Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লা ইয়োরোনা: নদীতীরে ক্রন্দনরত প্রেতাত্মা

মধ্যযুগীয় মেক্সিকোর সাজানো-গোছানো এক গ্রাম। ঐ গ্রামের এক নির্জন পথ ধরে আপন মনে হেঁটে চলেছে রদ্রিগেজ নামে কিশোর। হঠাৎ তার কানে এলো কান্নার শব্দ। অদূরেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে এক নারী। কান্নার শব্দ শুনেই সে বুঝে নিলো আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে। ভয়ের এক শিহরণ তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো। কিছু না ভেবেই উল্টো ছুটল সে। কারণ, ক্রন্দনরত সেই মহিলা যেকোনো সময় এসে তার পিণ্ডি চটকাতে পারে। লাতিন আমেরিকা তথা মেক্সিকোর লোকগাথায় ক্রন্দনরত এই নারী ‘লা ইয়োরোনা’ নামে পরিচিত। এখানে রদ্রিগেজ হলো কাল্পনিক এক চরিত্র, যে মেক্সিকোর ‘লা ইয়োরোনা’ উপকথায় বিশ্বাসী মানুষের প্রতিফলন।

লা ইয়োরোনা; Image Source: Leo D Amico.

 

পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই সংস্কৃতি ও অঞ্চলভিত্তিক নিজস্ব প্রাচীন লোকগাথা বিদ্যমান। এর মধ্যে বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে ভূত-প্রেত, অশরীরী, আত্মা, ও পৈশাচিক শক্তিকে কেন্দ্র করে। ‘লা ইয়োরোনা’ তেমনই এক প্রাচীন মেক্সিকান বিখ্যাত মৌখিক কিংবদন্তি, যেখানে ক্রন্দনরত এক অশরীরী নারী আত্মার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। মেক্সিকোর অনেক শিশু বেড়ে ওঠে লা ইয়োরোনার ভয় সাথে করে। উপকথায় এমন একজন নারীর কথা বলা হয়েছে, যিনি তার দুই ছেলের আত্মা না পাওয়া পর্যন্ত স্বর্গে প্রবেশ করতে অস্বীকার করেন। আধিভৌতিক কাহিনি জানতে পছন্দ করেন বা ভূত-গল্পপ্রেমীদের মাঝে ‘লা ইয়োরোনা’ বিশেষভাবে জনপ্রিয়। মৌখিক এই কিংবদন্তির উৎপত্তি কোথা থেকে, তা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে একদম অতীতে। শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে, যেখানে এমন ভয়াল চরিত্র ও গল্পের জন্ম।

মেক্সিকোতে লা ইয়োরোনার মূর্তি; Image Source: KatyaMSL.

 

কিংবদন্তি অনুসারে, মেক্সিকোর ছোট্ট এক গ্রামে মারিয়া নামে অপরূপ সুন্দরী এক যুবতী বাস করত। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসলেও সৌন্দর্য, মাধুর্য, ও করুণার জন্য গ্রামে তার বিশেষ পরিচিতি ছিল। একদিন ঐ গ্রামের মধ্য দিয়েই যাচ্ছিল ধনী এক ব্যক্তি। তখন হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় লাবণ্যময়ী মারিয়ার সৌন্দর্যে। সারা বিশ্ব ঘুরেও সে মারিয়ার মতো এত সুন্দরী কাউকে দেখেনি। সে ভাবল, যেকোনো মূল্যে মন জয় করতে হবে ঐ রমণীর। সাথে সাথে সে দিয়ে বসল প্রেমের প্রস্তাব। লাজে মারিয়ার মুখখানা লাল হয়ে গেলেও সে রাজি হয়ে যায়। অবশেষে বিয়ের পিড়িতে বসে দুজন। সুখেই কাটছিল তাদের সাজানো সংসার।

মেক্সিকোর এক গ্রামে বাস করত মারিয়া; Image Source: Warner Bros.

