Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আরাকনি: যেভাবে জন্ম নিলো পৃথিবীর প্রথম মাকড়সা

সে কী ভীষণ দিন, এক অসম প্রতিযোগিতা! মর্ত্যের এক মানবী স্বর্গের দেবী এথেনাকে প্রতিযোগিতায় আহবান জানানো হয়েছে। মর্ত্যের এই মানবীর নাম আরাকনি, এক কুমারী, যে কি না অর্জন করেছে বুনন আর সূচিকর্মে স্বর্গীয় দক্ষতা। যেমন তেমন হাতের কাজ নয় তার। যখন কাপড়খণ্ড সেলাই হয়ে যায়, তা যেমন অপূর্ব, তেমনি তাকে কাজ করতে দেখাও যেন সৌভাগ্যের।

তার বুনন দেখতে বনদেবী, জলপরীরা নিজ নিজ কুঞ্জবন, ঝর্ণা ছেড়ে ছুটে আসে। ঘন্টার পর ঘন্টা আরাকনির কাজ দেখে। উদ্ধত উলের দলাকে সে হাতের ছোঁয়ায় সুতো বানায়। তার হাতের উপর উলের গা এলিয়ে দেওয়ার সদিচ্ছা স্পষ্ট, যেন তারা জানে আরাকনির হাতের স্পর্শে তারা পরিণত হবে হালকা মেঘের দলায়। সেই মেঘ হওয়ার ইচ্ছেতেই তারা আরাকনির আঙুলে জড়ায়। আরাকনির দক্ষ হাত সেই মেঘ থেকে কাপড় বোনে। তারপর সূঁচের আঘাতে তাদের সাজায়।

মানুষ কাজ ফেলে তার সেলাই দেখতো; image source: penelopeswrist.wordpress.com

সে যখন বুনতে বসতো, মানুষ কাজ ফেলে তার সেলাই দেখতো আর প্রশংসা করতো। তাদের প্রশংসা বাড়ছিল। সাথে বাড়ছিল আরাকনির দর্প। ভূয়সী প্রশংসায় সবাই জুড়ে দিত নানারকম রূপক। একদিন এমনই কেউ বলে বসেছিল, “হে আরাকনি, তোমার কাজ দেখলে মনে হয়, স্বয়ং এথেনা তোমায় নিজে হাতে বোনা শিখিয়েছেন!” অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো আরাকনি। এ জ্ঞান তার বহু সাধনার। কারো কাছ থেকে সে শেখেনি। কারোর শিক্ষার্থী হওয়া তার কাছে তখন রীতিমত অপমানের। আরাকনি দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “মূর্খ মানব! বলো তোমাদের এথেনাকে কোনোদিন আমার সাথে নিজের দক্ষতার পাল্লা দিতে, দেখা যাবে কে বেশি যোগ্য। যদি হেরে যাই, এথেনাকে অপমান করার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি আছি আমি।” 

উদ্ধত আরাকনির কথা এথেনার কানে গেল। ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেন। কিন্তু এথেনা হলেন গ্রিক পুরাণের জ্ঞান আর কৌশলের দেবী। বারোজন অলিম্পিয়ানের তিনিও একজন সদস্য। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান, শিল্পকলা তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। এথেন্সের রক্ষক এই দেবী জন্মেছিলেন দেবরাজ জিউসের মাথা থেকে। সেই তাকে কি না এত বড় অপমান! একইসাথে এসব কারণেই মর্ত্যের তুচ্ছ নারীর প্রলাপে এথেনা শুরুতেই বচসা করতে লাগলেন না। এক বৃদ্ধার বেশ ধরে তিনি আরাকনির বাড়িতে হাজির হলেন। সেদিনও আরাকনি বোনার কাজে ব্যস্ত ছিল, বাড়িতে জমেছিল লোকজন।

