Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডিওক্যালিয়নের প্লাবন: গ্রিক পুরাণে বর্ণিত মহাপ্লাবনের আখ্যান

টাইটান যুদ্ধের পর জিউস নিজেকে স্বর্গের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। আসীন হলেন দেবরাজের সিংহাসনে। স্বর্গলোকের সকল দেবতাও তাকে বিনাবাক্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। পৃথিবী তখন মানুষের পদচারণায় মুখর। সেই সময় পৃথিবীতে বর্তমান ছিলেন দেবতা প্রমিথিউসের পুত্র ডিওক্যালিয়ন। গ্রিক পুরাণে দেবতা প্রমিথিউসের উপাখ্যান সবসময়ই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। টাইটানদের সাথে যুদ্ধজয়ের পর এই প্রমিথিউসের কাছেই মানবসৃষ্টির দায়িত্ব অর্পণ করে দেন দেবরাজ জিউস। স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মানবসভ্যতাকে এর ব্যবহার শেখানোর ফলে জিউস প্রমিথিউসকে দেন অবর্ণনীয় নরকতুল্য শাস্তি। ‘মানব-বন্ধু’ হিসেবে খ্যাত এই দেবতার পুত্র ডিওক্যালিয়ন আচার-ব্যবহারে ছিলেন অনন্য। কোনোপ্রকার মন্দ গুণ তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল না। সেই সাথে বেশ ধার্মিকও ছিলেন তিনি। বাবা দেবতা হলেও তিনি ছিলেন অতি সাধারণ গোছের একজন মানুষ।

আগুন হাতে দেবতা প্রমিথিউস; Image Source: Jan Cossiers.

গ্রিক উপকথা অনুসারে, প্যান্ডোরা হলেন বিশ্বের প্রথম মানবী। এই প্যান্ডোরা এবং টাইটান এপিমেথিয়াসের গভীর প্রণয়ের ফলে জন্ম নেয় পিরা। ডিওক্যালিয়ন এই পিরার সাথেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পিরাও ছিলেন ডিওক্যালিয়নের মতো বিশুদ্ধ ধার্মিক, এবং তার মা প্যান্ডোরার মতো রূপবতী।

সেই সময়ে প্রাচীন গ্রিসের মসনদে বসে আর্কাডিয়া অঞ্চল সামলাচ্ছিলেন সম্রাট লাইকায়ন। তিনি মোট পঞ্চাশজন পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। কারও কারও মতে সেই সংখ্যাটা আবার বাইশ। জনশ্রুতি অনুসারে, লাইকায়ন এবং তার পুত্রদের মতো এত অহংকারী, দুরাচারী, নিষ্ঠুর, এবং অধার্মিক মানুষ পৃথিবীতে আর কখনো জন্ম নেয়নি। পাপের কালিমায় পরিপূর্ণ ছিল তাদের আত্মা। লাইকায়নের ও তার পুত্রদের এই খবর পৌঁছে স্বয়ং জিউসের কানেও।

দেবরাজ জিউস; Image Source: David Roterberg.

সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি স্বর্গ থেকে নেমে এলেন মর্ত্যলোকে, ধরলেন ছদ্মবেশ। তিনি আর্কাডিয়ায় আসবেন, এর ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। তাই, ওখানকার লোকজন সকল খারাপ কর্ম ছেড়ে শুরু করল জিউসের উপাসনা। লাইকায়ন তাদের এই উপাসনা দেখে ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে। জিউসের শক্তিমত্তা নিয়েও করতে লাগল হাসি-তামাশা।

