কেবল নর্স না; বিশ্বের তাবৎ সংস্কৃতিকে সামনে টানা হলেও লোকি এক অদ্ভুত চরিত্রের নাম। ধূর্ততা আর প্রতারণার জন্য আলোচিত হলেও তার প্রকৃত স্বভাব রহস্যময়। কাজ এবং সুযোগ বুঝে যেকোনো আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম। সম্পদ, নারী, জ্ঞান কিংবা নেহায়েত বদমায়েশির বশেও নানা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। লোকির অপরিণামদর্শী ঢঙের জন্য দেবতারা বিপদে জড়িয়ে যায়। আবার তার বুদ্ধিতেই বিপদমুক্ত হয় প্রায়শ।
নর্স ধর্মচিন্তায় দেবতারা এসির এবং ভানির নামের দুই শিবিরে বিভক্ত। ওদিন, থর এবং ফ্রেয়ার মতো লোকিও এসির শিবিরের কেন্দ্রিয় মুখ। তার আখ্যানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যান্য চরিত্রের সাথে জড়িয়ে গেছে। তবুও দিনশেষে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে আলাদা লোকি। ওদিন কিংবা থর যখন দেবলোকের শৃঙ্খলা নিয়ে ব্যস্ত; চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই লোকি তখন সন্দেহের চোখে। এমনকি দেবতাদের প্রতি তার সমর্থন অব্দি প্রশ্নবিদ্ধ। ভবিষ্যদ্বাণী আছে, র্যাগনারক বা মহাপ্রলয়ের দিন লোকি দানবদের পক্ষ নিয়ে দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
বাস্তব অর্থে লোকি দেবতাদের পক্ষেও না; বিপক্ষেও না। ভালো কিংবা মন্দ দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বিশৃঙ্খলায় কোনো পক্ষকে সমর্থন না দিয়ে তার চিরকালীন টান প্রথা ও সীমানাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া। এই আদর্শ ও অস্থিরতা বিশ্বাসীদের সামনে নতুন এক সত্যকে উদ্ভাসিত করে। ‘ভালো আর খারাপের মধ্যকার সীমানা যতোটুকু ভাবা হয়; তার চেয়ে অনেক বেশি পাতলা।’
লোকি কাহিনী
লোকি শব্দটা প্রাচীন নর্স শব্দ ‘লোগি’- এর সাথে সম্পর্কিত; যার অর্থ আগুন। লোকি আগুনের মতোই ধ্বংসাত্মক এবং অনিশ্চয়তাপূর্ণ। উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক তাই প্রাসঙ্গিক। অবশ্য অন্য একটি মত পাওয়া যায়। জার্মানিক শব্দ হিসেবে লোকি অর্থ গিঁট কিংবা গর্ত। ভাষাগতভাবে এর সাথেও সামঞ্জস্য আছে। নর্স মিথে লোকি অঙ্কিত হয়েছে অসাবধানীকে বিপদে ফেলা চরিত্র হিসেবে। বিভিন্ন সময়ে মাকড়সাকে লোকি নামে ডাকা হতো। কারণ, লক্ষ্যবস্তুকে মাকড়সাও সেভাবেই নিজের জালে আটকে ফেলে। অন্যদিকে গিঁট বলার অর্থ প্রায়শ দেবতাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান নেয়া।
লোকির প্রধান অস্ত্র চাতুর্য আর ছলনা। এর বাইরে বিশেষ কোনো অস্ত্র সে ব্যবহার করে না। অংশগ্রহণ করে না সম্মুখ যুদ্ধেও। নির্দিষ্ট কোনো যাদুমন্ত্র, পোশাক কিংবা বাহন অব্দি নেই। অবশ্য কেউ এক জোড়া যাদুর জুতার কথা বলতে চান। লোকি সেই জুতা পরে বাতাস ও পানির উপর দিয়ে চলতে পারে। তবে এই দাবির শক্ত ভিত্তি নেই। একটা আখ্যানে লোকি ফ্রেয়ার থেকে বাজপাখির পালক নেয় সোয়ারতালফেইমে যাবার জন্য। অবশ্য দ্রুত তা ফিরিয়েও দেয়।
