বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্ধকার যুগ কি আসলেই ছিল?

প্রবহমান নদী যেমন বহু চরাই-উৎরাই পেরিয়ে সাগরে গিয়ে মিলিত হয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ব্যাপারখানাও ঠিক তেমনই। সে শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে আসা অতিথি পাখির মতো এমনি এমনি আসেনি। তাকে বহু চর্যাপদ আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কলকাঠি নাড়িয়ে আজকের আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করতে হয়েছে।

বাংলা সাহিত্য জীবনী] ১৮ শতকের অন্যতম কিছু কবিদের নিয়ে – পর্ব ১ – Site Title
বাংলা সাহিত্য চলেছে বন্ধুর পথ; Image Source: Boi Bazar

ইতিহাসের পাতা ভেদ করে আমরা যদি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাব, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ দাঁড়িয়ে আছে একখানা চর্যাপদের উপর। ১৮৮২ সালে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল’ গ্রন্থে চর্যাপদের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ উদ্ধার করেন। সেটি আবার ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। মূলত চর্যাপদ ছিল বৌদ্ধ সহজিয়া গূঢ় সাধনতাত্ত্বিক নিদর্শন।

এ তো গেল বাংলা সাহিত্যের ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রাচীন যুগ। এরপর ১৩৫০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যযুগ। মাঝখান দিয়ে ১২০১ থেকে ১৩৫০, অর্থাৎ ১৫০ বছর সময়টাকে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার কিংবা তামস যুগ। কেউ কেউ তো আবার এই সময়টাকে ইউরোপের ‘দ্য ডার্ক এজ’-এর সাথে তুলনা করেন।

মূলত তেরো শতকের গোড়ার দিকে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর হতে চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগে ইলিয়াস শাহী বংশের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে বাংলা সাহিত্যের জন্য অন্ধকার যুগ ছিল। এর কারণ হিসেবে ধরা হয়, সে সময়ের শাসকদের ধর্মান্ধতা, পীড়ন, লুণ্ঠন, হত্যাষজ্ঞ ইত্যাদিকে। ফলে, কেউ সাহিত্য রচনার প্রেরণা কিংবা স্বাধীনতা পাননি। আর এ কারণে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের প্রারম্ভেই ‘অন্ধকার যুগ’ কথাটার সৃষ্টি হয়।

তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খলজি
তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খলজি; Image Source: jbsgarage.wordpress.com

তবে কোনো কোনো পণ্ডিত বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেন। তাদের মতে, সে সময়ে খুব অল্প হলেও সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। তাই একেবারে অন্ধকার যুগ ধরে নেওয়াটা অসমীচীন।

প্রথমেই আমরা অন্ধকার যুগকে স্বীকৃতি দানকারী কিছু পণ্ডিতের মতামত তুলে ধরব। এবং এরপর এই অন্ধকার যুগের বিপরীতে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরার পর, সে যুগের কিছু সাহিত্য নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করব।

ড. সুকুমার সেনের মতে,

“মুসলমান অভিযানে দেশের আক্রান্ত অংশে বিপর্যয় শুরু হয়েছিল।”

গোপাল হালদার এ সম্পর্কে বলেন,

“তখন বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি আঘাত ও সংঘাতে অরাজকতায় মূর্ছিতা এবং অবসন্ন হয়েছিল। খুব সম্ভবত সে সময় তাই কেউ কিছুই সৃষ্টি করার প্রেরণা পায়নি।”

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্’র মতে,

“এ পর্যন্ত যুদ্ধবিগ্রহে বাংলাদেশ নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। সেজন্য সাহিত্যচর্চা নামেমাত্র ছিল। বস্তুত মুসলমান কাল হইতে এই সময় বাংলা সাহিত্য আমাদের হস্তগত হয় নাই। আমরা এই ১২০১ থেকে ১৩৫২ সময়টাকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার কিংবা যুগসন্ধিক্ষণ বলতে পারি।”

