Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বানশি: আইরিশ ক্রন্দসী ‘নিমপাখি’র গল্প

নিম-নিম-নিম!

গভীর সুষুপ্ত রাত্তির, সমাগত সন্ধ্যা, অথবা কদাচিৎ ভরদুপুরে পল্লীবাসি এ ডাক শুনলে শিউরে ওঠে। অলক্ষুণে বিবেচিত মৃদু অথচ ত্রাসসঞ্চারী এ রবের অধিকারী এক পাখি, স্বরের সাথে মিলিয়ে যার নামটি রাখা হয়েছে নিমপাখি। এ পাখির ডাক অমঙ্গলের বার্তা নিয়ে আসে বলে বিশ্বাস করা হয়। যেনতেন কোনো দুঃসংবাদ নয়, একেবারে মৃত্যুর ডাক। যে বাড়ির উঠোনের ধারের গাছে অথবা চালের ওপর নুইয়ে পড়া ডালে বসে নিমপাখি একবার ডেকেছে, সে বাড়ির মানুষজন তটস্থ হয়ে যায়। কারণ, এ ডাক বলতে চাইছে, বাড়ির সদস্যদের মাঝে কোনো একজনের বিদায়ের সময় এসেছে। তাই কেউই সাধ করে নিমপাখির ডাক শুনতে চায় না। নিরন্তর নির্বাক নিমপাখিতেই সবার স্বস্তি।

নিম-নিম-নিম, শব্দগুলোর একটা মানে আছে; নেব-নেব-নেব। ‘প্রাণ নেব’ বলে যা শ্রুত হয় বিধায় এই শব্দত্রয় নিমের মতোই তেতো শোনায় মানুষের কানে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে ‘নেব’ শব্দের আঞ্চলিক রূপ হচ্ছে ‘নিম’। কিন্তু নিমপাখির আরও একটি রূপভেদ আছে আমাদের দেশে। দক্ষিণাঞ্চলে এরকম ডাক যে পাখি ডাকে, তাকে ‘যমকোকিল’ বলে সম্বোধন করা হয়। এখানে ‘নিম’-এর জায়গাটি নিয়েছে ‘যম’; দুটোই কিন্তু মৃত্যুর সাথে তাদের আঁতাত ঠিক রেখেছে!

স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে কুসংস্কার বা লোককাহিনীর কিছুটা পরিবর্তন ঘটে বটে, কিন্তু এই চর্চা বা বিশ্বাসসমূহের মধ্যে অনেক সময় আশ্চর্য রকমের মিল দেখা যায়, সে যতটাই দূরত্বের ব্যাপার হোক না কেন। সেজন্য নিমপাখিকে কেউ কেউ চেনে যমকোকিল বলে, আবার কারও কাছে একই জিনিস ভয় ধরা দেয় বানশি হয়ে।

রাতবিরেতে হঠাৎ হঠাৎ বিলাপধ্বনির সুরে সমাগত মৃত্যুর খবর জানাতেন বানশিরা; Image Source: Checanty

বানশি, মৃত্যুর বাঁশি

বানশি ঠিক কোনো পাখি নয়, বরং পুরোদস্তুর মানুষরূপী। এমনকি সংস্কৃতি, কৃষ্টি, বা অবয়ব ইত্যকার বিষয়েও তার সাথে আমাদের ‘নিম-কোকিল’-এর কোনো মিল নেই। বানশির বাসও অনেক দূরে, সেই সুদূর আয়ারল্যান্ডে। আয়ারল্যান্ডে বানশিকে বেশ কিছু নামে ডাকা হয়; হ্যাগ অভ দ্য মিস্ট, লিটল ওয়াশারউম্যান, হ্যাগ অভ দ্য ব্ল্যাক হেড, অনেক নামের মধ্যে এগুলোই বেশি জনপ্রিয়। আইরিশ, স্কটিশ ইত্যাদি কেল্টিক ফোকলোরে বানশি একটি কাল্পনিক সৃষ্টি, একজন পরী। আর এই পরীর কাজ ছিল কোনো বাড়ির কেউ মারা যাওয়ার আগে রাতের বেলা সেই বাড়িতে এসে কান্নার ধ্বনি শোনানো, যে ক্রন্দনরোলের বার্তা শুধু একটাই- মৃত্যুর খবর আগাম জানানো। ইংরেজিতে যাকে বলে কিনিং (keening), বানশির বিলাপ ছিল তারই অনুকরণ। আর এই বিলাপ শোনার পর ওই বাড়ির কেউ একজনকে অবশ্যই কোনো না কোনো কারণে জীবনের মায়া ত্যাগ করতে হতো।

কিনিং আইরিশদের নিজস্ব প্রথা। ভারতের রুদালি সমাজ যে কাজটি করে, মৃতের জন্য বিলাপ করে শোক করা, কিনিং প্রথার মূল উদ্দেশ্যও একই। মৃতের কবরের পাশে বসে পরিবারের পক্ষ হয়ে একদল আইরিশ নারী হাহাকার ধ্বনি করে শোক প্রকাশ করতেন। স্কটিশ গেলিক ভাষায় তারা পরিচিত ছিলেন mnàthan-tuirim নামে। কিনারদের মতো এরকম বিলাপধ্বনি করেই রাত-বিরেতে হঠাৎ হঠাৎ সমাগত মৃত্যুর খবর জানাতেন বানশিরা। কেবল বানশিদের বেলায় এ বিলাপ মৃত্যুর আগেই শোনা যেত। আর একটু বেশিই করুণ হতো বানশির স্বর।

