Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জাপানের সৃষ্টি রহস্য: একটি কোজি-কি পৌরাণিক উপাখ্যান

কোজি-কি উপাখ্যান হচ্ছে জাপানের প্রাচীন সব ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর একটি ধারাবিবরণী বা আখ্যানস্বরূপ। জাপানের প্রাচীন ইতিহাসের পৌরাণিক ঘটনাবলী ৭১২ খ্রিস্টাব্দে একসাথে তালিকাভুক্ত করা হয়। এই মহান কাজটি করেন ও নো ইয়াসুমারো। মূল বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রেখে জাপানের প্রাচীন পৌরাণিক উপাখ্যানের অত্যন্ত কঠিন ভাষাকে এই সংগ্রহবিশেষের মাধ্যমে একটি অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষারুপ প্রদান করা হয়।

ইজানাগি এবং ইজানামির জন্ম

জাপানী সৃষ্টিতত্ত্ব উপাখ্যান ‘কোজি-কি’ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে , জাপান দ্বীপ সৃষ্টির পেছনে ইজানাগি এবং ইজানামি নামের এক ঐশ্বরিক দম্পতির প্রধান ভূমিকা রয়েছে। ইজানাগি এবং ইজানামি ছিলেন একাধারে ভাই-বোন এবং পরবর্তীতে ধর্ম স্বীকৃত দম্পতি। এই দম্পতি থেকে পরবর্তীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেব-দেবী জন্ম লাভ করেন।

Source: Pinterest

ইজানাগি এবং ইজানামি পৃথিবীতে আসার পূর্বে পৃথিবী ছিল নিরাকার জেলির মতো। চারিদিকে ছিল শুধুই বিশৃঙ্খলা এবং বসবাসের অনুপযোগী। প্রথমে দেব-দেবীদের স্বর্গের সমতল ভূমি তাকামাগাহারায় আবির্ভাব ঘটে। জাপানের পুরাণ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, তিন প্রধান দেবতা থেকে অন্যান্য সব দেব-দেবীর উৎপত্তি। এই তিন প্রধান দেবতা হলেন অ্যামেনোমিনাকানুশি, তাকামিমুসুবি এবং কামিমুসুবি। তাদের থেকে সাত সার্থক প্রজন্ম পর্যন্ত দেব-দেবীর জন্ম। এই ধারায় ৭ম প্রজন্মে ছিলেন দৈব পুরুষসত্তা ইজানাগি এবং দৈব নারীসত্তা ইজানামি।

রত্নখচিত বর্শা

পুরনো প্রজন্মের দেব-দেবীরা ইজানাগি এবং ইজানামিকে গঠনবিহীন, বিশৃঙ্খল পৃথিবীকে একটি সুশৃঙ্খল এবং গোছানো অবয়বে আনার জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন। এই কাজটি সুসম্পন্ন করতে তাদের দুজনকে একটি অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন আমা নো নুবোকো নামের রত্নখচিত বর্শা প্রদান করা হলো। সুশৃঙ্খল পৃথিবী তৈরির কাজটি কিভাবে শুরু করতে হবে, সেই বিষয়টি না জেনেই ইজানাগি এবং ইজানামি স্বর্গীয় ভাসমান সেতুর মাধ্যমে স্বর্গ থেকে এই ‘অপরিণত এবং বিশৃঙ্খল’ পৃথিবীতে নেমে আসলেন। রত্নখচিত বর্শার সাহায্যে তারা পৃথিবীতে ‘অসীম বিশৃঙ্খলা’ অপসারণের চেষ্টা করলেন। বর্শার ডগা থেকে ‘একবিন্দু রক্ত’ ঝরে ওনোগরো দ্বীপের সৃষ্টি হলো। ইজানাগি এবং ইজানামি দম্পতি এই দ্বীপে বসবাস শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং তাদের বসবাসের জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলেন। প্রাসাদের ঠিক অভ্যন্তরে একটি স্বর্গীয় স্তম্ভ ছিল।

