Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কিউপিড-সাইকির প্রেমোপাখ্যান

রোমান কিংবা গ্রীক পৌরাণিক গল্পে সর্বত্র প্রেমের ছোঁয়া লাগানো ব্যক্তিটি হলেন কিউপিড কিংবা এরোস। কিন্তু তার নিজের প্রেমের গল্পটা কেমন? আজকে সেই গল্পই শুনবো।

এ গল্পের নায়িকার নাম সাইকি। তার পিতা ছিলেন পৃথিবীরই কোনো এক সমৃদ্ধ দেশের রাজা। সাইকির বড় আরো দুটি বোন ছিল। অপর দুই রাজকন্যা রূপে-গুণে বহু সমৃদ্ধ হলেও সাইকির রূপের কাছে সবকিছুই যেন ম্লান হয়ে যেতো। দেবীতুল্য এই মানবীর প্রতি ঈর্ষা হতো দেবীদেরও। কারণ মানবী হয়েও দেবীদের চেয়েও বেশি দেবতুল্য সৌন্দর্য ছিল সাইকির মাঝে।

সময় ও স্থানের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া সাইকির সৌন্দর্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবী এবং স্বর্গের সর্বত্র। ভ্রমণকারীরা পথে থেমে একবার হলেও সাইকির দর্শন করে নিতে চাইতো। লোকমুখে তো এমন কথাও শোনা যায় যে রোমান দেবী ভেনাস চাইলেও কখনো সাইকির সমকক্ষ হতে পারবেন না। উল্লেখ্য, রোমান পুরাণ অনুযায়ী ভেনাসকে মনে করা হয় সৌন্দর্য, প্রেম, যৌনতা ও উর্বরতার দেবী।

দেবী ভেনাস; source: pinterest.com

দিনে দিনে খ্যাতির সাথে বাড়লো সাইকির ভক্তের সংখ্যাও। কেউই যেন তাকে শুধু মানবী ভেবে সন্তুষ্ট হতে পারতো না, তারা তাকে বসিয়ে নিয়েছিলো অন্তরের দেবীস্থলে। অপরপক্ষে ভেনাসের মন্দিরে দর্শনার্থীর ভিড় কমে যেতে লাগলো, ছাইয়ের গদিতে পরিণত হলো তার আসন।

এমন অবহেলা কি ভেনাস মেনে নিতে পারেন?

তাই তো এ পর্যায়ে আবির্ভাব ঘটে গল্পের নায়ক কিউপিডের। ভেনাসের পুত্র কিউপিড, যার তূণের তীরের আঘাত ব্যথা দেয় না, সৃষ্টি করে প্রেমের চিরক্ষত। যার তীরের শক্তি এড়াবার সাধ্য নেই পৃথিবী কিংবা স্বর্গে কারুরই। এই কিউপিডকেই তার মা ডাকলেন নিজের প্রতিহিংসা পূরণের জন্য, পুত্রও ছিল মায়ের একান্ত বাধ্য। ভেনাস তাকে আদেশ দিলেন সাইকিকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবের প্রেমে ফেলার জন্য। কিন্তু তিনি কল্পনায়ও ভাবতে পারেননি, সাইকির অদ্ভুত রূপ প্রভাব ফেলতে পারে কিউপিডের মধ্যেও!

সাইকির রূপে মুগ্ধ হলেন কিউপিড নিজেই; source: wekimedia commons

সাইকির রূপে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভুলবশত নিজের বুকেই তীর বেঁধালেন কিউপিড। প্রেমে পড়লেন। তবে সে কথা কাউকে জানালেন না, এমনকি ভেনাসকেও না। তিনি ফিরে গেলেন আবারো স্বর্গে।

এদিকে সাইকি কোনো নিকৃষ্ট জীবের প্রেমে তো দূরের কথা, কারো প্রেমেই পড়লেন না। এর চেয়েও আশ্চর্য কথা, সাইকিকেও কেউ ভালোবাসলো না। তার দু’বোনের রাজাদের সাথে চমৎকারভাবে বিয়ে হলেও সাইকিই রয়ে গেলেন অবিবাহিত, প্রেমহীন। সুন্দরের জীবন্ত মূর্তি সাইকি একা, বিমর্ষ বসে রইলেন আর শুধু প্রশংসিতই হলেন।