গ্রিক পুরাণের জ্ঞান আর কৌশলের দেবী; image source: SC Magazine

বৃদ্ধা তারই মাঝে আরাকনিকে বলতে লাগলেন, “দেখ মা আরাকনি, বয়স তো আমার কিছু কম হলো না, এ জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, আশা করি তোমারও এতটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে যে তুমি আমার উপদেশকে হেলাফেলা করবে না। হ্যাঁ, আজ বন্ধুর মতো উপদেশ দিতে এসেছি তোমাকে। তুমি বরং তোমার মতোই নশ্বর মানবদের প্রতিযোগিতায় আহবান কর, স্বর্গের সাথে পাল্লা দিও না। ভাল হয়, যদি যা যা বলেছ, তার জন্য দেবীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা কর। নিশ্চয়ই জানো, দেবী ক্ষমার সাগর, তিনি তোমায় মাফ করবেন।”

আরাকনি এতক্ষণ বৃদ্ধার কথা শোনার জন্য বোনা থামায়নি, তবু সে শুনছিল, ক্ষমা ভিক্ষার কথা শুনে সে বৃদ্ধার দিকে বিদ্রুপের চোখে তাকালো। বললো, “থামাচ্ছি না বলে যা ইচ্ছা তা-ই বলে যাবে? কে চাইছে তোমাদের দেবীর ক্ষমা? তোমার উপদেশগুলো তোমার মেয়ে আর কাজের মেয়েদের জন্য রেখে দাও। আর আমার কথা কান খুলে শুনে নাও। আমি সেটাই বলেছি, যেটা আমি মানি, ওটা আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া ভুল ছিল না। আমি তাই-ই বলেছি যা আমি করতে পারব। যদি দেবীর সাহস থাকে, আসুক নেমে, করুক নিজের শক্তি আর দক্ষতার পরীক্ষা।”

বৃদ্ধা বললেন, “তথাস্তু!” তার শরীর থেকে সরে গেল বৃদ্ধার পোশাক। হাত থেকে লাঠি আর পিঠ থেকে কুঁজ সরে গেল। চামড়ার ভাঁজের বদলে দেখা দিল আভা। মাথার ঘোমটার স্থানে রইলো শিরস্ত্রাণ। দেবীকে চিনতে পেরে উপস্থিত জলপরী আর বনদেবীরা লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। সেখান থেকেই তারা দেবীর গুণ গাইতে লাগল। দর্শনার্থী মানুষেরা দেবীর পূজোপাঠ শুরু করল।

প্রতিযোগিতা শুরু হলো; image source: Tor.com

আরাকনি একাই কিছু করছিল না। এমন পরিবর্তনেও যেন তার কিছু হয়নি। তার গালের রঙ পরিবর্তন হলো। একটু যেন লাল, তারপর ক্রমশ বর্ণহীনের দিকে। আরাকনিকে রক্তশূন্য লাগছিল। কিন্তু মনের এই ভয়কে সে সামনে আনতে চাইলো না। নিজের অন্ধ অহমিকাকে সে কিছুতেই দেবত্বের কাছে হারাতে দিতে পারে না। সে জানতো না তার এই দম্ভ তার ভাগ্যকে কোথায় বয়ে নিয়ে চলেছে। জানলেও হয়তো পিছু ফেরার সময় ছিল না।

এথেনা আর চিন্তা করবার বা আরও উপদেশ দেওয়ার বিরতি নিলেন না। তখনি লেগে পড়লেন কাজে। আরাকনিও বসলো, প্রতিযোগিতা শুরু হলো। তাদের হাতে সুদর্শন মাকু সুতোর সারির ভেতর দিয়ে মাছের মতো চলছিল। দ্রুতগতিতে দক্ষতার সাথে চলছিল দুজনের হাতই। একজন শিল্পের দেবী, অন্যজন নশ্বর মানুষ। কাজের উত্তেজনা পরিশ্রম কমিয়ে দিচ্ছিল। একেক রঙের উলের সুতো তাদের প্রয়োজন মতো নির্দিষ্ট জায়গায় বসে পড়ছিল, যেন তাদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। কারোর তাঁতে এমনভাবে কিছু বোনা যেতে পারে তা ছিল চিন্তার অতীত। উপস্থিত দর্শকদের মনে হচ্ছিল, কোনো জাদুকর তাদের অজ্ঞতার সুযোগে চোখকে ধোঁকা দিচ্ছে। রামধনুর মতো তাদের সেই বুনন। স্বর্গ থেকে আলো ঠিকরে পড়ে যেন হচ্ছে সেই রঙের সৃষ্টি।

