Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: দ্রোণ পর্বের সারসংক্ষেপ || পর্ব–১

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দশম দিনে কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ভীষ্মের পতন ঘটে এবং দ্রোণাচার্য কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। তিনি পরবর্তী পাঁচ দিন, অর্থাৎ যুদ্ধের একাদশ দিন থেকে পঞ্চদশ দিন পর্যন্ত কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মহাভারতের যে পর্বে/অধ্যায়ে এই পাঁচদিনের যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়েছে, সেটি ‘দ্রোণ পর্ব’ নামে পরিচিত।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের প্রবেশ এবং কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি পদে দ্রোণাচার্য

ভীষ্মের পতনের পর কর্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রবেশ করেন। ভীষ্মের পতনের ফলে কৌরব সৈন্যরা এসময় উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত অবস্থায় ছিল। রণকুশলতার বিচারে কর্ণকে ভীষ্মের সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এজন্য কর্ণের যুদ্ধে প্রবেশের ফলে কৌরব সৈন্যদের মধ্যেকার উদ্বেগ ও আতঙ্ক বহুলাংশে দূরীভূত হয়। অন্যদিকে, কর্ণের যুদ্ধে প্রবেশ পাণ্ডব শিবিরে শঙ্কার সৃষ্টি করে। ভীষ্ম পঞ্চপাণ্ডবকে স্নেহ করতেন এবং এটি সর্বজনবিদিত ছিল যে, তিনি কেবল কর্তব্যের খাতিরে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করছেন। কিন্তু কর্ণ ছিলেন দুর্যোধনের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং দুর্যোধনের মতো তিনিও তীব্র পাণ্ডববিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সুতরাং পাণ্ডবদের মধ্যে এই ধারণা বিদ্যমান ছিল যে, ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্রে পাণ্ডবদের প্রতি নমনীয়তা দেখিয়েছেন, কিন্তু কর্ণ পাণ্ডবদের প্রতি কোনো ধরনের নমনীয়তা দেখাবেন না।

ভীষ্মের পতনের পর কৌরব বাহিনীর জন্য নতুন একজন প্রধান সেনাপতি নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। এমতাবস্থায় প্রধান সেনাপতি হিসেবে কাকে নিযুক্ত করা উচিত, এই ব্যাপারে দুর্যোধন কর্ণের পরামর্শ চান। উল্লেখ্য, কর্ণ দুর্যোধনের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এবং কর্ণের শক্তিসামর্থ্যের প্রতি তার অগাধ আস্থা থাকা সত্ত্বেও দুর্যোধন সরাসরি কর্ণকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করার প্রস্তাব করেননি। এর মধ্য দিয়ে আবারো দুর্যোধনের বাস্তববাদিতা ও রাজনৈতিক চাতুর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কর্ণ প্রকৃতপক্ষে ছিলেন ক্ষত্রিয় এবং রাজবংশের সন্তান, কিন্তু এটি দুর্যোধনের জানা ছিল না। তিনি এবং বাকি সবাই কর্ণকে সারথি অধিরথের ছেলে হিসেবে জানতেন।

সারথিরা ছিল একেবারে নিচু বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং দুর্যোধন জানতেন, কর্ণকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হলে কৌরব বাহিনীর রাজরাজড়াদের অনেকেই তার সেনাপতিত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করতে পারেন বা এই বিষয়ে অসন্তুষ্ট হতে পারেন। এজন্য দুর্যোধন ভীষ্মের পর কর্ণকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করার প্রস্তাব করেননি। বরং তিনি সুকৌশলে কর্ণের কাছেই প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করার বিষয়ে পরামর্শ চান। কারণ তিনি জানতেন, প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্ণ নিজের নাম প্রস্তাব করবেন না।

চিত্রকর্মে দ্রোণাচার্য; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

কর্ণ দুর্যোধনকে পরামর্শ দেন যে, দ্রোণাচার্যকে কৌরব বাহিনীর নতুন প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হোক। দ্রোণাচার্য ছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের শিক্ষাগুরু, অত্যন্ত নিপুণ যোদ্ধা এবং ব্রাহ্মণ, সুতরাং তাকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করার যৌক্তিকতা ছিল এবং সকলের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। কর্ণ মন্তব্য করেন যে, দ্রোণাচার্যকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করলে কৌরব বাহিনীর সকল রাজাই সেটি মেনে নেবেন। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে, দুর্যোধনের মতো কর্ণও একই ধারায় চিন্তা করছিলেন।