সবাই আসতো, তাকে দেখে মুগ্ধ হতো এবং শ্রদ্ধাভরে সরে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতো। সাইকির পিতা-মাতার জন্য স্বাভাবিকভাবেই এটি ছিলো খুব দুশ্চিন্তার বিষয়। সাইকির পিতা তাই পরামর্শ চাইতে গেলেন ডেলফিতে, দেবতা অ্যাপলোর কাছে। ওদিকে কিউপিডও ততদিনে পুরো কাহিনী জানিয়েছেন অ্যাপলোকে।

সবদিক চিন্তা করেই অ্যাপলো নির্দেশ দিলেন, শোকের পোশাক পরিয়ে সাইকিকে যেন পর্বতের চূড়ায় একা বসিয়ে রাখা হয়। সেখানেই তার ভবিতব্য স্বামী তাকে গ্রহণ করবেন। অ্যাপলো এমনও বললেন যে সেই স্বামী হবে এক পাখাযুক্ত ভয়ানক জীব, যে দেবতাদের চাইতেও প্রবল শক্তিবান।

কিউপিডের মূর্তি; United Church of God

শোকের পোশাক পরিধান করে সাইকি এমনভাবে চললেন যেন মৃত্যুর কাছে যাচ্ছেন। বিষণ্ণ তার পরিবার ও শুভাকাঙ্ক্ষীরাও। চিরবিদায় নিয়েই গেলো সেই পর্বতচূড়ায়। রোদনে-ভাবনায় সাইকি একাকী বসে রইলেন আসন্ন ভয়ের অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ পর সবচেয়ে মিষ্টি এবং মৃদু হাওয়া জেফাইর এসে তার কানে গুণগুণ করতে লাগলো। সাইকি উড়তে শুরু করলেন। শৈলচূড়া থেকে সরে গিয়ে ফুলেল এক মাঠে পৌঁছুলো, যেখানে ঘাসের বিছানা পাতা তার জন্য। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গেলেন সাইকি, নিদ্রাভিভূত হয়ে ঢলে পড়লেন সে বিছানায়। ঘুম ভাঙার পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক উজ্জ্বল নদীর তীরে, যেখানে সবকিছুতেই ছিল স্বর্গীয় ছোঁয়া। সামনে একটি প্রাসাদ যার স্বর্ণে মোড়ানো থাম, রৌপ্যমন্ডিত মেঝে, চারিদিকে প্রশান্তির নীরবতা। কোথাও কেউ নেই। সাইকি আবারো বিমুগ্ধ হলেন এমন দৃশ্যে। কিন্তু প্রাসাদে প্রবেশ করবেন কিনা বুঝতে পারছিলেন না তিনি।

কিছু স্বর ভেসে এলো তার কানে। তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেলেও কন্ঠস্বরগুলো ছিল স্পষ্ট। তারা তাকে বললো নিশ্চিন্তে প্রবেশ করতে। এটাও বললো যে সাইকির সেবায়ই নিয়োজিত রয়েছে তারা।

সে প্রাসাদে জীবনের সবচাইতে উপভোগ্য দ্রব্যাদির মধ্যে তৃপ্ত হলেন সাইকি। সারাদিন কাউকেই দেখতে পেলেন না, সঙ্গী হিসেবে পেলেন শুধু কিছু কন্ঠস্বরকেই। রাতে তিন বুঝতে পারলেন যে তার স্বামী আসবেন, এলেনও। কিন্তু তাকেও দেখতে পেলেন না সাইকি, শুধু অনুভব করতে পারলেন। তবে যে ভয়ের কথা ভেবে পর্বতচূড়ায় বসেছিলেন, তার কিছুই আর রইলো না। রাতের আঁধারে কিউপিড তাকে সঙ্গ দিলেন, স্পর্শ দিলেন, শুধু নিজেকে দেখতে দিলেন না। সূর্যের আলো ফুটলেই চলে যেতেন কিউপিড। এভাবেই চলতে থাকলো সাইকির সংসার।

এক রাতে কিউপিড সাইকিকে খবর দিলেন যে সেই পর্বতচূড়ায় তার বোনেরা তার জন্য শোক প্রকাশ করতে আসছে। কিন্তু এই আগমন বিপদজনক হবে। তাই বারবার সাইকিকে তিনি সাবধান করে দিলেন যাতে বোনেদের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ না করেন। কারণ এতে তারই ধ্বংস আসন্ন।

