Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যেভাবে তৈরি হয়েছে থরের হাতুড়ি মিওলনির

বজ্রের দেবতা থর, অনর্থের দেবতা লোকি এবং সর্ব-পিতা ওডিন। যারা মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের সাথে পরিচিত তারা এই নামগুলোর সাথেও বেশ পরিচিত। মারভেল কমিকসের একটি বিরাট অংশ তৈরি হয়েছে নর্ডিক পুরাণের এই দেবতাদের কেন্দ্র করে। কিন্তু পুরাণে উল্লিখিত নানা ঘটনাকে মারভেল কমিকস তাদের নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করেছে। মূল ঘটনা ও মারভেলের কমিকবুক ও চলচ্চিত্রের মাঝে তাই আকাশ পাতাল পার্থক্য দেখা যায়। দুটি মাধ্যমে এই একই চরিত্রগুলোর মাঝে যে ভিন্নতা রয়েছে, তা রোর বাংলায় পূর্বে প্রকাশিত এই লেখাটি থেকে জানতে পারবেন।

মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের থর চলচ্চিত্রের পোস্টার; Image Source: amazon.com

বজ্র দেবতা থর নর্ডিক পুরাণের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। অসম সাহসী ও অত্যন্ত শক্তিশালী এই দেবতাকে ঘিরে অনেক গল্প রয়েছে। এসব গল্পে তার বীরত্ব ও শক্তিমত্তারও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। একারণেই তাকে মারভেল কমিকসের অন্যতম শক্তিশালী সুপারহিরো হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে।

শক্তিমত্তা ও বীরত্ব ছাড়াও থরের জনপ্রিয়তার পেছনে আরেকটি বস্তুর ভূমিকা রয়েছে। আর তা হলো থরের হাতুড়ি মিওলনির। এই অস্ত্রটি থরের ক্ষমতাগুলোকে পূর্ণতা দান করেছে। হাতুড়িটাকে সবসময় তিনি শরীরের অপর একটি অঙ্গের মতোই ধারণ করতেন। থর ছাড়া অন্য কেউ এই হাতুড়ি বহন করতে পারতেন না। পৌরাণিক কাহিনী ও মারভেল কমিকস দুটোতেই তাই থরের হাতুড়ি নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই।

থরের হাতুড়ি মিওলনির; Image Source: wallpaperaccess.com

মিওলনির নামক হাতুড়িটি এমনি এমনিই থরের হাতে আসেনি। এই হাতুড়ি পাওয়ার জন্য যাকে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দিতে হবে, তিনি হলেন লোকি। শুনতে অবাক লাগলেও অনর্থের দেবতা লোকির কারণেই কিন্তু থর তার হাতুড়িটি লাভ করে। লোকি হলেন থরের সৎ ভাই। অর্থাৎ ওডিনের পালক পুত্র।

দেবতা মহলে তিনি সবথেকে কুখ্যাত এবং প্রচন্ড কূট বুদ্ধির অধিকারী। বিভিন্ন সময়ে তার নানা কূট চালের শিকার হতে হয়েছে দেবতাদের। মিওলনির নামক হাতুড়িটির জন্মও হয়েছে লোকিরই এক দুষ্টু বুদ্ধির ফলস্বরূপ। তাই কথা না বাড়িয়ে এই হাতুড়ি তৈরির মূল কাহিনীতে চলে যাওয়া যাক।

পুরাণের থর ও চলচ্চিত্রের থর; Image Source: quirkybyte.com

থরের স্ত্রী সিফ ছিল দেবীদের মাঝে অনন্য সুন্দরী। নীল চোখ, লাবণ্যময়ী চেহারা ও লম্বা সোনালী চুলের জন্য সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কিন্তু সিফের এই রূপ লোকির কুনজরে পড়ে। এক রাতে থর ও সিফ নিজেদের কক্ষে গভীর ঘুমে নিমগ্ন ছিল। একই রাতে লোকি প্রচুর মদ্যপান করেন। মদ্যপ অবস্থায় তিনি মনে করেন, সিফের লম্বা চুলগুলো কেটে ফেললে ব্যাপারটা অনেক মজার হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নীরবে তিনি থরের কক্ষে প্রবেশ করেন। কাউকে বুঝতে না দিয়ে ঘুমের মাঝেই সিফের লম্বা সোনালী চুলগুলো একেবারে গোড়া থেকে কেটে দেন।

