এনিমেশন চলচ্চিত্রের ফ্যান যারা তাদের মাঝে ডিজনির ‘মোয়ানা (Moana)’ মুভি দেখা হয়নি এমন খুঁজে পাওয়া ভার! ছোট্ট মোয়ানার সাহসিকতা আর বীরত্ব পুরো মুভি জুড়ে দেখানো হলেও, সেই মুভির অন্যতম এক মূল চরিত্রে ছিল মাউই। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল এবং দৈত্যাকার শরীর বিশিষ্ট কখনো রাগী আবার কখনো বা হাসিখুশি এক চরিত্র। এই মাউই আসলে শুধুমাত্র একটি মুভি চরিত্র নয়, ডিজনি এই চরিত্রটি তৈরি করেছিলো হাওয়াই-পলিনেশীয় অঞ্চলের বিখ্যাত এক কিংবদন্তির অনুকরণে।
পলিনেশীয় অঞ্চলটা মূলত অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। নিউজিল্যান্ড, তাহিতি, সামোয়া, হাওয়াই ইত্যাদি ক্ষুদ্র সব দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে পলিনেশিয়া অঞ্চল। পৃথিবীর আর সব অঞ্চলভিত্তিক পুরাকাহিনীর মতো এই পলিনেশিয়ায় অঞ্চলের পুরাকাহিনী হলো মাউই। মাউই এর বিভিন্ন জনপ্রিয় কল্পকথা ও তার ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
মাউই বিশাল শরীরের হওয়ার কারণে তার খাবারও লাগতো অন্য সবার চেয়ে বেশি। কিন্তু প্রতিনিয়ত কাঁচা মাছ আর কাঁচা শাকসবজি খেতে খেতে মাউইয়ের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, কারণ তারা রান্না করার নিয়ম জানতো না। এই সময় একদিন মাউইয়ের কানে- এলো প্রাচীন এক অ্যালেই পাখির কাছে নাকি কী এক জাদু আছে, যেটা দিয়ে খাবারদাবার অনেক সুস্বাদু করে তোলা যায়। এই শুনে মাউই তার ভাইদের নিয়ে চললো সেই পাখির খোঁজে।
খুঁজতে খুঁজতে তারা চলে এলো হালেয়াকালা পর্বতের কাছাকাছি। ক্ষুধা পাওয়ায় সেখানকার হ্রদে মাছ ধরতে শুরু করলো মাউই এবং তার ভাইয়েরা। এই সময় মাউইয়ের চোখে পড়লো হালেয়াকালা পর্বতের চূড়া থেকে কেমন ধোঁয়ার মতো উঠছে। এই ঘটনা দেখে সে ভাইদের নৌকার কাছে রেখে গেলো রহস্যের অনুসন্ধান করতে। গিয়ে দেখে বিশাল এক অ্যালেই পাখি পাহাড়ের ধারে এক জলাভূমিতে বসে কীসব বস্তু হাতে নিয়ে ঘষে ঘষে সেখান থেকে আলো তৈরি করছে। পরে সেই আলোতে খাবার পুড়িয়ে খাচ্ছে। মাউই বুঝলো এটাই অ্যালেই পাখিরূপী সেই প্রাচীন দেবতা, যার কাছে খাবার সুস্বাদু করার জাদু আছে। সে দেখতে চাইলো পাখিটা কী বস্তু ঘষে ঘষে এভাবে আগুন জ্বালায়। তাই সে ওঁত পেতে বসে রইলো আড়ালে।
এদিকে পাখিটা টের পেয়ে গেছে যে তাকে কেউ অনুসরণ করে তার কাছ থেকে আগুন জ্বালানোর কায়দা শিখে নিতে চাইছে। কিন্তু সে চায় না এই ক্ষমতা কাউকে শেখাতে। তাই সে চুপ করে বসে রইলো। সকাল থেকে দুপুর গড়ালো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপরে সন্ধ্যা, অবশেষে নামলো রাত। কিন্তু কেউ হাল ছাড়ছে না। মাউই অন্ধকারে আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে আছে, ওদিকে পাখিটাও ঝিম মেরে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে। পাখিটার ক্ষুধা পেয়েছিলো অনেক। কিন্তু মাউইয়ের উপস্থিতিতে আগুন জ্বালাতে চায় না সে। তাই একপর্যায়ে ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে কাঁচা মাছ কতগুলোই গিলে খেয়ে নিলো।
এভাবে তিন দিন পার হয়ে তৃতীয় দিনের রাত নেমে আসলো। তা-ও কেউ নড়ে না নিজ নিজ অবস্থান থেকে। কাহাতক আর সহ্য করা যায়! তখন মাউই এক বুদ্ধি খাটালো। রাতের আঁধারে পাহাড় থেকে নিচে নেমে এসে নৌকায় তার ভাইদের কাছে গেলো। সেখানে একটা গাছের গুঁড়িকে ছেঁচে মানুষের আকৃতিতে বানিয়ে তার ভাইদের কাছে রেখে আসলো। দূর থেকে অন্ধকারে দেখলে মনে হবে, মাউই তার ভাইদের সাথে নৌকায় বসে আছে। এরপরে চুপিচুপি আবার চলে এলো পাখিটার কাছে। এদিকে টানা তিন দিন ধরে কাঁচা খাবার খেয়ে পাখির জিহ্বার স্বাদ গ্রন্থি উঠে যেতে শুরু করেছিলো। সে পাহাড় থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো মাউই অধৈর্য হয়ে চলে গেছে তার ভাইদের কাছে। নৌকায় বসে আছে। তখন পাখিটা আবার নতুন করে আগুন জ্বালালো। আগুন জ্বালানোর সাথে সাথেই মাউই এসে ক্যাঁক করে পাখিটার গলা চেপে ধরলো। তারপরে তাকে জেরা শুরু করলো, আলোটা সে কীভাবে জ্বালিয়েছে সেটা জানতে চেয়ে।
