান্তই অপ্রতুল।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অসংখ্য গান তো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ কিংবা অতুল প্রসাদের ‘মোদের গরব মোদের আশা/ আ-মরি বাংলা ভাষা’ ইত্যাদি গান ভুবনমোহন হয়ে উঠলেও, রজনীকান্তের অসংখ্য গান ও কবিতাই রয়ে গেছে অশ্রুত কিংবা স্বল্পশ্রুত। অথচ রজনীকান্তের গানে বাণী ও ছন্দের যে মেলবন্ধন, সুরের যে অপূর্ব লয়, সর্বোপরি ভাবের যে গভীরতা, তা এককথায় অতুলনীয়। তার রচিত একটি কবিতার দুটো চরণ উদ্ধৃত করলে হয়তোবা তাকে চিনতে পারবেন সবাই। ছোটবেলায় পড়া ‘স্বাধীনতার সুখ’ নামের এ কবিতাটি বহুলপাঠ্য ছিলো একসময়-

“বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই-
কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?”

রজনীকান্ত সেনের জন্ম ১২৭২ বঙ্গাব্দের ১২ই শ্রাবণ, বুধবার ভোররাতে (২৬ জুলাই, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ)। রবীন্দ্রনাথের চার বছরের ছোট। অর্থাৎ তিনি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও সমসাময়িক কবি তিনি। রজনীকান্তের জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমাতে। তার মা মনমোহিনী দেবী সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন পেশায় ছিলেন আইনজীবী। তিনি বৈষ্ণব ব্রজবুলি ভাষায় রচিত প্রায় ৪০০টি বৈষ্ণব পদাবলির একটি সংকলন প্রকাশ করেন ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামে। এই ‘ব্রজবুলি’ নামের মিষ্টি কৃত্রিম কবি ভাষাটি মিথিলার কবি বিদ্যাপতি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে উদ্ভাবন করেন। কিন্তু, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে এসে সেই ভাষা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য তাঁর বিখ্যাত ‘ভানু-সিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ গ্রন্থে ব্রজবুলি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন।

কান্ত কবি রজনীকান্ত সেনের পরিত্যক্ত বসত ভিটা পাবনা; Source: জাতীয় তথ্য বাতায়ন- sirajganj.gov.bd

ছেলেবেলায় বেশ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন রজনী। সারাদিনের দুরন্তপনা শেষে পড়াশুনার ফুরসতই মিলত না তাঁর। অসম্ভব মেধার কারণে বরাবরই পরীক্ষায় ভালো ফল করতেন রজনীকান্ত। এ ব্যাপারে তাঁর নিজের ডায়েরিতে লেখা ভাষ্যমতে,

“আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই”।

ছোটবেলায় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে (তৎকালীন বোয়ালিয়া জেলা স্কুল) ভর্তি হন। কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ, কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ ও বিএল (ব্যাচেলর ইন ল’) পাস করেন।

রজনীকান্তের পিতা আইনজীবী হওয়ায় সংসারে স্বচ্ছলতা ছিলো। কিন্তু সাব-জজ পদে অধিষ্ঠিত হবার অল্প দিনের মাথাতেই অসুস্থতাজনিত কারণে অবসর নিতে বাধ্য হন গুরুপ্রসাদ সেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারে নেমে আসে দারিদ্র্যের কষাঘাত। বিএল পাশ করে রজনীকান্তও পিতার মতো আইন ব্যাবসায় নামেন। ইতোমধ্যেই তাঁর কাকা আইনজীবী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। ওকালতি পেশায় কাকার সুনাম আর গান-বাদ্যে নিজের নামযশের কারণে মক্কেল যোগাতে রজনীকান্তের বেগ পেতে হতো না। কিন্তু ক্রমেই তিনি গানে এতটা নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে, মক্কেলদেরকে তিনি সময় দিতে পারতেন না। ফলে, আইন ব্যবসায় তিনি আর খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারেননি। সে কথাও তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, বলেছেন, “আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসায় করিতে পারি নাই।”

রজনীকান্ত সেনের নিজের হস্তলিপি, আইন ব্যবসায় খুব একটা সুবিধে করে উঠতে না পারার স্বীকারোক্তি; Source: commons.wikimedia.org

