Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পুলক বন্দোপাধ্যায়: বাংলা গানে যিনি দিয়েছিলেন আধুনিক কাব্যের ছোঁয়া

১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখের পড়ন্ত বিকেল। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদীর একটি শাখা নদী ‘হুগলি’। নদীর দু’পাড়ে পারাপার হয়ে চলেছে অগণিত মানুষ। কর্মব্যস্ত নদীর ঘাট। সেই ঘাটের একপাশে দাঁড়িয়ে পরবর্তী লঞ্চের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন পুলক বাবু। একসময় যাত্রীবাহী একটি লঞ্চে উঠে পড়লেন তিনি। ডেকের পাশে একটি খালি বেঞ্চিতে বসে পড়লেন। ধীরে ধীরে ছোট লঞ্চ নোঙ্গর তুলে যাত্রা শুরু করে।

হুগলি নদীর উপর বয়ে চলেছে যাত্রীবাহী লঞ্চ; Image Source: zeenews.india.com

লঞ্চের সাথে সাথেই শুরু হয় পুলক বাবুর মনের মধ্যে উথাল পাথাল ঢেউ। নিজের জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষতে থাকেন মনে মনে। সময় খুব কম, তাই হিসেব শেষ করতে হবে দ্রুত। লঞ্চ নদীর মাঝামাঝি চলে এসেছে তখন। পুলক বাবুর জীবনের হিসেবেটাও তখন প্রায় শেষের দিকে। ফলাফলের বিচারে প্রাপ্তির চাইতে হারানোর বেদনায় যেন বেশি মনে হল পুলক বাবুর। আর সেই দুঃসহ জীবন থেকে ছুটি পেতে চাইলেন এক বুক যন্ত্রণাকে আলিঙ্গন করে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন মাঝনদীতে। চারপাশ থেকে হইহই করে সরব উঠল যেন। তখনো হয়তো অনেকেরই জানা ছিল না, আমরা হারালাম বাংলা সংগীত জগতের এক অসামান্য দিকপাল, গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায়কে।

পুলক বন্দোপাধ্যায়; Image Source: alchetron.com

১৯৩১ সালের ২ মে হাওড়ায় জন্মগ্রহণ করেন পুলক বন্দোপাধ্যায়। পিতা কান্তিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী। ছবি আঁকতেন, বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, গান গাইতেন আর কবিতা লিখতেন। তাই খুব ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি হয় পুলক বন্দোপাধ্যায়ের। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় বন্ধুদের অনুরোধে একটি ছড়া লিখে পাঠিয়ে দিলেন একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিনে। সেবছরের পূজাবার্ষিকীতে সেই ছড়া ছাপা হলো। সম্মানী হিসেবে পেলেন পাঁচ টাকা। সেই থেকে লেখালেখিতে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে লাগলেন।  দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় ‘অভিমান’ ছবির জন্য প্রথম গান লেখেন। ছবির পরিচালক ‘রামচন্দ্র পাল’ গানের লেখককে দেখে বিশ্বাস করতে চাইলেন না গানগুলো এই অল্প বয়সী ছেলের লেখা। শেষটাতে পরিচালকের সামনে বসে গান লিখে প্রমাণ দিতে হলো পুলক বাবুকে।

বাংলা সংগীতের জনপ্রিয় গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায়;  Image Source: alchetron.com

কলেজ জীবনের শুরুতেই ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার লেখা প্রথম গল্প। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও অল্প দিনের মধ্যেই গীতিকার হিসেবেই সুপরিচিত হতে লাগলেন পুলক বাবু। বিভিন্ন  পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ও তাৎক্ষণিক শব্দচয়নে গান লিখে ফেলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল পুলক বন্দোপাধ্যায়ের।

একবার পূজোর গান নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে গেলেন পুলক বাবু। হেমন্ত পুলকবাবুকে দেখে বললেন, “পুলক, কতদিন পরে এলে; একটু বসো।” আর সেই কথাটাই যেন পুলক বাবুর মনের মধ্যে গেঁথে গেল। হেমন্ত বাবু চোখের আড়াল হতেই খাতা কলম নিয়ে লিখে ফেললেন জনপ্রিয় সে গান।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাথে পুলক বন্দোপাধ্যায়; Image Source: anandabazar.com