ঘুম থেকে উঠে নিজের স্ত্রীর অদ্ভুত চেহারা দেখে থর একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে চুলের বদলে নগ্ন চামড়ার স্পর্শ পেয়ে সিফও তার কাণ্ডজ্ঞান হারাতে বসে। থরের বুঝতে মোটেও সময় লাগে না। এমন কাজ একমাত্র লোকির দ্বারাই সম্ভব। নিজের সৎ ভাইকে অনেক ভালো করে চেনেন তিনি। তাই এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি লোকিকে খুঁজতে বের হয়।

ঘুমন্ত সিফের চুল কাটছেন লোকি; Image Source: germanicmythology.com

লোকির ঘরে ঢুকেই থর রীতিমতো তার গলার টুঁটি চেপে ধরেন। যেভাবেই হোক লোকিকে সিফের পুরনো সোনালী চুল ফিরিয়ে দিতে হবে। মদ্যপ অবস্থায় মজা করতে গিয়ে একটি ভুল করে বসেছে লোকি। থরের ক্রোধ দেখে তিনি তা পরিষ্কার বুঝতে পারেন। কিন্তু সিফের চুল ফিরিয়ে দেওয়া একেবারেই সম্ভব না। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে তিনি থরকে উপদেশ দেন সিফের মাথায় স্কার্ফ ব্যবহার করার জন্য। এ কথাটি শুনে থর প্রচন্ড রেগে যান এবং তখনই লোকির শরীরের সবকটি হাড় ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। এরকম হুমকি শোনার পরই লোকির কয়েকজন কামার বামনের কথা মনে পড়ে।

বামনদের রাজা ইভালডির সন্তানেরা ছিল অনেক দক্ষ কামার। তারা সম্ভব-অসম্ভব যেকোনো কিছু তৈরি করতে পারেন। লোকি বুঝতে পারেন যে, নিজের প্রাণ বাঁচাতে হলে এদের কাছেই যেতে হবে। তবে গেলেই তো আর হবে না। তাদেরকে সিফের নতুন চুল বানানোর জন্য যেভাবে হোক রাজি করাতেই হবে। এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এক ধূর্ত বুদ্ধির আশ্রয় নেন তিনি। প্রথমেই তিনি রওনা দেন বামনদের কর্মশালা সভারটাল্ফহাইমে।

কামার হিসেবে অনেক দক্ষ ছিলেন এই বামনেরা; Image source: devianart.com

প্রথমে লোকি এসে হাজির হন পাহাড়ের অপর পাশে ইভালডির দুই পুত্রের কাছে। কূট বুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে তিনি এক নতুন চাল চালেন। দুই বামনকে তিনি বলেন, অপর দুই সহোদর ব্রক ও ইত্রি নাকি নিজেদেরকে সর্বকালের সেরা নির্মাতা হিসেবে ঘোষণা করেছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনের নাম ছিল সিন্দ্রি। লোকির এই মিথ্যা কথা তিনি বিশ্বাস করে ফেলেন এবং তীব্র আপত্তি জানান।

ভাইদের দুজনই বড়াই করে বলেন যে, যেকোনো জিনিস তৈরিতে তারা ব্রক ও ইত্রিকে টেক্কা দিতে পারবে। এই কথাটির জন্যই মূলত অপেক্ষা করছিল লোকি। নিজের বানোয়াট মিথ্যা কথা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। বলেন যে, ব্রক ও ইত্রি নাকি তাদের উপর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। দেবতাদের জন্য উপহার হিসেবে তিনটি জিনিস তৈরি করতে হবে। তারাও এতে অংশগ্রহণ করবেন। কোন দুই ভাই জয়ী হবেন, তার বিচার করবেন দেবতারাই।

ইভালডির দুই সন্তান লোকির বানানো এই মিথ্যা চ্যালেঞ্জ লুফে নেন। যাওয়ার আগে লোকি বলতে ভুলে যান না যে, উক্ত তিনটি উপহারের মধ্যে একটি হবে সিফের লম্বা সোনালী চুল।

পুরাণ অনুযায়ী লোকি দেখতে ঠিক এমন; Image Source: norse-mythology.org

এবার লোকি রওনা দেন দুই বামন ভাই ব্রক ও ইত্রির কামারশালায়। তাদের কাছেও একইভাবে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা চ্যালেঞ্জের কথা শোনান। কাজের দিক থেকে ইত্রি ব্রকের তুলনায় অনেক দক্ষ হলেও ব্রকের বুদ্ধি ছিল অনেক বেশি। তিনি এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে লোকির কোনো চালাকি আছে কিনা তা সন্দেহ করতে থাকেন। দুই ভাই মিলে আলোচনা করে অবশেষে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান।

