উপকথা বা পুরাণের জগতে গ্রিক ও রোমানরাই উপকথাগুলো সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। তবে পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতির নিজস্ব উপকথাও কম নয়। তাদের মাঝে অন্যতম হলো মায়া উপকথা। অ্যাজটেক সভ্যতার আরও দক্ষিণে দেখা মিলবে মায়া সভ্যতার। প্রধানত উত্তর গুয়াতেমালা আর বেলিজের জঙ্গলে মায়াদের বিচরণ ছিল। বর্তমানেও প্রায় ছয় লক্ষ মায়া বংশধরকে দেখতে পাওয়া যাবে গুয়াতেমালায়, যা সেখানকার পুরো জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
মায়া সভ্যতা অ্যাজটেকের চেয়েও পুরনো। গবেষকদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দের মধ্যে প্রাচীন মায়ারা থাকার জন্য স্থায়ী বসতি তৈরি করে এবং চাষাবাদ শুরু করে। এ সভ্যতা তাদের সেরা সময় উপভোগ করে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী ৫০০ বছর। কিন্তু ৮০০ অব্দের ঠিক পরপরই তারা রহস্যময়ভাবে তাদের গ্রাম-শহর ছেড়ে চলে যেতে থাকে। উত্তরের ইউকাটান অঞ্চলে পাড়ি জমায় তারা, অনেকেই চলে যায় সুদূর মেক্সিকো পর্যন্ত। বেশিরভাগ মায়া গোত্র গুয়াতেমালার কুইচেতে আবাস গাড়ে। স্প্যানিশরা দখল করে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তারা সেখানেই থেকে যায়।
মায়া সভ্যতার নিজস্ব লেখনপদ্ধতি থাকায় তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর উপকথাগুলো লিখে রাখার সুযোগ পায়, যার ফলে জানা যায় তাদের সমৃদ্ধ কাহিনীগুলো। তবে স্প্যানিশরা আক্রমণ চালানোর সময় মায়া সভ্যতার বেশিরভাগ ডকুমেন্টই আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে। মাত্র ৪টি ডকুমেন্ট বা ‘কোডেক্স’ পাওয়া গিয়েছে, যা একটি একটি করে সংরক্ষিত আছে ড্রেসডেন, মাদ্রিদ, প্যারিস এবং নিউ ইয়র্কে। মায়া সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাকাব্য ‘পোপোল ভুহ’-এর যদিও সন্ধান পাওয়া যায়নি, পরবর্তীতে শিক্ষিত মায়ারা তা ‘কিশে’ ভাষায় অনুবাদ করে অস্তিত্ব রক্ষা করে।
পোপোল ভুহ
পোপোল ভুহ, ‘কাউন্সিল বুক’ কিংবা ‘বুক অব দ্য কমিউনিটি’ হিসেবে পরিচিত এই বইটি কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, স্প্যানিশরা অন্য বইগুলোর মতো এটিও পুড়িয়ে ফেলে। তবে ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে এক কিশে মায়া রোমান হরফে নিজের ভাষায় এটি লিখে রাখে। পরবর্তীতে এই ডকুমেন্ট ফ্রান্সিসকো জিমেনেজ নামক এক পাদ্রীর কাছে পৌঁছালে তিনি তা স্প্যানিশে অনুবাদ করেন। এই ডকুমেন্ট নিয়ে গবেষণার কমতি নেই। ইতিহাসবিদ, জ্যোতির্বিদ থেকে শুরু করে দার্শনিকরাও এটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছেন মায়া সভ্যতার রহস্য।