প্রথমে রাজি হলেও পরদিন সাইকি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন বোনদের কথা ভেবে ভেবে। অনবরত অশ্রু ঝরতে লাগলো। কিউপিডও শেষপর্যন্ত দুঃখী মনে হার মেনে বললেন সাইকির যা ভালো লাগে তা-ই করতে। কিন্তু সেইসাথে সতর্কবার্তাও দিলেন যাতে কোনোভাবেই কেউ কিউপিডকে দেখার চেষ্টা না করে, এমনটা করলে তাদের বিচ্ছেদ অনিবার্য। সাইকি তার কথা মানলেন এবং তার বোনেরা সেই প্রাসাদে অতিথি হয়ে এলো মৃদু হাওয়া জেফাইরের মাধ্যমে।

প্রাসাদের সকল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তারা জানতে চাইলো এই অঢেল ঐশ্বর্যের মালিক সেই ভাগ্যবানটি কে? কিন্ত সাইকি তেমন কিছু না বলে শুধু বললেন, তার স্বামী এক তরুণ ব্যক্তি, যিনি এখন শিকারে গেছেন। বহু উপহারে সুসজ্জিত হয়ে তারা আবার ফিরে গেলো কিন্তু মনে নিয়ে গেলো এক অদ্ভুত ঈর্ষার বীজ। তারা বুঝতে পারছিলো সাইকির তুলনায় তাদের সম্পদের পরিমাণ কিছুই নয়। এবং তারা ষড়যন্ত্র করতে লাগলো কীভাবে সাইকির সর্বনাশ করা যায়। তারা আবার ফিরতে চাইলো।

কিউপিড আবারো সতর্ক করলেন সাইকিকে। কিন্তু বোনের প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে সাইকি আবারো কিউপিডকে রাজি করালেন। তারা এলো এবং এবার তারা সাইকিকে বলতে লাগলো যে তারা জানে সাইকির স্বামী অ্যাপোলোর বলা সেই পাখাযুক্ত ভয়ানক সাপ, যে একদিন তার আসল রূপে ঠিকই ফিরে আসবে এবং সাইকির ক্ষতি করবে। এ কথা শুনে সাইকির হৃদয়ে প্রেমের স্থান দখল করলো আতঙ্ক। তিনিও ভাবতে লাগলেন, ঠিকই তো, তার স্বামী কেন সবসময় লুকিয়ে থাকে? নিশ্চয়ই তার বোনেরা ঠিক কথাই বলছে। তিনি কী-ইবা জানেন তার স্বামী সম্পর্কে?

সারাদিন ধরে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রইলেন সাইকি। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু শেষমেশ কিউপিডকে দেখে ফেলারই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

রাতে ঘুমুবার সময় তিনি একটি ছুরি লুকিয়ে রাখলেন। সেইসাথে একটি প্রদীপও। কিউপিড ঘুমিয়ে পড়ার পর প্রদীপটি জ্বালালেন। তারপর দেখতে পেলেন তার সাথে ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিটি কোনো ভয়াবহ সাপ নয়, বরং সবচেয়ে রূপবান ও সুদর্শন। নিজের অপরাধবোধের ভারে ভেঙে পড়লেন সাইকি, হাত থেকে পড়ে গেলো ছুরি। প্রদীপের তেলের কয়েক ফোঁটা পড়লো ঘুমন্ত কিউপিডের ঘাড়ে, জেগে উঠলেন তিনিও। সামনে দেখতে পেলেন এক বিশ্বাসঘাতককে। এক মুহূর্তও দেরি না করে কিউপিড সে স্থান ত্যাগ করলেন, সাইকি তার পেছনে ছুটলেন কিন্তু আর দেখতে পেলেন না।

যেতে যেতে কিউপিড বলে গেলেন,

“যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালোবাসা থাকতে পারে না”।

সাইকি নিজের কাছেই পণ করলেন, তার সারাটি জীবন কাটিয়ে দেবেন কিউপিডের খোঁজে। কিউপিডের মনে তার জন্য আর কোনো প্রেম অবশিষ্ট না থাকলেও তিনি তার প্রেমের দীপ জ্বেলে রাখবেন আজীবন। এই তার শাস্তি।

