Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল: রহস্য নাকি অতিরঞ্জন?

মায়ামি থেকে বিলাসবহুল ২৩ ফুট ইয়টে করে সাগরে পাড়ি জমালেন ক্যাপ্টেন ড্যান বুর‍্যাক আর তার বন্ধুবর ফাদার প্যাট্রিক হরগ্যান। ১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বর, কদিন বাদেই ক্রিসমাস। বড়দিনের আলোয় দূর থেকে মায়ামি দর্শনের মোহই আলাদা। তাই উইচক্র্যাফট নামের কেবিন ক্রুজারে চড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দুই বন্ধু। কিন্তু তীর থেকে সবে এক মাইল দূরে পৌঁছাতেই কোস্ট গার্ড কল পেলেন যে, জাহাজটি কোনোকিছুর সাথে বাড়ি খেয়েছে, তবে বড় ক্ষতি হয়নি।

কোস্ট গার্ড তখনই রওনা হয়ে গেল, ১৯ মিনিটের মাথায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা গেল, কিছুই নেই। কোনো চিহ্নই নেই জাহাজের। বলা হতো, এ জাহাজটি ডুববে না, কিন্তু ডোবা তো পরের কথা, জাহাজটি যে কখনো এসেছিল এখানে, তারই কোনো হদিস পাওয়া গেল না। জাহাজে এত লাইফ জ্যাকেট, লাইফবোট, ফ্লেয়ার, বিপদসংকেত পাঠাবার যন্ত্র- সব থাকা সত্ত্বেও কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারলো না। সে জায়গাটি ছিল কুখ্যাত বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কিনারায়।

কী হয়েছিল উইচক্র্যাফটের? শুধু উইচক্র্যাফট নয়, আরো অনেক জাহাজ, অনেক বিমান নিয়েই শোনা যায় নানা কথা- যেগুলো নাকি বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছে, কিংবা সেখান দিয়ে আসতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছে অদ্ভুত সব ঘটনার। সেসব রহস্য নিয়েই আমাদের আজকের লেখা।

Source: huffington post

‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ নামটা প্রথম দেন ভিনসেন্ট এইচ গ্যাডিস, সেই ১৯৬৪ সালে। তিনি উত্তর আটলান্টিক সাগরের এক নামহীন জায়গায় অদ্ভুত সব হারিয়ে যাবার ঘটনা থেকে এ জায়গার নাম দেন বারমুডা ত্রিভুজ। জায়গাটার ক্ষেত্রফল লেখকভেদে প্রায় ১,৩০০,৩০০ থেকে ৩,৯০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। তবে এর আগে ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দ্য মায়ামি হেরাল্ড পত্রিকায় এ অঞ্চলে জাহাজের উধাও হওয়া নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল।

সত্তরের দশকে খুব বিখ্যাত হয়ে যায় এ জায়গার নাম এবং এর ঘটনাগুলো।  তখন থেকেই পাইলট আর জাহাজ চালকেরা নানা কাহিনী বলতে থাকেন এ জায়গা নিয়ে। পরে দেখা যায় বেশিরভাগই আসলে নাম কামাবার জন্য বানোয়াট কাহিনী। এ এলাকাটা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের মায়ামি, পুয়ের্তো রিকো ও বারমুডা দ্বীপপুঞ্জ- এ তিন স্থলবিন্দুর সংযোগে গঠিত এক জলজ এলাকা। যেমনটা নিচে দেখতে পাচ্ছেন-

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল; Source: The Washington Post

মজার ব্যাপার, এ সংক্রান্ত প্রথম লিখিত ঘটনা কিন্তু গত শতকের নয়। পঞ্চদশ শতকে যখন ক্রিস্টোফার কলম্বাস ইউরোপ থেকে আমেরিকা যান, তখন তার জার্নালে এ ব্যাপারে লিখেছিলেন। বর্তমান ফ্লোরিডা ও পুয়ের্তো রিকোর এ এলাকা যখন পার হচ্ছিলেন, তখন তার কম্পাসের কাটা ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল। সেখানে তিনি নাকি এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলেন।