কর্ণের পরামর্শ মোতাবেক দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। এসময় দ্রোণাচার্য তার দুইটি সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি দুর্যোধনকে জানান যে, তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করতে সমর্থ হবেন না, কারণ ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্মই হয়েছে দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার জন্য। দ্রোণাচার্য আরো উল্লেখ করেন যে, পঞ্চপাণ্ডব তার বিরুদ্ধে ‘উৎফুল্ল হৃদয়ে’ যুদ্ধ করবেন না। অর্থাৎ, দ্রোণাচার্য এই ইঙ্গিত করেন যে, পঞ্চপাণ্ডব যেহেতু তার বিরুদ্ধে ‘উৎফুল্ল হৃদয়ে’ (অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি দিয়ে) যুদ্ধ করবেন না, সেহেতু তিনিও তাদেরকে হত্যা করতে পারবেন না। এরপর তিনি দুর্যোধনের কাছে জানতে চান যে, দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে ঠিক কী আশা করছেন?

দ্রোণাচার্যের প্রশ্ন শুনে দুর্যোধন কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং এরপর দ্রোণাচার্যকে বলেন যে, তিনি যেন জীবিত অবস্থায় যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করেন। দুর্যোধনের বক্তব্য শুনে দ্রোণাচার্য খুশি হয়েছিলেন, কারণ তার ধারণা হয়েছিল দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করে তার সঙ্গে সন্ধি করতে চাচ্ছেন। উল্লেখ্য, ভীষ্মের মতো দ্রোণাচার্যও পঞ্চপাণ্ডবকে স্নেহ করতেন এবং তিনিও প্রধানত কর্তব্যের খাতিরেই কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। যাই হোক, দ্রোণাচার্য দুর্যোধনকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করবেন। কিন্তু তিনি এই শর্ত জুড়ে দেন যে, এক্ষেত্রে অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অপসারণ করতে হবে, কারণ অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছাকাছি থাকলে যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করা সম্ভব হবে না।

যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার পরিকল্পনার পশ্চাতে দুর্যোধনের বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। তিনি জানতেন যে, দ্রোণাচার্য পঞ্চপাণ্ডবকে হত্যা করতে সম্মত হবেন না, কিংবা সম্মত হলেও সেটির বাস্তবায়ন করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা চালাবেন না। এজন্য তিনি যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার জন্য দ্রোণাচার্যকে আহ্বান জানান। তার উদ্দেশ্য ছিল এরকম: যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করে তিনি তাকে আবার পাশা খেলতে বাধ্য করবেন এবং এরপর পঞ্চপাণ্ডবকে চিরকালের মতো বনবাসে প্রেরণ করবেন। দুর্যোধনের মধ্যে এই আশঙ্কাও ছিল যে, যুধিষ্ঠিরকে হত্যা করা হলে অর্জুন ও ভীম প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুদ্ধ করবেন এবং সেক্ষেত্রে তাদেরকে প্রতিহত করা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। দুর্যোধনের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে আবারো তার চাতুর্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

উত্তর–পশ্চিম ভারতের একটি চিত্রকর্মে কর্ণ; Source: Indic Today

কিন্তু দুর্যোধনের চাতুর্য তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুর্যোধন জানতেন যে, দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহশীল এবং তার মনে এই আশঙ্কা ছিল যে, দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বটে, কিন্তু তিনি সেই মোতাবেক কাজ নাও করতে পারেন। এজন্য দুর্যোধন তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে দেন যে, দ্রোণাচার্য যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুর্যোধনের এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল দ্রোণাচার্য যেন এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন সেটি নিশ্চিত করা। কিন্তু দুর্যোধন কৌরব সৈন্যদের কাছে দ্রোণাচার্যের এই প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়ে দেয়ায় পাণ্ডবরা তাদের গুপ্তচরের মাধ্যমে এই তথ্য তৎক্ষণাৎ জানতে পারেন। এই সংবাদ পেয়ে যুধিষ্ঠির উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, কিন্তু অর্জুন তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি উপস্থিত থাকতে কেউই যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করতে পারবে না।

