Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: জয়দ্রথ–বধ পর্বের সারসংক্ষেপ || পর্ব–৫

[৪র্থ পর্ব পড়ুন]

কর্ণের নিকট ভীমের পরাজয়ের পর ভীম আহত অবস্থায় সাত্যকির রথে আরোহণ করেন এবং শীঘ্রই সাত্যকি ভীমের জন্য নতুন একটি রথের বন্দোবস্ত করেন। সেসময় নাগাদ অর্জুন, সাত্যকি ও ভীম একে অপরকে দেখতে পেয়েছিলেন। একটি বিশেষ সঙ্কেত প্রেরণের মাধ্যমে ভীম যুধিষ্ঠিরকে জানান যে, অর্জুন ও সাত্যকি উভয়েই নিরাপদে আছেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এরপর অর্জুন, সাত্যকি ও ভীম কৌরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

এসময় সাত্যকির তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় রাজা অলম্বুশ সাত্যকির দিকে অগ্রসর হয়ে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি তীব্র কিন্তু সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর সাত্যকির তীরের আঘাতে অলম্বুশের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং এরপর অলম্বুশ নিজেও নিহত হন। উল্লেখ্য, এই অলম্বুশ ইতিপূর্বে উল্লিখিত দুই রাক্ষস অলম্বুশের থেকে আলাদা ব্যক্তি ছিলেন।

অলম্বুশ নিহত হওয়ার পর সাত্যকির তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হতে থাকে এবং তাকে প্রতিহত করার জন্য দুঃশাসন তার দিকে অগ্রসর হয়ে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর সাত্যকির তীরের আঘাতে দুঃশাসনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং দুঃশাসন সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। সাত্যকির নিকট দুঃশাসনের পরাজয়ের পর ৫০ জন রথীর নেতৃত্বে ত্রিগার্তার সৈন্যরা সাত্যকিকে আক্রমণ করে, কিন্তু তারা সাত্যকির নিকট পরাজিত হয় এবং পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। এরপর সাত্যকি আবার কৌরব বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করতে শুরু করেন।

ভুরিশ্রবা–সাত্যকি যুদ্ধ: সাত্যকির বিপর্যয়, অর্জুনের নিয়ম লঙ্ঘন এবং ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ভুরিশ্রবার মৃত্যু

এমতাবস্থায় ভুরিশ্রবা সাত্যকির দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভুরিশ্রবা ও সাত্যকি ছিলেন পুরনো শত্রু এবং তাদের সম্পর্ক ছিল অনেকটা কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যেকার সম্পর্কের মতো। ভুরিশ্রবা ছিলেন বাহ্লিক রাজ্যের রাজপুত্র সোমদত্তের ছেলে এবং রাজ্যটির রাজা বাহ্লিকের নাতি। বহু বছর আগে রাজকুমারী দেবকীর স্বয়ম্বর সভায় সাত্যকির পিতামহ সিনি ও তার বন্ধু বসুদেব উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সেই সভায় সোমদত্তও উপস্থিত ছিলেন। সিনি তার বন্ধু বসুদেবের পক্ষ নিয়ে সোমদত্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করেন এবং তার বুকে পদাঘাত করেন। সিনির নিকট সোমদত্তের পরাজয়ের পর রাজকন্যা দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়ে হয়। উল্লেখ্য, কৃষ্ণ ছিলেন বসুদেব ও দেবকীর সন্তান।

চিত্রকর্মে ভুরিশ্রবা ও সাত্যকির মধ্যেকার দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় সাত্যকিকে হত্যা করতে উদ্যত ভুরিশ্রবা; Source: Stringfixer

সিনির নিকট পরাজিত হওয়ার পর সোমদত্ত শিবকে সন্তুষ্ট করার জন্য কঠোর তপস্যায় লিপ্ত হন এবং তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তাকে এই মর্মে বর প্রদান করেন যে, তার ছেলে ভবিষ্যতে সিনির ছেলেকে পরাজিত করবে। এরপর সোমদত্তের যে ছেলের জন্ম হয়, তিনিই ছিলেন ভুরিশ্রবা। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় সিনি বা সিনির ছেলে কেউই জীবিত ছিলেন না। সুতরাং সিনির নাতি সাত্যকি ভুরিশ্রবার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। যুদ্ধের পঞ্চম দিনে সাত্যকির ১০ ছেলে ভুরিশ্রবার হাতে নিহত হন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সাত্যকিও ভুরিশ্রবাকে চরম শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতেন। এমতাবস্থায় এই দ্বৈরথটি ছিল ভুরিশ্রবা ও সাত্যকির মধ্যেকার চূড়ান্ত যুদ্ধ। উল্লেখ্য, ভুরিশ্রবা পিতামহ বাহ্লিক ছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের প্রপিতামহ শান্তনুর বড় ভাই, অর্থাৎ ভুরিশ্রবা ছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের পিতৃব্যতুল্য।

