প্রদীপ জ্বাললে জীবন উজ্জ্বল
ঘুপচি ছাদের ঘরে
চাঁদকে জীবন্ত উজ্জ্বল দেখে
আঁধার পালায় ডরে।।
অজ্ঞানতার আঁধার ভিতরে
পাঁড় ছ্যাঁচোর রত্নাকর
জ্ঞানের উজ্জ্বলতা দেখে হয়ে গেল
বাল্মীকি মুনিবর।।
[কবি হলধর নাগ, কোশলি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন, কৌশিক ভাদুড়ি]
জীবন তার খুবই সহজ, সরল। বেশভুষাতেও নেই কোনো চাকচিক্য। সাদা ধুতি আর ফতোয়া তার সারা জীবনের অহংকার। জীবনে পায়ে কখনও ওঠেনি সস্তার স্যান্ডেলও। গ্রামের সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এই মানুষটির তেমন কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই, টেনেটুনে তৃতীয় শ্রেণি পাশ। তারপরও তাকে নিয়ে হইচই। তিনি কবি হলধর নাগ। তিনি এমন এক ভাষায় কবিতা লেখেন, যে ভাষায় সাহিত্য চর্চা খুবই বিরল। সেই কোশলি ভাষাকে আঁকড়ে ধরেই তার নিয়ত কাব্যচর্চা। কবিতার মধ্যে দিয়ে তিনি হাজারো বছরের পুরনো এক প্রাচীন ভাষাকে সাধারণ মানুষের মাঝে তুলে এনেছেন।
অল্প বয়সেই জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া
ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের বারগড় জেলার ঘেনসে গ্রামে ১৯৫০ সালের ৩১ মার্চ এক গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কবি। মাত্র দশ বছর বয়সে পিতা-মাতাকে হারান। তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। পড়াশোনার পাঠে সেখানেই ছেদ পড়ে। অল্প বয়সে জীবন-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। গ্রামের এক হোটেলে কাপ-প্লেট ধোয়ার কাজ পান। দু' বছর সেখানে কাজ করেন। তারপর গ্রামপ্রধানের সহায়তায় গ্রামের হাইস্কুলের ছাত্রাবাসে রাঁধুনি হিসেবে যোগ দেন। ষোল বছর সেখানে কাজ করেন। সেখানে কাজ করতে করতেই গ্রামের এক ব্যাংক থেকে ১০০০ রুপি লোন নিয়ে একটা ছোট স্টেশনারি দোকান খুলেন। এভাবেই চলতে থাকে তার সাদাসিধে ও আটপৌরে জীবন।
তিনি এতটাই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত যে ৪ এপ্রিল, ২০১৬ সালে তিনি যখন ভারতীয় রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পদ্মশ্রী পদক নিতে যান, তখনও বাবরি চুলের কৃষ্ণ বর্ণের ছিপছিপে চেহারার এই কবির গায়ে থাকে সেই চিরপরিচিত স্যান্ডো গেঞ্জি, ধুতি, বুক ঢাকার জন্য ঘাড়ের ওপর দিয়ে প্যাঁচানো সাদাটে একটা চাদর। তখনও পায়ে ছিল না কোনো স্যান্ডেল। তাই এই নির্মোহ কবি অন্য সবার থেকে একেবারেই আলাদা।
কবি জীবন
দৈনন্দিন নানা কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে কখন তার মধ্যে কবিত্ব প্রকাশ পেয়েছিল, তা কবি নিজেও জানেন না। আপন খেয়ালে প্রথম দিকে কিছু কবিতা লিখলেও তা যে শেষ পর্যন্ত কবিতার পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা বলা যাবে না। ১৯৯০ সালে তার প্রথম কবিতা আত্মপ্রকাশ পায়। কোশলি ভাষায় লেখা তার প্রথম কবিতাটির নাম ছিল ‘ধোড়ো বারগাচ’, অর্থাৎ ‘বুড়ো বট গাছ’। কবিতাটি প্রসঙ্গে কবি তার এক সাক্ষাৎকারে জানান, কবিতাটির মূল বিষয়বস্তু ছিল গ্রামের একটি বটগাছ। গ্রামের মানুষদের জীবনে ঘটে চলা নানা ঘটনার সাক্ষী এ বট গাছ। নিজের জায়গায় স্থির থেকে সে নিয়ত দেখে যাচ্ছে গ্রামের মানুষদের পরিবর্তনের ইতিহাস।
কবিতাটি তিনি পাঠান স্থানীয় এক পত্রিকায়। কবিতাটি প্রকাশিত হতেই তার কবিতার লেখার ইচ্ছে আরও বাড়তে থাকে। পত্রিকার জন্য পরপর চারটি কবিতা লেখেন। ধারবাহিকভাবে চারটি কবিতাই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর কবি আর তিনি থেমে থাকেননি। লিখে গেছেন একের পর এক কবিতা। তা স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুধু কবিতাই নয়, তার কলম দিয়ে বের হয়েছে ২০টি মহাকাব্য।