স্বীয় আকৃতি বদলের জন্য দেবতাদের মধ্যে লোকি অতুলনীয়। বেশ কয়েকবার সে স্যামন, মাছি, মশা কিংবা ঘোড়ার রূপধারণ করেছে। মানুষের বেশও ধরেছে মাঝে মাঝে।
জন্মসূত্র এবং পরিবার
দানব ফারবাউতির সন্তান লোকি। ফারবাউতির অর্থ ‘নিষ্ঠুর আক্রমণকারী’। মায়ের নাম লাউফি; অবশ্য মাঝে মাঝে নালও বলা হয়া। লোকির ভাই হেলব্লিন্দি এবং বিলেইস্তর দুইজনেই দানব।
দেবী সিগিনকে বিয়ে করে লোকি। তার গর্ভে এক পুত্র জন্ম নেয় নারি কিংবা নারফি নামে। এর বাইরে সিগিন সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। দানবী আঙ্গরবদার মাধ্যমে আরো তিনটি সন্তানের পিতা হয় লোকি। প্রথম জন পাতাল দেবী হেল, দ্বিতীয় জন পৃথিবীকে ঘিরে রাখা সামুদ্রিক সাপ ইয়োরমুঙ্গানদর এবং তৃতীয় জন বিশাল নেকড়ে ফেনরির। ভবিষ্যদ্বাণী আছে র্যাগনারকের সময় ইয়োরমুঙ্গানদরের কারণে নিহত হবে থর। ওদিনের মৃত্যু হবে ফেনরির হাতে।
লোকির নিজের আরেকটা সন্তান আছে। একবার লোকি ঘোটকীর রূপ ধারণ করে। ঠিক তখনই সোয়াদিলফারি নামের একটা ঘোড়া এসে তার সাথে মিলিত হয়। কিছু সময় পরে লোকি জন্ম দেয় আট পাওয়ালা ঘোড়া স্লেইপনিরকে; ওদিনের প্রিয় সওয়ারি।
নর্স মিথোলজিতে লোকির আগমন অন্য সবার চেয়ে পরে। উৎপত্তিও স্পষ্ট না। অষ্টম শতকের সাহিত্যিক কাজগুলোতে লোকি অনুপস্থিত। জার্মান জনগোষ্ঠীর কাছে খ্রিষ্টধর্মের আগমনের আগে লোকি কখনো অনুপস্থিত, কখনো উপস্থিত হলেও পুরোপুরি ভিন্নভাবে। তাতে করে এই সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে না, লোকি উত্তর ইউরোপ তথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার নিজস্ব দেবতা।
সংশোধনহীন লোকি
লোকিকে নিয়ে প্রচলিত পৌরাণিক আখ্যানে তার চরিত্রের শঠতা আর ছলনাই ফুটে উঠে বারবার। তার মধ্যে স্নোরি স্টারলাসনের এডা গদ্যে বর্ণিত গল্পটা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। বজ্রদেবতা থরের স্ত্রী সিফ ছিল সুন্দর আর আকর্ষণীয় চুলের জন্য পরিচিত। লোকি একবার ঘুমন্ত সিফের চুল কেটে দেয়। যথারীতি ক্রুদ্ধ থর। বেগ পেতে হয়নি পেছনের হোতা বের করতে। হাড় ভেঙে দেবার শাসানি দিতেই ভুল স্বীকার করে বেচারা। প্রতিজ্ঞা করে চুল এনে দেবার।
নর্স পুরাণের নয় জগতের অন্যতম সোয়ারতালফেইম। নাগরিক বামনেরা নির্মাণের জন্য বিখ্যাত। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নির্মাতা আবার ইভালদির দুই পুত্র। সিফের নতুন চুল তৈরি করে আনতে সেখানেই যায় লোকি। পাশাপাশি আরো দুই মহামূল্যবান বস্তু বানিয়ে নেয় সেখান থেকে। প্রথমটি স্কিদব্লাদনির নামের জাহাজ। পাল তোলা মাত্রই তা বাতাস খুঁজে নিতে পারে। তারচেয়ে বড় কথা, ভাজ করে ছোট্ট পকেটে রেখে দেয়া যায়। সবিশেষ গুঙনির নামের অপ্রতিরোধ্য এক বর্শা।