মহাভারতে প্রদত্ত বিবরণ অনুযায়ী, ভীষ্ম পর্বে কৌরব ও পাণ্ডবরা উভয়েই দুই অক্ষৌহিণী করে সৈন্য হারিয়েছিল। অর্থাৎ, দ্রোণাচার্য যখন কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন, তখন কৌরবদের ছিল নয় অক্ষৌহিণী সৈন্য, আর পাণ্ডবদের ছিল পাঁচ অক্ষৌহিণী সৈন্য। অর্থাৎ, সংখ্যাগত দিক থেকে তখনো কৌরবদের আধিপত্য ছিল।

কর্ণ–অর্জুন দ্বন্দ্ব পরিচিতি

মহাভারতে বহুসংখ্যক তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুতার উল্লেখ রয়েছে। দুর্যোধন ও ভীমের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভীষ্মের প্রতি শিখণ্ডীর শত্রুতা, দ্রোণাচার্য ও দ্রুপদের মধ্যেকার শত্রুতা, দ্রোণাচার্যের প্রতি ধৃষ্টদ্যুম্নের শত্রুতা, ভুরিশ্রবা ও সাত্যকির মধ্যেকার শত্রুতা — মহাভারত জুড়ে এরকম বহু প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুতার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু মহাভারতের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুতা সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, সেটি হচ্ছে কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যেকার শত্রুতা। কুরু রাজ্যের সিংহাসন সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে কর্ণ তার বন্ধু দুর্যোধনের পক্ষে ছিলেন, আর অর্জুন তার ভাই যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ছিলেন, সুতরাং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল অতি স্বাভাবিক।

তদুপরি, তাদের দুইজনের মধ্যে কে অধিকতর দক্ষ ধনুর্ধর, সেটি নিয়েও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। তারা উভয়েই একে অপরকে নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতেন। দ্যূতসভায় যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় দ্রৌপদীকে বাজি রেখে হেরে যাওয়ার পর কর্ণ দ্রৌপদীকে ‘অসতী’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং এজন্য অর্জুন কর্ণকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেন। অন্যদিকে, পাণ্ডবরা বনবাসে থাকাকালে দুর্যোধন গন্ধর্বদের হাতে বন্দি হওয়ার পর যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে অর্জুন দুর্যোধনকে মুক্ত করেন। এতে অপমানবোধ করে দুর্যোধন আত্মহত্যার সংকল্প নেন এবং সেসময় দুর্যোধনকে শান্ত করার জন্য কর্ণ অর্জুনকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেন।

চিত্রকর্মে অর্জুন ও অর্জুনের রথ। অর্জুনের রথের সারথি ছিলেন কৃষ্ণ এবং রথের উপরে যে বানরের মূর্তি দেখা যাচ্ছে সেটি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ত্রেতা যুগের বীর হনুমান; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

কর্ণের যুদ্ধে প্রবেশের পর এই দ্বন্দ্ব সত্যিকারের লড়াইয়ে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে কে অধিকতর দক্ষ ধনুর্ধর ছিলেন, মহাভারতে এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং মহাভারত নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের মধ্যে এই বিষয়ে তীব্র মতবিরোধ বিদ্যমান। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কর্ণকে অর্জুনের চেয়ে অধিকতর দক্ষ ধনুর্ধর হিসেবে বিবেচনা করেন, আবার কেউ কেউ অর্জুনকে কর্ণের চেয়ে অধিকতর দক্ষ ধনুর্ধর হিসেবে বিবেচনা করেন।

ধনুর্বিদ্যায় কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে কে অধিকতর দক্ষ ছিলেন, সেটির নির্ণয় করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে নেয়া যেতে পারে। কর্ণ যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রবেশ করেন, তখন অর্জুন বেশ কয়েকটি দিক থেকে কর্ণের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন।

প্রথমত, অর্জুনের রথের (যেটি ‘কপিধ্বজ’ নামে পরিচিত ছিল) ওপরে একটি বানরের মূর্তি ছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যে উল্লেখিত বিখ্যাত বীর হনুমান। পাণ্ডবদের বনবাসের সময় তিনি ভীমকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি যুদ্ধের সময় অর্জুনের রথের ওপরে থেকে তার শত্রুদের শক্তিক্ষয় করবেন এবং অর্জুনকে রক্ষা করবেন। এর বিপরীতে কর্ণের সেরকম কোনো রক্ষাকারী ছিল না।