ভূদেব চৌধুরীর মতে,

“বাংলার মাটিতে রাজ্যলিপ্সা, যুদ্ধ, আততায়ীর হাতে মৃত্যু, নারকীয়তার যেন সীমা ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর জনসাধারণের জীবনেও উৎপীড়ন, লুণ্ঠন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ধর্মহানির সম্ভাবনা উৎকট হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই জীবনের এই বিপর্যয় লগ্নে কোনো সৃজনশীল কর্ম সম্ভব হয়নি।”

বিপরীত যুক্তি 

১) প্রকৃতপক্ষে মুসলমান শাসকগণ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের চর্চা বিঘ্নিত করেননি, বরং পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। তা না হলে মুসলিম বিজয়ের ২/৩ বছর পরেই ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীধর দাস কর্তৃক সম্পাদিত ‘সদুক্তবর্শামৃত’ নামক কবিতা সংকলনটি বের হতে পারত না। কেননা এই সংকলনটিতে রয়েছে ৪৮৫ জন কবির ১২৭০টি কবিতা। আর কোনো নিরাপদ আশ্রয় ব্যতীত কবির পক্ষে এরূপ কাজ করা সম্ভব নয়।

২) মুসলমানদের উৎসাহের ফলে বাংলা সাহিত্য যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। কারণ ব্রাহ্মণবাদীরা বাংলা ভাষা প্রচারে যে নিষেধাজ্ঞা উচ্চারণ করেছিলেন, তাতে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাহীন হয়ে পড়ে। মুসলমান শাসকগণ বাংলা সাহিত্যকে যে দুর্দিন থেকে উদ্ধার করেন, সেটার গুরুত্ব বিবেচনা করেই ড. দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেছিলেন,

“আমাদের বিশ্বাস মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয়ই বঙ্গ ভাষারই সৌভাগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

৩) তুর্কি শাসকগণ রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী ছিলেন, ধর্মলিপ্সা কিংবা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নয়। কারণ, রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাই সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শত্রু বানিয়ে রেখে রাজ্য চালানো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। অন্তত রাজ্যের স্থায়িত্বের তাগিদে সে সময় কোনো মুসলিম শাসকই নির্বিচারে হিন্দু নির্যাতনে সাহসী হতেন না। এমনকি সে সময় অনেক হিন্দুই রাজ্যের রাজকর্মের উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ থেকে বলা যায়, সে সময়ের মুসলমান শাসকগণ কারো উপর জোর করে ধর্ম চাপিয়ে দিতেন না।

তুর্কিদের বাংলা বিজয়
তুর্কিদের বাংলা বিজয়; Image Source: shshailani.wordpress.com

৪) তৎকালীন মুসলিম শাসকদের নিজস্ব ভাষা আরবি ও ফারসি ছিল এবং সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল বেশ উঁচুমানের। প্রমাণস্বরূপ বলা যায় ১২১০ সালে ভোজব নামের একজন ব্রাহ্মণ ‘অমৃতকুণ্ড’ নামের একটি সংস্কৃত গ্রন্থ একজন মুসলিম শাসককে দেন এবং কাজী রুকুনুদ্দিন নামক একজন রাজকর্মচারী গ্রন্থটি আরবি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এ সময়ে সংস্কৃত, আরবি-ফারসি উভয় সাহিত্য পরস্পরের পরিপূরক ছিল।

৫) সেই সময়ে প্রায় ২০ জন সংস্কৃত সাহিত্যিককে পাওয়া যায়, যাদের রচিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েকটি গ্রন্থের নাম ও রচনাকাল সহ উল্লেখ করা হলো-

ক) সদুক্তি কর্ণামৃত (রচনা), শ্রীধর দাস, ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ;
খ) হাওকুল হায়াত (রচনা), কাজী রুকুনদ্দিন সমর কান্দি, ১২১০-১৩;
গ) চম্পকাব্য (গ্রন্থ), নারায়ই, ১৩৭৩।

এবারে বলা যাক সেই অন্ধকার যুগে রচিত হওয়া কিছু সাহিত্য নিয়ে।

সেক শুভোদয়া

সেক শুভোদয়া রাজার লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রের রচিত সংস্কৃত গদ্যপদ্যে লেখা একধরনের চম্পুকাব্য । আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গ্রন্থটি রচিত। এ গ্রন্থে নানান ঘটনার মাধ্যমে মূলত পীরদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এতে রয়েছে বাংলা গান, চর্যা ও ভাটিয়ালী গানের একটি প্রেমসঙ্গীত। এর কিছু পঙক্তি ছিল এমন-

