Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাউই: আকাশ ও সূর্যকে বশ মানানো এক অর্ধদেবতার গল্প

অ্যানিমেশনপ্রেমী অনেকেই হয়তো ডিজনি স্টুডিওর মোয়ানা (Moana) মুভিটি দেখেছে। এর অন্যতম প্রধান একটি চরিত্রে ছিল মাউই। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল এবং দৈত্যাকার বপুওয়ালা মাউই কখনো রাগী আবার কখনো বা হাসিখুশি এক চরিত্র। তবে এই মাউই আসলে শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র-চরিত্র নয়, তিনি পলিনেশিয়ান এক কিংবদন্তি। 

মাউই ছিলেন একজন ডেমিগড, বা অর্ধদেবতা। একবার একটি যজ্ঞে ভুল মন্ত্রের কারণে অমরত্বের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। তবে অর্ধদেবতা হওয়া সত্ত্বেও তার শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা ছিল দেবতাদের মতোই। হাওয়াইয়ান পুরাকথায় মাউইর আকাশ ঠেলে ওপরে তোলার গল্প পাওয়া যায়।

সৃষ্টির শুরুর দিকের কথা। আকাশ তখন পৃথিবীর একদম মাটি ছুঁইছুঁই। দেখলে মনে হবে যেন আকাশ মাটির সাথে প্রায় মিশে আছে। এত নিচু আকাশের কারণে পৃথিবীর মানুষদের বেশ সমস্যা হচ্ছিল। এতই নিচু সে আকাশ যে, ঠিকভাবে হাঁটাচলাও করা যায় না। কেউ লম্বা বেশি হলে তার মাথা ঠেকে যেত আকাশে। তাছাড়াও আকাশের বুকে সূর্য থাকার কথা থাকলেও নিচু আকাশের কারণে সূর্য আলো চারদিকে ছড়াতেও পারত না, যে কারণে অন্ধকারে পরিপূর্ণ ছিল পৃথিবীর অনেক অঞ্চল। সেসব এলাকার মানুষেরা অন্ধকারের দরুণ কোথাও হাঁটাচলাও করতে পারত না, ভালোমতো কাজকর্ম করতে পারত না।

পৃথিবীর মানুষদের এই দুর্দশা দেখে মাউই ভাবল তাদের জন্যে কিছু একটা করার। সে ঠিক করল, আকাশটাকে ঠেলেঠুলে অনেক ওপরে তুলে দেবে। এতে করে সবারই উপকার। কিন্তু আকাশটা যে ভারী! দেবতা হলেও এই কাজ তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ কাজে তার শক্তিশালী কারোর সাহায্য লাগবে। কে করবে তাকে এই কাজে সাহায্য? মাউই দিনরাত শুধু এটি নিয়েই ভাবতে লাগল। হঠাৎ তার মনে পড়ল তার বাবার কথা। সেই ছোটবেলায় একবার দেখা হওয়ার পর বাবার সাথে তার আর দেখা হয়নি কখনো।

মোয়ানা চলচ্চিত্রে মাউই; source- screenrant.com

সে ভাবল, একসাথে দুই কাজ সেরে ফেলা যায়। বাবার সাথে দেখা করাও হবে, সাথে বাবাকে রাজি করিয়ে আকাশটাকে ঠেলেঠুলে উঁচু করার কাজটাও হয়ে যাবে। তাই সে চলল তার বাবা দেবতা মাকেয়াতুতারার খোঁজে।

বাবার কাছে গিয়ে বললো সে নিচু আকাশের কথা, পৃথিবীর অন্ধকার সব অঞ্চলের কথা, মানুষদের অসুবিধার কথা। তারপরে বাবাকে বলল আকাশটাকে তুলে অনেক ওপরে পাঠিয়ে দেবার কাজে তাকে সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু মাকেয়াতুতারা প্রথমে রাজি ছিল না। আকাশ ঠেলে ওপরে তোলা তার কম্ম নয়! কিন্তু মাউইয়ের জেদের কারণে অবশেষে মাকেয়াতুতারা রাজি হলো।