এক রাতে জিউস সেই ছদ্মবেশ নিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য ভেবে স্বভাবতই লাইকায়ন ওই বুড়োকে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু লাইকায়নের কলুষিত মনে তখনও লুকিয়ে আছে ছলনা ও প্রবঞ্চনার ছাপ। নৈশভোজে সে তার নিজ পুত্র নিকটিমোসকে হত্যা করে নরমাংস পরিবেশন করল ছদ্মবেশী জিউসের সামনে। এক টুকরো মাংস মুখে নিতেই জিউস তাদের জোচ্চুরি ধরে ফেলতে পারল। প্রচণ্ড ক্ষোভে লাইকায়নকে নেড়কেমানবে পরিণত করলেন তিনি। নিজের তৈরি বজ্র দিয়ে সহসাই লাইকায়নের সুউচ্চ প্রাসাদ এবং তার ছেলেদের ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন জিউস। আর নিকটিমোসকে পুনরায় জীবন দান করলেন। লাইকায়নের পর সিংহাসন দেখভালের দায়িত্ব গিয়ে বর্তায় নিকটিমোসের উপর।

লাইকায়নকে নেকড়তে পরিণত করলেন জিউস; Image Source: Jan Cossiers.

একইসাথে ঘটা কিছু কাহিনির জন্য মনুষ্যজাতির উপর বেজায় চটে গেলেন জিউস। বললেন,

ওরা ঐদিনের চুনোপুঁটি মাত্র। আমার আদেশেই ওদেরকে তৈরি করা হয়েছে। আর ওরা আমার উপর চালাচ্ছে মাতব্বরি! পাপে পূর্ণ হয়েছে এই ধরা। অহমিকা, নৃশংসতা, শঠতার কালো থাবা গ্রাস করেছে পৃথিবীকে। একসময় ওরা আমাদের বিপদে কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই, এই ঝামেলা মিটানোর একমাত্র উপায় হলো মানবজাতিকে সমূলে উৎপাটন করা।

প্রমিথিউসের পুত্র ডিওক্যালিয়ন প্রতিবছরই ককেশাস পাহাড়ে যেতেন, তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য। বাবা ডিওক্যালিয়নকে মহাপ্লাবনের ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন। সেই সাথে বললেন, প্রস্তুতি নিয়ে রাখার জন্য। পাপ থেকে দূরে থাকা শুদ্ধচিত্তের এই মানুষটি সবাইকে সঠিক পথে ফিরে আসার অনুরোধ করতে লাগলেন। বললেন পাপ কাজ ছেড়ে দেবতাদের উপাসনা করার কথা। পাপের ফল হিসেবে কী দুর্দমনীয় শাস্তি ধেয়ে আসছে, সে সম্পর্কেও সতর্ক করলেন।

অবশ্য মানুষ বিপথগামী হবার পেছনে দোষ রয়েছে স্বয়ং জিউসেরও। ককেশাস পর্বতে প্রমিথিউসকে বন্দি করে রাখার সময় প্যান্ডোরার বাক্সে তিনি জরা, ব্যাধি, অসুস্থতা, ঝগড়া, হিংসা, ঈর্ষা ইত্যাদি বন্দি করে রেখেছিলেন। সেই বাক্স খোলার পরেই এসব জিনিস ঢুকে পড়ে মানুষের মনে। মানুষ জড়িয়ে পড়ে হানাহানি ও সংঘর্ষে, লিপ্ত হয় অপকর্মে।

পৃথিবীর প্রথম মানবী প্যান্ডোরা; Image Source: James Smetham.

যে-ই ভাবা সেই কাজ। ধরণী থেকে অধার্মিক, ঝগড়াটে, হিংসুক, এবং সকল পাপী ও পাপের চিহ্ন মুছে ফেলতে এক মহাপ্লাবনের পরিকল্পনা করেন জিউস। ডাকা হলো তার ভাই সমুদ্র দেবতা পসাইডনকে। দুজনে মিলে স্বর্গ থেকে নামালেন বৃষ্টি। মুষলধারে ঝরা সেই বৃষ্টিতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে লাগল স্থলভাগ। কানায় কানায় পূর্ণ হতে লাগল নদীসমূহ, জলে টইটম্বুর হয়ে যেতে লাগল চারপাশ। যেদিকে চোখ যায় শুধু বিস্তীর্ণ জলরাশি ছাড়া আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব চোখে পড়ে না।