কিংবদন্তী আর উপকথায় ভরপুর পোপোল ভুহ-এ বৈজ্ঞানিক তথ্যও কম নয়, বিশেষ করে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে অনেক কিছুই লিপিবদ্ধ করা আছে এখানে। কোনো গ্রহ বা নক্ষত্র কখন দেখা যাবে, কখন আবার হারিয়ে যাবে, সবই হিসাব করে দেখানো হয়েছে এখানে। মায়াদের কাছে প্রতিটি নক্ষত্র ও প্রতিটি গ্রহই একেকটি দেবতার প্রতিরূপ। নক্ষত্রের উদয়াস্ত পর্যবেক্ষণ করে তারা বিভিন্ন উৎসব পালন করত, শিকারে যেত, যুদ্ধের মহড়া দিত কিংবা দুর্ভিক্ষের প্রস্তুতি নিত।
বিশ্বের প্রতিটি কোনার উপকথাতেই তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্যের ব্যাখ্যা, মহাজগৎ কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে কিংবা কীভাবে মানুষ সৃষ্টি করা হল। পোপোল ভুহতে লিপিবদ্ধ সে উপকথাগুলোই তুলে ধরা হল।
মানুষের জন্ম
মানুষের জন্মের আগে প্রকৃতির সবকিছুই ছিল, গাছপালা, মাটি, পাথর, পশুপাখি। তারও আগে ছিল শুধু নীল আকাশ, গভীর নীল সমুদ্র। কোনো আলো বা শব্দ ছিল না। দেবতারা থাকত সমুদ্রের গভীরে।
অন্ধকার গভীর সমুদ্রে থাকতে থাকতে দেবতারা বিরক্ত হয়ে গেল। একদিন তারা সবাই একসাথে বের হয়ে এল, এই পৃথিবীতে সবকিছু তৈরি করার জন্য। তারা বলে উঠলো, “সৃষ্টি শুরু হোক! এই পরিত্যক্ত স্থান ভরে উঠুক! সাগর নিচে নেমে যাক, উঠে আসুক মাটি! মাটি উঠে আসো!”
আর এরপরই সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসল পাহাড়-পর্বত, হ্রদ, জলপ্রপাত, গাছপালা। প্রথমে, দেবতারা তাদের সৃষ্টি দেখে খুশি হলেন। উঁচু পাহাড়, দুরন্ত গতিতে বয়ে চলা ঝর্ণা, আর সবুজ সাইপ্রেস গাছ দেখে তারা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। কিন্তু এ পৃথিবী যেন বড্ড নীরব। তাই দেবতারা আবার তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন, সৃষ্টি হলো হরিণ আর কিছু পাখি।
তারপর দেবতারা আদেশ করল, “তোমরা, হরিণ: নদীর পাড়ে গিয়ে ঘুমাও, গিরিখাতের মধ্যে যাও, বনের মধ্যে থাকো। নিজেদের সংখ্যা বাড়াও। তুমি চার পায়ে দাঁড়িয়ে চলবে।। আর তোমরা, পাখিরা: তোমাদের জায়গা হলো গাছে, ঝোপে, সেখানে তোমরা বাসা বানিয়ে থাকবে। সেখানে নিজেদের সংখ্যা বাড়াও।”
দেবতারা পশুপাখিদের নিয়ে সন্তুষ্ট হলেন, কিন্তু তখনো একটা সমস্যা রয়ে গেল। দেবতারা চাইছিলেন তাদের কাজের জন্য কেউ প্রশংসা করুক, তাদের উপাসনা করুক। পশুপাখিরা সামান্য কিছু শব্দ করতে পারে, যার কোনো মানেই নেই। দেবতারা তাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে অসন্তুষ্ট হলেন। তাই তারা আদেশ করলেন, “আমরা তোমাদের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নেব না, যা আমরা তোমাদেরকে দিয়েছি। বরং আমরা এমন কাউকে সৃষ্টি করবো যারা আমাদেরকে ভালোবাসবে এবং আমাদের শ্রদ্ধা করবে। এই নতুন সৃষ্টিগুলো তোমাদের চেয়ে সেরা হবে এবং তোমাদের শাসন করবে। এটা তোমাদের চূড়ান্ত ভাগ্য যে, তারা তোমাদের দেহ ছিঁড়ে ফেলে মাংস আলাদা করবে, তারপর তোমাদের খেয়ে ফেলবে। এটাই হোক।”
এরপর দেবতারা পশুপাখির চেয়েও ভালো কিছু বানানোর চেষ্টা করলেন। এরা হলো মায়া। এরা কথা বলতে পারবে, দেবতার প্রশংসা করতে পারবে। কিন্তু এদেরকে বানানো মোটেই সহজ কাজ নয়।