অল্পে তুষ্ট হওয়া লোকির স্বভাব না। মনে একটাই চিন্তা ‘যখন এসেছি; আর কিছু জিনিস নিয়েই যাই’। ফন্দি অনুযায়ীই ব্রোকর এবং সিন্দ্রি নামের দুই বামন ভাইয়ের সাথে দেখা করলো সে। ইভালদির ছেলেদের কীর্তি দেখিয়ে প্রশংসা করে ঈর্ষা জাগিয়ে তুললো। বাজি ধরলো তারচেয়ে ভালো কিছু নির্মাণ করে দেবার জন্য। ব্রোকর এবং সিন্দ্রি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নতুন তিনটা মহামূল্যবান বস্তু তৈরি করে দেখালো লোকিকে। এক. সোনালি চুলের শূকর গুলিনবুরস্তি। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে, পানি কিংবা বাতাসেও চলতে পারে, দ্রুততা ঘোড়ার চাইতে বেশি। দুই. স্বর্ণের রিং দ্রাউপনির; যা প্রতি নবম রাত্রে আরো আটটা রিং নির্গত করতো। এবং সবিশেষ থরের হাতুড়ি মিওলনির; নর্স মিথোলজিতে সবচেয়ে আলোচিত অস্ত্র।
লোকি ব্রোকরকে নিয়ে আসগার্দে ফিরলো। দেবতাদের মধ্যে আলোচনা উঠলো কোনটা সবচেয়ে মূল্যবান। লোকি সিফের জন্য আনা সোনালি চুল তুলে দেয় থরের হাতে। গুঙনির পায় ওদিন এবং স্কিদব্লাদনির দেয়া হয় ফ্রেয়াকে। ব্রোকর নিজে এগিয়ে এসে উপহার দেয়। শূকরটা ফ্রেয়াকে, ওদিনকে সেই রিং এবং থরকে মিওলনির। দেবতারাও একমত হলেন থরের হ্যামারটাই সবচাইতে সুন্দর। অতঃপর ব্রোকর বাজি অনুযায়ী লোকির মাথা দাবি করতে গেলো। টের পেয়ে লোকি লাপাত্তা। পরে অবশ্য থর তাকে খুঁজে বের করে দেয়। কিন্তু ব্রোকর আর মাথা দাবি করতে পারলো না; কারণ ধূর্তদেবতা নিজের পথ ধাঁধাঁয় পূর্ণ করে রেখেছিলে।
ক্রোধ কিংবা কৌতূক
Poetic Edda তে অপর একটি গল্পে লোকির রসবোধের প্রকাশ ঘটেছে। একবার সমুদ্রের দেবতা এগির সকল দেবতাকে দাওয়াত দিলো। নির্দিষ্ট দিনে নিমন্ত্রণ কক্ষে খাওয়া আর পানে এলাহি কাণ্ড। সকল দেবতাই খাবারের সাথে সংশ্লিষ্ট এগিরের দুই চাকরের প্রশংসা করলেন। তাদের নাম যথাক্রমে ফিমাফেঙ এবং এলদির। কিন্তু লোকি দেবতাদের বিরোধিতা করলো। অবস্থা এতোদূর গড়ালো যে হত্যা করে ফেললেন ফিমাফেঙকে। এবার দেবতারা ক্ষেপে উঠলেন। বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হলো লোকিকে।
কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসলো লোকি। কথা হলো দেবতাগণ ও লোকির মধ্যে ফ্লাইটিং হবে। বলে রাখা ভালো, ফ্লাইটিং হলো দুইপক্ষের মধ্যে ঝগড়ার একটা বিশেষ পদ্ধতি। যেখানে একপক্ষ আরেকপক্ষকে কাব্যিক ঢঙে অপমান করবে। মধ্যযুগের ইউরোপে এইটা খুব সাধারণ সংস্কৃতি বলে পরিগণিত হতো। শেক্সপিয়ার তার নাটকেও ফ্লাইটিং ব্যবহার করেছেন। যাহোক, প্রথমে লোকির পর্ব। প্রায় প্রত্যেকটা দেবতার নামে