Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাচীন সাহিত্যের কালজয়ী তিন নায়িকা

সাহিত্য কিংবা সিনেমা- সবই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে নায়ককেন্দ্রিক। নায়িকারা সেখানে আসেন নায়ককে মহিমান্বিত করতে, আনন্দ দিতে কিংবা ধ্বংস ডেকে আনতে। কখনো নারীকে আমরা দেখি প্রণয়িনী রূপে, কখনোবা স্নেহময়ী মায়ের রূপে। সহায়ক কিংবা নিছকই গল্পের খাতিরে নারীকে সাহিত্যে আঁকা হলেও কোনো কোনো নারীচরিত্র ছাপিয়ে গেছেন তার চরিত্রকে, ছাড়িয়ে গেছেন সমাজ এবং কালকে। মানুষ তাদের মনে রেখেছে, রাখবেও আরো অনেকদিন। প্রাচীন সাহিত্যের তেমনই তিন কালজয়ী নায়িকাকে নিয়ে আজকের আয়োজন।

সফোক্লিসের ‘অ্যান্টিগনি’

খ্রিস্টপূর্ব ৪৪১ অব্দে গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস ‘অ্যান্টিগনি‘ রচনা করেন। অ্যান্টিগনি সফোক্লিসের আরেক বিখ্যাত ট্র্যাজিক নাটক ‘রাজা ইদিপাস’ এর সিক্যুয়েল। ‘অ্যান্টিগনি’ নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র রাজা ইদিপাসের মেয়ে ‘অ্যান্টিগনি’।

ইদিপাসের দুই পুত্র এটিওকলস ও পলিনিসেস থেবসের রাজত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ফলশ্রুতিতে দুজনই মৃত্যুবরণ করে। এদিকে তখন থেবসের রাজা ছিলেন ইদিপাসের শ্যালক ক্রেয়ন। এটিওকলস ক্রেয়নের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। তাই ক্রেয়ন এটিওকলসকে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করার আদেশ দিলেও পলিনিসেস প্রতি আদেশ ছিলো বিরূপ। যেহেতু পলিনিসেস রাজদ্রোহ করেছে, তাই সে সমাধি পাবে না। তার মৃতদেহ অনাবৃত অবস্থায় শহরের মাঝের রাস্তায় ফেলে রেখে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করা হলো। কেউ যদি তার জন্য শোক প্রকাশ করে বা তাকে সমাহিত করার চেষ্টা করে, তবে তার জন্য শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।

চিত্রকরের তুলিতে অ্যান্টিগনি; Source: pinterest

সবাই ক্রেয়নের আদেশ মানলেও মানলো না এটিওকলস আর পলিনিসেসের বোন অ্যান্টিগনি। তার কাছে দুই ভাই-ই সমান। তার ভাই সমাধি পাবে না এটা সে কোনোমতেই মানতে পারলো না। অ্যান্টিগনি পলিনেসেসকে সমাহিত করতে গিয়ে প্রহরীদের হাতে ধরা পড়লো। তাকে বন্দী করা হলো। এদিকে ক্রেয়নের পুত্র হিমন ভালোবাসে অ্যান্টিগনিকে। ক্রেয়নও চায় না অ্যান্টিগনির শাস্তি হোক। কেননা একদিকে অ্যান্টিগনি তার ভাগ্নি, অন্যদিকে পুত্রের বাগদত্তা। কিন্তু রাজদন্ডের উপর কিছু করারও নেই। অ্যান্টিগনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হলো।

এদিকে অ্যান্টিগনির প্রতি ক্রেয়নপুত্রের ছিলো অগাধ ভালোবাসা। সে পিতাকে বোঝালো এতে অ্যান্টিগনির কোনো দোষ নেই। হয়তো ঈশ্বরেরই ইচ্ছা ছিলো যে পলিনিসেস সমাধি পাবে। ক্রেয়ন তার আদেশ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন অ্যান্টিগনি। পরে অ্যান্টিগনির মৃত্যুতে আহত হয়ে ক্রেয়নপুত্র হিমনও বেছে নিলেন স্বেচ্ছামৃত্যু। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে আত্মহত্যা করলেন ক্রেয়নের স্ত্রী। এই ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়েই শেষ হয় অ্যান্টিগনি নাটক।