 

একসময় মারিয়ার কোল আলো করে জন্ম নিল ফুটফুটে দুটো শিশু। কিছুদিন পর পূর্বের মতো বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে গেল মারিয়ার স্বামী। ভ্রমণে বের হবার পরই মারিয়ার প্রতি টান কমে যায় তার। মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে শুধু বাচ্চাদেরকেই একটু দেখে যেত সে। মারিয়া বিশেষ পাত্তা পেত না। মারিয়া তখন ভাবছিল, বয়সের ভারে হয়তো তার ঔজ্জ্বল্য দিন দিন কমে যাচ্ছে। এজন্যই তার স্বামী তাকে আগের মতো ভালোবাসছে না। তবে মারিয়ার জন্য বিরাট চমক তখনও অপেক্ষা করছিল। একদিন তার স্বামী অল্পবয়স্ক এক মেয়েকে সাথে করে গ্রামে ফিরে আসে। যথারীতি মারিয়াকে উপেক্ষা করে তার সন্তানদের বিদায় জানিয়ে আবারও সে ফিরে আসে। এবার পুরোপুরি ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় মারিয়ার। প্রচণ্ড ক্রোধে ফুঁসছিল সে। দুই ছেলেকে নিয়ে এক নদীর কাছে চলে যায় মারিয়া। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে সন্তানদের ঐ নদীতে ডুবিয়ে মারে।

নিজের সন্তানদের হত্যা করছে মারিয়া; Image Source: Warner Bros.

 

খানিক বাদে বাস্তব চেতনায় ফিরে আসলে তার মন বুঝতে পারে, কত বড় এক ভুল করে বসেছে সে। নিজের সন্তানদের হত্যা করেছে নিজ হাতে! মাথায় হাত দিয়ে নদীর কূলে বসে কাঁদতে থাকে সে। তারচিৎকারে নদীতীরের পরিবেশ সকল নীরবতা ভেঙে ভারী হয়ে ওঠে।

কিছুদিন পর তার স্বামী গ্রামে ফিরে আসলে সন্তানদের দেখতে চায়। তখন মারিয়া জানায়, সে তার সন্তানদের পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলেছে। এ কথা জানতে পেরে রাগান্বিত স্বামী সাফ জানিয়ে দেয়, সন্তানদের না পেলে সে মারিয়ার সাথে সংসার করবে না। তখন সাদা গাউন পরে নদীর ধারে তার ছেলেদের খোঁজে সে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। সন্তানেরা আবারও ফিরে আসবে- এই ছিল তার প্রত্যাশা।

গাছে খোদাই করা লা ইয়োরোনার ছবি; Image Source: Gabriel Perez Salazar

 

ছেলেদের ফিরে পাবার আগপর্যন্ত কিছু মুখে নেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করল মারিয়া। সাদা গাউন পরিপূর্ণ হলো কাদামাটিতে। সময় গড়িয়ে যেতে লাগল, কিন্তু ছেলেরা তো আর ফিরে আসে না। কোনো খাবার না গ্রহণ করায়, সে ক্রমশ শারীরিকভাবে ভেঙে পড়ছিল। একসময়ের সুন্দরী মারিয়া হাড্ডিসার অবস্থায় অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। সেই থেকেই তার অস্থির আত্মা অন্ধকার ভেদ করে সাদা গাউনে নদীর তীরে হাঁটতে থাকে। সাদা গাউন যেন ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে একটুকরো আলোর প্রতিচ্ছবি।

কথিত আছে, তার দীর্ঘ সাদা গাউন জলের উপর ছড়িয়ে দিয়ে তাকে স্রোতে ভাসতে দেখা গেছে। অনেকে আবার তাকে অন্ধকার রাতে নদীতীরে হাঁটতে দেখেছেন। সেই থেকে আজও মারিয়ার বিদেহী আত্মা তার হারানো সন্তানদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিজের ছেলেদের জন্য আজও তাকে বিলাপ করতে শোনা যায়। কেউ কেউ বলে, তাকে “আয়, মিস হিজোস!” বলে কান্নাকাটি করতে শোনা যায়, যার বাংলা অনুবাদ “ওহ, আমার বাচ্চারা!” বা “ওহ, আমার ছেলেরা!”। এটাও বলা হয়, সে চিৎকার করে “দনদে এস্তান মিস হিজোস?” বলে, যার অর্থ,“আমার ছেলেরা কোথায়?”