বানশির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সেই ১৩৮০ সালের দিকে; Image Source: Thomas Crofton Croker

বানশির উৎস

কিনারদের কাজে পয়সার ছোঁয়া ছিল, যার কান্নায় যত বেশি দম ছিল, তার পসারও জমতো বেশি। তাই সবচেয়ে পারদর্শী কিনারদের কাজ পড়তো সমাজের উচ্চবিত্তদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। বনেদী বাড়ির লোকেরা বিশ্বাস করতেন তাদের কবরে মানুষের পাশাপাশি পরীরাও এসে অশ্রুপাত করতেন। আইরিশ ভাষায় এ পরীদের ডাকা হতো ‘bean sidhe’ বলে। এই শব্দটির উচ্চারণ ছিল ‘বানশি’। পরে তা-ই ইংরেজিতে ‘banshee’-তে রূপান্তরিত হয়। বানশির গল্প এভাবেই ডালপালা ছড়িয়ে শেষপর্যন্ত লোককাহিনীতে গিয়ে আশ্রয় পায়।

কিনার আর বানশির মধ্যে আরও কিছু মিল পাওয়া যায়। কিনারদের পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হতো মদ। বুড়ো বয়সে এরা অনেকেই পাঁড়মাতাল হয়ে যেতেন। তাই অনেক সময় তাদেরকে গ্রাম থেকে দূর করে দেওয়া হতো। সমাজচ্যুত, একঘরে, জরাগ্রস্ত এই মানুষগুলোকে বানশির সাথে মিলিয়ে ফেলাটা অসম্ভব কিছু নয়।

বানশির সাথে মৃতদের দুনিয়ার সম্পর্ক থাকার কথা জানা যায়। প্রাচীন আইরিশ ভাষার ‘পরীর ঢিবির নারী’ শব্দটি থেকে বানশি নামের উৎপত্তি। আয়ারল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলের দিকে মাটির তৈরি কিছু সমাধিস্তম্ভ এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এই ঢিবিগুলোকে টুমুলি নামে ডাকা হয়। টুমুলিগুলোতে মৃতের আত্মারা বাস করে বলে বিশ্বাস করা হতো একসময়।

বানশির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সেই ১৩৮০ সালের দিকে। যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু করার আগে জঙ্গলের মধ্যে বানশির কান্না শোনার পর যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালানোর গল্পও শোনা যায় আইরিশ লোকগল্পের ইতিহাসে। আর এসব গল্পের মাধ্যমেই ক্রমশ শক্ত ভিত্তি তৈরি করে বানশি কিংবদন্তী।

বেন নাই যে ব্যক্তির মৃত্যু হবে তার পোষাক থেকে রক্ত পরিস্কার করে; Image Source: ihorror.com

বানশি দেখতে কেমন?

বানশির রূপ একাধিক। কখনো সে সুন্দরী তরুণী, কখনো জমকালো সাজের পূর্ণযৌবনা রমণী, আবার সময়ে সময়ে কুৎসিত ডাইনি। তার পরনে আপাদমস্তক ঢাকা আলখাল্লা। সেই আলখাল্লার রঙ হয় সাদা, নয়তো ধূসর। যারা তাকে দেখেছে বলে দাবী করেন, তাদের বর্ণনায় বানশির মাথাভর্তি লম্বা সাদাটে চুল। কেউ কেউ বলেন, বানশি তার চুল আঁচড়ায় চিরুনী দিয়ে। অনেকে এর সাথে মিল খুঁজে পান শোকের প্রাবল্যে মাথা আছড়ানোর সাথে।

বানশির চোখজোড়া লাল টকটকে, অতিরিক্ত কান্নার ফলে তার চোখের এ দশা। তাকে কখনো দেখা যায় জলাশয়ের পাশে বসে নিজের আলখাল্লা থেকে রক্ত পরিস্কার করতে। তবে বানশির স্কটিশ জাতবোন বেন নাই (Bean Nighe)-এর (বানশি: Bean Sidhe) ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ব্যক্তির মৃত্যু হবে তার পোষাক থেকে রক্ত পরিস্কার করতে। এ জন্যই বানশির আরেক নাম লিটল ওয়াশারউম্যান।

স্কটিশ বানশি

বানশি সামগ্রিকভাবে কেল্টিক ফোকলোর হলেও আইরিশ ফোকলোরেই তার প্রাধান্য বেশি। স্কটিশ ফোকলোরে বানশির সমতুল্য যিনি, তিনি বেন নাই নামে পরিচিত। নাকে একটিমাত্র ছিদ্র, ঠিকরে বের হয়ে থাকা বড়সড় একখানা দাঁত, লম্বা ঝোলানো স্তন, সবুজে মোড়া দেহাবরণ; বেন নাই-এর বর্ণনায় এসব বৈশিষ্ট্যের কথাই উল্লেখ পাওয়া যায়। পরিত্যক্ত ঝর্ণা, নালার ধারে বসে মৃত্যুনির্ধারিত ব্যক্তিদের পোষাক পরিস্কার করাই তার কাজ।