সফোক্লিস সেসময়কার নারীদের তুলনায় অ্যান্টিগনিকে এঁকেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে, দারুণ সাহসী এবং ভ্রাতৃবৎসল রুপে। প্রথাগত নারীর নতজানু ভাবের বদলে সে প্রতিবাদী। তার মাঝে যেমন প্রেম আছে, তেমনি আছে দ্রোহও। অ্যান্টিগনি মরণকে ভয় পায় না। তাই মরেও অ্যান্টিগনি অমর।

ব্যাসদেবের ‘দ্রৌপদী’

সাহিত্যে কিংবা পুরাণে তো নারীর রূপের বর্ণনা অনেকই আছে। কিন্তু তবুও কেন দ্রৌপদী সবার চেয়ে আলাদা? ব্যাসবেদের মহাভারতের চরিত্র ‘দ্রৌপদী’। তৎকালীন পুরুষশাষিত সমাজে দ্রৌপদীকে ঘর করতে হয়েছে পাঁচ স্বামীর। স্বামী তাকে জুয়ার আসরে বাজি রেখেছেন। প্রকাশ্য জুয়ার আসরে বস্ত্রহরণ করা হয়েছে তার। সন্তান হারিয়েছেন; দুঃখ, দুর্দশা আর অপমানের চূড়ান্ত তাকে সহ্য করতে হয়েছে। তবুও তিনি অসামান্যা। তার কারণ একটাই, সেটা তার তেজস্বিতা। মহাভারতে তার রূপের বর্ণনায় তাকে শ্যামবর্ণ বলা হলেও তার তেজস্বিতা আর সাহসই তাকে করেছে আকর্ষণীয়া।

দ্রৌপদীর পিতা ছিলেন পাঞ্চোলের রাজা ধ্রুপদ। আগুনের যজ্ঞ থেকে তার জন্ম। তেজস্বিনী, বুদ্ধিমতী আর সুন্দরী দ্রৌপদীর পাণিপ্রার্থী ছিলো অনেকেই। দ্রৌপদী স্বামী বেছে নিয়েছিলেন স্বয়ম্ভর সভার মাধ্যমে। সেখানেও ধনুক প্রতিযোগিতারর মাধ্যমে বিজয়ী রাজপুত্র অর্জুনকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তাকে অর্জুনসহ তার চার ভাইয়ের স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। ক্ষুব্ধ আশাহত দ্রৌপদীর দুঃখ এখানেই শেষ হয়নি।

রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের উদ্যোগ নিচ্ছে দুঃশাসন; Source: ISCON News

একাধারে তার ভাসুর এবং স্বামী যুধিষ্ঠির জুয়ার আসরে নিঃস্ব হয়ে তাকে বাজি রেখেছেন এবং হেরেছেন। প্রকাশ্য সভায় দ্রৌপদীর স্বামীকুল এবং সমস্ত গুরুজনদের সামনে দুঃশাসন তার বস্ত্র হরণের উদ্যোগ নেয়। দ্রৌপদীর বীর স্বামীকুল এবং তথাকথিত গুরুজনেরা চুপ করে সব দেখে যান। ঘৃণায়, ক্ষোভে, লজ্জায় যখন দ্রৌপদী পর্যুদস্ত, তখন স্বয়ং ধর্ম এসে তাকে রক্ষা করে।

দ্রৌপদী তেজী। সে তার স্বামীসহ সকলকে ধিক্কার জানায়। ধিক্কার জানায় দেবতাদের, যাদের খেয়াল খুশিতে তাকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে বারবার। সে প্রতিবাদ করেছে। যে পুরুষ তাকে লাঞ্ছিত করেছে স্বামীদের সাহায্যে, তার উপর সে প্রতিশোধ নিয়েছে। সবসময়ই সে রাজকন্যার মতো আচরণ করেছে। নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য প্রতিবাদ করেছে। দ্রৌপদী যদিও একটি কালের, একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিনিধি, কিন্তু দ্রৌপদী চিরন্তন। নিয়তির নির্মমতা, দুঃখ আর গ্লানি তাকে অমলিন করতে পারেনি এতটুকুও।

হোমারের ‘হেলেন’