লা ইয়োরোনার সাদা গাউনটি যেন অন্ধকারের মাঝে এক টুকরো আলোর প্রতিচ্ছবি; Image Source: Bekka Bjorke.

 

এই কিংবদন্তি অনুসারেই তার নাম দেওয়া হয়েছে La Llorona। শব্দটি মূলত এসেছে আমেরিকান স্প্যানিশ ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘ক্রন্দনরত নারী’। লোককথা অনুসারে, তার কান্না কানে এলে উল্টো ছুটতে হবে। নইলে তা মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। তার কান্নার শব্দ কাছাকাছি শোনা গেলে বাস্তবিক অর্থে সে অনেক দূরে আছে, আর কান্নার শব্দ ক্ষীণ শোনা যাওয়ার মানে হচ্ছে সে খুব কাছাকাছিই আছে।

জনশ্রুতি আছে, ‘লা ইয়োরোনা’ রাতে ঘুরে বেড়ানো শিশুদের অপহরণ করে নিজের শিশু ভেবে। সে নিজের ক্ষমার জন্য স্বর্গের কাছে ভিক্ষা চায়, এবং অপহরণ করা শিশুদের পানিতে ডুবিয়ে দেয়। মারিয়ার অশরীরী আত্মার দেখা মেলে সন্ধ্যা বা গভীর রাতে, নদীর ধারে। পরনে থাকে ঘোমটাসহ একটি সাদা গাউন। যেন সে সদ্য তার বিয়ের আসর থেকে উঠে এসেছে।

লা ইয়োরোনা ও তার মৃত দুই সন্তান; Image Source: PudgeMuffin Creations.

লা ইয়োরোনার কিংবদন্তি ঐতিহ্যগতভাবে মেক্সিকো, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকাসহ পুরো লাতিন আমেরিকায় বিস্তৃত। অনেক সময় ‘লা ইয়োরোনা’কে ‘লা মালিঞ্চে’র উপকথার সাথে মেশানো হয়। এই কিংবদন্তি গড়ে উঠেছিল এক নাহুয়া মহিলাকে ঘিরে, যিনি একাধারে ছিলেন হার্নান কর্টেসের দোভাষী এবং উপপত্নী। তিনি এক সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু কর্টেস এক স্প্যানিশ ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করার জন্য তাকে সন্তানসহ ত্যাগ করেন। বলা হয়, জেদের বশে তিনি নিজ সন্তানকে হত্যা করেন। দুই কাহিনির মূলধারা প্রায় একইরকম হওয়ায় অনেকে ‘লা ইয়োরোনা’ এবং ‘লা মালিঞ্চে’কে তুলনা করতে ভালোবাসেন।

মেক্সিকো সিটিতে প্রথম লা ইয়োরোনার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫৫০ সালের এক নথিতে। ইউরোপীয় এবং আদিবাসী আমেরিকান, উভয় সংস্কৃতির লোককাহিনীতেই ক্রন্দনরত মহিলার গল্প মোটামুটি পরিচিত। পণ্ডিতরা লা ইয়োরোনা এবং অ্যাজটেক পৌরাণিক কাহিনীর সিহুয়াকোটল, এবং ওল্ড ওয়ার্ল্ড পুরাণের ইভ এবং লিলিথের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছেন। অ্যাজটেক সভ্যতার উপকথায় এক নারীকে কাঁদতে দেখা যায়। তবে তিনি তার সন্তান মেরে ফেলার জন্য নয়, কাঁদেন সন্তানদের মুখে খাবার জোটাতে না পেরে। লা ইয়োরোনার কিংবদন্তি সম্পর্কে লেখক বেন র‌্যাডফোর্ডের তদন্তে উঠে এসেছে, এরকম একটি গল্প ১৫০০ সালের দিকে জার্মান লোককথায়ও প্রচলিত ছিল।