গ্রামীন জীবন তার কবিতার বিষয়বস্ত
প্রকৃতি, গ্রামীন সমাজ জীবন, সমাজের শোষণ-বঞ্চনা, পুরাণ, ধর্ম এবং সামাজিক সংস্কারের কথায় তার কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে।
বছরে একবার আজ যে দশমী
পথে উল্টো রথের ঢল
শ্বশুর ভিটেতে খেটে মরা বধুর
সে খবরটাই সম্বল।।
গিরগিটি বয় কাপড়ের গাঁট
ফুল সাজি বয় ফিঙে
দুটো টুনটুনি যেন বউ দুটি
উলু দেয় তিতিরে।।
মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসা, যাপিত জীবনের নানা গল্প কিংবা অতীতের গৌরবময় ইতিহাসের কথা কবি অসাধারণ দক্ষতায় তার কবিতা ও মহাকাব্যে ব্যক্ত করেছেন। তার কবিতায় মিশে থাকে মাটির স্যোঁদা গন্ধ। তাই তো তিনি যেমন মানুষের কবি, তেমনি তিনি মাটির কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, সাম্যেরও কবি।
কবির জীবনে প্রেম
কবি বলতে এক প্রেমিক মনকে বোঝায়। কবি হলধর নাগও একজন পুরোদস্তুর প্রেমিক। ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন পাশের গ্রামের পার্বতীকে। কিন্তু সে বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি যে স্কুলের হোস্টেলে রান্নার কাজ করতেন, সেখানেই নিয়মিত কাজ করতে আসতেন মালতি নামের এক লাজুক মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। একসাথে কাজ করতে করতে একটা সময় মালতিকে ভালো লেগে যায় কবির। কিন্তু কিছুতেই তা প্রকাশ করতে পারেন না। এ ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কবি শেষে আশ্রয় নিলেন কবিতার। কবি তার প্রেমের কথা, গাঢ় অনুভূতির কথা কবিতায় প্রকাশ করতে লাগলেন।
মালতি রান্নাঘরের যেখানে কাজ করতেন, সেখানকার দেয়ালে মালতিকে উদ্দেশ করে কবি লিখে চললেন একের পর এক কবিতা। কবির মনের মধ্যে বেজে ওঠা পঙক্তিমালা কবিতা হয়ে তা রান্নাঘরের দেয়ালে প্রকাশ পেতে লাগলো। প্রথমদিকে মালতি তা লক্ষ করেননি। কিন্তু একদিন সে কবিতা আর তার নজর এড়ালো না। মালতি সে কবিতা পড়ে বুঝতে পারলেন তার প্রতি কবির ভালোবাসার কথা। এই অভিনব প্রেমের প্রস্তাবে মালতিও সাড়া না দিয়ে পারেননি। তারপর দু'জনের মধ্যে চলে মন দেওয়া-নেওয়া পর্ব। এই মালতির সাথেই আবার নতুন করে সংসার পাতেন। সেই মিষ্টি মধুর প্রেম এখনও দু'জনের মধ্যে অমলিন।
কবি যখন হয়ে ওঠেন গবেষণার বিষয়
কবি হলধর নাগ শুধু একজন কবিই নন, অসম্ভব তার স্মৃতিশক্তি। তার সব কবিতা ও মহাকাব্য ঠোঁটস্থ। কেউ যদি তার কবিতার নাম ও তার দু-এক পঙক্তি উল্লেখ করেন, তিনি কবিতার পুরোটাই আওড়ে যেতে পারেন। কবি মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পাশ হলেও তার লেখা কবিতা হয়ে ওঠে অন্য সবার গবেষণার বিষয়বস্তু। তাকে নিয়ে গবেষণা করছেন এক দল পড়ুয়া।
এর মধ্যে পাঁচজন তার লেখা নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এখনো চলছে তার কবিতার আঙ্গিক নিয়ে নানা গবেষণা। উড়িষ্যা জেলার সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠসূচীতে তার বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ স্থান পেয়েছে। উড়িষ্যা রাজ্য সরকার এই বিস্ময়কর প্রতিভাকে লোক কবিরত্ন উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তার কর্মময় জীবন ও সাহিত্য নিয়ে একাধিক চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।
কোন কবির কাজ তাকে অনুপ্রাণিত করে?