যেসব নারীর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছেন তারাই বেন নাই-এ পরিবর্তিত হয়েছেন; Image Source: scotclans.com

কথিত আছে, যেসব নারীর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছেন তারাই বেন নাই-এ পরিবর্তিত হয়েছেন। অনেকটা অভিশপ্ত এ জীবন তাদের চালিয়ে যেতে হবে ঠিক ততদিন, যতদিন তারা স্বাভাবিক আয়ু পেতেন মানুষ হিসেবে। কোনো মানুষ যদি বেন নাই-এর কাপড় পরিস্কার করার সময় লুকিয়ে গিয়ে তার স্তনপান করার সাহস দেখাতে পারে, তবে সে ওই বেন নাই-এর পালক সন্তান হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারবে এবং তার কাছ থেকে একটি বর প্রার্থনা করতে পারবে।

বানশি বৃত্তান্ত

বানশি কখনো সরাসরি কারও ক্ষতি করে না। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, যেসব নারীরা খুন হয়েছেন অথবা প্রসবকালে মারা গেছেন, তারাই বানশিতে রূপান্তরিত হন। অন্যদের ভাবনায়, বানশি হলো পরীদের রানী যারা মানবজাতির আগমনের পর পাতালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।

বানশিকে সচরাচর কেউই দেখতে পায় না, কিন্তু তার কান্না শোনার দাবি অনেকেই করেছেন। বানশির চিৎকার নিয়েও বিস্তর দাবি-পাল্টা দাবি রয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে তার গলা এতটাই তীক্ষ্ণ যে এর ফলে গ্লাস ফেটে চৌচির হয়ে যায়। আবার কোনো অঞ্চলে তার কান্না ভীষণ কর্কশ। এর বিপরীতটাও আছে। আরেক অঞ্চলে তাকে শোনা যায় মৃদু, মোলায়েম কণ্ঠে গান গাইতে। তবে যেভাবেই বিলাপ করুক না কেন, তার এ তীব্র সকরুণ ধ্বনি বেশ দূর থেকেই শোনা যেত। কেউ দাবি করেন ভবিতব্য মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকরাত টানা শোক প্রকাশ করে বানশি। কেউ বা বিশ্বাস করেন, বানশি কেবল মৃত্যুর রাতেই কাঁদতে হাজির হয়। কান্নার সময় তার স্বর ওঠানামা করে, প্রায় কয়েক মিনিটের জন্য বাতাসে হু-হু করে রোদনধ্বনি ছড়াতে থাকে বানশি।

তার সাক্ষাৎ পাওয়াটা দুঃসাধ্য ছিল; Image Source: iStock

বানশিকে নিয়ে আরেকটি প্রচলিত ধারণা হলো এরা শুধু কিছু নির্দিষ্ট পরিবারের কারও মৃত্যু সম্পর্কে সতর্ক করতে উদয় হয়। এ পরিবারগুলো হলো মূলত প্রধান কিছু আইরিশ পরিবার; ও’কনর, ও’নেইলস, ও’ব্রায়ানস, ও’গ্রেডিস, এবং কাভানফস। এই বংশগুলো আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বনেদী বংশ হিসেবে খ্যাত। আরেকটি দাবি অনুযায়ী, কোনো প্রভাবশালী, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে একাধিক বানশির ক্রন্দনধ্বনি শোনা যায়।

বানশি কিংবদন্তীর প্রথমদিকে তারা কেবল সেসব মানুষদের কাছে দেখা দিত যাদের মৃত্যু খুব কষ্টদায়ক হতো। যেমন- অপঘাতে মৃত্যু, খুন ইত্যাদি। পরের গল্পগুলোর মতে, বানশি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান্নার শব্দ করত, কিন্তু তার সাক্ষাৎ পাওয়াটা দুঃসাধ্য ছিল।

যারা বানশির গল্পে ভোলেন না, তারা দাবী করেন মানুষ যেসব বানশির ডাক বলে শুনেছে, সেগুলো আদতে লক্ষ্মীপ্যাঁচা বা খেঁকশিয়ালির ডাক ছাড়া আর কিছুই নয়। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের নিমপাখিও কিন্তু বস্তুতপক্ষে একধরনের প্যাঁচা। নিমপ্যাঁচা বা নিমখোর প্যাঁচা নামে পরিচিত এ পাখিটির কথা জীবনানন্দ স্মরণ করেছেন তার কবিতায়ও।

-সকালে যে নিমপাখি উড়ে আসে কাতর আবেগে নীল তেঁতুলের বনে-

This is a Bengali article about the Irish folklore legend the Banshee. Necessary references are hyperlinked.

Featured Image: purefandom.com

Related Articles