আঠারো শতকের শেষদিকে মেক্সিকান কবি ম্যানুয়েল কার্পিওর লেখা একটি সনেটে ‘লা ইয়োরোনার’ উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তাতে শিশুহত্যার কোনো কাহিনি নেই, বরং এতে লা ইয়োরোনাকে একজন মহিলার ভূত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাকে হত্যা করেছিল তার স্বামী।

 

সেলুলয়েড পর্দায় বিভিন্ন সময়ে জীবন্ত হয়েছে এই লোককাহিনী। ১৯৩৩ সালে সর্বপ্রথম লা ইয়োরোনার কাহিনি নিয়ে মেক্সিকোতে ‘লা ইয়োরোনা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এছাড়াও লা ইয়োরোনার মোড়কে মেক্সিকোতেই ১৯৬০ সালে রেনে কারদোনার পরিচালনায় ‘লা ইয়োরোনা’ এবং ১৯৬৩ সালে হরর ফিল্ম ‘দ্য কার্স অভ দ্য ক্রাইং ওম্যান’ মুক্তি পায়। ২০০৮ সালে মেক্সিকান হরর ফিল্ম ‘কিলোমিটার ৩১’ নির্মিত হয় লা ইয়োরোনার কিংবদন্তি নিয়ে। স্বল্প বাজেটে, ‘দ্য রিভার: দ্য লিজেন্ড অভ লা ইয়োরোনা’, ‘রিভেঞ্জ অভ লা ইয়োরোনা’, ‘দ্য ওয়াইলার: লা ইয়োরোনা’ নামে কিছু সিনেমা নির্মিত হয়েছে।

লা ইয়োরোনার কিংবদন্তি নিয়ে নানা সময়ে নির্মিত হয়েছে নানা সিনেমা; Image Source: IMDb.

 

প্রোডাকশন হাউজ ওয়ার্নার ব্রাদার্সের অধীনে বিগ বাজেটে লা ইয়োরোনা হাজির হয়েছে কনজুরিং ইউনিভার্সে, ‘দ্য কার্স অভ লা ইয়োরোনা’ সিনেমার মাধ্যমে। তাই, লা ইয়োরোনা এখন অফিশিয়ালি কনজুরিং ইউনিভার্সের একটি অংশ। মাইকেল শ্যাভেজের পরিচালনায় এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন লিন্ডা কারডেলিনি, রেইমন্ড ক্রুজ, প্যাট্রিশিয়া ভ্যালাসকুয়েজ, ম্যারিসল র‍্যামিরেজ প্রমুখ।

কনজুরিং ইউনিভার্সের লা ইয়োরোনা; Image Source: Warner Bros.

 

তবে সিনেমাটি সমালোচক বা দর্শকদের মন সেভাবে জয় করতে পারেনি। বক্স অফিসেও কনজুরিং ইউনিভার্সের অন্যান্য সিনেমা থেকে লভ্যাংশ প্রাপ্তি থেকে এটি বেশ পিছিয়ে। ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই মুভি আয় করেছে ১২৩ মিলিয়ন ডলার। ফলে এটি বর্তমানে কনজুরিং ইউনিভার্সের সবচেয়ে কম আয় করা সিনেমা। ৫.২/ ১০ আইএমডিবি রেটিং নিয়ে, এটি রোটেন টমাটজে মাত্র ২৮% ফ্রেশ।

Related Articles