১৮৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর মারি সেলেস্ত নামের এক মালবাহী জাহাজ নিউ ইয়র্ক বন্দর থেকে যাত্রা করে। কিন্তু যেখানে মালামাল পৌঁছাবার কথা, সেখানে কোনোদিনই পৌঁছায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জাহাজখানা ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকায়। কিন্তু ১১ জন কর্মীর কেউ ছিল না জাহাজে। ব্যক্তিগত জিনিসপাতি, খাবারদাবার, দামি মালামাল, লাইফবোট সবই অক্ষত সে জাহাজে, শুধু মানুষগুলো উধাও। আরো অবাক ব্যাপার, প্লেটে খাবার ছিল, সেগুলোতে পচন ধরে গিয়েছিল যখন উদ্ধারকারীরা পৌঁছায়। কী এমন হয়েছিল যে খাবারের মাঝ থেকে উঠে যেতে হবে?

১৮৮১ সালে এলেন অস্টিন নামের একটি জাহাজ সমুদ্রে এক পরিত্যক্ত ভাসমান জাহাজ দেখতে পায়। জাহাজের ক্রুরা পরিকল্পনা করলো পরিত্যক্ত জাহাজের জিনিসপাতি নিয়ে নেবে। এমন ভাবনা থেকে কয়েকজন নেমে পড়লো জাহাজটিতে। তারা ভাবছিল সেই জাহাজটিকে চালিয়ে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাবে। দুটো জাহাজ রওনা হলো একসাথেই। কিন্তু এলেন অস্টিন খুব শীঘ্রই নামহীন জাহাজটির খেই হারিয়ে ফেলল।

পরে যখন আবার খুঁজে পেলো, তখন দেখা গেল, জাহাজটি পরিত্যক্ত, তাদের নিজেদের ক্রুরাও উধাও! তখন এলেন অস্টিন থেকে বার্তা পাঠানো হলো, উদ্ধারকারী জাহাজ পাঠাতে। যখন উদ্ধারকারী জাহাজ এসে পৌঁছাল, সে জায়গা অর্থাৎ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল থেকে এলেন অস্টিন ও নামহীন জাহাজ দুটোই উধাও। কোনোদিন তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কথিত আছে, অনেক জাহাজ নাকি এ দুটো জাহাজকে একসাথে ঘুরতে দেখেছে সমুদ্রে, তারা চেষ্টারত ছিল অন্য জাহাজদের পথভ্রষ্ট করতে।

শিল্পীর তুলিতে এলেন অস্টিন ও নামহীন জাহাজখানা; Source: Ranker

১৯১৮ সালে একইভাবে কোনো চিহ্ন না রেখেই হারিয়ে যায় ইউএসএস সাইক্লপস, ব্রাজিলগামী সে জাহাজটি মার্কিন সরকার কর্তৃক ব্রিটিশদের সাহায্য করতে দেয়া হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। মার্চের ৪ তারিখে সেটিকে শেষবার দেখা যায় বারবাডোজের তীরে। ৩০৬ জন ক্রুও এর সাথে উধাও। ১৯৪১ সালেও ইউএসএস প্রোটিয়াস ও ইউএসএস নিরিয়াস একইভাবে নেই হয়ে যায়।

ইউএসএস সাইক্লপস; Source: Wikimedia Commons

এবার আসা যাক প্লেনের কথায়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া সবচেয়ে আলোচিত হলো ফ্লাইট নাইনটিন। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে মার্কিন নেভির পাঁচ সেরা অ্যাভেঞ্জার বম্বার একটি রুটিন মিশনে বের হয়। লেফটেন্যান্ট চার্লস টেইলর নিয়মিত কথা বলছিলেন রেডিওতে বেজের সাথে। কিন্তু হঠাৎ বাক্যের অর্ধেকেই সব চুপ হয়ে যায়। এমন না যে, ঝিরঝিরে বা অস্পষ্ট হয়ে গেল- একদম নেই হয়ে গেল। আর কোনোদিন সেই পাঁচ বিমানের দেখা মেলেনি। সেগুলোকে উদ্ধার করতে পাঠানো বিমানগুলোও ফেরেনি কোনোদিন। আর জায়গাটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। তদন্তে লেখা হয়েছিল ‘অজ্ঞাত কারণে’ তারা উধাও।