ভুরিশ্রবা ও সাত্যকি একে অপরকে তীরবিদ্ধ করেন এবং একে অপরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। ভুরিশ্রবা সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাকে তীরবিদ্ধ করে আবার তার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকি তীরের সাহায্যে ভুরিশ্রবা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর তারা একে অপরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। উভয়ের শরীর থেকেই রক্ত ঝরতে শুরু করে। এরপর ভুরিশ্রবা ও সাত্যকি একে অপরের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে হত্যা করেন এবং তাদের তীরের আঘাতে তাদের একে অপরের ধনুক কাটা পড়ে। এমতাবস্থায় তারা উভয়েই একটি করে ঢাল ও তলোয়ার উঠিয়ে তাদের বিকল রথদ্বয় থেকে নেমে একে অপরকে আক্রমণ করেন। উভয়ের মধ্যে তীব্র তলোয়ারযুদ্ধ শুরু হয়।

কিছুক্ষণ তলোয়ারযুদ্ধের পর তাদের তলোয়ারের আঘাতে তাদের একে অপরের ঢাল টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এরপর তারা তলোয়ার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হন। বেশ কিছুক্ষণ তীব্র মল্লযুদ্ধ চলার পর ভুরিশ্রবা সাত্যকিকে সজোরে আঘাত করেন এবং সাত্যকি মাটিতে পড়ে যান। এই অবস্থায় ভুরিশ্রবা সাত্যকিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকেন এবং একটি তলোয়ার উঠিয়ে সাত্যকির চুল ধরে তাকে টেনে তোলেন। সাত্যকির বুকে পদাঘাত করে তিনি তলোয়ারের সাহায্যে সাত্যকির মাথা কেটে ফেলতে উদ্যত হন। অর্জুন ও কৃষ্ণ দূর থেকে ভুরিশ্রবা ও সাত্যকির মধ্যেকার দ্বৈরথ যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সাত্যকিকে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় দেখে অর্জুন ভুরিশ্রবার দিকে তীর নিক্ষেপ করেন এবং অর্জুনের তীরের আঘাতে ভুরিশ্রবার ডান হাত কাটা পড়ে। এটি ছিল যুদ্ধের নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ভুরিশ্রবা সাত্যকিকে ছেড়ে দিয়ে অর্জুনের এই কাজের তীব্র নিন্দা জানান।

চিত্রকর্মে সাত্যকি কর্তৃক ধ্যানমগ্ন ভুরিশ্রবাকে হত্যার দৃশ্য। ভুরিশ্রবার শরীরের পাশে অর্জুনের তীরে কাটা পড়া তার ডান হাত পড়ে আছে; Source: Ramanarayanadatta Shastri/archive.org

অর্জুন ভুরিশ্রবার বক্তব্যের কোনো জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকেন এবং এমতাবস্থায় আহত ভুরিশ্রবা অস্ত্র পরিত্যাগ করে মৃত্যু পর্যন্ত ধ্যান করার সিদ্ধান্ত নেন। উপস্থিত সকল যোদ্ধা অর্জুনের নিন্দা করে এবং ধ্যানরত ভুরিশ্রবার প্রশংসা করে। অর্জুন অভিমন্যুর মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলে তার কাজকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এদিকে ভুরিশ্রবার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সাত্যকি উঠে দাঁড়ান এবং একটি তলোয়ার উঠিয়ে ধ্যানমগ্ন ভুরিশ্রবাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীম, যুধমন্যু, উত্তমৌজ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, বৃষসেন, জয়দ্রথ এবং উপস্থিত সকল যোদ্ধা সাত্যকিকে এই কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান করেন, কিন্তু সাত্যকি তাদের সকলকে উপেক্ষা করে তলোয়ারের সাহায্যে ধ্যানমগ্ন ভুরিশ্রবাকে হত্যা করেন। উপস্থিত সকলেই সাত্যকির এই কাজের তীব্র নিন্দা জানান। সাত্যকি আত্মপক্ষ সমর্থন করে একটি বক্তব্য রাখেন, কিন্তু উপস্থিত কৌরব ও পাণ্ডব যোদ্ধারা এর কোনো উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকেন এবং মনে মনে ভুরিশ্রবার প্রশংসা করতে থাকেন।