দ্বিতীয়ত, অর্জুনের ধনুক (যেটি ‘গাণ্ডীব’ নামে পরিচিত ছিল) ছিল দেবতাদের দেয়া। এই ধনুকটিকে যুদ্ধের সময় তীরের আঘাতে বা অন্য কোনোভাবে কেটে ফেলা সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ, যুদ্ধ চলাকালে অর্জুনকে নিরস্ত্র করা সম্ভব ছিল না। এর বিপরীতে কর্ণ সাধারণ ধনুক ব্যবহার করতেন, যেগুলোকে কেটে ফেলা ছিল খুবই সহজ ব্যাপার।

তৃতীয়ত, অর্জুনকে দেবতারা এমন দুইটি তূণীর দিয়েছিলেন, যেগুলোতে থাকা তীর কখনো শেষ হতো না। অর্থাৎ, যুদ্ধের সময় অর্জুন যথেচ্ছভাবে তীর ব্যবহার করতেন, কিন্তু তীর শেষ হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা তার ছিল না। এর বিপরীতে কর্ণের এরকম কোনো সুবিধা ছিল না, এবং অন্য যে কোনো সাধারণ যোদ্ধার মতো তার তূণীরের তীর শেষ হয়ে গেলে তাকেও বিপজ্জনক অবস্থায় পড়তে হতো।

চিত্রকর্মে কৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনের রথের ঘোড়াগুলোর পরিচর্যা করার দৃশ্য; Source: Cosmic Insights

সর্বোপরি, অর্জুনের রথের সারথি ছিলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ রথচালক। যুদ্ধের সময় সুনিপুণভাবে রথ পরিচালনা করে তিনি বহু বার অর্জুনকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। তদুপরি, কৃষ্ণের উপস্থিতির কারণে অর্জুনের রথটি পুরো যুদ্ধের সময় জুড়ে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে নিরাপদ ছিল এবং কোনো দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেই সেটিকে বিকল করা সম্ভব ছিল না। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণকে হত্যা করাও সম্ভব ছিল না, ফলে অর্জুনের রথ চালকবিহীন হয়ে পড়বে, এরকম সম্ভাবনাও ছিল না। এর বিপরীতে কর্ণের রথের সারথিরা ছিল সাধারণ মানুষ এবং তাদেরকে হত্যা করা ছিল খুবই সহজ কাজ।

উল্লেখ্য, ভীষ্ম পর্বে প্রাপ্ত বিবরণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, দুইজন রথী যখন একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হতেন, তখন তাদের মূল লক্ষ্য থাকতো প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা। প্রতিদ্বন্দ্বী রথীকে হত্যা করা ব্যতীত তাকে পরাজিত করার দুইটি উপায় ছিল। হয় তাকে এমনভাবে আহত করতে হতো, যাতে সে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়, কিংবা তার রথের সারথিকে বা রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে হত্যা করতে হতো, যাতে রথটি বিকল হয়ে যায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী, দ্বিতীয় উপায়টি ছিল নিষিদ্ধ ও অনৈতিক, কারণ রথের সারথি বা রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে আক্রমণ করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই এই নিয়মটির লঙ্ঘন শুরু হয়।

কিন্তু অর্জুনের বিরুদ্ধে যারাই যুদ্ধে লিপ্ত হতেন, তাদের জন্য দ্বিতীয় উপায়টি ছিল অকার্যকর, কারণ অর্জুনের রথ ছিল সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত। অন্যদিকে, অর্জুন ঠিকই তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের রথ বিকল করে দিয়ে তাদেরকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করতে পারতেন। বলাই বাহুল্য, কর্ণও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

এছাড়া কর্ণের আরো দুইটি গুরুতর সমস্যা ছিল। তাকে তার গুরু মহর্ষি পরশুরাম এই মর্মে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, জীবনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তিনি ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের মন্ত্র ভুলে যাবেন। তদুপরি, এক ব্রাহ্মণ কর্ণকে এই মর্মে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের সময় তার রথের চাকা মাটিতে আটকে যাবে। এই অভিশাপগুলো কখন কার্যকরী হবে, সেটি কর্ণের জানা ছিল না। সুতরাং এই অভিশাপ দুইটি আমৃত্যু তার জন্য মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে ছিল।

