Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আফ্রোদিতি: গ্রিক পুরাণের সৌন্দর্য ও ভালোবাসার দেবী

সৃষ্টিজগতের অন্যতম আরাধ্য বোধহয় রূপ ও গুণ! দেব-দেবী থেকে শুরু করে মানুষ, সবাই রূপ ও গুণের পূজারী। সৃষ্টির সবাই সৌন্দর্যের প্রতি চরমভাবে আকৃষ্ট। নারীর সৌন্দর্যে ডুব দিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায় জগতের প্রতিটি পুরুষই। সুন্দরী নারীর প্রতি যৌনতা ও ভালোবাসা অনুভব করা পুরুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সুন্দরী নারীর প্রতি ভালোবাসা ও কামনা অনুভব করে না এমন পুরুষ নেই। গ্রিক উপকথা সৌন্দর্য ও ভালোবাসার ধারণাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। সেখানে সৌন্দর্য, ভালোবাসা ও যৌনতা যার মাধ্যমে অন্য মাত্রা পেয়েছে তিনি আফ্রোদিতি। রোমান উপকথায় আফ্রোদিতিকে ভেনাস নামে অভিহিত করা হয়েছে। 

সৌন্দর্য, কাম ও ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি গ্রিক পুরাণের অন্যতম প্রভাবশালী দেবী; Image courtesy: Ancient Origins 

গ্রিক মিথোলজির সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বিখ্যাত ১২ দেব-দেবীকে অলিম্পিয়ান নামে অভিহিত করা হয়। প্রথম যুগের টাইটানদের পর এই ১২ জন দেব-দেবী ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন। অলিম্পাস পাহাড়ে তাদের বসবাস ছিল বলে তাদের অলিম্পিয়ান নামে ডাকা হয়। তারা গ্রিক পুরাণের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রাচীন গ্রীকদের জীবনে দারুণ প্রভাব রেখেছেন। 

গ্রিক পুরাণের এই অলিম্পিয়ান দেবদেবীদের অন্যতম হলেন সৌন্দর্য ও ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি। তার রূপে, গুণে মুগ্ধ হয়েছে দেবতা থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সকলেই। তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা করেছে স্বর্গ থেকে শুরু করে মর্ত্যের অনেকেই। আফ্রোদিতিও স্বর্গ-মর্ত্যের অনেককে যৌনসুখ দিয়েছেন। প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি প্রেমও করেছেন অনেক দেবতা ও মানুষের সঙ্গে। 

হেসিয়ডের বর্ণনানুযায়ী, আফ্রোদিতি হলেন সবচেয়ে প্রাচীন অলিম্পিয়ান। তিনি সমুদ্রকে শান্ত করেন, তৃণভূমিগুলোকে ফুল দিয়ে সতেজ করেন। এমনকি, তার কথায় ঝড় থেমে যায়। বন্য প্রাণীরাও তার বশ্যতা স্বীকার করে। এই কারণেই তার প্রধান প্রতীকগুলো সাধারণত প্রকৃতি থেকে আসা, যার মধ্যে রয়েছে গোলাপ, ঘুঘু, চড়ুই এবং রাজহাঁস। 

সমস্ত দেব-দেবীর মধ্যে আফ্রোদিতি সবচেয়ে বেশি কামুক এবং যৌনতায় পরিপূর্ণ। এজন্য অনেক ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মে তাকে নগ্নভাবে দেখানো হয়। লম্বা সোনালি চুলগুলো তার পিঠের নিচে প্রবাহিত হয়। 

আফ্রোদিতির জন্ম নিয়ে বেশ কয়েকটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। অনেকে বলে, তিনি দেবরাজ জিউসের কন্যা, আবার কারো কারো মতে জিউসের আগেই আফ্রোদিতির অস্তিত্ব ছিল। সবচেয়ে প্রচলিত ও বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, আফ্রোদিতি ছিলেন ইউরেনাসের কন্যা। উপকথা অনুযায়ী, দেব-দেবীদের জন্মের আগে আদিম বিশৃঙ্খলা ছিল। সেই আদিম বিশৃঙ্খলা থেকে গাইয়া, আর্থ বা পৃথিবীর দেবীর জন্ম হয়। একসময় ইউরেনাস গাইয়ার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে এবং বারোজন টাইটান, তিনটি সাইক্লোপস, এক চোখের দৈত্য এবং পঞ্চাশটি মাথা ও ১০০ হাতসহ তিনটি দানবীয় হেকাটোনচায়ার জন্ম হয়। কিন্তু ইউরেনাস তার সন্তানদের ঘৃণা করতেন। তিনি তার এই সন্তানদের অস্তিত্বে খুশি ছিলেন না, বরং ক্ষুব্ধ ছিলেন। 

