Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মৃত্যু ও শোকের কবি ফিলিপ লারকিন

জন্মের ক্ষণ থেকেই মৃত্যুর দিকে পথচলা শুরু হয়ে যায় তার। জীবনের সুসংবাদের মধ্য দিয়ে হয় সকল দুঃখের সূচনা। প্রতিটি জীবনই এক মহাসত্যের দিকে নিয়ত ধাবমান, প্রাণের প্রতিটি অস্তিত্বই একই পরিণতিতে শেষ হয়েছে, হবে। এই পরিণতি হলো প্রাণের ধ্বংস, জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য তো মৃত্যুই।

জীবন আর মৃত্যুর মাঝের এই সময়টুকু নিয়েই আমাদের যত আয়োজন, যত আনন্দ। তাহলে কি সব আনন্দের মাঝেই বেদনার গভীর সুর বাজে? একটু ভেবে দেখলেই কি সমস্ত আয়োজনের মাঝে পাওয়া যায় সমাপ্তির আভাস? মানুষের জীবনের এই অসহায় সমাপ্তি আর মৃত্যু যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে কেটে আসছে গভীর দাগ, জীবনের অক্ষয় এই সত্য ভাবিয়ে তুলেছে মানুষকে। মানব জীবনের সকল আনন্দ-সুখের সাথে মানুষের সকল বেদনা, অশ্রু আর অসহায়ত্বের ছবি সবচেয়ে বেশি যেখানে আঁকা হয়, সে হলো সাহিত্যের পাতা।

তবে সুখ আর আনন্দের চেয়ে জীবনের দুঃখ, বেদনা আর অন্তিম পরিণতির চরম অসহায়ত্বই যেন কবি ও লেখকদের চিরকাল ভাবিয়ে তুলেছে বেশি। তাদের সংবেদনশীল মন অশ্রুতে পীড়িত হয়েছে সহজেই। আজ আমরা এমনি এক কবির গল্প শুনবো, সেই শিশুকাল থেকে যিনি বুঝেছিলেন এই আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের নির্বিশেষ নিষ্ফল ধ্বংসের সত্য, ভেবেছিলেন জীবনের সমস্ত আয়োজনের সীমাবদ্ধতাকে নিয়ে আর কলমের আঁচড়ে মানুষের ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিলেন নিজের সৃষ্টিশীল সাহিত্যপ্রতিভা দ্বারা। নিজের পুরো জীবন ধরে মৃত্যুর জয়গান ঘোষণা করা এই কবির নাম ফিলিপ লারকিন।

একাকী ও নিভৃতেই শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন কবি লারকিন; source: independent.co.uk

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেসময়কার ইংরেজি সাহিত্যাঙ্গনে যখন তাঁর সময় ও নিকট অতীতের কবিরা আধুনিক পৃথিবী ও মানব জীবনের জয়ধ্বনি করতে ব্যস্ত, তখন তিনি মৃত্যুর চরম সত্য ও মানব জীবনের সীমাবদ্ধতা আর অসহায়ত্বকে সামনে রেখে সৃষ্টি করেন সাহিত্যের নতুন এক অধ্যায়। খুব ছোটবেলা থেকে নিঃসঙ্গতা আর উদাসীন মন জীবনের গভীরতম বিষয়গুলো নিয়ে ভাবাতে শেখায় তাঁকে। দৈনন্দিন জীবনের একঘেঁয়েমিতা থেকে মুক্তি পেতে জীবনের সার্থকতার সন্ধান করতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু সব শেষে খুঁজে পান মৃত্যুর গাঢ় অন্ধকারে জীবনের অন্তিম সমাপ্তি। মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে স্বর্গ- নরকের আশা ও প্রতিশ্রুতির হাজারো ধর্মীয় বাণী শান্ত করতে পারেনি তাঁর মন। তাঁর প্রশ্নবিদ্ধ হৃদয় ধর্মীয় নানা প্রতিশ্রুতির নিশ্চয়তা খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে বারবার। তাই তো মাত্র পনেরো বছর বয়স থেকে আমৃত্যু তিনি মৃত্যু আর ধ্বংসের কালো পাতায় মানবের বেদনা আর অসহায়ত্বের অক্ষরে লিখে গেছেন অসাধারণ সব কবিতা।