আশু বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মজবুত এক নৌকা নির্মাণ করেছিলেন ডিওক্যালিয়ন। পানি বাড়ার সাথে সাথেই নিজ স্ত্রী পিরাকে নিয়ে নৌকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন তিনি। টানা নয় দিন নয় রাত বিস্তীর্ণ জলরাশিতে ভাসতে ভাসতে তাদের নৌকা গিয়ে ঠেকে পারন্যাসাস পাহাড়ের চূড়ায়। নৌকা থেকে বের হয়ে উঁকি দিলেন দুজন। কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। শুধু অথৈ জলধি। দুজনেই সৎ ও ধার্মিক হওয়ায়, জিউস তাদের প্রতি দয়া দেখালেন। কমিয়ে দিলেন প্লাবনের পানি। ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে আবারও জেগে উঠল স্থলভাগ।

পারন্যাসাস পাহাড় থেকে নামার পর প্রথমেই তাদের চোখে পড়ল দেবী থেমিসের মন্দিরে। দীর্ঘ সময় ধরে পানির নিচে থাকায় মন্দিরে শেওলা পড়ে তা পিচ্ছিল হয়ে গেছে। তবে তখনও সেটি টিকে ছিল। মন্দিরে গিয়েই ভক্তিতে লুটিয়ে পড়লেন দুজন। প্রাণের জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন দেবতাদের নিকট। ঠিক ঐসময় তাদের পেছন থেকে এক দৈবস্বর ভেসে এলো। বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে পেছনে তাকালে দেখা গেল- পাথরের উপর সুদর্শন এক যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। সুঠাম গড়নের সেই যুবকের চুল ছিল হলুদ, চোখ ছিল নীল রঙয়ের। উচ্চতায় অনেক লম্বা তিনি। জুতোজোড়া এবং টুপিতে ডানা লাগানো, এবং পোশাকে প্যাঁচানো সোনালি সাপ দেখেই ডিওক্যালিয়ন বুঝতে পারলেন তিনি হলেন হার্মিস, জিউসের বার্তাবাহক।

দেবতা হার্মিস; Image Source: DeviantArt/Fallfox.

হার্মিস বললেন,

দেবতারা তোমাদের উপর সন্তুষ্ট। তোমরা কী চাও? যা চাও, তা-ই দেওয়া হবে।

বিনয়ের সাথে ডিওক্যালিয়ন উত্তর দিলেন,

আমাদের মানুষ দরকার। বন্ধু, প্রতিবেশী, সমাজ ছাড়া এই পৃথিবীতে একা বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

তোমরা নিজেদের মাথা ঢেকে, চোখ বন্ধ করে তোমাদের মায়ের অস্থিগুলোকে পিছনে নিক্ষেপ করো,

এই বলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন দেবতা হার্মিস।

দেবতার কথা মাথামুণ্ডু কেউই কিছু বুঝতে পারলেন না। কারণ, তাদের দুজনের মা-ই ভিন্ন এবং দুজনেই গত হয়েছে বহু আগেই। অনেক চিন্তাভাবনার পর তারা বুঝতে পারল, মা বলতে বোঝান হয়েছে গায়াকে। বলা যায়, গ্রিক পুরাণের সকল কিছুর উৎপত্তিই গায়া বা পৃথিবী থেকে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার চিরপরিচিত রূপ ধারণ করেছে এই গায়ার জন্যই। যা-ই হোক, তারা মায়ের অস্থি বলতে বুঝল নদীর ধারের পাথরকে। তখন তারা দেবরাজ জিউসের নাম নিয়ে, চোখ বন্ধ করে একে একে পাথরগুলো পেছন দিকে মাটিতে নিক্ষেপ করতে থাকেন। প্রত্যেকটা পাথর থেকে একেকজন মানুষ জন্মাতে লাগল। হার্মিস তাদের চোখ বন্ধ রাখতে বলেছিলেন, যাতে মরণশীল কোনো মানুষ মানবসৃষ্টির প্রক্রিয়া দেখতে না পারে।

দেবী থেমিস; Image Source: Panjoool.