এরপরও ইউরেনাস গাইয়াকে বার বার তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করতে বাধ্য করে। কিন্তু যখন তাদের মিলনের ফলে দানব শিশুর জন্ম হতে থাকে, তখন সেই শিশুদের তিনি গ্রহণ করতেন না। ফলে গাইয়া ইউরেনাসকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। শেষে নিরুপায় হয়ে গাইয়া তার শিশুদের কাছে সাহায্য চায়। আর্থের শিশুদের মধ্যে ক্রোনাস অত্যন্ত সাহসী ছিল। যখন ইউরেনাস এসে আবার গাইয়ার সাথে শুয়ে পড়ে, তখন অদম্য সাহসী ক্রোনাস তার পিতার যৌনাঙ্গ কেটে সমুদ্রে ফেলে দেয়। 

সর্বকনিষ্ঠ টাইটান ক্রোনাস তার পিতার যৌনাঙ্গ কেটে সমুদ্রে ফেলে দেন; Image Courtesy: Deviant Art

আরেক মত অনুযায়ী, ইউরেনাস যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন গাইয়া ক্রোনাসের হাতে একটি কাস্তে তুলে দেন এবং ক্রোনাস সেই কাস্তে দিয়ে ইউরেনাসের যৌনাঙ্গ কেটে দেয়। ইউরেনাসের সেই যৌনাঙ্গ সাইথেরার কাছে গিয়ে পড়ে এবং সমুদ্রের স্রোতে সেই যৌনাঙ্গ সাইপ্রাস দ্বীপের উপকূলে চলে যায়। ইউরেনাসের যৌনাঙ্গ থেকে সৃষ্ট সমুদ্রের ফেনা থেকে একটি সুন্দরী মেয়ের জন্ম হয়। সেই কন্যা যখন দ্বীপে পা রাখে, তার পায়ের নীচ থেকে ঘাস ঝরছিল। সেই কন্যাই সৌন্দর্য ও ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি। 

গ্রিক ভাষায় ‘আফ্রোস’ শব্দের অর্থ ‘ফেনা’। সমুদ্রের ফেনা থেকে জন্ম হয়েছিল বলে তাকে আফ্রোদিতি নামে ডাকা হয়। গ্রিক ভাষায় আফ্রোদিতি শব্দের অর্থই হলো ‘সমুদ্রোদ্ভুতা’, মানে যার জন্ম সমুদ্র থেকে হয়েছে। এভাবে সাইথেরার লেডি, সাইপ্রাসের লেডি এবং প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি প্রথম আদিম দেবী হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রিক কবি হিসিওড এই মতের পক্ষে। আরেক বিখ্যাত গ্রিক কবি হোমারের মতে, আফ্রোদিতি দেবরাজ জিউস ও দেবী ডিওনের কন্যা। দার্শনিক প্লেটো আফ্রোদিতি সম্পর্কে আরেক তত্ত্ব দেন। তার মতে, দেবালয়ে আফ্রোদিতি নামে দুজনের অস্তিত্ব ছিল। এর একজন ছিল ‘স্বর্গীয় প্রেমের দেবী’, অপরজন ‘দৈহিক প্রেমের দেবী’। 

প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির অনেক পুরুষের সঙ্গে প্রেম ছিল। তিনি যদিও বিয়ে করেছিলেন শিল্পের দেবতা হেফাস্টাসকে, তথাপি তিনি অনেকের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলেন। আফ্রোদিতি যখন অলিম্পাসে অবতরণ করেন, তখন সেখানকার সবাই আফ্রোদিতির সৌন্দর্যে দিশেহারা। সেখানে তখন এক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়। এমতাবস্থায় বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে এবং কোনোরকম যুদ্ধ এড়াতে দেবরাজ জিউস ও বিয়ের দেবী হেরা আফ্রোদিতিকে শিল্প ও আগুনের দেবতা হেফাস্টাসের সঙ্গে বিয়ে দেন। হেফাস্টাস ছিলেন খোঁড়া এবং কুৎসিত চেহারার। আফ্রোদিতি তার সঙ্গে সুখী ছিলেন না। ফলে তিনি শুরু করলেন পরকীয়া। 