এবার আসল কাজ। মাউই আর মাকেয়াতুতারা বড় একটি মাঠে এসে হাজির হলো। তারা দুজনে পরিকল্পনা করল এখানে শুয়ে প্রথমে মাউই দু’হাতে ঠেস দিয়ে ধরবে আকাশটা। এরপরে তার বাবা হাত লাগাবে। মাঠে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে দুই হাতে গায়ের জোরে আকাশটাকে ওপরের দিকে ঠেলতে শুরু করে মাউই। কিন্তু বেচারা মাউই আকাশটাকে শুধু একটু নাড়াতেই পারল, সরাতে আর পারল না।

ছেলের করুণ অবস্থা দেখে মাকেয়াতুতারাও একইভাবে শুয়ে পড়ে হাত লাগাল ছেলের সাথে। এরপরে দুজনে মিলে একসাথে ঠেলতে লাগল আকাশটা ওপরের দিকে। এবারে কাজ হলো। নড়তে শুরু করল আকাশ। ঠেলতে ঠেলতে আকাশকে অনেকখানি ওপরে তুলে ফেলল তারা দুজনে। তাদের ধাক্কায় আকাশ এতই ওপরে উঠে গিয়েছিল যে, আকাশের দিগন্তগুলো একদম সমুদ্র আর পাহাড়ের ওপারে চলে গিয়ে মানুষের চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিল।

যখন মনে হলো আকাশকে যথেষ্ট উপরে উঠানো হয়েছে, মানুষ নির্বিঘ্নে হাঁটাচলা কাজকর্ম করতে পারবে, তখন তারা ক্ষান্ত দিল। এভাবেই পিতা-পুত্রের মিলিত শক্তিতে আকাশটা উপরে ঠেলে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে তুলেছিল তারা দুজন।

সেই থেকে আকাশ গিয়ে মিশেছে সবুজ পাহাড় আর ঘন নীল সমুদ্রের দিগন্তের সাথে। আর দিগন্তগুলো হারিয়ে গেছে পাহাড় আর সমুদ্রের ওপারে, লোকচক্ষুর আড়ালে। এই দিগন্ত হতে ঐ দিগন্তে ছুটে গিয়ে খেলা করে রংধনুরা।

তখন থেকে যখনই আকাশ অনেক নিচে নেমে এসে কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরাত, তখনো সে ভয়ে ভয়ে বেশ তাড়াহুড়ায় থাকত, কখন বুঝি মাউই এসে তাকে ঠেলে একেবারে পৃথিবীছাড়াই করে দেয়। বিশেষ করে সূর্যের সাথে একবার মাউইর বড় ধরনের একটি ঝামেলা হওয়ার পর থেকে প্রকৃতি মাউইকে বেশ ভয় পেয়ে চলত।

এ তো গেলো আকাশ ঠেলার কাহিনী। পলিনেশিয়ান কল্পকাহিনীতে মাউই দ্বারা সূর্যকে লাগাম টানার গল্প পাওয়া যায়। মাউই একবার তার মাকে প্রচণ্ড বিরক্ত দেখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। মা বিরক্ত মুখেই জবাব দিল, সূর্যটা বেশিক্ষণ থাকে না আকাশে। দিনের অংশটা রাতের অংশের চেয়ে অনেক ছোট। ঘরদোরের সব কাজ দিনের বেলায় বসে শেষ করা যায় না।

সে প্রায়ই তার ভাইদের কাছে শুনত যে, দিনের বেলা সূর্যের আলো যথেষ্ট থাকে না বলে কী রকম কষ্টটাই না হয়! রাতের পর রাত আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে ওরা সবাই এই সমস্যাটির কথা আলোচনা করত। যত ভোরেই উঠুক না কেন, সারাদিনের গ্রামের কাজকর্ম, মাছ ধরা, শিকার করা সারতে সারতে আলো আর থাকত না।

মাউই তাই শুনে শুনে ভাবত, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। তারপর একদিন মাউই তার ভাইদের কাছে বলল, একটি সমাধান বের করেছে সে। চেষ্টা করলেই সে নাকি সূর্যটাকে বশ মানাতে পারবে!