তারা লোকিকে জানান যে, বিষয়টা আরো ব্যক্তিগত করলে ভালো হয়। নিজেরাই যে সবার থেকে সেরা তাতে দুই ভাইয়ের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেবতারা যদি তাদের জয়ী ঘোষণা করে, তবে লোকিকে শর্তস্বরূপ নিজের মাথা দান করতে হবে। নিষ্পাপ সেজে থাকা লোকি শুরুতে তাদের এই শর্ত শুনে হেসে ফেললেও পরে বুঝতে পারেন যে, বামন দুই ভাই আসলেই তা চান। একদিকে থরের কাছে মৃত্যুর হুমকি ও অন্যদিকে বামনদের কাছে মাথা হারানোর ভয় লোকিকে পেয়ে বসে। অবশেষে তিনি ব্রক ও ইত্রির দেওয়া শর্ত মেনে নেন।

লোকির ঘাড় থেকে একটা বিপদ কেটে গেছে। পাহাড়ের অপর পাশে ইভালডির দুই ছেলে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। তারা সিফের জন্য সোনালী চুল তৈরি করবে। কিন্তু এদিকে তার জন্য নতুন এক ঝামেলার উদ্ভব হয়েছে। আর তা হলো ব্রক আর ইত্রিকে যেভাবেই হোক পরাজিত হতে হবে। তা না হলে লোকির নিজের মাথাটাই যে আর থাকবে না।

আগে থেকে জানিয়ে রাখা উচিত যে, লোকির এক বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। আর তা হলো, তিনি যেকোনো জীবের রূপ ধারণ করতে পারেন। ব্রক ও ইত্রিকে হারানোর জন্য সে তার এই ক্ষমতাটিকেই ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন।

চলচ্চিত্রে ধূর্ত স্বভাবের লোকির চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছেন অভিনেতা টম হিডলস্টোন; Image Source: screengeek.net

ব্রক ও ইত্রি দ্রুত তাদের কাজে হাত দেন। শুরু করার আগে তারা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নেন। ইত্রি কাজের নেতৃত্ব দেন। ব্রক তাদের লোহার পাত সঠিক তাপমাত্রায় উত্তপ্ত রাখার জন্য হাপর চালাবেন। আর ইত্রি সেই উত্তাপে নিজের হাতুড়ি ব্যবহার করে উপহার তৈরি করবেন। এভাবে ব্রককে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার পর ইত্রি হাপর চালানো ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

তিনি দরজা খোলার সাথে সাথে একটি মাছি ব্রকের কাজের জায়গায় প্রবেশ করে। সে এক বিদঘুটে মাছি! মৌমাছিও না, আবার সাধারণ মাছিও না। মৌমাছির থেকেও বড় এই কালো মাছিটির ওড়ার মাঝেই যেন এক অশুভ ভাব রয়েছে। লোকি নিজেই আসলে এই মাছির রূপ ধারণ করেছিলেন দুই বামনের কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য। ব্রক নির্দিষ্ট ছন্দে হাপর চালাচ্ছেন।

বাইরে থেকে ভেসে আসছে ইত্রির হাতুড়ির আওয়াজ। উত্তাপের সামান্য হেরফের হলে তাদের কাজের পুরোটা পণ্ডশ্রম হবে। সমান তালে ব্রক হাপর চালিয়ে যেতে থাকেন। উড়ে উড়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছিল মাছিতে রূপ নেওয়া লোকি। দুই হাত দিয়ে হাপর চালাচ্ছিলেন ব্রক। এক হাতে গিয়ে মাছি বসে পড়লো। মাছিটাকে দেখেও ব্রক তার কাজে বিরতি দিলেন না। তাপমাত্রার এক বিন্দুও এদিক ওদিক হওয়া যাবে না। কাজ হচ্ছে না দেখে লোকি ব্রকের হাতের উপর প্রচন্ড শক্তি দিয়ে একটি কামড় বসিয়ে দিলেন।

গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন দুই বামন ব্রক ও ইত্রি; Image Source: Wikipedia

মাছির রূপ ধারণকারী লোকির কামড়কে একদম পাত্তা দিল না ব্রক। তার সকল মনোযোগ ছিল হাপরের উপর। অবশেষে ইত্রি দরজা খুলে ভিতরে ঢোকেন। আগুন থেকে বের করে আনেন তাদের বানানো প্রথম উপহার। একটি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি শুকর। কোনো রকম বিলম্ব না করে দ্বিতীয় উপহার বানানোর কাজে লেগে গেল দুইজন। এবার ইত্রি একটি সোনার পিন্ড তুলে তা আগুনে দিয়ে দিলেন।