প্রথমে দেবতারা মাটি দিয়ে মানুষ তৈরি করলো। কিন্তু মাটি দিয়ে তৈরি এই মানুষরা ঠিক সেরকম না, যা দেবতারা চাইছিলেন। তারা খুবই নরম আর ভঙ্গুর, সোজা হয়ে দাঁড়াতেও এদের সমস্যা হচ্ছিল। আর বৃষ্টি হওয়ার পর তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো দেহ থেকে ধুয়ে চলে যাচ্ছিল। এর চেয়েও বড় কথা হলো, তাদের দেখার মতো চোখ কিংবা কাজ করার জন্য কোনো মস্তিষ্ক ছিল না। শুধু কথা বলার জন্য মুখ দেওয়া হয়েছে। মস্তিষ্কবিহীন এই মানুষরা ঠিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে না পারায় অর্থহীন কথা বলে বেড়াচ্ছিল। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে দেবতারা এই মাটির মানুষগুলোকে ধ্বংস করে দিলেন।
তারা আবার চেষ্টা করলেন, এবার মানুষ তৈরির উপাদান হলো কাঠ। মাটির মানুষদের চেয়ে এই কাঠের মানুষগুলো গুণে আরেকটু ভালো হলো। শক্তপোক্ত কাঠের ফলে তারা সহজেই দাঁড়াতে পারল। তাছাড়া কথা বলার গুণ তো রয়েছেই।
কিছুদিন পরেই দেবতারা বুঝতে পারলো, মাটির মানুষদের মতোই, কাঠের মানুষগুলোরও কোনো মস্তিষ্ক নেই, তারা অর্থহীন কথা বলে সময় নষ্ট করছে। তাদের দেহে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার মতো কোনো শিরা নেই, তাই তাদের চামড়া সতেজ আর সজীব হওয়ার বদলে শুকিয়ে যাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে। তাদের কোনো হৃদয় নেই, এমনকি চেহারাও নেই যে তারা কোনোরকম মুখভঙ্গি করতে পারবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের কোনো আত্মা নেই। ফলে, তারা কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তা আলাদা করতে পারছে না। এই নির্বোধ মানুষগুলো নিজেদের খাবার তৈরি করার পাত্রগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, কুকুরগুলোকে খেতে না দিয়ে পিটিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে। শেষমেশ দেবতারা বুঝতে পারলেন, এই কাঠের মানুষগুলোকেও ধ্বংস করে ফেলতে হবে। এবং তৃতীয়বারের মতো আরও সম্পূর্ণ কোনো মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে।
তবে দেবতারা কাঠের মানুষগুলোকে সহজে ছেড়ে দিলেন না। প্রথমে দেবতারা একধরনের আঠালো পদার্থের বন্যা হওয়ার আদেশ দিলেন। ফলে মানুষগুলো মাটির সাথে আটকে গেল। পুড়িয়ে দেওয়া হাড়িগুলো তাদের পুড়ে যাওয়া অংশগুলো কাঠের মানুষদের কাঠের উপর চেপে ধরে আগুন ধরিয়ে দিল। মার খাওয়া কুকুরগুলো তাদের দাঁত দিয়ে কাঠ কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল।