ফ্লাইট নাইনটিনের পাঁচ অ্যাভেঞ্জার ©Lee Krystek

১৯৬৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। ৬০০ ফুটের দানবীয় মেরিন সালফার কুইন জাহাজ তার শেষ যাত্রায় রওনা দিল। ভেতরে ছিল ১৫ হাজার টন গলিত সালফার আর ৩৯ জন ক্রু। ফেব্রুয়ারির চার তারিখ পর্যন্ত জাহাজের অবস্থান জানতো সবাই, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। এরপর হঠাৎ অফ হয়ে গেলো রেডিও ট্রান্সমিশন। অফ হয়ে যাবার আগে কমান্ডার বলছিলেন, আবহাওয়া কত সুন্দর, কত চমৎকারভাবে নেভিগেশন চলছে।

মেরিন সালফার কুইন; Source: listas.20minutos.es

বলতে থাকলে এরকম আরো অনেকগুলোই বলা যাবে, কিন্তু সবগুলো কাহিনীর সত্যতা আসলে নেই। তবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছেন অনেকেই, কেউ কেউ দিয়েছেন আজব সব থিওরি। যেমন, কেউ বলেছেন এখানে শয়তানের আস্তানা, শয়তান টেনে নিয়ে যায় এসব জাহাজ আর বিমান। কেউ বলেন, এখানে আসলে এলিয়েনদের বেজক্যাম্প আছে; এজন্যই এখানে অদ্ভুত আলো দেখা যায়। এখানে ঢুকলে কম্পাস কখনো কখনো অদ্ভুত আচরণ কেন করে- সেটার পেছনে যুক্তি দেয়া হয়েছে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের। কোনো থিওরি অনুযায়ী, দাজ্জালের দ্বীপ আসলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলেই। কেউ বা আবার বলেছেন এখানেই আসলে হারানো আটলান্টিস শহর আছে, পানির তলদেশে।

আরেক অদ্ভুত এক তত্ত্ব হলো এখানে নাকি সময় সুড়ঙ্গ (Time Tunnel) আছে। যেমন, ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর অ্যান্ড্রোস আইল্যান্ড বাহামাস থেকে দক্ষিণ ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন পাইলট ব্রুস গার্নোন। তিনি বলেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকায় উড়ে যাবার সময় তিন মিনিটের জন্য তিনি নাকি ছিলেন ‘ইলেকট্রনিক ফগ’ নামের অদ্ভুত এক ধূসর কুয়াশায়। তিনি যখন পাম বিচে অবতরণ করলেন তখন দেখলেন প্লেনের সবার ঘড়িতে দুপুর তিনটা আটচল্লিশ বাজে। অর্থাৎ মাত্র ৪৭ মিনিটে তিনি আড়াইশ মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রতিদিন তার এ ফ্লাইটে ৭৫ মিনিট লাগে অন্তত। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কুয়াশায় তিনি তিন মিনিটে হারিয়েছেন ২৮ মিনিট! সেবা প্রকাশনীর বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে প্রকাশিত বহু আগের বইটিতে এ ঘটনা এবং আধখাওয়া খাবারওয়ালা ভাসমান জনশূন্য জাহাজের ঘটনা বেশ গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছিল।