আগের মতোই কাজ চলছে দুই বামনের। ব্রক হাপর চালিয়ে তাপমাত্রা ঠিক রাখছে, আর ইত্রি বাইরে হাতুড়ি চালাচ্ছেন। মাছিটা ঠিকই ঘরের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। এবার লোকি আর ব্রকের হাতের উপর বসলেন না। বসলেন ঠিক তার ঘাড়ের উপর। ঘাড় বেয়ে অনবরত বেয়ে পড়া ঘাম উপেক্ষা করে মাছিটা কামড়ের সঠিক সুযোগ খুঁজতে থাকে। অপরদিকে ইত্রি বাইরে থেকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এবারের কাজ বেশ সূক্ষ্ম। হাপরের গতি যেন সামান্যতম বাড়ানো বা কমানো না হয়। মাছিটা হঠাৎ ব্রকের ঘাড়ে কামড়ে বসলো, আগের থেকেও বেশি শক্তি দিয়ে। বিন্দু বিন্দু ঘাম আর রক্তে ব্রকের ঘাড় একাকার হয়ে গেল। তবুও সে সামান্য পাত্তা দিলেন না। এক মনে হাপর চালিয়ে যেতে থাকলেন।

কাজ শেষ হওয়ার পর ইত্রি পুনরায় ঘরে প্রবেশ করলো। তার হাতে একটা সোনালী রঙের আংটি। ঠিক আঙ্গুলের না, হাতের কব্জিতে পড়ার আংটি। ইত্রি এর নাম দিল ড্রুপনির। এর অর্থ ফোঁটা ঝরে যায় যার থেকে।

অ্যাভেঞ্জারস ইনফিনিটি ওয়ার চলচ্চিত্রে ইত্রির চরিত্রে অভিনয় করেছেন গেইম অফ থ্রোন্সের অভিনেতা পিটার ডিংকলেজ; Image Source: cbr.com

পরপর দুবার বিফল হওয়ার পর মাছিরুপী লোকি বুঝতে পারল যে এটিই তার শেষ সুযোগ। এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলেই নিজের মাথা খোয়াতে হবে তাকে। তাই ব্রক আর ইত্রি আবার কাজ শুরু করে দিলে সে নতুন এক জায়গা বসার জন্য বেছে নিলেন। এবার লোকি কোনো ভুল করবেন না। তিনি বসে পড়েছেন একেবারে ব্রকের দুই চোখের মাঝখানে। যথারীতি দুই বামন ভাই মিলে তাদের শেষ কাজ শুরু করে দিয়েছে। এবার কামড় দিতে শুরু করলেন লোকি। প্রচন্ড ব্যথার মধ্যেও একই গতিতে হাপর চালাতে থাকলেন ব্রক। লোকিও থেমে নেই। একের পর এক কামড় বসাতে লাগলেন তিনি। বামনের চোখ একেবারে লাল হয়ে যায়। তার চোখের পাপড়ি থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকে। এই রক্তের কারণে তিনি কিছুই দেখতে পান না।

এই প্রথমবার ব্রক ইতস্তত বোধ করতে শুরু করে। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে মাছিটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করেন। ঠোঁট সরু করে ফুঁ দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ঐদিকে ইত্রি তাকে জানিয়ে রেখেছেন যে, এটি আগের দুই কাজের থেকেও অনেক বেশি সূক্ষ্ম এবং তাদের করা এ পর্যন্ত সেরা কাজ হবে। কিন্তু ব্রকের সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছে। তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন যে, যখনই ইত্রি হাতুড়ির বাড়ি পড়বে, তখনই তিনি এক হাত দিয়ে মাছিটি সরিয়ে দেবেন। অবশেষে তিনি হাতুড়ির শব্দ শুনলো। প্রচন্ড বেগে নিজের মুখের উপর হাত চালালো সে। সময়মতো সরে না গেলে মাছি অবস্থায়ই লোকি অক্কা পেতেন।

দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো ইত্রি। তার চোখেমুখে হতাশা। সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু শেষের দিকে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। তাদের সেরা কাজ নষ্ট হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে নিজের আসল রূপে বামনদের কামারশালায় প্রবেশ করলেন লোকি। তাদের কাজ কতদূর বাকি জানার ইচ্ছা পোষণ করলেন তিনি। ইত্রি আগ বাড়িয়ে বললেন যে, ব্রক তাদের উপহার দেবতাদের আবাস অ্যাসগার্ডে নিয়ে যাবেন। আর জয়ী হবার পর লোকির মাথাটাও কেটে নিয়ে আসবেন।

মাছিরুপী লোকির কারণে বামনদের শেষ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায় ; Image Source: Pinterest

অ্যাসগার্ডে উপহার প্রদর্শনী শুরু হলো। বিচারকের আসনে ছিল সর্ব-পিতা ওডিন, বজ্র দেবতা থর এবং সৌন্দর্যের দেবী ফ্রে। এক পাশে আছে ইভালডির দুই সন্তান এবং অপর পাশে ব্রক। ইত্রি এখানে উপস্থিত হননি। লোকি যথারীতি সেখানে ইভালডির সন্তানদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে দেবতাদের সামনে এই দুজনের বানানো উপহার পেশ করা হলো।

ইভালডির সন্তানেরা প্রথমে ওডিনকে উপহার দিল গুংগির নামক একটি বর্শা। শত হলেও ওডিনের একটি চোখ নেই। এই বর্শা তাকে লক্ষ্যভেদ করতে সাহায্য করবে। অসামান্য কারুকাজে সৃষ্টি এই বর্শা যেকোনো লক্ষ্য ভেদ করতে পারবে। উপহারটি ওডিনের পছন্দ হয়।

নিজের গুংগির বর্শা হাতে দেবতা ওডিন ; Image Source: ancientpages.com

দ্বিতীয় উপহার ছিল থরের স্ত্রী সিফের জন্য। এক গোছা সোনালি চুল। এই পরচুলাটি মাথায় দিলে তা তার চামড়ার সাথে জুড়ে যাবে। চুলটি পরখ করে স্ত্রী সিফকে পরিয়ে দিলেন থর। নতুন চুল পাওয়ার পর সিফকে আগের থেকেও বেশি সুন্দরী দেখায়। উপহারের কার্যকারিতা দেখে খুশি হয়ে গেলেন থর।

তৃতীয় উপহার ছিল একটা রুমাল। এই উপহারটি দেবী ফ্রের জন্য বানানো। দেখতে সামান্য রুমাল মনে হলেও এর ভাঁজ খুললে বেরিয়ে আসবে এক বিরাট বড় জাহাজ। দূরে যাতায়াতের জন্য এই জাহাজ ব্যবহার করা যাবে। আবার প্রয়োজনে ভাঁজ করে রাখা যাবে। জাহাজটার নাম স্কিডব্লাডনির। এই উপহারটিও ফ্রের অনেক পছন্দ হয়।

স্কিডব্লাডনির জাহাজের একটি ছবি; Image Source: Pinterest

এইবার ব্রকের পালা। প্রথম প্রতিযোগীর সব উপহার দেবতাদের পছন্দ হয়েছে। আর ব্রক আর ইত্রির বানানো শেষ উপহার ঠিকমতো তৈরি হয়নি। এ ব্যাপারটা ভেবেই লোকি মিটমিট করে হাসতে থাকে।

মাছির কামড়ে ব্রকের চোখ ও ঘাড় ফুলে গেছে। এমন অবস্থায় তিনি দরবারে দেবতাদের সামনে তার উপহারগুলো নিয়ে হাজির হন। ব্রক প্রথমে বের করলো ড্রুপনির নামক আংটিটা। এটি তিনি এবং ইত্রি ওডিনের জন্য বানিয়েছেন। দেখতে অসম্ভব সুন্দর ছিল আংটিটা। আট রাত অন্তর অন্তর এই আংটি থেকে ঝরে পড়বে একই রকম দেখতে আরো আটটি আংটি। ওডিন চাইলে এই আংটিগুলো অন্যদের উপহার দিতে পারেন কিংবা নিজের জন্য রেখে দিতে পারেন। আংটিটা ওডিনের পছন্দ হয়ে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ তা হাতে পরে নেন।

পুরাণের বর্ণনা হুবুহু অনুসরণ করে বানানো ড্রুপনির ; Image Source: emp.co.uk

দ্বিতীয় উপহারটি ছিল একটি স্বর্ণ নির্মিত শুকর। এই উপহার তৈরি করা হয়েছে দেবী ফ্রের জন্য। তিনি তার রথে এই শুকর বেঁধে দিলে তা সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ার থেকেও বেশি বেগে দৌড়াতে পারবে। আর রাতের অন্ধকারে পথ চেনার জন্য শুকর থেকে আলো নির্গত হবে। এই উপহারটি ফ্রের অনেক পছন্দ হয়ে যায়।

