Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্রিক পুরাণে রংধনুর দেবী আইরিস

আইরিস উজ্জ্বল হাওয়ার দমকের মতো উড়ে যায়। তাকে বলা হয় সোনালী ডানার দূত, বলা হয় ত্রস্তপদী। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় সে রংধনুর দেবী। স্বর্গ আর মর্ত্যের মাঝে যোগাযোগ তৈরি করাই তার কাজ। কিন্তু গ্রিক পুরাণে সবচাইতে কম পরিচিত দেবতাদের সেও একজন।
আইরিসের বাবা থমাস সাগরের পুত্র, মা ইলেক্ট্রা একজন মেঘপরী। গ্রিক পুরাণে তাই মেঘ থেকে সাগরে রংধনু দেখানো হয়। তার বোনদের মাঝে অন্যতম হারপিস এবং আরকি।

রংধনুর দেবী আইরিস; image source: Painting You With Words

আইরিস আর তার বোনদের নিয়ে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে। ট্রয়ের যুদ্ধের আগের কথা। জ্যাসন আর নাবিকদল চলেছে সোনালী ঝালর চুরি করতে। পথে হাজার রকম বাধা। একসময় তারা ফিনিয়াসের দ্বীপে থামল। সেই দ্বীপে একা একা বাস করছে অন্ধ ফিনিয়াস। ফিনিয়াসের বিয়ে হয়েছিল বোরিয়াসের মেয়ে ক্লিওপেট্রার সাথে। তাদের সংসারে ফুটফুটে দেবশিশুর মতো ছেলে জন্মায়। কিন্তু ছেলে ছোট থাকতেই মারা গেল ক্লিওপেট্রা। দ্বিতীয়বার বিয়ে করল ফিনিয়াস। সৎ মা একটুও দেখতে পারত না বাচ্চাদের। সারাদিন ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলত ফিনিয়াসকে। একদিন ফিনিয়াস নিজের ছেলেদের চোখ অন্ধ করে দিল। এদিকে বোরিয়াস নিজের নাতিদের এমন অবস্থা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে জিউসের কাছে বিচার দিলেন। বিচারে ফিনিয়াসকে আজীবন অন্ধত্ব ও নির্বাসন, অথবা মৃত্যুদণ্ড বেছে নিতে বলা হল। প্রাণ বাঁচাতে ফিনিয়াস অন্ধত্বকেই বরণ করে নিল। কৃষ্ণসাগরের এক নির্জন দ্বীপে তাকে নির্বাসন দেওয়া হল। সূর্যের দেবতা হেলিওস চেয়েছিল ফিনিয়াসের আরও বড় শাস্তি হোক। তাই সে হারপিসকে পাঠালো ফিনিয়াসকে সবরকম যন্ত্রণা দিতে, সারাদিন ধরে ফিনিয়াস যে খাবার সংগ্রহ করত সেগুলো চুরি করে আনতে। হারপিস সব খাবার চুরি করত না। দুর্গন্ধযুক্ত অল্পকিছু খাবার ফেলে আসত, যাতে ফিনিয়াসের এই কঠিন জীবন আরো দীর্ঘায়িত হয়। 

জ্যাসন আর তার নাবিক ভাইয়েরা দ্বীপে পৌঁছে ফিনিয়াসের এই দুর্দশার কথা শুনে কষ্ট পেল;image source:  Greek Mythology Link

জ্যাসন আর তার নাবিক ভাইয়েরা দ্বীপে পৌঁছে ফিনিয়াসের এই দুর্দশার কথা শুনে কষ্ট পেল। তারা হারপিসকে ধরার ফাঁদ পাতল। কিন্তু ডানাওয়ালা হারপিস উড়ে আসত আর দ্রুতগতিতে চলে যেত। তাকে ফাঁদ পেতে ধরা যাচ্ছিল না। জ্যাসনরা তখন অন্য ফন্দি আটল। জ্যাসনের নাবিক বন্ধুদের ভেতর দুজন ছিল বোরিয়াসের ছেলে। তাদের দুজনের পিঠেই আছে ডানা। হারপিস যখন খাবার চুরি করতে এল, তারা হারপিসকে আটকে রাখল। বোনকে আটকানোর কথা শুনে ছুটে এলো আইরিস। প্রথমে সে বোরিয়াসের ছেলেদের দেবতার ভয় দেখালো। কিন্তু ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ফিনিয়াস অপরাধ করেছিল তাদের ভাগ্নের উপর। তার যথেষ্ট সাজা সে পেয়েছে। তখন আইরিস কাকুতি মিনতি করল তার বোন দেবতার আদেসে এসব করেছে নিজে থেকে নয়। কিছুতেই তাদের মন না গলায় আইরিস স্টিক্স নদীর নামে শপথ করে বলল, বোনকে ছেড়ে দিলে আর কখনো ফিনিয়াসকে জ্বালাতন করতে আসবে না তারা। বোনকে ভালোবাসার নিদর্শনের এটা প্রচলিত গল্প হলেও হেসিওড তার গল্পে আইরিসের বদলে সব কৃতিত্ব দিয়ে গেছেন হার্মিসকে।