এথেনা আঁকছিলেন স্বর্গের স্তুতি। পোসাইডনের সাথে তার প্রতিযোগিতা, বারোজন অলিম্পিয়ান, দেবরাজ জিউস, নিজের মহিমা নিয়ে সবার মাঝে বসে আছেন, তারপর নিয়ন্ত্রণ করছেন বিশ্বসংসার। তিনি আঁকলেন সাগরের দেবতা পোসাইডনকে, ত্রিশূল হাতে, নিজেকে আঁকলেন মাথায় শিরস্ত্রাণ, গায়ে বর্ম চড়িয়ে। চার কোনায় এঁকে দিলেন স্বর্গের বিরুদ্ধে নশ্বর মানুষদের বিদ্রোহের গল্প, আর দেবতাদের অভিশাপে তাদের কত শাস্তি হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বীকে এভাবে তিনি হুমকি দিলেন। আরো কত শত স্বর্গীয় ব্যাপারই না তিনি আঁকলেন, তার সব মর্ত্যবাসীর জানাও নয়।

আরাকনি বুঝে-শুনেই উল্টো চাল চাললো। দেবতাদের স্বর্গের মুখোশে যত ঘৃণ্য কাজ আছে সব তার কাপড়খণ্ডে বোনা হলো। সে আঁকলো হাঁসের বেশে জিউস লেডাকে বোকা বানায়, ভোলাভালা ষাঁড় সেজে ঠকায় ইউরোপাকে। তার কাপড়ে আঁকা ষাঁড়কে সবাই আসল ষাঁড় ভেবে ভুল করলো। যখন ইউরোপা ষাঁড়ের কাঁধে চড়ে বসলো, ষাঁড় তাকে অপহরণ করে নিয়ে চললো সাগরের দিকে। উপস্থিত দর্শকেরা ভাবলো এই যে, পানিটাও বুঝি সত্য, এখনই চাইলে সাঁতার কাটা যাবে। অসহায় ইউরোপা লম্বা চোখের ভেজা পাঁপড়ি শুধু সাগর কিনারে তাকিয়ে। দর্শকেরা বুঝলো, সে তার বন্ধুদের খুঁজছে, সাহায্যের আশায়। ইউরোপার দুঃখে তাদের চোখ ভিজে উঠলো।

এমনই সব গল্পে ভরা ছিল আরাকনির ক্যানভাস। তার বোনার দক্ষতায় এথেনাও মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু দেবতাদের কদর্য রূপ বাইরে আনায় তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত লাগলো। নিজের মাকু দিয়ে ক্যানভাসটিকে তিনি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। তারপর সেটাকে চেপে ধরলেন আরাকনির মাথায়, যেন সে অনুতপ্ত আর লজ্জিত হয়। আরাকনি এই লজ্জা সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যা করলো। এই দৃশ্যে দেবীর মনে দয়ার উদ্রেক হলো। এত গুণীকে তিনি বোধহয় একেবারে মেরে ফেলতে চাননি। তিনি বললেন, “বেঁচে ওঠো অপরাধী নারী! আর এই শিক্ষা যেন আমৃত্যু মনে থাকে, তাই ঝুলতে থাকো দড়ির সাথেই।”

ঝুলতে থাকো দড়ির সাথেই; image source: ArtStation

একোনাইটের রস ছিটিয়ে দিলেন কিছু। আরাকনির সারা শরীর একইসাথে সংকুচিত আর লোমশ হতে থাকলো। গজিয়ে উঠলো একাধিক চোখ। আঙুলগুলো সরু সরু পায়ে পরিণত হলো, দেহের পেছন থেকে আসছিলো সাদা সুতো। এথেনা তাকে সেই সুতো ধরে তুললেন, তারপর অভিশপ্ত জীবনের জন্য ছেড়ে দিলেন। সেই থেকে আজও মাকড়সা জাল বুনে চলেছে।

গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, পৃথিবীতে এভাবেই এসেছিল প্রথম মাকড়সা।

ফিচার ইমেজ সূত্র: Science Source

Related Articles