ফিলিপ অার্থার লারকিন ১৯২২ সালের ৯ আগস্ট ইংল্যান্ডের কনভেন্ট্রি রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম সিডনি লারকিন, তিনি ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। মায়ের নাম ইভা লারকিন। বড় বোন ক্যাথরিনের জন্মের দশ বছর পর জন্মগ্রহণ করা ফিলিপের নাম রাখা হয় রেঁনেসার কবি ফিলিপ সিডনির নামানুসারে। বড় বোনের সাথে হেসে-খেলে ও বাবা-মায়ের স্নেহ ও নিরাপত্তার মাঝে ফিলিপ বেড়ে উঠলেও ছোটবেলা থেকেই একাকিত্ব, উদাসীনতা আর গৎবাঁধা জীবনের প্রতি বিরক্তি গ্রাস করে তাঁকে। তাই যে শৈশবের স্মৃতিচারণ তিনি করতে পারতেন আনন্দের সাথে, সেই ছোটবেলার কথা তিনি কদাচিৎ উল্লেখ করেছেন তাঁর পরবর্তী জীবনে ও আত্মজীবনীতে।

জন্ম থেকেই জীবনের সমস্ত আয়োজনের প্রতি বিতৃষ্ণা শুরুতেই ছাপ ফেলে তাঁর শৈশবে। তাই তো নিজের কবিতাতেই তিনি নিজের ছেলেবেলার কথা বলতে গিয়ে ‘এক ভুলে যাওয়া বিষণ্ণতা’র মতো শব্দগুলোকেই বেছে নিয়েছেন। বড় হয়ে এই বিষণ্ণতাকেই কালিতে ঢেলে তিনি সৃষ্টি করেন এক অনবদ্য কবিতার সম্ভার।

জীবনের প্রারম্ভে ফিলিপ লারকিন; source: greetar.co.uk

অধিকাংশ ইংরেজ কবির মতো লারকিনও পার করে আসেন এক বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন। কনভেন্ট্রিতে রাজা অষ্টম হেনরি গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। সেসময় ইংল্যান্ডে শিক্ষার জন্য গ্রামার স্কুলগুলো ছিলো সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও উচ্চবিত্তদের প্রথম পছন্দ। স্কুল শেষ করে ১৯৪০ সালে তিনি পা দেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৪৩ সালে সম্মান শেষ করেন।

স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের এই সময়টাতে তিনি শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হন। তাঁর বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে কলার অনুরাগী বিভিন্ন গুণী ব্যক্তির সাথে। স্কুলে থাকতে তাঁর বন্ধুত্ব হয় জিম সাটন নামের এক ব্যক্তির সাথে। পরবর্তীতে এই ব্যক্তি একজন প্রসিদ্ধ চিত্রকর হিসেবে পরিচিত হন। অক্সফোর্ডে কিংসলে অমিস, অ্যালান রাস প্রভৃতি সাহিত্যানুরাগী ও গুণী ব্যক্তির সাথে তাঁর বন্ধুত্ব তাঁকেও নিজ সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী ও ব্রতী করে তোলে। লেখনির প্রতিভা তাঁর মাঝে পনেরো বছর বয়স থেকেই উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবিত অক্সফোর্ডের পরিবেশ তাঁর এই প্রতিভাকে আরো উন্নত, ফলপ্রসূ ও প্রস্ফুটিত করে তোলে।