মাউইয়ের শক্তিশালী হাতের মুঠোয় পড়ে পাখির দম আটকে যেতে শুরু করলো। তখন সে বললো, জলাভূমি থেকে একগাদা ঘাস এনে জড়ো করো। তারপরে সেগুলো জড়ো করে ঘষতে থাকো। তাতে আগুন ধরবে। মাউই গেল জলাধারের ঘাস খুঁজতে। কিন্তু যাবার আগে পাখিটাকে খাঁচায় আটকে রেখে গেলো। পাখিটা প্রমাদ গুনলো। সে মাউইকে ভুল তথ্য দিয়েছে। ভেবেছিলো মাউই ঘাস খুঁজতে যাবার সুযোগে সে পালিয়ে যাবে। কিন্তু পাখিটির সেই পরিকল্পনা কোনো কাজে দিল না। মাউই ঘাস খুঁজে এনে পাখির কথামতো হাতের তালুতে রেখে ঘষতে শুরু করলো। কিন্তু যথারীতি কিছুতেই কিছু হয় না। রেগেমেগে তাই আবারো ক্যাঁক করে চেপে ধরলো পাখিটার গলা। পাখি বুঝলো সত্য বলা ছাড়া তার নিস্তার নেই। তাই অবশেষে সত্যটা বললো সে। চন্দনকাঠ এনে একটার সাথে আরেকটাকে ঘষতে বললো। এবারে কাজ হলো। মাউই জ্বালাতে পারলো আগুন।
কিন্তু সত্যিটা বের করতে পারলেও মাউইয়ের মেজাজ একদম চড়ে বসেছিলো। টানা তিন দিন না খাইয়ে তাকে বসিয়ে রেখেছে তাকে পাখিটা। তার উপরে মিথ্যা কথা বলে ধোঁকাবাজিও করতে চেয়েছে। তাই সে রেগেমেগে পাখিটাকে উপুড় করে আগুনের উপরে ধরলো। এতে পাখিটার চাঁদির পালক সব পুড়ে গেলো। এরপরে আগুন নিয়ে মানুষদের কাছে ফিরে গেলো মাউই। মাউইয়ের মাধ্যমে সেই থেকে মানুষেরা আগুনের ব্যবহার শিখলো। আর সেই থেকেই অ্যালেই পাখিরাও তাদের মাথার চাঁদির সব পালক হারালো। এখনো টেকো-মাথা অবস্থাতেই তাদের পাওয়া যায় জলাভূমিতে বিচরণ করতে!
হাওয়াই দ্বীপের এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, মাউই তার ভাইদের নিয়ে মানাইয়াকালানির হুকে ধরেছিলো এক বিশাল মাছ। এত বিশাল মাছ কোনো মানুষ আর কখনো চোখে দেখেনি। মাউই তখন মাছটাকে তার ভাইদের জিম্মায় রেখে গিয়েছিলো এক পুরোহিতের খোঁজে। পুরোহিত এসে প্রার্থনা করলে পরে মাছটা কেটে সবার মাঝে ভাগ করে দেবে সে। কিন্তু সে চলে যাবার পরে তার ভাইয়েরা সিদ্ধান্ত নিলো, মাছটাকে তারা একাই খেয়ে ফেলবে।
তখন সেটাকে কাটতে শুরু করলো তারা, আর সেই বিশাল মাছ গগনবিদারী আর্তনাদ শুরু করলো। সেই আর্তনাদে আশেপাশের বিশাল অঞ্চল ভেঙে পুরো চৌচির হয়ে গেলো। এক এলাকা আরেক এলাকা থেকে আলাদা হয়ে পড়লো। ভূমিকম্পের ফলে জেগে উঠলো অনেক পাহাড় আর আগ্নেয়গিরি। ভাইয়েরা মাউইয়ের কথা শুনলে ঐ এলাকার সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারতো। কিন্তু বেশি লোভ করার ফলে এখন সবাই একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেলো। এভাবেই মাওরি, হাওয়াইয়ান, তাহিতিয়ান কিংবা সামোয়ানের মতো দ্বীপ জেগে ওঠে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে।
কল্পকাহিনী হোক আর যা-ই হোক, মাউইয়ের গল্প যুগ যুগ ধরে টিকে রয়েছে পলিনেশিয়ার উপাখ্যানে। গ্রীক, পারস্য, আরব্য বা ভারতীয় মিথোলজির মতো সমৃদ্ধ মিথোলজি পলিনেশিয়ানদের হয়তো নেই, তবে তাদের ছোট এই এক কিংবদন্তির ইতিহাস বারে বারে মুখে ফেরে তাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। মাউই নামে কখনো কোনো মরণশীল দেবতা ছিলো কি না তা হয়তো কখনো জানা যাবে না, তবে এই উপাখ্যানের উপর ভিত্তি করে বই লেখা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে, তা-ই বা কম কীসে!
This article is about a Hawaiian legend, maui. There are lots of polynesian legends. Maui is one of them.
Source : Hyperlinked in the article.
Feature imsge : moanamovies