জয়দ্রথের মুখোমুখি অর্জুন: সাত কৌরব যোদ্ধার বিরুদ্ধে অর্জুনের লড়াই

সাত্যকির হাতে ভুরিশ্রবা নিহত হওয়ার পর অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে কৌরব ব্যূহের একেবারে শেষ প্রান্তের দিকে অগ্রসর হন, যেখানে জয়দ্রথ অবস্থান করছিলেন। অর্জুনকে অগ্রসর হতে দেখে কর্ণ, দুর্যোধন, জয়দ্রথ এবং অন্যান্য শীর্ষ কৌরব যোদ্ধা অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। দুর্যোধন কর্ণকে বলেন যে, এবার কর্ণের শক্তি প্রদর্শনের সময় এসেছে এবং কর্ণ যেন সর্বশক্তি দিয়ে জয়দ্রথকে রক্ষা করেন। কর্ণ প্রত্যুত্তরে বলেন যে, ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তার শরীরের প্রতিটি অংশ ভীমের তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এবং তা সত্ত্বেও কেবল দুর্যোধনের জন্য তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি তার সামর্থ্য অনুযায়ী জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করবেন, কিন্তু তিনি যোগ করেন যে, জয়–পরাজয় ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন।

কর্ণ ও দুর্যোধনের আলাপচারিতার সময় অর্জুন কৌরব সৈন্যদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালান এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃষসেন, শল্য, কৃপাচার্য ও দুর্যোধন একযোগে অর্জুনকে আক্রমণ করেন এবং তাদের ঠিক পিছনে অবস্থান নিয়ে জয়দ্রথ এই আক্রমণে যোগ দেন। তারা সকলেই অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে উক্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন। অশ্বত্থামা অর্জুন ও কৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তিনি ও কৃপাচার্য অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে তাদের তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃষসেন, শল্য ও দুর্যোধন অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং মন্ত্র উচ্চারণ করে অর্জুনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন। অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে পাল্টা দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে উক্ত দিব্যাস্ত্রগুলোকে নিষ্ক্রিয় করেন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।

চিত্রকর্মে অর্জুন ও জয়দ্রথের রক্ষীদের মধ্যেকার যুদ্ধ। কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃষসেন, শল্য, কৃপাচার্য ও দুর্যোধন ছিলেন জয়দ্রথের রক্ষী; Source: Ramanarayanadatta Shastri/archive.org

এরপর অর্জুন জয়দ্রথের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু কর্ণ তার গতিরোধ করেন। অর্জুন, সাত্যকি ও ভীম একযোগে কর্ণকে আক্রমণ করে তাকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে কর্ণ তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন। একদিকে কর্ণ এবং অন্যদিকে অর্জুন, সাত্যকি ও ভীম পরস্পরের ওপর তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ তীব্র যুদ্ধ চলার পর অর্জুন কর্ণকে ব্যাপকভাবে তীরবিদ্ধ করেন এবং কর্ণের পুরো শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। প্রত্যুত্তরে কর্ণ অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে এবং এরপর অর্জুন কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে কর্ণের দিকে আরেকটি তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং এরপর কর্ণ ও অর্জুন একে অপরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন।

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলে। এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে কর্ণের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। কর্ণ তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে অশ্বত্থামার রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ অব্যাহত রাখেন। জয়দ্রথ, বৃষসেন, শল্য ও কৃপাচার্য অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে অর্জুন তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন। অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে তাদের বিরুদ্ধে একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন, কিন্তু তারা মন্ত্র উচ্চারণ করে পাল্টা দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে সেটিকে নিষ্ক্রিয় করেন এবং অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। অর্জুন কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃষসেন, শল্য, কৃপাচার্য ও জয়দ্রথকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে জয়দ্রথ অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করে তার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অর্জুন তীরের সাহায্যে জয়দ্রথ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরের আঘাতে জয়দ্রথের রথের সারথি নিহত হয় ও রথটির ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। কিন্তু উক্ত কৌরব যোদ্ধারা অর্জুনের দিকে অব্যাহতভাবে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন।