হেমন্তবাবুর কন্ঠে উত্তম কুমারের কতো যে গান জনপ্রিয় হয়েছে তা বলে শেষ করার নয়। তবে উত্তম কুমার অভিনীত ছবি ‘শঙ্খবেলাতে’ পরিচালক সরোজ দে চাইছিলেন নতুন কাউকে দিয়ে গান গাওয়ানোর জন্যে। সেসময় পুলক বাবুর সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল মান্না দে’র। পুলকবাবুর আগ্রহে সেই চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো উত্তম কুমারের লিপে কন্ঠ দিয়েছিলেন মান্না দে। গানটি ছিল “কে প্রথম কাছে এসেছি, কে প্রথম ভালো বেসেছি” যে গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম হাজারো প্রেমিক প্রেমিকার প্রিয় মুহূর্তের কথাটাই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়।

মান্না দে’র সাথে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের সাথে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। একবার এক অনুষ্ঠানে ভূপেন হাজারিকা মান্না দে-কে বললেন, “মান্না, কী করে তুমি এত সুন্দর করে গান গাও বলো তো?” উত্তরে মান্না দে বিনয়ের হাসি হেসে বললেন, “এই জীবনে যদি পুলকের জন্ম না হতো তাহলে মান্না দে’রও জন্ম হতো না”। মান্না দের জন্য অসংখ্য জনপ্রিয় গান লিখেছেন পুলক বাবু। মান্না দের বাড়িতে গিয়ে পুলক বাবু দেখলেন বন্ধু রান্নায় ব্যস্ত। তখন তিনি বসার ঘরে এসে কাগজে কিছু লিখে ফেললেন। মান্না দে কাছে আসতেই পড়ে শোনালেন সে লেখা। পরবর্তীতে ‘প্রথম কদমফুল’ ছবিতে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে মান্না দে গেয়েছিলেন “আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না”।

মান্না দে’র সাথে পুলক বন্দোপাধ্যায়; Image Source: anandabazar.com

পুলক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন মোহনবাগানের একনিষ্ঠ সমর্থক। সময় সুযোগ পেলেই চলে যেতেন মাঠে খেলা দেখতে। একদিন মাঠে বসে খেলা দেখছেন, হঠাৎ মাথায় চলে এলো কয়েকটা লাইন- “হৃদয়ের গান শিখে তো গায় সবাই”।

একবার এক রেস্টুরেন্টে বসে খাবারের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে খানিকটা বিরক্ত হয়ে হাতের কাছের ন্যাপকিনটা তুলে নিয়ে লিখে ফেললেন, “রঙ্গিলা পাখিরে কে ডাকে, ঘুম ঘুম নির্ঘুম রাতের মায়া”। লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে গাওয়া গানটি অল্প দিনের মধ্যেই অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কিশোর, হেমন্ত ও লতার সাথে পুলক বন্দোপাধ্যায়; Image Source: thequint.com

সুরকার নচিকেতা ঘোষের সাথে দূরালাপনে কথা বলতে বলতে হথাৎ বলে উঠলেন “ক’ফোটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি, ভালোবাসবে”। নচিকেতা ঘোষ তখনই তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন স্টুডিওতে আর তৈরি করলেন কালজয়ী সেই গান।  

মান্না দে’র সাথে খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল পুলক বাবুর। দুজনে একসাথে বসে যে কত অসাধারণ গান সৃষ্টি করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। মান্না দে আর পুলকবাবু গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলেন। মান্না দে একটি ঠুমরি গুনগুন করতে লাগলেন। পুলকবাবু সেই সুরের উপর লিখে ফেললেন “ললিতা গো, ওকে আজ চলে যেতে বল না”। একটি কাওয়ালি গান খুব ভালো লেগে গিয়েছিল পুলক বাবুর। মান্না দে’কে জিজ্ঞেস করলেন কাওয়ালির কথাগুলোর ভাবটা বুঝিয়ে দিতে। মান্না দে এককথায় বোঝালেন, কার এত বড় সাহস যে আমাকে পাগল বলবে?। ব্যস, ও আচ্ছা বলেই পুলক বাবু লিখে ফেললেন তার আরেক অমর সৃষ্টি “যখন কেউ আমাকে পাগল বলে”।