মাউইয়ের কথা তার ভাইরা হেসে উড়িয়ে দিল। তাদের এক কথা, সূর্যকে কেউ বশ মানাতে পারে না। সূর্যের কাছাকাছি গেলেই পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হয়, সূর্যকে বশ মানানোর কোনো উপায় নেই। সে মস্ত বড় আর তার ভীষণ শক্তি।

কিন্তু মাউই জেদ করতে লাগল। বলল, সে যেভাবেই হোক সূর্যকে বশ মানিয়ে দেখাবে। ভাইদেরকে মাউই মনে করিয়ে দিল তার জাদুর শক্তির কথা, কীভাবে সে বিভিন্ন প্রাণীর আকার ধারণ করতে পারে। এই যুক্তির পরে আর কথা চলে না। তাই ভাইয়েরা রাজি হলো মাউইর সাথে সূর্যকে বেঁধে-মেরেধরে ধীরে চালানোর পরিকল্পনায়।

মাউই তার ভাইদের বলল, গ্রামের যত মেয়ে আছে, তাদের সকলে যেন যে যেখান থেকে যত পারে, শন কেটে আনে এবং এক জায়গায় এনে জড়ো করে। তারপর মাউই তা দিয়ে এমন শক্ত জাল বুনে দেখাবে, যা দিয়ে সূর্যটাকে পর্যন্ত বেঁধে ফেলা যাবে, আর সেও এই জাল ছিঁড়ে বেরোতে পারবে না।

মাউইর পরিকল্পনামতো তার ভাইয়েরা কাজে নেমে পড়ল। সবাই মিলে নানান জায়গা থেকে পাহাড়সমান শন জোগাড় করে আনল, তখন মাউই আর বাকি সবাই মিলে সেই শন দিয়ে ছোট-বড় নানা রকমের পোক্ত দড়ি বাঁধল। সেই দড়িগুলো বেঁধে বেঁধে মাউই আর তার ভাইয়েরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কাজ করে একটি প্রকাণ্ড জাল তৈরি করল।

শিল্পীর চোখে মাউই; 4bpblogpost.com

জাল বোনা হয়ে গেলে, মাউই প্রথমে গেল তার পূর্বসূরী, দেবী ‘মুরিরাঙ্গা-হোয়েনুয়া’র কাছে। তার চোয়ালের হাড় নিয়ে আসল সে। এটাকে দিয়ে বানাল এক অস্ত্র। এটাই মাউইর বিখ্যাত অস্ত্র ‘মানাইয়াকালানি’। অস্ত্রটি দেখতে অনেকটা বড়শির হুক এবং গদার সংমিশ্রিত রূপ। 

এরপরে মাউই তার ভাইদের সাহায্যে বানাল বিশাল এক দড়ি। সেটির এক মাথায় তৈরি করল ফাঁস। অতঃপর সবকিছু নিয়ে চলল ‘হালেআকালা’ পর্বতের দিকে। ওখান দিয়ে সূর্য প্রতিদিন আকাশে ওঠে।

সূর্যের নজরে যাতে না পড়ে যায়, তাই মাউই ও তার ভাইয়েরা দিনের আলোয় লুকিয়ে থাকত আর রাতে পথ চলত। অনেকদিন ধরে যাওয়ার পরে পূর্বদিকে, যেখানে সূর্য বিশ্রাম নিতে যায়, সেইখানে গিয়ে পৌঁছল তারা। সেখানে পৌঁছে, একটু থেমে আবার সবাই মিলে প্রস্তুতি শুরু করল।

প্রথমে যে গুহাটা থেকে পরের দিন সকালবেলা সূর্য বেরিয়ে আসবে, সেই গুহাটাকে খুঁজে বের করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, গুহার মুখটাকে জাল দিয়ে আটকে দিল। তারপর সবাই যখন দেখল যে সত্যি-ই গুহার মুখটা বেশ ভালো মতন আটকানো হয়েছে, তখন দড়িগুলো গাছের ডালপালা, আর পাতা দিয়ে লুকিয়ে ফেলল, যাতে কিছু বোঝা না যায়।

সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে হবে, তাই নিজেরাও বেশ খানিকটা মাটি মেখে চারপাশে মাটির দেয়াল তৈরি করে তার মধ্যে সবাই লুকিয়ে পড়ল। গুহাটার একপাশে মাউই একা ঘাপটি মেরে বসে রইল, আর বাকি লোকগুলো গুহাটার অন্যপাশে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

মাউইর বিখ্যাত মানাইকালানি; source- ae01.alicdn.com

একটু পরেই, গুহাটার ভেতর থেকে সূর্যের প্রথম আলোর ছটা দেখতে পাওয়া গেল। সুর্যের আলো যত বাড়তে লাগল, প্রচণ্ড গরম ও তাপে সব কিছু ঝলসে যায় যায় অবস্থা। ওদিকে মাউইর চার ভাই আর বাকি লোকজন তখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। সবাই ধরেই নিয়েছে মাউইর ফন্দি কিছুতেই খাটবে না।

এমন সময়ে মাউই হঠাৎ ফাঁস ধরে জোরে টান মারল। যেই না টান মারা, অমনি সেই জাল সূর্যের ওপর ফাঁসের মতন আটকে গেল। ওদিকে ফাঁসে আটকে সূর্য তখন গর্জন করে দড়িটা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করতে শুরু করে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ততক্ষণে মাউইও বুঝে গেছে যে, শুধু সূর্যকে দড়ির মধ্যে আটকে রাখলে চলবে না। তখন সে তার ভাইদেরকে বলল, ওর দিকের দড়িটা ধরে রাখতে। তারপর মাউই মাটির দেয়াল ভেঙে, হাতে তার অস্ত্র তুলে ধরে সূর্যের দিকে ছুটে গেল। তাপের চোটে তার শরীর আর চুল ঝলসে যাচ্ছে, তবু সে তার গদা নিয়ে সূর্যকে মারতে শুরু করল।

ভাইদের নিয়ে সুর্যকে বাঁধছে মাউই; source- 1bpblogpost.com

ধুন্ধুমার মার খেয়ে অস্থির হয়ে পড়লো সূর্য। মাফটাফ চেয়ে বলল, দেবতা মাউই যা চাইবে তাই-ই পাবে। মাউই বলল, এখন থেকে তাড়াহুড়া না করে ধীরেসুস্থে সূর্যকে উদয়-অস্তে যেতে হবে। মানুষকে বেশি করে আলো দিতে হবে তাদের প্রতিদিনকার সব কাজ ঠিকমতো সারার জন্যে।

সূর্য বলল, ঠিক আছে, তাই-ই হবে; সে এখন থেকে বছরের অধিকাংশ সময় পৃথিবীতে বেশি করে আলো ছড়াবে। শুধু সামান্য কিছু সময় সে তাড়াতাড়ি ডুবে যাবে।

রাজি হলো মাউই। সূর্যকে ছেড়ে দিল আবার। সেই থেকে সূর্য মোটামুটি ঠিকভাবেই তার দায়িত্ব পালন করে। গরমের দিনে বেশি আলো ছড়ায় সে পৃথিবীতে, আর শীতকালে তাড়াতাড়ি কাজে ইস্তফা দিয়ে ডুবে যায় সে।

এভাবেই বিভিন্ন পুরাকথায় অর্ধদেবতা মাউইর চমৎকার সব গল্পের কথা পাওয়া যায়। গল্প নাকি বাস্তব, সে দূরের বিতর্ক! কিন্তু আর বিভিন্ন প্রাচীন জাতির মত ক্ষুদ্র পলিনেশিয়াদেরও নিজেদের পুরাকথা রয়েছে, তা-ই বা কম কিসে! যুগে যুগে এভাবেই টিকে থাকুক মাউইর গল্পগাঁথা, পৃথিবী পরিচিত হোক এক কিংবদন্তি অর্ধদেবতার সঙ্গে। সুন্দর পুরাকথাগুলো টিকে থাকুক পলিনেশিয়ানদের মুখে মুখে।

This Bengali article is about the myth of Polynesian legend Maui and his stories. All the necessary references have been hyperlinked inside the article.

Featured Image: pngphoto.com

RB-TI

Related Articles