ইচ্ছে মতো গালাগালি করলো লোকি। ওদিনের স্ত্রী ফ্রিগের সাথে ওদিনের ভাই ভিলি এবং ভে- এর অবৈধ সম্পর্ক আছে, ফ্রেয়া একজন ডাইনি এবং নিজের ভাইয়ের ফ্রেয়রের সাথে অশ্লীল কাজে লিপ্ত, টিয়রের স্ত্রীর গর্ভের জন্ম নেয়া এক সন্তানের বাপ লোকি নিজে, থর ভীতুর ডিম, ওদিনের ধর্মজ্ঞান নেই প্রভৃতি। সবিশেষ আয়োজনকারী এগিরকে বললো, “এমন দাওয়াত আর আয়োজন করবে না। করলে যা আছে সব আগুনে জ্বলবে।”
তারপর দেবতাদের পালা আসতেই লোকি নিজেকে স্যামন মাছে রূপান্তরিত করে সমুদ্রে ঝাঁপ দিলো। পালিয়ে গেলো দেবতাদের অপমান আর ক্রোধ থেকে। লোকির পলায়নের পর দেবতারা এতোটাই স্তব্ধ হয়ে গেলো যে, কোনো কিছুই আর ভাবতে পারলো না। ফিরে গেলো।
বিশ্বস্ত বন্ধু
থরের হাতুড়ি চুরি হলো একবার। বিষয়টা আসগার্দে চিন্তার বিষয়। কারণ থরের মিওলনিরই তাদের রক্ষাকবচ। লোকির উপরেই বর্তালো খুঁজে বের করার দায়িত্ব। দেবী ফ্রেয়ার কাছ থেকে বাজপাখির পালক ধাঁর করলো লোকি। তারপর পাখি হয়ে উড়ে গেলো খুঁজতে। দানবরাজ্য ইয়োতুনহেইমারে গিয়ে মুখোমুখি হলো রাজা থ্রিমের। থ্রিম স্বীকার করলো হাতুড়ি চুরির দায়। কিন্তু ফেরত দেবার জন্য শর্ত জুড়ে দিলো, দেবী ফ্রেয়াকে তার হাতে তুলে দিতে হবে। লোকি খালি হাতে ফিরে আসলো আসগার্দে।
থ্রিমের প্রস্তাব মেনে নেয়া কোন ভাবেই সম্ভব না। হতাশ দেবতাদের সামনে হেইমদ্যাল একটা উপায় তুলে ধরলো। থরকে ফ্রেয়ার ছদ্মবেশে সাজানো হবে। দানবরাজ্যে গিয়ে মিওলনির হাতে পেলেই কেল্লাফতে। থর এই প্রস্তাব অপমানজনক মনে করলেও লোকি সবাইকে রাজি করালো। বুদ্ধি মতো থরকে সাজানো হলো ফ্রেয়ার গয়না ও পোশাকে। আবৃত করা হলো মুখ। সব প্রস্তুত হলে থর আর লোকি গিয়ে নামলো দানবরাজ্যে। এবার জমলো নাটক। বিশ্বাস করে থ্রিম আহ্লাদিত হয়ে খাবার দিলো অতিথিদের। ফ্রেয়ারূপী থর সেই সময়ও নিজের পেটকে সামাল দিতে পারলো না। একটা ষাঁড়, আটটা স্যামন মাছ, তিন বোতল মদ সাবাড়। হবু বউয়ের খাবারের ধরন দেখে আঁতকে উঠলো থ্রিম। বিষয়টা আঁচ করতে পেরে লোকি বুঝালো, ‘আপনার বিরহে কাতর ফ্রেয়া গত এক সপ্তাহ ধরে কিছু খায়নি। এজন্য এমন করে খাচ্ছে।’ থ্রিম আপাতত আশ্বস্ত হলো লোকির বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে। কিন্তু উঁকি দিয়ে দেখতে গেলো কনের চোখ। থরের চোখ তখন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। থ্রিম বিব্রত হলে লোকি আবার বুঝালো, ‘আপনাকে দেখতে না পেরে গত এক সপ্তাহ ঘুমায়নি বেচারি। তাই অমন চোখ লাল।’
যথারীতি বিয়ে শুরু হলো। শর্ত মোতাবেক থ্রিম মিওলনিরকে এনে কনের কোলের উপর রাখলেন। এবার হাসতে হাসতে মিওলনির হাতে নিয়ে ঘুমটা তুলে দাঁড়ালো থর। এক এক করে সবাইকে মেরে গোটা অনুষ্ঠান লণ্ডভণ্ড করলো। অতঃপর ফিরলো লোকিকে নিয়ে।
কতো শত রূপ!