চিত্রকর্মে কর্ণ কর্তৃক ব্রাহ্মণবেশী ইন্দ্রকে নিজের সহজাত কবচ–কুণ্ডল প্রদানের দৃশ্য; Source: Hinglaj

সর্বোপরি, কর্ণ সূর্যদেবের প্রদত্ত কবচ–কুণ্ডল নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার এই সহজাত কবচ–কুণ্ডল তাকে যে কোনো দিব্যাস্ত্রের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারত। অর্থাৎ, কর্ণ ছিলেন অংশত অমর। কিন্তু পাণ্ডবরা বনবাসে থাকাকালে অর্জুনের বাবা ইন্দ্রদেব এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে কর্ণের কাছ থেকে তার কবচ–কুণ্ডল চেয়ে নেন। কর্ণ কখনো কোনো দানপ্রার্থীকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না, এজন্য তিনি তার কবচ–কুণ্ডল শরীর থেকে কেটে ছদ্মবেশধারী ইন্দ্রকে দিয়ে দেন। কর্ণের দানশীলতায় অত্যন্ত খুশি হয়ে ইন্দ্র কর্ণকে ‘বাসব শক্তি’ অস্ত্র প্রদান করেন। এই অস্ত্রের সাহায্যে যে কাউকে হত্যা করা সম্ভব ছিল, কিন্তু এই অস্ত্র কর্ণ কেবল একবারই ব্যবহার করতে পারতেন। কর্ণ ঠিক করে রেখেছিলেন যে, তিনি অর্জুনের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করবেন। একমাত্র এই দিক থেকেই কর্ণ অর্জুনের বিরুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন।

যুদ্ধের একাদশ দিন: পাণ্ডবদের কৌশলগত বিজয়

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একাদশ দিনে দ্রোণাচার্য কৌরব সৈন্যদের নিয়ে ‘শকটব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ কৌরব বাহিনীকে একটি শকট/গাড়ির আকারে সজ্জিত করেন। এটিকে প্রতিহত করার জন্য পাণ্ডবরা ‘ক্রৌঞ্চব্যূহ’ গঠন করে, অর্থাৎ পাণ্ডব বাহিনীকে একটি বকের আকারে সজ্জিত করে। উভয় পক্ষের ব্যূহ গঠনের পর তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়।

যুদ্ধের শুরুতেই দ্রোণাচার্য তার অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে পাণ্ডবদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। তার তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয় এবং পাণ্ডব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে থাকে। দ্রোণাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করে পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করেন এবং এর ফলে পাণ্ডবদের বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্রসর হয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে পাল্টা দিব্যাস্ত্র ব্যবহার করেন এবং দ্রোণাচার্য কর্তৃক প্রয়োগকৃত দিব্যাস্ত্রগুলোকে প্রতিহত করেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের আক্রমণের ফলে দ্রোণাচার্যের সৈন্যদলের বিভিন্ন অংশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তখন দ্রোণাচার্য তার সৈন্যদের পুনরায় সংগঠিত করেন এবং পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করেন। তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তার তীরে আবারো বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। দ্রোণাচার্যের তীব্র আক্রমণের ফলে পাণ্ডব বাহিনীর বিভিন্ন অংশ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে থাকে।

এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠিরের নেতৃত্বে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা দ্রোণাচার্যকে প্রতিহত করার জন্য তার দিকে অগ্রসর হন এবং কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য তাদের দিকে অগ্রসর হন। এসময় উভয় পক্ষের শীর্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে বহুসংখ্যক দ্বৈরথ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, কিন্তু সেগুলোর সিংহভাগের ফলাফলই মহাভারতে উল্লেখ করা হয়নি।

শকুনি সহদেবের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর সহদেবের তীরের আঘাতে শকুনির ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং তার রথের সারথি নিহত হয়। সহদেব তীরবর্ষণ করে শকুনির রথটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেন। এমতাবস্থায় শকুনি একটি গদা হাতে নিয়ে তার ধ্বংসপ্রাপ্ত রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং সহদেবের দিকে ছুটে গিয়ে গদার আঘাতে তার রথের সারথিকে হত্যা করেন। এরপর সহদেব একটি গদা হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং শকুনির বিরুদ্ধে গদাযুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু এই গদাযুদ্ধের ফলাফল কী হয়েছিল, সেটি মহাভারতে উল্লেখ করা হয়নি।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একাদশ দিনে কৌরবদের মূল লক্ষ্য ছিল যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করা; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