কৃষ্ণের ইন্দ্রজাল, অর্জুনের বিদ্যুৎগতির আক্রমণ এবং জয়দ্রথের মৃত্যু

এমতাবস্থায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত ছয় কৌরব যোদ্ধা (কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃষসেন, শল্য, কৃপাচার্য ও দুর্যোধন) জয়দ্রথকে রক্ষা করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অর্জুনের পক্ষে জয়দ্রথকে হত্যা করা সম্ভব হবে না। এদিকে সূর্যাস্তের সময় হয়ে আসছিল এবং তাদের হাতে সময় ছিল খুবই কম। এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, তিনি ইন্দ্রজালের সাহায্যে সূর্যকে কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে ফেলবেন। এর ফলে কৌরব যোদ্ধারা ও জয়দ্রথ অসতর্ক হয়ে পড়বেন এবং সেই সুযোগে তিনি জয়দ্রথকে হত্যা করার জন্য অর্জুনকে পরামর্শ দেন।

চিত্রকর্মে কৃষ্ণের ইন্দ্রজালের ফলে সৃষ্ট অন্ধকারের মধ্যে অর্জুনের হাতে জয়দ্রথের মৃত্যু; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

কৃষ্ণ যোগ করেন যে, জয়দ্রথের বাবা বৃদ্ধক্ষত্র জয়দ্রথকে এই মর্মে বর দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি জয়দ্রথের মাথাকে তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে মাটিতে ফেলবে, তার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। এজন্য কৃষ্ণ অর্জুনকে এই মর্মে পরামর্শ দেন যে, অর্জুন যেন এমনভাবে জয়দ্রথের মাথা তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেন যাতে সেটি উড়ে গিয়ে বহুদূরে ধ্যানমগ্ন বৃদ্ধক্ষত্রের কোলের ওপর পড়ে। অর্জুন কৃষ্ণের এই পরিকল্পনায় সম্মতি জ্ঞাপন করেন।

এরপর কৃষ্ণ ইন্দ্রজালের সাহায্যে সূর্যকে ঢেকে ফেলেন এবং সকলের ধারণা হয় যে, সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। কৌরবরা নিজেদের বিজয় নিশ্চিত মনে করে অত্যন্ত উল্লসিত হয়ে ওঠে এবং উল্লসিত জয়দ্রথ ও তাকে রক্ষার জন্য নিযুক্ত কৌরব যোদ্ধারা সকলেই পিছন ফিরে সেসময় সূর্য আকাশের যে স্থানে অবস্থান করছিল সেদিকে তাকান। তাদের এই অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে তাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এই আকস্মিক আক্রমণে কৌরব যোদ্ধারা হতচকিত হয়ে পড়েন। অর্জুন কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃষসেন, শল্য, কৃপাচার্য ও দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে কর্ণ ও বৃষসেনের ধনুক কাটা পড়ে। এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে শল্যের রথের সারথি নিহত হয় এবং অর্জুন অশ্বত্থামা ও কৃপাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন।

এর পরপরই অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে মন্ত্র উচ্চারণ করে জয়দ্রথের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে গাণ্ডীব থেকে নিক্ষিপ্ত একটি তীর জয়দ্রথের শরীর থেকে তার মাথাকে বিচ্ছিন্ন করে সেটিকে বহু দূরে ধ্যানরত বৃদ্ধক্ষত্রের কোলের ওপর নিয়ে ফেলে। বৃদ্ধক্ষত্র চোখ খুলে ধ্যান থেকে উঠে দাঁড়ানোর পরপরই জয়দ্রথের মাথা তার কোল থেকে মাটিতে পরে যায় এবং এর ফলে বৃদ্ধক্ষত্রের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। অর্জুনের হাতে জয়দ্রথ নিহত হওয়ার পর কৃষ্ণ তার ইন্দ্রজাল প্রত্যাহার করে নেন এবং এর ফলে পুনরায় আকাশে সূর্যের দেখা পাওয়া যায়। এটি দেখে কৌরবরা বুঝতে পারে যে, তারা কৃষ্ণ কর্তৃক সৃষ্ট ইন্দ্রজালে বিভ্রান্ত হয়েছিল, কিন্তু তখন আর তাদের কিছু করার ছিল না। জয়দ্রথের মৃত্যুতে পুরো কৌরব বাহিনী শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