ব্রুস গার্নোন; Source: History Channel

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চেষ্টা করেছে এ রহস্যের সমাধানের। ২০১৬ সালের ৪ মার্চ প্রকাশিত তাদের আর্টিকেল অনুযায়ী, ৭৫টির মতো বিমান আর প্রায় ৩০০-এর মতো জাহাজ হারিয়ে গেছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। অনেক বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন, আসলে মানবঘটিত ভুল, বৈরী আবহাওয়া আর দুর্ভাগ্যের কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। কিন্তু আসলে স্বভাবতই এ তত্ত্বগুলো সব ঘটনার ব্যাখ্যা দেয় না। এ ব্যাপারে মার্কিন কোস্ট গার্ডকে জিজ্ঞেস করলে তাদের অফিসিয়াল বিবৃতি ছিল, “আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, প্রকৃতি আর মানবস্বভাবের অননুমানযোগ্যতা (unpredictability) বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকেও হার মানায় বহু বার।” ইউএস কোস্ট গার্ড বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ব্যাপারে বরাবরই অবিশ্বাসী। এমন ঘটনাও আছে, যেখানে বর্ণনা করা হয়েছিল, জাহাজডুবির পর কোনো দেহ পাওয়া যায়নি, সেখানে আসলে কোস্ট গার্ডরা মৃতদেহের যথেষ্ট ছবি তুলে এনেছিল

ইউএস কোস্ট গার্ড; Source: Foreign Policy

গবেষক আর্নেস্ট ট্যাভেস ও ব্যারি সিংগার বলেছেন যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ওপর ভিত্তি করে প্রচুর ব্যবসা চালানো হয়েছে, এবং হচ্ছে। এটা নিয়ে মিডিয়ায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করা হয়। সুতরাং একে মিথ্যে প্রমাণ করা আসলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর। এজন্য বরং গুজবগুলো আরো ফুলে ফেঁপে উঠছে।

বিজ্ঞানীরা যুক্তি দেখান যে, এ অঞ্চল নিয়ে বেশি মাতামাতির কারণে, অন্য অঞ্চলের দুর্ঘটনাগুলোকে মানবমন বেশি গুরুত্ব দেয় না। এর মানে এই না যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল ছাড়া অন্য জায়গায় এত বেশি দুর্ঘটনা হয় না; এ অঞ্চলটা আসলে সমুদ্রের অন্য অঞ্চলের মতোই, এটাই বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত। আর, অনেক সময়ই কাহিনীগুলো পরে রঙ চং যোগ করে বলা হয়। সত্যি বলতে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের পাড় ঘেঁষে প্রতিদিন অনেক জাহাজ, প্রমোদতরী আর ফ্লাইট যায় আমেরিকা, ইউরোপ আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। বেশি বেশি চলাচলার কারণেই এ এলাকার দুর্ঘটনা পরিমাণ হয় বেশি। এর সাথে কোনো ট্রায়াঙ্গলের সম্পর্ক নেই। তাছাড়া বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো আরেকটি জায়গা হলো ডেভিলস সী বা ড্রাগন্স ট্রায়াঙ্গল। এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা পড়তে ক্লিক করুন এখানে

তবে কি বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে কোনো রহস্য নেই? আছে বটে। কয়েকটি ঘটনার যে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি তা সত্য। কিন্তু সেগুলোতে যে আসলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কোনো প্রভাব আছে তারও প্রমাণ নেই। তবে একটি মজার থিওরি দিয়েছিলেন কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্যাটেলাইট মিটিওরলজিস্ট ড. স্টিভ মিলার। ২০১৬ সালের অক্টোবরে তিনি নাসার স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে সায়েন্স চ্যানেলের What on Earth প্রোগ্রামকে জানান, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকা জুড়ে জায়গায় জায়গায় ষড়ভুজ মেঘ দেখা যায়। এখানে এমনকি ঘণ্টায় ১৭০ মাইল গতি পর্যন্ত বায়ু বয়ে যায়। এই এয়ার-পকেটগুলোই নাকি জাহাজ বা প্লেন দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। কোনো কোনো মেঘ ২০ থেকে ৫৫ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। তবে তিনি জানান, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হলে আরো গবেষণা করা লাগবে।