লোকি বুদ্ধিকে ব্যবহার করেছেন বিস্ময়কর সব উপায়ে। একবার এক পাহাড়ি দানব দেবতাদের কাছে আসলো। প্রস্তাব দিলো আসগার্দে এক অভেদ্য দূর্গ নির্মাণ করে দেবার; যা শত্রুদের হাত থেকে দেবরাজ্য রক্ষা করবে। কিন্তু শর্ত হলো সূর্য, চন্দ্র এবং ফ্রেয়াকে তার হাতে তুলে দিতে হবে। দেবতারা জানালো, কাজ শেষ করতে হবে গ্রীষ্মের প্রথম দিনের আগেই। এটা শুনে নির্মাতা তার সোয়াদিলফারি নামের ঘোড়াটিকেও ব্যবহার করতে চাইলো। কোনো ক্ষতি না দেখে রাজি হলো দেবতারা।
গ্রীষ্ম প্রায় এসে গেছে; দুর্গের কাজও শেষের পথে। কাজের অধিকাংশই করেছে সোয়াদিলফারি। দেবতাদের মধ্যে ফ্রেয়াকে হারানোর ভীতি দেখা দিল। দানবের কাজে বাগড়া দেবার বুদ্ধি আটলো দেবতারা। লোকি নিজেকে একটা ঘোটকীতে পরিণত করে সোয়াদিলফারির সামনে গেল। নানা রকম ইশারায় ব্যস্ত করে রাখলো তাকে। ফলে থমকে গেলো কাজ। ঘটনায় রেগে গিয়ে দেবতাদের আক্রমণ করলো নির্মাতা দানব। কোনঠাসা দেবতারা থরকে ডাকলে সে এসে হত্যা করে দানবকে। কিন্তু ততক্ষণে ঘোড়া সোয়াদিলফারির দ্বারা ঘোটকী রূপী লোকি গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরে জন্ম নেয় আট পা বিশিষ্ট ঘোড়া স্লেইপনির।
চতুর্দশ শতকের খ্রিষ্টান যাজকদের লেখায় আরেকটা গল্প পাওয়া যায়। এক রাতে ফ্রেয়া ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে একটা গুহা দেখতে পায়। সেখানে বামনেরা একটা অদ্ভুত সুন্দর নেকলেস তৈরি করেছে। ফ্রেয়া নেকলেসটি চাইলে বামনরা রাজি হয়। তবে শর্ত দেয় মূল্য বাবদ তাদের সবার সাথে ফ্রেয়াকে শুতে হবে। ফ্রেয়া তাদের কথা মেনেই নেকলেস নিয়ে বাসায় ফেরে। এদিকে লোকি তার কুকর্ম দেখতে পেয়ে ওদিনকে জানায়। ওদিন অভিযোগের প্রমাণস্বরূপ নেকলেসটি খুঁজতে আনতে বলে লোকিকে। কাজটা কঠিন। লোকি নিজেকে মাছিতে রূপান্তরিত করে ফ্রেয়ার ঘরে ঢুকলো। গালে কামড় দিলো; তাতে করে পাশ ফিরলো ফ্রেয়া। এবার নেকলেসটা খুলে ওদিনের হাতে পৌছে দিলো লোকি।
বালদর ট্র্যাজেডি
দেবতাদের সাথে লোকির সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু নির্ণীত এখানে। ঘটনার শুরু ওদিনের ছেলে এবং থরের সৎ ভাই বালদরকে নিয়ে। হঠাৎ করে সে নিজের মৃত্যুর স্বপ্ন দেখতে লাগলো। একই স্বপ্ন দেখলো তার মা ফ্রিগও। চিন্তিত ওদিন এক ভোলভাকে ডাকলেন উত্তর জানার জন্য। ভোলভা বলতে বুঝায় জ্যোতিষ আর জাদুচর্চাকারী একটা বিশেষ শ্রেণিকে। যাহোক, ভোলভা স্বপ্নের সত্যতা স্বীকার করলো। জানালো, সত্যিই মারা যাবে বালদর। যদিও মৃত্যুর প্রক্রিয়া নিয়ে মুখ খুললো না। বিমর্ষ ফ্রিগ পুত্রের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর সকল কিছু সরিয়ে ফেললেন। কেবল রেখে দিলেন লতাগাছ। কারণ তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