ডিওক্যালিয়ন যে পাথরগুলো নিক্ষেপ করেছিলেন তা থেকে সৃষ্টি হলো পুরুষ, আর পিরার নিক্ষেপকৃত পাথর থেকে স্ত্রীলোক। যেহেতু পাথর থেকে তাদের জন্ম হয়েছিল, তাদের ‘পাথরমানব’ বলেও অভিহিত করা হয়। তারা ছিল সাধারণের চেয়ে সুদৃঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী এক প্রজন্ম। জনশূন্য ও নিস্তেজ পৃথিবীর বুকে প্রাণ সঞ্চার করে একে সুজলা-সুফলায় রূপ দিতে এমন এক প্রজন্মেরই দরকার ছিল। দেবতাদের ইচ্ছাই ছিল সেরকম। ডিওক্যালিয়ন এবং পিরার ঘরে জন্ম নিলো বহু সন্তান। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল হেলেন, হেলেনিক সভ্যতার প্রথম পুরুষ।

পাথর ছুড়ছেন ডিওক্যালিয়ন এবং পিরা; Image Source: Peter Paul Rubens.

এরপর জিউসের আদেশে একে একে অন্যসকল প্রাণীও সৃষ্টি হতে লাগল। সূর্য উদয়ের সাথে সাথে নতুন ভোরের বার্তা পৃথিবীতে ঘটাল বহু নতুন প্রজাতির প্রাণস্পন্দন। কিছুটা পুরনো রূপে, কিছুটা নয়া ধাঁচে। তবে, মহাপ্লাবনে বেঁচে যাওয়া একমাত্র মানব-মানবী ছিলেন ডিওক্যালিয়ন ও পিরা, এমনটা ভাবাও উচিত নয়। জেরানিয়া পর্বতের চূড়া মহাপ্লাবনের তোপে ডুবে যায়নি। সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন জিউসের এক সন্তান। সেখানে আরও ছিলেন পেলিয়নের কেরাম্বাস, এক নিম্ফের ডানার সাহায্যে চূড়ায় আরোহণ করেন তিনি।

প্রাচীন উপকথাগুলোর বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য হলো, এক সভ্যতা আরেক সভ্যতার তা ছড়িয়ে গিয়েছিল বলে কাহিনিগুলোতে প্রচুর মিল লক্ষ্য করা যায়। ফারাক থাকে শুধু চরিত্রের নামে। ডিওক্যালিয়নের প্লাবনের সাথে হযরত নূহ (আ) এর প্লাবন এবং সুমেরীয় মহাপ্লাবনের কাহিনির অনেক সামঞ্জস্য পাওয়া যায়।

শিল্পীর কল্পনায় নূহ (আ) এর তৈরি নৌকা; Image Source: Hideyoshi.

প্রাচীন পৃথিবীর প্রায় সকল সভ্যতায় বর্ণিত মহাপ্লাবনের উপাখ্যানের সারকথা একটাই- দেবতা বা ঈশ্বর মানবজাতির উপর ক্ষুব্ধ হয়ে এই গজব বর্ষণ করেছিলেন। তবে যুগভেদে কাহিনি কিছুটা নতুনত্ব মোড় নিলে বা কিছু সংযোজন ঘটলেও মূল কাহিনি ঘুরে ফিরে একইরকম। সকল উপকথাতেই মহাপ্লাবন শেষে শুধু ধার্মিক, ঈশ্বরের প্রতি অনুগত, এবং নিষ্পাপ মানুষগুলোই বেঁচে ছিল। তাদের থেকেই রিক্ত পৃথিবীতে আবার জন্ম নিয়েছিল পুরো মানবসভ্যতা।

Related Articles