একা থাকতে ভালোবাসেন স্টিক্স;image source: DevianArt

আইরিস আর স্টিক্স নদীকে নিয়েও গল্প আছে পুরাণে। অমর দেব-দেবীরা এতই চতুর আর ছলাকলায় পারদর্শী, কে যে কখন কার পেছনে ষড়যন্ত্র করে, বোঝা যায় না। তাই দেবতারা স্বজাতিকেও খুব বেশি বিশ্বাস করতে পারেন না।একজন দেবতার জন্য সবচেয়ে বড় শপথ হল স্টিক্স নদীর নামে শপথ করা। নিজের উপর আস্থা আনানোর জন্য তাই তারা স্টিক্সের নামে শপথ করেন। এ কারণে স্টিক্সকে বলা হয় শপথের নদী। স্টিক্স নদী বয়ে চলেছে পাতালের পাশ দিয়ে। স্টিক্সের দেবী থাকেন হেডিস পার্সিফোনির বাড়ির কাছেই, রূপার স্তম্ভে দাঁড়ানো পাথরের ছাদের বাড়িতে। স্টিক্স দেবতাদের খুব একটা পছন্দ করেন না। তাই তাদের থেকে দূরেই থাকেন। অমর সৃষ্টি হিসেবে স্টিক্সের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি আছে শুধু আইরিসের। এজন্য অলিম্পাসে কোনো ঝামেলা হলেই জিউস হন্তদন্ত হয়ে ডেকে পাঠান আইরিসকে, স্টিক্সের কাছ থেকে এক কলস পানি আনতে। এই পানি পান করে দেবতারা শপথ করেন বা সত্য কথা বলেন। কোনোভাবে তারা এই শপথ ভাঙলে বা পানি খেয়ে মিথ্যা বললে শাস্তিস্বরূপ তাদের এক বছরের জন্য দেবালয় থেকে অমৃত, মধু বা স্বর্গীয় বাতাস সরবরাহ বন্ধ থাকে। যদি অন্যায় গুরুতর হয় তবে সাথে আরো নয় বছর যোগ করা হয়। শাস্তি চলাকালে দেবতাদের কোনো অনুষ্ঠানে হাজির হতে পারেন না অপরাধী।