সুন্দরী রানী লেডা। একদিন গোসল করছিলেন। দেবরাজ জিউস মুগ্ধ হলেন তার নগ্ন সৌন্দর্যে। রাজহাঁসের ছদ্মবেশে মিলিত হলেন রানীর সাথে। জন্ম নিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী হেলেন। হেলেন রক্ত মাংসের মানুষ হলেও সে দেবতার ঔরসজাত। তাই তার সৌন্দর্যও স্বর্গীয়। হোমার তার মহাকাব্য ‘ইলিয়ড’ ও ‘ওডিসি’তে হেলেনকে এঁকেছেন স্বতন্ত্রভাবে। হেলেন একাধারে প্রেমিকা, স্ত্রী, পুত্রবধূ এবং মাতাও বটে। পরিণত বয়সে হেলেনকে পাওয়ার জন্য তৎকালীন গ্রীস ও তার আশেপাশের অনেক রাজ্যের রাজকুমারেরাই মরিয়া হয়েছিলো। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের উপক্রমও হয়েছে বহুবার। হেলেন বেছে নিয়েছিলেন স্পার্টার রাজা মেনেলাউসকে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন হেলেন। কিন্তু গোল বাঁধালেন সেই দেবতারাই।

তিন দেবীর মাঝে কে বেশি সুন্দর তা নিয়ে যুদ্ধ লেগেছে। তিন দেবীতে মিলে সৌন্দর্য বিচারের জন্য গেলেন আরেক রক্ত মাংসের মানুষ ট্রয়ের রাজা প্রায়ামের ছেলে প্যারিসের কাছে। তিন দেবীই প্যারিসকে ঘুষ দিয়ে নিজে সেরা সুন্দরীর খেতাবটি জিতে নিতে চান। তিন দেবীর মাঝে প্রেমের দেবী লাস্যময়ী আফ্রোদিতি বললেন, আমাকে জিতিয়ে দিলে তুমি পাবে বিশ্বের সেরা সুন্দরীর প্রেম। প্যারিস তাই জিতিয়ে দিলেন আফ্রোদিতিকে। অন্য দুজন অবশ্য তাকে ঐশ্বর্য আর জ্ঞানের প্রস্তাব করেছিলো। প্যারিসের মনে ধরেনি সেসব। যদিও তখন সে ঘর করছিলো সুন্দরী পাহাড়ি পরী ইনানির সাথে।

‘ট্রয়’ সিনেমায় প্রায়ামপুত্র প্যারিসের সাথে হেলেন; Source: pinterest

আর কি? প্যারিস চুরি করলো হেলেনকে। শুরু হলো গ্রীস আর ট্রয়ের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। টানা ১০ বছরের সেই যুদ্ধে পুড়ে নিঃশেষ হলো ট্রয় নগরী, মারা গেলো গ্রীসের অগণিত জনতা। সকলে এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছে হেলেনকে। তাকে অভিশাপ  দিয়েছে। সম্মান তিনি শুধু পেয়েছেন প্রায়ামের বড় ছেলে মহান বীর হেক্টরের কাছে। যুদ্ধ শেষে হেলেন প্রাক্তন স্বামী মেনেলাউসের সাথে ফিরে এসেছেন গ্রীসে। সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তাদের বড় করেছেন। এখানে তিনি স্নেহময়ী মা। তার সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা নিঃশেষ হলে পরে মেনেলাউস এক দাসীর গর্ভে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সব দেখেও তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজে হেলেন সবকিছু মুখ বুজে সয়ে গেছেন।

হেলেন সৌন্দর্যের আরেক নাম। দেবতাদের খামখেয়ালিপনায় সৃষ্ট গ্রীস ও ট্রয়ের যুদ্ধের জন্য লোকে দায়ী করেছে হেলেনকে। কিন্তু আদৌ রক্ত মাংসের মানুষ হেলেন কী-ই বা করতে পারতো? নিয়তি, দেবতা আর পুরুষশাসিত সমাজের কাছে পুতুল বৈ কিছু তো নয় সে। তবুও হেলেনকে মানুষ মনে রেখেছে। কেউবা ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে, কেউ আবার সুন্দরের উপমা হিসেবে।

তথ্যসূত্র: গ্রীস ও ট্রয়ের উপাখ্যান; আবদার রশীদ

ফিচার ইমেজ সোর্স: Youtube

Related Articles