ষড়ভুজ মেঘ; Source: Science Channel

তবে বহুদিন পর্যন্ত জনপ্রিয় একটি তত্ত্ব ছিল মিথেন হাইড্রেট গ্যাস থিওরি। একটি মহাদেশের সীমারেখা থেকে পানির নিচে যতটুকু ভূমি বিস্তৃত হয় সোজা কথায় তাকে কন্টিনেন্টাল শেলফ বলে। সেখানে মিথেন হাইড্রেট প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল উপস্থিতি দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়াতে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, এরকম জায়গা থেকে সৃষ্ট বাবল বা বুদবুদ পানির ঘনত্ব কমিয়ে বড় জাহাজকেও ডুবিয়ে দিতে পারে। নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে সৃষ্ট এ বুদবুদের কারণে জাহাজডুবি হয়ে থাকতে পারে, যেহেতু মহাদেশের সীমারেখার সাথেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। এক্ষেত্রে বিনা পূর্বাভাসেই দ্রুত জাহাজডুবি হতে পারে।

কিন্তু প্লেন দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা এ থিওরি দিতে পারে না। তাছাড়া এ থিওরি মাঠে মারা পড়ে, যখন একবিংশ শতকেই U.S. Geological Survey (USGS) থেকে জানানো হয়, গত পনেরো হাজার বছরে এ এলাকায় কোনো মিথেন হাইড্রেট গ্যাস নির্গত হয়নি। USGS থেকে ভূতত্ত্ববিদ বিল ডিলিয়নের ভাষ্যে আরো জানানো হয়, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আসলে একটি রূপকথা।

কন্টিনেন্টাল শেলফ; Source: whatarethe7continents.com

১৯৭৫ সালে Larry Kusche প্রকাশ করেন The Bermuda Triangle Mystery: Solved বইখানা। তিনি যুক্তি দেখান যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নাম যিনি দিয়েছিলেন সেই গ্যাডিস ও অন্য লেখকেরা আসলে অনেক জায়গায় অতিরঞ্জন করেছেন। এমনকি ভুয়া আর শোনা কথা থেকেও তারা কাহিনী নিয়েছেন। তিনি অনেক কাহিনীর অসঙ্গতি প্রমাণ করে দেন। আরো মজার ব্যাপার, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের শিকার বলে চালিয়ে দেয়া বেশিরভাগ ঘটনাই আসলে এ ত্রিভুজের বাইরে ঘটেছিল। তিনি কাহিনীগুলোর সত্যতা ঘাটতে গিয়ে দেখেন, আসলে অনেক কাহিনী আদৌ ঘটেনি। আবার এমন ঘটনাও বলা হয়েছে, যেখানে এক জাহাজের উধাও হয়ে যাবার কাহিনী বলা হলেও, সেটা যে পরে ফিরে এসেছিল সে ঘটনা বলা হয়নি। ট্রপিক্যাল সাইক্লোন প্রবণ এ এলাকায় জাহাজডুবি খুব অবাক করা কিছু না।

Larry Kusche রচিত বইটির প্রচ্ছদ; Source: Goodreads

প্রসঙ্গত, অতিরঞ্জনের একটা উদাহরণ দেয়া যায়। কথা বলছিলাম ফ্লাইট নাইনটিন নিয়ে। এটি সত্য যে, তদন্তে কারণ হিসেবে লেখা হয়েছিল ‘অজ্ঞাত’। কিন্তু এর আগে আসলে পাইলটের ত্রুটি লেখা ছিল, কিন্তু মৃতদের স্বজনদের চাপে সেটা পরিবর্তন করা হয়। হারিয়ে যাবার আগে পাইলট বলছিলেন, কম্পাস কাজ করছে না, তিনি কোথায় আছেন বুঝতে পারছেন না, হয়তো ফ্লোরিডার দিকে।