মান্না দে’র সাথে হাস্যোজ্জল পুলক বন্দোপাধ্যায়; Image Source: blogus-abogusblog.blogspot.com

অসংখ্য গানের গীতিকার এই পুলক বন্দোপাধ্যায়। সঠিক কোনো হিসেব না থাকলেও ধারণা করা হয় তিন হাজারেরও বেশি সংখ্যক গানের সৃষ্টিকার এই পুলক বাবু। গানের জগতে অনেক বড় বড় শিল্পীর সাথে কাজ করেছেন পুলক বাবু। রবিশঙ্কর, নৌসাদ, আলী আকবর খান, লতা, আশা, কিশোর কুমার, রফি, তালাত মাহমুদ, মুকেশ, গীতা দত্ত, আর ডি বর্মণ, বাপ্পী লাহিরী, যতিন ললিত, তরুণ বন্দোপাধ্যায়, হৈমন্তি শুকলাসহ আরো অনেকে। সঙ্গীতাঙ্গনে আজকের অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর জন্য নেপথ্যে অনেক কাজ করে গেছেন পুলক বাবু। কিন্তু কখনো কারো কাছে কোনো প্রতিদান চাননি। গান লেখার প্রতি যেমন ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা, অর্থ সম্পদের প্রতি ছিলেন তেমন উদাসীন। কখনো কোনো লেখার জন্য কোনো অর্থ দাবি করতেন না। পারিশ্রমিক হিসেবে যা পেতেন তাতেই খুশি থাকতেন।

Image Source: youtube.com

লেখালেখির পাশাপাশি লেখাপড়াতেও বেশ ভালো ছিলেন পুলক বাবু। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হবার পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু লেখার মাদকতা যখন পেয়ে বসল, তখন বিচার বিভাগের চৌকাঠ পেরোনোর কথা ভুলেই গেলেন।

পুলক বন্দোপাধ্যায়ের গানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। অসংখ্য জনপ্রিয় সব গানের রচয়িতা তিনি। আধুনিক রোমান্টিসিজমের ভাবাবেগকে তুলে ধরেছেন তার কলমের অসাধারণ চিত্রকল্পে। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে গীতিকার হিসেবে যেন মোটেও আত্মতৃপ্ত ছিলেন না পুলক বাবু। হতে চেয়েছিলেন কবি, লিখেছিলেনও কবিতা। কিন্তু সেসব লেখা কী করে জানি গানে রূপ নিল। পুরো সমাজ তাকে গীতিকার হিসেবে আখ্যা দিল। আর যেন কবি হয়ে উঠতে পারলেন না তিনি। আধুনিক কবি সমাজের বিজ্ঞ কবি বোদ্ধারা যেন গীতিকারদের কবি পরিচিতি দিতে নারাজ। তাই পুলক বন্দোপাধ্যায় তার আত্মজীবনী ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’তে এই আক্ষেপের কথা অনেকবার লিখে গেছেন।

গান তৈরিতে ব্যস্ত মান্না দে, পুলক বন্দোপাধ্যায় ও তাদের দল; Image Source: calcuttayellowpages.com

আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ যে সময়টিকে ধরা হয়, যে সময়টিতে বাংলার অসংখ্য শক্তিশালী সংগীতশিল্পীর জন্ম, যে সময়টিতে তৈরি হয়েছে কালজয়ী সব গান, তেমনই এক সময়ে জন্মেছিলেন এই প্রতিভাবান গীতিকার ও কবি পুলক বন্দোপাধ্যায়। বাংলা গানের জগতে তার অবদান সুদূরপ্রসারী। কিন্তু কোনো এক না পাওয়ার ক্রন্দন বারবার বিরহে কাতর করে তুলেছে পুলক বন্দোপাধ্যায়কে। তাই হয়তো এক গভীর অভিমানে বিদায় নিয়েছিলেন সকলের অগোচরে, নিজেই নিজের আত্মহননে।

ফিচার ছবি: youtube.com

Related Articles