ক্ষত নিয়ে কিউপিড ফিরে গেলেন ভেনাসের কাছে, সবকিছু খুলে বললেন। কিন্তু ভেনাস যখন জানতে পারলেন তার পুত্র সাইকিকে ভালোবেসেছে, ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে অসুস্থ অবস্থায় একা ফেলে চলে গেলেন। ভেনাস এবার নিজেই সাইকিকে শাস্তি দেবেন বলে তাকে খুঁজতে গেলেন।

এদিকে সাইকিও খুঁজছেন ভেনাসকে, কিউপিডের জন্য। তাদের দেখা হবার পর ভেনাস তাকে বহু ধিক্কার দিলেন এই বলে যে তার জন্যই কিউপিড আজ এতো কষ্টে আছেন। ভেনাস তাকে এ-ও বললেন যে একমাত্র দুঃসহ কিছু কাজের পরই তার মতো মেয়ে ভালোবাসার মানুষকে পেতে পারে।

প্রথম কাজ- অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন শস্যদানা একসাথে মিশিয়ে দিয়ে বলা হলো সেগুলো এক রাতের মধ্যেই সব আলাদা করতে হবে। বনের পিঁপড়ে এবং পাখিদের সহায়তায় এই কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারলেন সাইকি

দ্বিতীয় কাজ- নদীর ওপারে থাকা দুরন্ত ভেড়ার স্বর্ণালী পশম নিয়ে আসতে হবে। সন্ধ্যেবেলা ভেড়ারা যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলো, তখন সাইকি গিয়ে কিছু পশম সংগ্রহ করলেন।

তৃতীয় কাজ- পাহাড় থেকে উৎপন্ন স্টাইক্স নদীর কালো পানি একটি পাত্র ভরে নিয়ে আসতে হবে। এই নদীটিতে শুধু পাখাযুক্ত প্রাণীই পৌঁছুতে পারতো। এ সময় একটি বৃহদাকৃতির ঈগল সাইকিকে সাহায্য করলো।

তারপরেও ভেনাস থামলেন না। সে তার চেষ্টা চালিয়ে যেতেই থাকলেন। কীভাবে সাইকির রূপ মলিন করে দেয়া যায়, সে চিন্তায় ভেনাস রাতদিন বিভোর হয়ে থাকতেন।

চতুর্থ কাজ- এবার তিনি সাইকিকে একটি ছোট বাক্স দিয়ে বললেন প্রোসেরপাইনের কাছে গিয়ে তার জন্য কিছু সৌন্দর্য ধার করে আনতে। প্রোসেরপাইনকে এ-ও বলতে বললেন যে ভেনাস তার পুত্রের সেবা করতে করতে ক্রমেই মলিন হয়ে পড়ছেন এবং তার এই রূপের খুবই দরকার।

প্রোসেরপাইনের কাছ থেকে ভেনাসের জন্য সৌন্দর্য আনতে গেলেন সাইকি; source: pinterest

এবারও তিনি একজন পথপ্রদর্শক পেলেন, যে খুব সহজেই তাকে প্রোসেরপাইনের প্রাসাদে পৌঁছে দিলো এবং কাজও সম্পন্ন হলো। ফিরে যাবার পথে কৌতূহলবশত সাইকি বাক্সটি খুলতে চাইলেন। তিনি ভাবছিলেন যে বাক্সে থাকা রূপের কিছুটা নিয়ে কিউপিডের জন্য তিনি আরো রূপবতী হয়ে উঠবেন। কিন্তু বাক্সটি খোলার পর কিছুই পাওয়া গেলো না এবং এক মোহময় তন্দ্রা এসে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো।

এদিকে ভেনাসের গৃহবন্দী কিউপিড সুস্থ হয়ে ডানা মেলে উড়ে এলেন সাইকির কাছে। সব দেবতাদের সম্মুখে মিলন হলো কিউপিড ও সাইকির। কিউপিড তার স্ত্রীর অমরত্বের প্রার্থনা করলেন এবং দেবতাদের প্রাসাদে স্থান পেলেন মানবী থেকে দেবীতে পরিণত সাইকি। ভেনাসও একজন দেবীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না।

অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো…

তথ্যসূত্র- বই: Mythology- Timeless Tales of Gods and Heroes, by Edith Hamilton. (page no. 92-100)

ফিচার ইমেজ- hiveminer.com

Related Articles