এ প্রসঙ্গে কবি হলধর নাগ বলেন,
“আমি প্রথম কবি বিনোদ নায়কের কবিতা পড়েছিলাম। তার কবিতা ‘গ্রাম পাঠ’ কবিতা আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করে। কীভাবে কবিতা নির্মাণ করতে হয় এ কবিতা পড়েই আমি ধারণা লাভ করি। তার থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার প্রথম কবিতা ‘ধোড়ো বারগাচ’ রচনা করি। নায়কের রচনাগুলোর কাব্যিক উৎকর্ষ অনুকরণীয়। এখনও অনুপ্রেরণার জন্য তার কবিতার কাছে আমি বারবার ফিরে যাই। তাকে ছাড়াও এমন আরও অনেকে আছেন, যারা আমার লেখায় প্রভাব ফেলেছেন। বিশেষত, গঙ্গাধর মেহেরের প্রকৃতির বর্ণনার ধরন, রাধানাথ রায়ের কাব্যিক কৌশল প্রয়োগ এবং কবিতায় অলঙ্কারের ব্যবহার আমি অনুসরণ করার চেষ্টা করি।”
কবিতা লেখার মধ্যে পান আত্মিক প্রশান্তি
কবিতাই তার বেঁচে থাকার প্রেরণা। কবিতার মধ্য দিয়ে খুঁজে পান মুক্তির স্বাদ। তিনি যখন কোথাও কবিতা পড়ে শোনাতে যান, সেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে যায়। যারা তার কবিতা বা তার কবিতার বই কখনও পড়েননি, এমন মানুষও তার কবিতা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। সহজ-সরল ভাষায় উপস্থাপন করার জন্য তার কবিতা সাধারণ দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ করে।
কবি হলধর নাগ একজন বিপ্লবীও
জাদরেল গোঁফের আড়ালে মুখখানি নিষ্প্রভ মনে হলেও তার ভেতরের আলো কোশলি ভাষাকে এক নবজীবন দিয়েছে যে ভাষায় হাতেগোনা কয়েকজন কবি কাব্যচর্চা করেছেন। শব্দের পর শব্দ ভাসিয়ে কবি লিখে যান তার সুখ-দুঃখের কাব্য। দেশের নানা সামাজিক আন্দোলনে তিনি প্রথম সারিতে থাকেন। উনিশ শতকের আগে কোশলি ভাষার কোনো লিখিত রূপ পাওয়া যায় না। কিন্তু এ ভাষা উড়িষ্যার বহু মানুষের মুখের ভাষা। এ ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য কবি হলধর নাগ দীর্ঘদিন সংগ্রাম করছেন। এই ভাষায় কবিতা রচনার মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বের সামনে এ ভাষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছেন।
বিভিন্ন জায়গায় তাকে নিয়ে যে এত উচ্ছ্বাস বা এতো সম্মাননা পেয়েছেন তা নিয়ে কবির কোনো মধ্যে কোনো উত্তাপ নেই। তিনি মনে করেন, সম্মান পাওয়ার সাথে তার লেখার কোনো যোগসূত্র নেই। তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রতিটি কবি নিজের মতো বাঁচে। আর কলমের মধ্যে দিয়ে তার চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। হয়তো তা থেকে বেরিয়ে আসে কোনো কালজয়ী কবিতা।
রাজনীতি কি তার কবিতায় ব্রাত্য?
তিনি তা মনে করেন না। হয়তো প্রবলভাবে রাজনীতি আসেনি তার কবিতায়, কিন্তু কখনও তিনি রাজনীতিকে উপেক্ষাও করেননি। ‘কাহি এ বাহিরচি ঘরু’- এই কবিতাটিতে তিনি রাজনীতিকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করেছেন। গ্রামে মন্ত্রী এসেছেন বলে সকলে তাদের নানা অভাব-অভিযোগ জানানোর জন্য মন্ত্রীর কাছে ভিড় করেছেন। গ্রামের এক অন্ধেরও ইচ্ছা, তার সমস্যার কথা মন্ত্রীর কাছে জানাবেন। কিন্তু তিনি রাস্তায় বেরোতেই মন্ত্রীর গাড়ির নিচে চাপা পড়লেন। গ্রামের সবাই এতে মন্ত্রীর কোনো দোষ দেখল না। তাদের কথা- ‘কাহি এ বাহিরচি ঘরু?’ (কেন ও ঘর থেকে বেরিয়েছে?)।
কেন কবি জুতো পরেন না? এর এক চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন কবি হলধর নাগ। তার যুক্তি, খালি পায়ে থাকলে তিনি মাধ্যাকর্ষণের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারেন, যা স্যান্ডেল বা জুতো পায়ে থাকলে সম্ভব নয়।
কবিতা তার কাছে সাধনা। কবিতায় পান আত্মিক মুক্তি। কবিতার মধ্যে দিয়ে এ চারণ কবি দীর্ঘজীবন লাভ করুক, দীর্ঘায়িত হোক তার কাব্য সাধনা।
যেখান থেকে অমৃত ঝরে
সাত সমুদ্র থেকে
স্বর্গ থেকে
মায়ের স্তন থেকে
মহৎ নীতির ধারা থেকে
কবির কলম চালাই।।
This article is a Bengali article. This story is about a rural poet of Odisha in India. Odisha Koshali poet Haldhar Nag who got lakhs of followers in Odisha and Chatishgarh. This article tells about his life and work . All the sources are hyperlinked inside the article.
Featured Image: jharka.com