Source: Pinterest

দুর্ভাগা রক্তচোষা শিশুর জন্ম

নতুন প্রাসাদ তৈরি হলে এবার তারা নতুন পরিবার গঠনের দিকে নজর দিলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা দুজনে স্বর্গীয় স্তম্ভটি প্রদক্ষিণ শুরু করলেন। তারা দুজন দুটি ভিন্ন অভিমুখে এই প্রদক্ষিণ কাজ শুরু করলেন, যাতে করে প্রতিবার প্রদক্ষিণকালে তাদের মুখোমুখি সাক্ষাত হয়। প্রদক্ষিণকালে তারা একে অপরের প্রতি মানসিক এবং শারীরিকভাবে আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করলেন। পরবর্তীতে ইজানামির আহ্বানে এই দম্পতি পরস্পরের সাথে মিলিত হলেন ।

Source: Pinterest

কী করতে হবে, একদমই কিছু বুঝতে না পেরে এই দম্পতি দুটি সাহায্যকারী দোয়েলপাখির পরামর্শ গ্রহণ করলেন। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ইজানামি একটি পুত্র শিশুর জন্ম দিলেন। ‘হিরুকো’ নামের এই শিশুটি সুস্থ এবং স্বাভাবিক ছিল না। হিরুকো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং অস্থিমজ্জাহীন একটি রক্তচোষা শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসেবে শিশুটিকে তারা পরিহার করলেন এবং নলখাগড়ার তৈরি একটি নৌকায় করে অজানার উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দেন। ইজানাগি-ইজানামি পরবর্তীতে আবারো সন্তান গ্রহণের জন্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু এবারো তারা একটি সুস্থ-স্বাভাবিক সন্তানের জন্ম দিতে পারলেন না।

জাপান দ্বীপপুঞ্জের সৃষ্টিতত্ত্ব

ইজানাগি ভাবলেন, তাদের হয়তো কোথাও বেশ বড় ধরনের একটি ত্রুটি হয়েছে। বিষণ্ণ মনে এই দম্পতি স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করে অভিজ্ঞ দেবতাদের কাছে তাদের ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলেন। দেবতারা বললেন, তাদের সংশয়ই সঠিক। তারা বললেন,

হে ইজানাগি! তোমার সংশয় ঠিক। কিন্তু ভুলটা তোমার নয়, বরং তোমার স্ত্রীর। তোমার স্ত্রীর তরফ থেকে তোমাকে সঠিকভাবে অভিবাদন করা হয়নি।

এখানে উল্লেখ্য, জাপানি পুরাণ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারিরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রথমে কোনো আহ্বান ধর্মীয় আচার অনুসারে স্বীকৃত নয়। ঠিক এই কারণে ধর্মীয় আচার-প্রথা ভাঙবার ফলে ইজানাগি-ইজানামি দম্পতি সুস্থ-স্বাভাবিক কোনো সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হচ্ছিলেন।

Source: Pinterest

ভুল বুঝতে পেরে এই দম্পতি পুনরায় তাদের প্রাসাদে ফিরে গিয়ে আবারো সন্তানের জন্য চেষ্টা করলেন। এ পর্যায়ে স্বর্গীয় স্তম্ভ পরিক্রমণকালে ইজানাগি তার স্ত্রী ইজানামিকে আহ্বান করেন এবং যথাযথ রীতি মান্য করে ইজানামি তার স্বামীর আহ্বানে সাড়া প্রদান করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ইজানামি থেকে সার্থকভাবে অ্যায়্যাজি, শিকোকু, ওকি, কিয়ুসু এবং সুশিমা নামক দ্বীপপুঞ্জের উত্থান ঘটে। সবশেষে উত্থান ঘটে সবথেকে বৃহৎ দ্বীপ হনশুর। এই দম্পতি ওয়াশিমাকুমির নামে নতুন এই দ্বীপগুলো উৎসর্গ করেন। পরবর্তীতে ইজানামি থেকে আরও ছোট ছোট বেশ কয়েকটি দ্বীপের উত্থান ঘটে।