বিবিংশতি (দুর্যোধনের ভাই) ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর বিবিংশতির তীরের আঘাতে ভীমের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং তার ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। ক্ষিপ্ত ভীম বিবিংশতির রথের দিকে একটি গদা নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে বিবিংশতির রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। এরপর বিবিংশতি একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং ভীমের রথের দিকে ছুটে যান। কিন্তু তারপর কী ঘটেছিল, সেটি মহাভারতে উল্লেখ করা হয়নি।

কৃপাচার্য চেদির রাজা দৃষ্টকেতুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দৃষ্টকেতু তীরের সাহায্যে তার দিকে কৃপাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরের আঘাতে কৃপাচার্যের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। এরপর কৃপাচার্য দৃষ্টকেতুর ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন, কিন্তু এই দ্বৈরথের ফলাফল কী হয়েছিল, সেটিও মহাভারতে উল্লেখ করা হয়নি। অনুরূপভাবে, কৃতবর্মা সাত্যকির বিরুদ্ধে, ভুরিশ্রবা শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে, অলম্বুষ ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে, অনুবিন্দ চেকিতনের বিরুদ্ধে এবং লক্ষ্মণ ক্ষত্রদেবের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু এই দ্বৈরথগুলোর ফলাফল মহাভারতে উল্লেখ করা হয়নি।

দ্রোণাচার্য দ্রুপদের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই দেখা যায় যে, দ্রুপদ ভগদত্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। অন্যত্র শল্য নকুলের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর নকুলের তীরের আঘাতে শল্যের রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং তার ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। শল্যকে পরাজিত করার পর নকুল শঙ্খধ্বনি করেন। এদিকে মৎস্য রাজ্যের রাজা বিরাট তার সমগ্র সৈন্যবাহিনী নিয়ে কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু কর্ণ একাকী বিরাট ও তার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন এবং কর্ণের তীরে মৎস্য রাজ্যের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়।

পৌরব অভিমন্যুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর অভিমন্যুর তীরের আঘাতে পৌরবের রথের ঝাণ্ডা ও ধনুক কাটা পড়ে। এরপর অভিমন্যু পৌরবকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কৃতবর্মা তীরের সাহায্যে উক্ত তীরটিকে এবং অভিমন্যুর ধনুক কেটে ফেলেন। এরপর অভিমন্যু একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং পৌরবের রথের দিকে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে যান। তিনি পৌরবের রথের ওপরে ওঠেন এবং তার পদাঘাতে পৌরবের রথের সারথি নিহত হয়। এরপর তিনি পৌরবের চুল ধরে তাকে টেনে শূণ্যে তোলেন এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন।

এটি দেখে জয়দ্রথ অভিমন্যুকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন এবং একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার নিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পৌরবের রথের দিকে ছুটে আসেন। তখন অভিমন্যু পৌরবকে ছেড়ে দিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন। কৌরব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে অভিমন্যুর দিকে বহুসংখ্যক বর্শা, কুঠার ও তলোয়ার নিক্ষেপ করে, কিন্তু অভিমন্যু সেগুলোকে হয় তার ঢালের সাহায্যে প্রতিহত করেন, নয়ত তার তলোয়ারের সাহায্যে কেটে ফেলেন। এরপর তিনি জয়দ্রথের বিরুদ্ধে তলোয়ারযুদ্ধে লিপ্ত হন। তীব্র লড়াইয়ের পর জয়দ্রথ অভিমন্যুর ঢালে আঘাত করলে তার তলোয়ারটি ভেঙে যায় এবং এরপর জয়দ্রথ ক্ষিপ্রগতিতে পশ্চাৎপসরণ করে তার রথে আরোহণ করেন। জয়দ্রথের পরাজয়ের পর অভিমন্যু তার নিজের রথে আরোহণ করেন এবং তার তীরে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।

একাদশ দিনের যুদ্ধে অভিমন্যু বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন; Source: Wikimedia Commons