চিত্রকর্মে ধ্যানমগ্ন বৃদ্ধক্ষত্রের কোলে জয়দ্রথের বিচ্ছিন্ন মাথার পতন; Source: Ramanarayanadatta Shastri/archive.org

এদিকে অর্জুনের হাতে জয়দ্রথ নিহত হওয়ার পর অর্জুন ও কৃষ্ণ শঙ্খধ্বনি করেন এবং ভীম তীব্র গর্জন করে যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশ্যে একটি সঙ্কেত প্রদান করেন। ভীমের সঙ্কেত থেকে যুধিষ্ঠির বুঝতে পারেন যে, অর্জুনের হাতে জয়দ্রথ নিহত হয়েছেন এবং এরপর পাণ্ডব সৈন্যরা বিজয়োল্লাস শুরু করে। অর্জুনের বিজয়ে উল্লসিত হয়ে তারা নতুন উদ্যমে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখে অবস্থানরত দ্রোণাচার্য ও তার সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালায়, এবং অর্জুন, ভীম ও সাত্যকি কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে কৌরব সৈন্যদের ওপর নতুন করে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এমতাবস্থায় সূর্যাস্ত হয়, কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অন্যান্য দিনের মতো সেদিন সূর্যাস্তের পর কোনো পক্ষ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়নি। কৌরবরা তাদের ব্যর্থতার কারণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ছিল এবং এজন্য তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের চিন্তা করেনি। অন্যদিকে, পাণ্ডবরা তাদের সাফল্যের কারণে অত্যন্ত উল্লসিত ছিল এবং এজন্য তারাও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের চিন্তা করেনি। এই পরিস্থিতিতে সূর্যাস্তের পরেও উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলতে থাকে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিন ছিল এই যুদ্ধের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন এবং কৌরবদের জন্য সবচেয়ে বিপর্যয়কর দিন। এই দিনের যুদ্ধে অর্জুনের হাতে কৌরবদের পুরো এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিহত হয় এবং সাত্যকি ও ভীম কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কৌরবদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেন। অর্জুনের হাতে কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক শীর্ষ যোদ্ধা (যেমন: শ্রুতায়ু, শ্রতায়ুধ, সুদক্ষিণ, বিন্দ, অনুবিন্দ প্রমুখ) নিহত হন এবং শেষ পর্যন্ত জয়দ্রথও অর্জুনের হাতে নিহত হন। সেদিনের যুদ্ধে কৌরবদের মূল লক্ষ্য ছিল জয়দ্রথকে রক্ষা করা এবং পাণ্ডবদের মূল লক্ষ্য ছিল জয়দ্রথকে হত্যা করা, সুতরাং সেদিনের যুদ্ধে পাণ্ডবরা বড় ধরনের কৌশলগত সাফল্য অর্জন করে। 

তদুপরি, এদিনের যুদ্ধে সাত্যকির হাতে ভুরিশ্রবা নিহত হন এবং ভীমের হাতে দুর্যোধনের মোট ৩১ ভাই নিহত হন। এই ঘটনাগুলো কৌরবদের ব্যর্থতার পাল্লাকে আরো ভারী করে তোলে। সর্বোপরি, দ্রোণাচার্যের প্রাণপণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অর্জুন, সাত্যকি ও ভীম কৌরব ব্যূহে প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং কৌরবরা আবারো যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করতে ব্যর্থ হয়। শেষোক্ত বিষয় দুইটি কৌরবদের মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে দুর্বল করে দেয় এবং দ্রোণাচার্যের রণকুশলতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিপরীতক্রমে, এদিনের যুদ্ধে পাণ্ডবদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও নেহায়েত কম ছিল না। কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে গিয়ে তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং দ্রোণাচার্যের হাতে বহুসংখ্যক শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধা (যেমন: দৃষ্টকেতু, বৃহৎক্ষত্র, জরাসন্ধের ছেলে, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভাইয়েরা প্রমুখ) নিহত হন। কিন্তু অর্জুনের হাতে জয়দ্রথের মৃত্যু তাদের সমস্ত ক্ষয়ক্ষতিকে ভুলিয়ে দেয় এবং তারা উৎফুল্ল চিত্তে কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে।

Related Articles