অগ্নিদেবতা কাগুতশুচির জন্ম এবং ফলস্বরূপ ইজানামির মৃত্যু

পরবর্তীতে এই দ্বীপগুলোকে যথাযথ আকার প্রদান করার জন্য ইজানামির গর্ভ থেকে বেশ কয়েকজন দেবতার জন্ম হয়। এসব দেব-দেবীর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন সমুদ্রের দেবতা, বায়ুর দেবতা, বৃক্ষাদির দেবতা, পর্বতের দেবতা এবং স্বাভাবিক প্রকাশের দেবতা। অগ্নির দেবতা কাগুতশুচির জন্মের সময়ে ইজানামির শরীর আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। ইজানাগি অনেক চেষ্টার পরেও এক্ষেত্রে তার স্ত্রীকে শেষরক্ষা করতে পারলেন না। ইজানামির ভস্মীভূত শরীর থেকে মৃত্যু এবং দুঃখের দেবতা জন্মলাভ করেন। স্ত্রীর মৃত্যুশোকে বিহ্বল ইজানাগির অশ্রু থেকে পরবর্তীতে আরও দেব-দেবী জন্মলাভ করেন। একপর্যায়ে ক্রুদ্ধ ইজানাগি আগুনের দেবতা কাগুতশুচিকে স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে মেনে নিতে না পেরে তরবারি দিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীতে ঐ রক্তাক্ত তরবারি থেকে আরও অনেক দেবশিশু জন্মপ্রাপ্ত হয়।

Source: Pinterest

ইয়োমি মৃত্যুপুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা

স্ত্রী হারানোর শোকে অনেকদিন বিহ্বল থাকার পরে ইজানাগি তার মৃত স্ত্রীর আত্মা ফিরিয়ে আনার জন্য ইয়োমি নামক মৃত্যুপুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। দীর্ঘ এবং বিপদজনক এক পরিভ্রমণ শেষে তিনি দৈত্যদের প্রহরায় সুরক্ষিত একটি বিশালাকার প্রাসাদের সামনে আসেন। পেছনের গোপন দরজা দিয়ে ভয়ঙ্কর সেই প্রাসাদে প্রবেশকালে তিনি তার মৃত স্ত্রী ইজানামির আত্মাকে দেখতে পান।

ইজানামি তার স্বামীকে দেখে আনন্দে আপ্লুত হলেও তার সাথে ফিরে আসতে অস্বীকার করেন। একপর্যায়ে ইজানাগি অনেক অনুরোধ করলে তিনি ফিরতে রাজি হন এবং সেই মৃত্যুপুরীর দেবতার কাছে স্বামীর সাথে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রার্থনা করেন। মৃত্যুপুরীতে প্রবেশের আগে ইজানামি তার স্বামীকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন তার ফিরে আসার পূর্বপর্যন্ত প্রাসাদের বাইরেই অপেক্ষা করেন। সমস্ত দিন কেটে গেলেও ইজানামি না ফিরে এলে তিনি অধৈর্য হয়ে পড়েন এবং স্ত্রীর খোঁজে তার চিরুনির একটি দাঁতকে আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহার করে মৃত্যুপুরীর মধ্যে প্রবেশ করেন।

Source: Pinterest

মৃত্যুপুরীর মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ইজানাগি হঠাৎ করে তার স্ত্রীর পচিত-গলিত শরীর দেখতে পান। নষ্ট এবং বিকৃত হয়ে যাওয়া ইজানামির শরীরের পাশেই সদ্যপ্রসূত বেশকিছু বজ্র-দেবশিশু দেখতে পান। এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত ইজানাগি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তার স্ত্রীর শরীর, বজ্র-দেবশিশু, হাজার হাজার যোদ্ধা এবং ডাইনি তার পেছনে ধাওয়া করে।

ধাওয়া করা সৈন্যদের পরাস্ত করে একপর্যায়ে ইজানাগি মৃত্যুপুরী থেকে কোনো রকমে বের হয়ে বড় একটি পাথর দিয়ে মৃত্যুপুরীর দরজা বন্ধ করে দিতে সক্ষম হন। তার নশ্বর স্ত্রীর শরীর মৃত্যুপুরীর মধ্যে আটকা পড়ে যায়। ইয়োমি মৃত্যুপুরীর পাথর দিয়ে চাপা পড়া প্রবেশপথ পরবর্তীতে ইজুমুর ইফুয়া প্রবেশপথ নামে পরিচিতি লাভ করে। অতঃপর ইজানামি হয়ে ওঠেন ইয়োমোতসু-ও-কামি, জাপানের পুরাণের ভয়ংকরতম ‘মৃত্যুর দেবী’।

ফিচার ছবি- pinterest.com

Related Articles