জিপিএসহীন যুগে পাইলটদের নিজস্ব অবস্থান বোঝার উপায় ছিল যাত্রাশুরুর বিন্দু ও কতক্ষণ কত বেগে চালিয়েছেন সেটা বুঝে- তাই একবার পথ হারালে সমুদ্রের উপর অবস্থান বোঝা বড্ড কঠিন ছিল। আর জ্বালানি শেষ দিকে থাকলে তো কথাই নেই। এটাই আসলে ফ্লাইট নাইনটিনের উধাও হবার পেছনে মূল রিপোর্ট ছিল। সার্চ পার্টি কোনোদিন ফিরে আসেনি এটা আংশিক সত্য। আসলে, সার্চ পার্টির দুটো মার্টিন মেরিনার প্লেনের একটি প্লেন ফিরে আসেনি। কারণ, যাবার পথে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মাঝেই তেলের ট্যাংকে বিস্ফোরণ হয়েছিল সেটির, এবং সেখানেই তার ইতি। বাজে আবহাওয়ার কারণে এর ধ্বংসাবশেষ ফিরিয়ে আনা হয়নি, তবে পাওয়া গিয়েছিল। সম্ভবত, ২২ জন ক্রুর একজন ভুলবশত সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন এরকম পরিবেশে কেবিনে বিশেষ গ্যাস থাকে- সেখান থেকেই বিস্ফোরণ।

সার্চ পার্টির বিমানের মডেল; Source: USN

গল্পগুলো বলার সময় সময় কেন এ কথাগুলো সাথে সাথে বলিনি? কারণ, তা না হলে প্রথম দিকে ব্যাখ্যা আর তদন্ত ছাড়াই গল্পগুলো কীভাবে বহুশ্রুত আর জনবিদিত হয়ে পড়েছিল সেটা বোঝা যাবে না। কিন্তু পরে যখন গল্পের গভীরে ঢোকা হয় তখন বোঝা যায় আসলে ঘটনা একটু ভিন্ন। যেমন ধরুন, সালফারবাহী সে জাহাজের কথা, মেরিন সালফার কুইন। সে জাহাজটি কিন্তু খুবই দুর্ঘটনাপ্রবণ ছিল, দুর্বলও ছিল- কোস্ট গার্ড বলেছিল যে, জাহাজটি চালানোই উচিত না, এটা দুর্ঘটনার অপেক্ষায় আছে। এটা ভাগ্যের পরিহাস যে, এর অন্তিম মুহূর্তের কারণে দোষটা পড়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ওপর, জাহাজের ওপর নয়। এই যেমন, এসএস মেরিন সালফার কুইন জাহাজের সাথে বানানো জমজকে দেখুন, কী সুন্দর করে দুর্বল ট্যাংকারখানা দু’ভাগে ভেঙে গেছে।

Source: unmuseum.org

বহুল কথিত কম্পাসের ছোটাছুটির রহস্য এখনো অমীমাংসিত। অনেকের মতে, এ এলাকায় নিশ্চয়ই ম্যাগনেটিক অ্যানোমালি আছে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটা সত্য যে, চৌম্বক মেরুর সাথে কম্পাসের ছোটাছুটি নতুন কিছু নয়, জাহাজ চালকেরা বহু শতাব্দী ধরে এ সম্পর্কে অবগত। আর শুরুর দিকে এলেন অস্টিন আর নামহীন জাহাজের কথা যে বলা হলো, সেটার ঐতিহাসিক নির্ভরশীলতা নিয়ে বেশ গলদ রয়েছে। আর পাইলট ব্রুস গার্নোন তার ২৮ মিনিট খোয়ানো নিয়ে দিতে পারেননি কোনো প্রমাণ, তাছাড়া তিনি দাবি করেন তিনি অনেক ইউএফও দেখেছেন উড়তে তার পাইলট জীবনে। এসবের পর তিনি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন বিজ্ঞান সমাজের কাছে।

Source: compassbenefitsolutions.net

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের আদতে কোনো রহস্য যদি না-ও থাকে, তবুও অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে রহস্যের খোরাক হিসেবে জনমনে আগ্রহ জাগিয়ে গিয়েছে এ জলজ ত্রিভুজ। লেখাটি পড়া শেষ করে আপনার এখন কী ধারণা? বারমুডা ট্রায়াঙ্গল কি রহস্য নাকি কেবলই অতিরঞ্জন?

ফিচার ইমেজ- Humans At Sea

Related Articles