এমতাবস্থায় শল্য অভিমন্যুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং অভিমন্যুর দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু অভিমন্যু লাফিয়ে উঠে সেই তীরটি ধরে ফেলেন এবং সেটিকে শল্যের রথের দিকে নিক্ষেপ করেন। উক্ত তীরের আঘাতে শল্যের রথের সারথি নিহত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শল্য একটি গদা হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং ক্ষিপ্রগতিতে অভিমন্যুর রথের দিকে ছুটে যান। এটি দেখে ভীম গদা হাতে শল্যের দিকে ছুটে আসেন। অভিমন্যুও শল্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু ভীম তাকে নিরস্ত করে নিজেই শল্যের বিরুদ্ধে গদাযুদ্ধে লিপ্ত হন। এরপর শল্য ও ভীমের মধ্যে একটি তীব্র গদাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে শল্য ও ভীম একে অপরের গদার আঘাতে সংজ্ঞাহীন হয়ে মাটিতে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে কৃতবর্মা সেখানে উপস্থিত হয়ে শল্যকে নিজের রথে তোলেন এবং সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। ইতোমধ্যে ভীম সংজ্ঞা ফিরে পান এবং কৌরবদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এর ফলে কৌরব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে।

এমতাবস্থায় কর্ণের ছেলে বৃষসেন পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হতে থাকে। বৃষসেনের তীরে পাণ্ডব বাহিনীর হাজার হাজার রথী, অশ্বারোহী সৈন্য, পদাতিক সৈন্য ও হাতি নিহত হয়। এমতাবস্থায় পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে বৃষসেনকে ঘিরে ফেলেন। শতানীক (নকুল ও দ্রৌপদীর ছেলে) বৃষসেনের দিকে ছুটে যান এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু শীঘ্রই বৃষসেনের তীরের আঘাতে শতানীকের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। এরপর বাকি চার উপপাণ্ডব (প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকীর্তি ও শ্রুতকর্মা) একযোগে বৃষসেনকে আক্রমণ করেন। এমতাবস্থায় অশ্বত্থামার নেতৃত্বে একদল কৌরব রথী বৃষসেনকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং উপপাণ্ডবদেরকে আক্রমণ করেন। এটি দেখে পঞ্চপাণ্ডব তাদের ছেলেদের রক্ষা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন।

এরপর কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দ্রোণাচার্য, কর্ণ, অশ্বত্থামা ও কৃপাচার্যের তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়, এবং অনুরূপভাবে ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এসময় পাণ্ডব সৈন্যদের তীব্র আক্রমণের মুখে কৌরব সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। দ্রোণাচার্য কৌরব সৈন্যদেরকে থামানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। এরপর ক্রুদ্ধ দ্রোণাচার্য পাণ্ডব বাহিনীর একেবারে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্যকে হত্যা করেন। যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যের ওপর তীরবর্ষণ করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের ধনুক কাটা পড়ে।

দ্রোণাচার্যকে যুধিষ্ঠিরের নিকটবর্তী হতে দেখে পাঞ্চালের রাজপুত্র কুমার দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করেন, কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে তিনি নিহত হন। এরপর দ্রোণাচার্য পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের তীরবিদ্ধ করতে করতে যুধিষ্ঠিরের দিকে অগ্রসর হন। পাণ্ডব রথী যুগন্ধর দ্রোণাচার্যকে বাধা দেয়ার জন্য অগ্রসর হন, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে তিনি নিহত হন। এরপর পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা দ্রোণাচার্যকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেন। পাঞ্চালের রাজপুত্র বিগ্রহদত্ত ও সিংহসেন একযোগে দ্রোণাচার্যের ওপর আক্রমণ চালান, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে তারা উভয়েই নিহত হন।

এরপর দ্রোণাচার্য অগ্রসর হয়ে যুধিষ্ঠিরের রথের একেবারে সামনে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু তখনই অর্জুন সেদিকে ছুটে আসেন এবং কৌরব বাহিনীর ওপর বিপুল তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। বস্তুত অর্জুন এত তীর নিক্ষেপ করেছিল যে চারদিক তার নিক্ষিপ্ত তীরে ছেয়ে গিয়েছিল, এবং ঠিক সেসময়ই সূর্যাস্ত হয়। এমতাবস্থায় দ্রোণাচার্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেন এবং এরপর পাণ্ডবরাও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে শুরু করেন। সেদিনের যুদ্ধে কৌরবদের মূল লক্ষ্য ছিল যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করা, কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এজন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একাদশ দিনের যুদ্ধে কৌরবদের কৌশলগত পরাজয় ঘটে।

Related Articles