ঠিক এই সময় একটা ভয়ানক খেলা খেললো লোকি। লতাগাছ দিয়ে সে একটা বর্শা বানালো আর তা তুলে দিলো হোদরের হাতে। হোদর ছিল ওদিন ও ফ্রিগের অন্ধ ছেলে এবং বালদরের ভাই। লোকি হোদরকে মজা স্বরূপ বালদরের দিকে বর্শা ছুড়ে দিতে বললেন। হোদরও কিছু না দেখে, না বুঝেই ছুড়ে মারলো। বর্শা ভেদ করে গেলো বালদরের বুক; আর সে ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। রিন্দর নামে ওদিনের আরেকটা ছেলে ছিল। এই ঘটনায় সে ক্রুদ্ধ হয়ে হত্যা করলো হোদরকে। লোকিকেও ছাড় দেয়া হলো না। পাথরের সাথে গেঁথে নারফির নাড়িভুরি দিয়ে বেঁধে দিলো। মাথার উপরে রাখা হলো বিষাক্ত সাপ। লোকির শরীরের ও মুখে বিষের আঘাতে কেঁপে উঠে তামাম পৃথিবী। আধুনিক মানুষ যাকে ভূমিকম্প নাম দিয়েছে; নর্স মিথে তা ছিলো লোকির বেদনা। র্যাগনারক অব্দি লোকি এভাবেই থাকবে।
নিয়তি
নর্স পুরাণে দেবতাদের অতীত নয় শুধু; ভবিষ্যতও বর্ণিত হয়েছে। র্যাগনারক বা মহাপ্রলয় হলো পৃথিবীর ধ্বংস, দেবতার মৃত্যু এবং পুনঃসৃষ্টির মতো অনেকগুলো নিয়তি নির্ধারিত ঘটনার সমাবেশ। যাহোক, মহাপ্রলয়ের পুরোটা জুড়েই লোকির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেবতাদের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সে যোগ দেবে দানব শিবিরে। চরম আকার নেবে দানব-দেবতা যুদ্ধ। লোকির সন্তান সাপ ইয়োরমুঙ্গানদর সমুদ্র ছেড়ে উঠে আসবে ভূমিতে। বিষাক্ত করবে বাতাস। আরেক সন্তান নেকড়ে ফেনরির আগুন জ্বালাবে পৃথিবীর জুড়ে। সবশেষে লোকি মুখোমুখি হবে হেইমদ্যালের। পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করবে সেদিন।
অবশেষ
জার্মান জাতীয়তাবাদের জাগরণের সাথে সাথে উনিশ শতকে লোকি আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। আসলে সে সময় সকল পৌরাণিক দেবতা ও দানবরাই ফিরে আসতে থাকে পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপে। শিল্প ও সংস্কৃতিতে প্রায়শ দেখা যেতে থাকে তাদের মুখ। সাম্প্রতিক সময়ে মার্ভেল কমিক এবং সিনেমাতে তার পরিচিতি ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। লোকি চরিত্রে আবির্ভূত হয়েছেন টম হিডলস্টন। অবশ্য লোকিকে দেখানো হয়েছে থরের ভাই এবং ওদিনের পালকপুত্র হিসাবে।
পুরাণকে স্বপ্নের মতো করেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। প্রাচীন উত্তর ইউরোপের মানুষগুলো যে সব বিশ্বাস আর সংস্কৃতির দ্বারা চালিত ছিল; তারই উপস্থাপন নর্স উপকথা। মানুষের বর্তমানও রচিত অনেক উপকথার সমন্বয়ে। পার্থক্য এই যে, বিশ্বাসগুলো পুরাতন না হলে আমরা তাকে মিথ বলে আখ্যা দেই না। হয়তো কোনো এক ভবিষ্যতে আমাদের মিথগুলো চিহ্নিত হবে। অন্তত এ কারণেও পুরাণ নাকচ করে উড়িয়ে দেয়ার বিষয় না, সঠিক উপায়ে তর্জমা করার বিষয়।
This Bengali article is about Loki, The great trickster god of the Norse pantheon.
References
1) Gods of the north, Brian Branston, Thames and Hudson, London, 1970, Pages- 165-177
2) Stories of Norse Gods and Heroes, Annie Klingensmith, A Flanagan Publisher, Chicago, Pages- 13
3) Norse Mythology, Neil Gaiman, W. W. Norton & Company; First Edition edition, 2017,
4) Some Lectures in youtube by Jackson Crawford, Instructor of Nordic Studies and Coordinator of the Nordic Program, University of Colorado Boulder,
5) Poetic Edda, Translated by Jackson Crawford, Hackett Publishing Company, 2015
Featured Image: bavipower.com