আইরিসকে গ্রিক পুরাণে জিউসের রাণী হেরার সহচর ও একান্ত বাধ্যগত দাসী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে হেরার জন্য আইরিস শিকারী কুকুরও হতে পারবে। আইরিস কখনো ঘুমিয়ে থাকলেও তার কান সজাগ থাকে যেন হেরার আদেশ অব্যর্থ না হয়। এভাবে বিবেচনা করলে আইরিসকে উচ্চশ্রেণীর দাস বলা যেতে পারে। কিন্তু আইরিস তার ব্যক্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছিল, সে প্রমাণ পাওয়া যায় এপলোন আর আরটেমিসের জন্মের সময়।
হেরা জিউসের তৃতীয় স্ত্রী। হেরাকে বিয়ে করার পর জিউস আকৃষ্ট হয় লেটোর প্রতি। লেটোর গর্ভে তার সন্তান জন্মায়। হেরা কিছুতেই স্বামীকে নিরস্ত না করতে পেরে লেটোকে শাস্তি দেয়ার উপায় খুঁজে বের করে। পৃথিবীর সব মাটি, জঙ্গল, পাহাড়, ঝর্ণার দেবীদের বলে দেয় কেউ যেন বাচ্চা প্রসবের জন্য লেটোকে স্থান না দেয়। লেটো প্রসবযন্ত্রণা নিয়ে সবখানে ঘুরলেও কেউ হেরার ভয়ে তাকে জায়গা দিতে অস্বীকার করে। অবশেষে সে পৌঁছায় ডেলোসের দ্বীপে। ডেলোস তাকে এক শর্তে থাকতে দিতে রাজি হয়। ডেলোস জানতো হেরা তার ভয়ের কারণ হতে পারে,কিন্তু জিউসের ছেলে হওয়ার সুবিধা করে দিয়ে সে জিউসের সুনজর আদায় করতে পারবে। যতদিন এই ছেলে তার দ্বীপে থাকবে, হেরা তার কিছু করতে পারবে না। ডেলোস শর্ত দেয়, লেটোর সন্তান কখনো এই দ্বীপ ছেড়ে যেতে পারবে না। স্টিক্সের পানি দিয়ে অগত্যা লেটোকে তাই মেনে নিতে হয়। এখানে পানি এনে দিয়েছিল আইরিস। এদিকে নয়দিন হয়ে গেলেও বাচ্চা জন্মাচ্ছিল না লেটোর। হেরা তার মেয়ে জন্মের দেবী ইলিথিয়াকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখে যেন সে লেটোর কথা জানতে না পারে। লেটো আইরিসকে পাঠায় সে যেন কোনোভাবে ইলিথিয়াকে নিয়ে আসে, নইলে এই যন্ত্রণায় হয়ত বিষপান করে বসবে সে। আইরিস ইলিথিয়াকে তার মায়ের অগোচরে সব বুঝিয়ে বলে। ইলিথিয়া এক মুহূর্ত দেরি না করে লেটোকে সাহায্য করে। জন্ম হয় এপলোন আর আরটেমিসের।

ঘুমের অলস দেবতা সোমনাস; image source: AllPosters

হেরা আর আইরিসের এমন একটা গল্প আছে যেখানে হেরা ঘুমের দেবতার কাছে আইরিসকে স্বপ্ন নিয়ে আসতে পাঠান। ঘুমের দেবতা সব দেবতাদের মাঝে অলসের সেরা। তার ঘুম কেউ ভাঙালে তিনি ভয়ানক রেগে যান, তার উপর নিক্ষেপ করেন বস্তা বস্তা দুঃস্বপ্ন। আইরিস তখন নিতান্ত বাচ্চা। হাতে সাতরঙের ধনুক নিয়ে নাচতে নাচতে চলল ঘুমের দেবতার কাছে। পথে কতশত বাধা পার হতে হল, তা গুণে শেষ হবেনা। অবশেষে সে ঘুমের দেবতার গুহার সামনে পৌঁছালো। গুহার মুখে আফিমসহ নানা ঘুমপাড়ানি গাছ। গুহার ভেতর গাছ আছে, ফুল আছে। তবে তারা সবাই ঘুমাচ্ছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। আইরিসের মনে হলো, না জানি সোমনাসের (ঘুমের দেবতা) ঘর কেমন হবে। আইরিসের গায়ের রঙে বর্ণিল আলোর ছটা বের হয়। সেই আলোয় ঘুম ভেঙে গেল অন্ধকার গুহার সোমনাসের। আইরিস তাকে বোঝাতে স্তুতি করে গান গাইলো। কিছুতেই কিছু হল না। ক্রুদ্ধ সোমনাস ছেলেদের বললেন, “এক বস্তা দুঃস্বপ্ন এনে ছুঁড়ে মারো ওই নোংরা উজ্জ্বল সৃষ্টির গায়।” ছুঁড়ে মারার আগেই আইরিস সরে গিয়েছিল। বেছে বেছে কিছু স্বপ্ন নিয়ে এক দৌড়ে সে ঘুমের রাজ্য পার হয়ে গেল।  

হার্মিস; image source: Pinterest

হার্মিসের তুলনায় অনেক বিশ্বাসযোগ্য বার্তাবাহক হলেও হার্মিসের কথা যতবার পুরাণে এসেছে, তার সিকিভাগও পায়নি আইরিস। তার নিজের নামে ফুল আছে, আছে পুরাণে বড় অবদান তবু হার্মিস মহাকাব্যের পরিচিত মুখ। এদিকে আইরিস পুরাণে আর পৌরাণিক আলোচনায় প্রায় বিস্মৃত এক নাম।

ফিচার ইমেজ- Painting You With Words

Related Articles