ছোটবেলা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লারকিন আর সবার থেকে আলাদা একজন মানুষ ছিলেন। নিঃসঙ্গতাপ্রিয়, ঘরকুনো এই মানুষটিকে যেন বয়সের আগেই পেয়ে বসেছিলো বার্ধক্য, আর জীবনের ভারাক্রান্ত যত চিন্তা। কিন্তু তাই বলে তাঁর জীবন কিন্তু নারীপ্রেমহীন কাটেনি। বারবার পৃথক পৃথক নারীর সংস্পর্শে তিনি এসেছেন, তাঁদের প্রতি মুগ্ধ হয়েছেন, তাঁদের প্রেমে মশগুল থেকেছেন। কিন্তু জীবনের প্রতি উদাসীন  লারকিন কোনো নারীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। জীবনের এই অংশটাতেও তাঁর নিজস্বতা ছিলো লক্ষ্য করার মতো। অনেক বেশি মদ্যপান করার পাশাপাশি পর্নোগ্রাফিক চিত্রশিল্পের প্রতিও তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিলো। স্বদেশের প্রতি তাঁর ছিলো গভীর মমতা আর নিজের সাহিত্যের প্রতি ছিলো অন্ধ ভালোবাসা ও অহংকার। মনে হয়, এই অহংকার থেকেই তিনি নিজেকে অন্য সকল দেশের সাহিত্য থেকে দূরে রাখেন, যার মধ্যে ছিলো আধুনিক আমেরিকান সাহিত্যও।

প্রিয়জনদের মৃত্যুতে পীড়িত, রোগে-শোকে-বার্ধক্যে মানুষের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জ্ঞাত লারকিনের প্রতিটি কবিতাতেই যেন রয়েছে কবি-হৃদয়ের গভীর যাতনার ছাপ। যদিও কবিতাই তাঁকে স্বীকৃতি ও খ্যাতি এনে দিয়েছে, কিন্তু সাহিত্যাঙ্গনে তিনি প্রথমে উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘জিল’ ও ‘এ গার্ল ইন উইন্টার’ নামের দুটি উপন্যাস লেখার পর তৃতীয় উপন্যাসের সম্পূর্ণ রূপদান করতে তিনি ব্যর্থ হন। হাত দেন কবিতা লেখার কাজে।

এই কবিতার জগতেই তাঁর প্রতিভা সর্বোচ্চ বিকাশ লাভ করে। ১৯৪৫ সালে তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘দ্য নর্থ শিপ’ প্রকাশিত হয়। এরপর একের পর এক প্রকাশিত হয় ‘দ্য লেস ডিসিভড’, ‘দ্য হুইটসন ওয়েডিংস’ ও ‘হাই উইন্ডোজ’। দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তিনি সাহিত্যজগতে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘হাই উইন্ডোজ’ এর অনন্যতা ও সৃষ্টিশীল গভীরতা লারকিনকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইংল্যান্ডে তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত কবি। ‘কুইন্স মেডেল’সহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিয়ান। তবে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে তিনি কাজ করেছিলেন হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে।

মৃত্যু আর জীবনের সীমাবদ্ধতাই ছিলো তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য; source: youtube.com

জীবনকালে যেমন এই দুঃখের কবি মানুষের দৃষ্টির আড়ালে, নিভৃতে থাকা পছন্দ করতেন, তেমনি তিনি ছিলেন নিজের মৃত্যুতেও। মধ্যবয়স থেকেই ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে দফায় দফায় তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়। একসময় সেরে উঠলেও কয়েক বছরের মধ্যে আবার স্বাস্থ্যজনিত জটিলতায় ভুগে ১৯৮৫ সালের ২রা ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কবিতায় যে মৃত্যুর কথা তিনি বারবার বলে যান, শেষপর্যন্ত সেই মৃত্যুতেই তাঁর সমাপ্তি ঘটে।

মৃত্যুর সাথে শেষ হয় এই কবির জীবনের গল্প; source: Westminster-abbey.org

ফিচার ইমেজ: telegraph.co.uk

Related Articles