কামার দেবতা হেফাস্টাস ছিলেন আফ্রোদিতির স্বামী; Image courtesy: Wikimedia Commons

স্ত্রীর পরকীয়ার কথা জানতে পেরে হেফাস্টাস তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতে থাকেন। দেবালয়ের কামার এবং শিল্পের দেবতা হেফাস্টাস এমন একটি বিছানা তৈরি করেন যেখানে কেউ শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হলে সোনার শেকলে আটকা পড়বে। আফ্রোদিতির প্রেমিক ছিলেন যুদ্ধের দেবতা অ্যারিস। অ্যারিস ও আফ্রোদিতির অনেক সন্তানও ছিল। একদিন হেফাস্টাসের তৈরি সেই বিছানায় আফ্রোদিতি ও অ্যারিস যৌনসম্পর্কে আবদ্ধ হলে তারা সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় শেকলে আটকা পড়েন। শেষপর্যন্ত সমুদ্রদেবতা পসাইডন তাদের এই অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন। 

এছাড়াও আফ্রোদিতি আরো অনেক দেবতার সঙ্গে প্রেম ও শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পসাইডন ও হার্মিস। শুধু দেবতাই নয়, মানুষের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্ক ছিল আফ্রোদিতির। অ্যাডোনিসসহ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। 

গ্রিক উপকথার সমুদ্রদেবতা পসাইডন ছিলেন আফ্রোদিতির প্রেমিক; Image Courtesy: wallpaper Access

ট্রোজান যুদ্ধের জন্য পরোক্ষভাবে হলেও আফ্রোদিতি অনেকাংশেই দায়ী ছিলেন। এই ঘটনার সূত্রপাত দেবতাদের এক বিয়েতে। দেবতা পেলেউস ও থেটিসের বিয়েতে ‘বিবাদের দেবী ইরিস’ একটি সোনার আপেল নিয়ে আসেন এবং সবচেয়ে সুন্দরী দেবীকে দেওয়ার কথা জানান। এই প্রতিযোগিতায় অ্যাথেনা, হেরা এবং আফ্রোদিতিই ছিলেন সবার শীর্ষে। দেবরাজ জিউসের আদেশে ট্রোজান রাজপুত্র প্যারিসের উপর এই প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব বর্তায়। 

সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতি নিজেকে এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নারী বলে বিশ্বাস করতেন। অন্য কেউ তার চেয়ে বেশি সুন্দরী হতে পারে এটা তিনি মানতেই পারতেন না। ফলে এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার জন্য তিনি উঠে-পড়ে লাগেন। আফ্রোদিতি প্যারিসকে বলেন, প্যারিস যদি তাকে সেরা সুন্দরী হিসেবে ঘোষণা দেয় তবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তার প্রেম করিয়ে দেবে। প্যারিসও এই প্রস্তাব ফেলতে পারেনি। 

ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিসকে স্বর্গের দেবীদের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিচারক করা হয়; Image Courtesy: Fandom

সেই প্রতিযোগিতায় প্যারিস আফ্রোদিতিকে সেরা সুন্দরী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে দেবীও তার কথামতো স্পার্টার রানী হেলেনের সঙ্গে প্যারিসের প্রেম ঘটিয়ে দেন। হেলেন ছিলেন স্পার্টার রাজা মেনেলাওসের স্ত্রী। হেলেনের প্রেমে অন্ধ প্যারিস তখন তাকে নিয়ে নিজের শহর ট্রয়ে পালিয়ে আসেন। মেনেলাওস তার ভাই আগামেমননকে ট্রয় দখল করে হেলেনকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়। ফলস্বরূপ শুরু হয় ট্রয়ের যুদ্ধ। 

গ্রিক উপাখ্যানের সৌন্দর্য ও ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতিকে নিয়ে যুগ যুগ ধরে বহু গল্প ও আখ্যান তৈরি হয়েছে। সেই প্রাচীন গ্রিস থেকে এখনো পর্যন্ত শিল্পী ও সাহিত্যিকরা আফ্রোদিতির রূপ নিয়ে মাতামাতি করেন। নিঃসন্দেহে আফ্রোদিতি গ্রিক পুরাণের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেব-দেবীদের অন্যতম একজন। তিনি গ্রিক তথা পশ্চিমা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক চিত্তাকর্ষক চরিত্র। 

Related Articles