কয়েকজন পালিয়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করল, কেউ কেউ বাড়ির ছাদে গিয়ে লুকাল। কিন্তু গাছ আর বাড়িও প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত। গাছগুলো তাদের ডালপালা ঝাঁকিয়ে মানুষগুলোকে ফেলে দিল, বাড়িগুলো কাঠের মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার চেয়ে নিজেরাই ভেঙে পড়ল। আশ্রয়বিহীন কাঠের মানুষগুলো এবার পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু গুহাও পাথর ফেলে নিজেদের মুখ বন্ধ করে দিল। বেশিরভাগ মানুষই বন্যায় ডুবে গেল, যারা বেঁচে ছিল তাদের চেহারা দেখেও আর মানুষ বলে চেনার উপায় নেই। তারা পরিবর্তিত হলো এক নতুন ধরনের প্রাণীতে, বানর হিসেবে।
তৃতীয়বারের মতো, দেবতারা মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করলেন। তারা যখন আলোচনা করছেন, কীভাবে একটি সম্পূর্ণ মানব প্রজাতি তৈরি করা যায়, ঠিক তখনই তাদের কাছে চারটি প্রাণী দেখা করতে আসলো। এরা হলো পাহাড়ি বিড়াল, কয়োট, টিয়া আর কাক। তারা দেবতাদেরকে বললো ‘ব্রোকেন প্লেস’-এ এক নতুন ধরনের খাবার রয়েছে, যা দেবতাদের কাজে লাগতে পারে। দেবতারা সেখানে গিয়ে দেখলেন এক নতুন ধরনের শস্য, যব। দেবতারা বুঝতে পারলেন, মানুষ তৈরির জন্য যা দরকার তা তারা পেয়ে গেছেন।
দেবতারা যব গুড়ো করে এই গুড়ো দিয়ে চারজন মানুষ বানালেন। এই চারজন হলো ‘ফোর ফাদার্স’। তারপর দেবতারা যব আরও গুড়ো করে তরল বানিয়ে এই চারজনকে খেতে দিলেন। এটি খাওয়ার পর চার পিতার দেহে পেশি আর শক্তি তৈরি হলো। এই চারজন ঘুমিয়ে গেলে দেবতারা তাদের চারজনের জন্য চারজন সুন্দরী সঙ্গী বানিয়ে দিলেন।
চার পিতা দেবতাদেরকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাল। তাদেরকে এই জগৎ সম্পর্কে সব জ্ঞান দেওয়া হলো। চার পিতা দেবতাদেরকে বলল, “আমরা দেখতে পারি, শুনতে পারি, কথা বলতে পারি, চলতে পারি, চিন্তা করতে পারি। আমরা অনুভব করতে পারি সবকিছু, আমরা সবকিছু জানি, আমরা এই পৃথিবী দেখতে পারি, দেখতে পারি ওই আকাশ। ধন্যবাদ আমাদেরকে বানানোর জন্য...”
তারপর হঠাৎ করেই আবার নতুন একটা সমস্যার সৃষ্টি হলো। দেবতারা বুঝতে পারলেন, মানুষদেরকে বেশি নিখুঁতভাবে তৈরি করে ফেলা হয়েছে। এতটাই নিখুঁত যে, তারা দেবতাদের মতোই জানে এবং দেখতে পারে! অর্থাৎ তারা নিজেদের সমান সৃষ্টি তৈরি করে ফেলেছে! তাই তারা জ্ঞান সীমাবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন, সাথে তাদের অন্যান্য ক্ষমতাও।
দেবতারা চার পিতার চোখে কুয়াশার ঝাপটা মারলেন। ফলে তারা আর আগের মতো অনেক দূর পর্যন্ত দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো। জ্ঞানও কমিয়ে দেওয়া হলো, যতটুকু তাদের প্রয়োজন। দ্রুতই চার পিতা আর তাদের স্ত্রীদের সন্তান-সন্ততি হলো। এবং এভাবেই পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল মায়ারা।
This article is in Bangla language. It is about how humans were made according to the mayan mythology. Necessary resources have been hyperlinked inside the article.
References: Mayan and Aztec Mythology - Michael A. Schumann
Featured Image: Digital Trends