“হঙ যুবতি পতি এ হীন।
গঙ্গা সিনায়িবাক জাইএ দিন।
দৈব নিয়োজিত হৈল আকাজ
বায়ু ন ভাঙ্গএ ছোট গাছ।”

এই সঙ্গীতটিতে প্রাচীন যুগের ব্যক্তি মানসের ও সমাজচিত্রের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে, যা মধ্যযুগের প্রথমদিকের বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। কেউ কেউ আবার এসব নিদর্শনের সাহায্যে বাংলা সাহিত্যকে সেই অন্ধকার যুগের বন্ধ্যাত্বের অপবাদ থেকে রেহাই দিয়েছেন।

শূন্যপুরাণ

রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ ছিল ধর্মপূজার একটি শাস্ত্রগ্রন্থ। বৌদ্ধদের শূন্যবাদ ও হিন্দুদের লৌকিক ধর্মের সম্মিলনে ধর্মপূজার প্রতিষ্ঠিত শূন্যপুরাণে প্রাচীন বাংলা ভাষার প্রভাব বিদ্যমান। এ কাব্যের অন্তর্গত নিরঞ্জনের রুষ্মা নামক কবিতাটি তুর্কি বিজয়ের পরে, অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকের রচনা বলে মনে করা হয়।

ডাক ও খনার বচন

‘ডাক’ বলতে বোঝায় ‘প্রচলিত বাক্য’, আর খনা বলতে একজন ব্যক্তিবিশেষকে। খনা ছিলেন একজন বিদুষী নারী, যাকে একজন বাঙালি কবি মনে করা হয়। বাঙালি কবি খনার জীবনকাল ছিল ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। মূলত খনা কর্তৃক কথিত মূল্যবান বচনসমূহই খনার বচন নামে পরিচিত।

১) কলা রুয়ে না কাট পাত,
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।

২) কার্তিকের ঊন জলে,
     খনা বলে দুনো ফলে।

৩)জৈষ্ঠ্যে শুকো আষাঢ়ে ধারা
    শস্যের ভার না সহে ধরা।

কিংবদন্তির খনা: যার প্রজ্ঞায় হেরে জিহ্বা কেটে নিয়েছিল স্বামী ও শ্বশুর
খনা; Image Source: Sayanlal Halder

ডাক ও খনার বচন বাংলা সাহিত্যের কোনো লিখিত নিদর্শন না হলেও তা প্রাচীন যুগে সৃষ্টি হয়ে মধ্যযুগের প্রথম থেকেই ব্যাপক প্রচলিত ছিল। এতে লোকজীবনের দৈনন্দিন বিশ্বাস, আচরণ ও খণ্ডিত জীবনগাথা স্থান পেয়েছে। বিশেষত কৃষিকাজের ও দৈনন্দিন জীবনের অতি প্রয়োজনীয় সূত্রগুলো এখানে ছন্দাকারে রচিত হয়েছে। তাই সমাজজীবনে ডাক ও খনার বচনের প্রায়োগিক মূল্য অপরিসীম।

পরিশেষে

বাংলা সাহিত্যে ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ সময়টাকে ‘অন্ধকার যুগ’ না ধরে ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পুরো সময়টাকেই মধ্যযুগ ধরা উচিত। কারণ, মধ্যযুগের প্রথমদিকে খুব অল্প হলেও সাহিত্য রচিত হয়েছে। ‘অল্প’ শব্দটা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে, এদেশের মানুষের চিরন্তন জীবনযাপন ব্যবস্থা, এখানকার আবহাওয়া, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আকষ্মিক দুর্ঘটনার কথা। এ প্রসঙ্গে আমরা ড. এনামুল হকের মন্তব্য স্মরণ করতে পারি,

“এ সময়ে মানুষ তাহার সুখ-দুঃখের কোনো গান কিংবা গাথা নিজস্ব একেবারেই প্রকাশ করে নাই, এমন হইতেই পারে না।”

Related Articles