রজনীকান্তের মা-বাবা দুজনই ছিলেন সঙ্গীতে যথেষ্ট দক্ষ। মা-বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তো বা ছেলেবেলা থেকেই গান-পাগল হয়ে ওঠেন তিনি। তবে ১৪ বছর বয়সে বন্ধু তারকেশ্বর চক্রবর্তীর সাথে- যিই কিনা খুব ভাল গান গাইতে পারতেন। সেখান থেকেই গানের প্রতি নেশাটা একেবারে হৃদয়ে গেঁথে যায় তাঁর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘কালীসঙ্গীত’ রচনা করে সংগীত সত্ত্বার পরিচয় দেন।

১২৯৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে প্রকাশিত ‘আশালতা’ নামের মাসিক একটি পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় রজনীকান্ত সেনের কবিতা। গান রচনায় অস্বাভাবিক দ্রুত গতিসম্পন্ন ছিলেন রজনীকান্ত। কলেজের কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন হলে পরে রজনীকান্তের ডাক পড়ত। রজনীকান্ত অনুষ্ঠানস্থলে এসে অনুষ্ঠান চলাকালীনই গান রচনা ও তাতে সুর সংযোজন করে তা গেয়ে আসর জমাতেন। তাঁর বিখ্যাত সব গানের বেশির ভাগই খুবই অল্প সময়ের মধ্যে রচিত। বিশিষ্ট সাংবাদিক জলধর সেন এরূপ একটি ঘটনার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন যে, রাজশাহী গ্রন্থাগারে একদিন বিকেল চারটায় এক সভার আয়োজন করা হয়েছে। তিনটার সময় রজনীকে অনুরোধ করা হয় গান লিখতে। রজনীকান্ত জলধর সেনকে অবাক করে দিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় একটি গান লিখে ফেললেন। এটি তাঁর অসামান্য জনপ্রিয় বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান-

“তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরনী সরসা,

ঊর্দ্ধে চাহ অগণিত-মনি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা

সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা৷”

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলনে বিলাতী সব পণ্য বয়কট করে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার প্রতি যে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, সে আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের মতো রজনীকান্তও সমর্থন দেন। রজনীকান্ত রচনা করেন-

“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;

দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।।”

তাঁর এই গানটি গণ-আন্দোলনে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জোয়ার সৃষ্ট করে। এর মাধ্যমেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন এবং কান্তকবি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখার দারুণ ভক্ত ছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নাটোর সফরে এলে তিনি পরম আগ্রহে তাঁর সাথে দেখা করেন। একসময় রজনীকান্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমপর্যায়ভুক্ত লেখা লিখতে শুরু করেন।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়- বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল, এঁর প্রভাবে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন রজনীকান্ত; Source: indichouse.com

এমনকি ডি. এল. রায়ের হাসির কবিতাগুলোও তাকে হাস্য রসাত্মক কবিতা ও গান রচনায় আগ্রহী করে তোলে। তাঁর ‘পুরাতত্ত্ববিৎ’ রচনায় লেখা একটি দেখতে পাই,

“রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি

টোডরমলের কটা ছিল নাতি,
কালাপাহাড়ের কটা ছিল ছাতি,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির 

আকবর শাহ কাছা দিত কিনা,
নূরজাহানের কটা ছিল বীণা,
মন্থরা ছিলেন ক্ষীণা কিম্বা পীনা,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।”

নীতিকবিতা রচনাতেও তাঁর জুড়ি নেই। জীবনের শেষ দিকে এসে অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ সঞ্চয়ে তিনি লিখে রেখে গেছেন নীত-আদর্শ সম্বলিত এই মহান নীতি কবিতাগুলো। বহুল পরিচিত দুয়েকটা উদ্ধৃত করছি,

“শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,

জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।”

কিংবা,

“নদী কভু নাহি করে নিজ জলপান

তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,

গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,

কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান”

রজনীকান্ত সঙ্গীতের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ঈশ্বর-ভক্তিমূলক গানগুলোর জন্যই। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম, বিশ্বাস ও আস্থা তাঁর গানগুলোতে প্রতিভাত হয়ে বাংলা গানকে গভীর দর্শন চিন্তায় স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। জীবনের সমস্ত আনন্দগুলোতে তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করেছেন। গভীর সংকটে যখন তিনি নিপতিত হয়েছেন, একে ঈশ্বরদত্ত আশীষ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবার উদ্দেশ্যে বিনয়ের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে বারবারই নিজেকে দীন-হীন ভাবে উপস্থাপন করেছেন রজনীকান্ত। তাই, তাঁর রচিত ভক্তিমূলক নানা গান প্রার্থনারূপে উপাসনালয়গুলোতে আজও গীত হয়।

মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন রজনীকান্ত। ছোটবেলাতেই তাঁর বড় ভাই ও বড় বোনের অকাল প্রয়াণ ঘটে। ছোট ভাই জননীকান্তও জলাতংক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই সকল মৃত্যু তাঁকে গভীর জীবনবোধে উজ্জীবিত করতে ভূমিকা রাখে।

ব্যক্তিগত জীবনে রজনীকান্ত সেনের সাথে হিরন্ময়ী দেবীর বিয়ে হয়। তাঁদের সংসারে চার পুত্র ও দুই কন্যা। কিন্তু ভূপেন্দ্র খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। এই মৃত্যুতে রজনীকান্ত গভীর ব্যথায় আহত হন, কিন্তু হতাশ হন না। বরং ঈশ্বরের উপর অগাধ বিশ্বাসে রচনা করেন—

“তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷
তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব৷”

কন্যা শতদলবাসিনীর মৃত্যুতেও তাঁর আক্ষেপ জাগে না, জাগে না এতটুকু অভিমান। ঈশ্বরের প্রতি প্রশস্তি জ্ঞাপন করে লিখেন বিখ্যাত সেই গান-

“আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি।।”

পরম বিনয়ের গুণে নিজের সমস্ত আরাধনা-উপাসনাকে তিনি সর্বদাই অপ্রতুল মনে করতেন রজনীকান্ত। তাই তাঁর পরম প্রার্থনা-

“তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে;

তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে প্রথম পরিচয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভা উপলব্ধি করতে পারেন। পরে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে বেরিয়েও আসেন একদিন রজনীকান্ত। উল্লেখ্য, রজনীকান্তের জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ কবি মহলে যথেষ্ট নিন্দিত ও তিরস্কৃত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন রজনীকান্তের মৃত্যুর কয়েক বছর পর। গৌরবহীন সেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত কদর রজনীকান্ত যথার্থতার সাথেই করতেন। রবীন্দ্রনাথও রজনীকান্তের প্রতিভায় ছিলেন অভিভূত।  

স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেশাত্নবোধক গান রচনা এবং অসাধারণ সব প্রার্থনাসঙ্গীত রচনা করে আর জলসায় জলসায় গান গেয়ে যখন রজনীকান্ত পরিচতি পেতে লাগলেন, কিছুটা নাম-যশ পেয়ে উঠলেন, তখনই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর কণ্ঠনালীতে প্রদাহ দেখা দেয়। পরে চিকিৎসকেরা তাঁর কণ্ঠনালীতে ল্যারিঙ্কস্‌ ক্যানসার সনাক্ত করেন।

এত বড় অভিঘাতেও সামান্য বিচলিত হলেন না। পরম প্রিয় ঈশ্বরের কাছে জানালেন সুস্থতার আবেদন। কিন্তু সে আবেদন গ্রাহ্য না হলেও এতটুকু খেদ নেই বিধাতার প্রতি। তাঁর বরং মনে হলো, এই সব দুঃখ বেদনার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর তাঁকে পরিশুদ্ধ করছেন।  

ক্যান্সার গুরুতর আকার ধারণ করায় চিকিৎসাতে কোন কাজ হচ্ছিল না। চিকিৎসকেরা জানান, বিলেত থেকে রেডিয়াম এনে থেরাপি প্রয়োগ করলে তবেই সুফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ হওয়ায় সেই পদ্ধতি অবলম্বন করা সম্ভব হয়নি। আরোগ্যের আশায় দুটি বইয়ের সত্ব বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তাঁর কণ্ঠনালীতে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয় না, বরং অবস্থা জটিল হয়ে চিরতরে বাকশক্তি হারান এই কবি। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিদারুণ কষ্ট ও শোকের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছেন রজনী। তবে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলেও তিনি নির্বাক অবস্থায় ক্রমাগত লিখে চলছিলেন নানান নীতি কাব্যগাথা আর ভক্তিমূলক সংগীত। 

তিনি এ সময় রবীন্দ্রনাথকে একবার দেখতে চান। হাসপাতালের বাজে পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের ছিলো চরম অস্বস্তি। তা সত্ত্বেও, রজনীকান্তের অনুরোধ জানতে পেরে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান রবীন্দ্রনাথ। সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজে হারমোনিয়াম বাজান আর গান ধরেন রজনীকান্তের সন্তান ক্ষিতীন্দ্র ও শান্তিবালা। রবীন্দ্রনাথের বিদায়ের পর এই অনুভূতির প্রেক্ষিতেই তিনি রচনা করেন,

“আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চুর,

তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর।

ঐগুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে,

তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছে দীন আতুর।”

রজনীকান্তের এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের বোলপুরের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।

বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, পঞ্চকবিদের প্রধান শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; রজনীকান্ত সেনের সাথে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গভীর সখ্য ছিলো; Source: peopletimes24.com

রবীন্দ্রনাথ আপ্লুত হন গানটির বাণী পড়ে। চিঠির প্রতি-উত্তর দিয়ে দীর্ঘ পত্র লেখেন রবীন্দ্রনাথ,

“প্রীতিপূর্বক নমস্কারপূর্বক নিবেদন, সেদিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাইণ্ড পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই। আপনি যে গানটি পাঠাইয়াছেন, তাহা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।”

১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০ সালে (১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৮শে ভাদ্র)  মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কলকাতা মেডিকেল কলেজের কটেজ ওয়ার্ডেই এই মহান কবি পরলোক গমন করেন। তাঁর মহাপ্রয়াণের পরও তাঁর বংশধরেরা পূর্ববঙ্গেই দীর্ঘদিন বসবাস করেন। কবির নাতনি রমা সেন ভারতে চলে যান এবং ‘সুচিত্রা সেন’ নাম নিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক শক্তিমতী অভিনেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন।

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন, রজনীকান্ত সেনের নাতনী রমা সেন; Source: google.com

রজনীকান্তের জীবদ্দশায় তাঁর তিনটি বই প্রকাশিত হয়- ‘বাণি’, ‘কল্যাণী’, ‘অমৃত’। আর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় পাঁচটি গ্রন্থ- ‘অভয়া’, ‘আনন্দময়ী’, ‘বিশ্রাম’, সদ্ভাবকুসুম ও শেষদান। এসব গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর গানগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, প্রীতিমূলক ও  হাস্যরসাত্মক গান।

কবির নাতনী সূচিত্রা সেনের পাবনায় অবস্থিত পৈতৃক নিবাস; Source: প্রথম আলো

কন্যা শান্তিবালা দেবীর দেওয়া তথ্যানুসারে, তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০টি। তবে তাঁর অসংখ্য গান হারিয়ে গেছে বলেই জানা যায়। রজনীকান্ত সেন গান লিখে উদাসীনভাবে সেগুলো ফেলে রাখতেন। কিন্তু যখন গাইবার দরকার পড়তো, তখন সেগুলো খুঁজে পেতেন না। এজন্য সহধর্মিনী হিরন্ময়ী দেবী এগুলো যখনই এখানে সেখানে পেতেন, সেগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে রাখতেন। কিন্তু সব তো আর পাওয়া যায়নি। তাই, তাঁর রচিত গানের প্রকৃত সংখ্যা আসলে কত, তা ঠিক আঁচ করা যায় না।

২০১৫ সালে উদযাপিত হয় তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী। ঢাকায় ছায়ানট আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ৯৮ বছর বয়সী কবি দৌহিত্র দিলীপ কুমার রায়।

ছায়ানটে রজনীকান্ত সেন স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান গাইছেন দিলীপ কুমার রায়; Source: prothomalo.com

কর্কট রোগের মত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও ঈশ্বরের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে যেসব অশ্রুতপূর্ব গান রচনা, সেগুলোই ছিলো তাঁর শেষ দিনগুলোর অনিঃশেষ প্রাণশক্তির উৎস। তাঁর গান, তাঁর কাব্য, তাঁর নীতিকবিতাগুলো পাঠে প্রতিটি বাঙালি পাঠকই এক অনিঃশেষ প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠেন। এ বছর তাঁর ১৫৩তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর সৃষ্টিশীল রচনাগুলোকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

তথ্যসূত্র

১) কবি আসাদ চৌধুরী রচিত জীবনীগ্রন্থ ‘রজনীকান্ত সেন’ (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৯)

২) রবির জীবনে মৃত্যুশোক ; অঞ্জন আচার্য ; প্রকাশনী- আত্মজা পাবলিশার্স; কোলকাতা।

৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস; মাহবুবুল আলম; প্রকাশকঃ খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি (প্রথম প্রকাশ: ২০০০); দ্বাদশ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৫৮৫

ফিচার ইমেজ- en.banglapedia.org

Related Articles