এবার শেষ উপহার দেখানোর পালা। লোকির জন্য যে উপহারটি প্রায় নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিল। থরের সামনে একটা হাতুড়ি এনে রাখলেন ব্রক। হাতুড়িটা দেখেই থর একটা বিতৃষ্ণার আওয়াজ করে বসলেন। কারণ এর হাতল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক ছোট। ব্রক তার এই অভিযোগ মেনে নিলেন। কিন্তু এটি বাতিল করার আগে থরকে অনুরোধ করলেন এর কিছু বৈশিষ্ট্য শোনার জন্য।

তিনি জানালেন যে, হাতুড়িটি ছুঁড়ে মারলে তা কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না। কথাটি থরের ভালো লাগলো। তিনি আরো কিছু জানার জন্য উন্মুখ হন। ব্রক আবার বলতে শুরু করেন। এটি যতদূরেই ছুঁড়ে মারা হোক না কেন, ঠিকই এর মালিকের হাতে ফিরে আসতে পারে। এটি তার মালিকের আদেশে ক্ষুদ্র থেকে বিশাল যেকোনো আকার ধারণ করতে পারে। আর এই হাতুড়ির সবচেয়ে বড় যে গুণ তা হলো, এটি কখনো ধ্বংস করা যাবে না। তারা এর নাম দিয়েছে মিওলনির বা বজ্র প্রস্তুতকারী।

প্রাচীন ভাইকিং সম্প্রদায় থরের হাতুড়িকে কবচ হিসেবে পরিধান করতো; Image Source: desktopbackground.org

পরম শক্তিমত্তার অধিকারী থর কেন যেন কোনো হাতিয়ার বেশি সময়ের জন্য আগলে রাখতে পারেন না।  তাছাড়া তিনি খুব ভালো নিশানাও করতে পারেন না। হাতুড়িটি সম্পর্কে জানার পর তিনি বাচ্চাদের খেলনা পাওয়ার মতো তা নাড়াচাড়া করতে থাকে। হাতল ছোট হওয়াতে তার কোনো মাথা ব্যথাই নেই। ওডিন ও ফ্রেও এই শেষ উপহারটি অনেক পছন্দ করেন। ওডিন তো একেবারে বলে দেন যে, এই হাতুড়ি অ্যাসগার্ডকে বহিরাগত শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবে। হাতুড়িটি হাতে নেওয়ার পর তা আকাশের দিকে উচিয়ে ধরেন থর। অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন সবাই। এই হাতিয়ারটি বজ্র দেবতা থরকে পরিপূর্ণ করেছে।

যথারীতি প্রতিযোগিতায় ব্রক ও ইত্রির দল জিতে যায়। এবার শর্তানুযায়ী, লোকির মাথা সংগ্রহ করার পালা। ব্রক একটি ছুরি নিয়ে লোকির দিকে আগাতে থাকেন। পায়ে পড়া উড়ন্ত জুতার সাহায্যে লোকি পালানোর চেষ্টা করেন। লোকিকে পালাতে দেখে ব্রক থরের কাছে অনুরোধ করেন তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। এতক্ষণ থর তামাশা দেখছিলেন। এবার তিনি নতুন হাতিয়ার ব্যবহার করে ফেরত নিয়ে আসে লোকিকে। কিন্তু অতি শীঘ্র মাথা হারাতে যাওয়া লোকির চোখে কোনো ভয় নেই। এটুকু সময়ের মধ্যে তিনি এক নতুন ফন্দী এঁটে ফেলেছেন।

মিওলনির থরের শক্তিকে পূর্ণতা দিয়েছে ; Image Source: wallpapercave.com

লোকি ব্রককে বলেন যে, মাথা যদি সে নিতে চায় তো নিতে পারবে, কিন্তু তার গলা কাটা যাবে না। কারণ শর্তে গলা কাটার কোনো কথা বলা ছিল না। এবার ব্রক পড়লেন এক নতুন ঝামেলায়। গলা কাটা ছাড়া তো আর মাথা পাওয়া যাবে না। ওডিন তাদের এই দ্বন্দ্ব এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিল। তিনিও লোকির কথার মাঝে যুক্তি খুঁজে পেলেন। তিনি লোকির এই যুক্তি মেনে নিলেন।

ব্রকের এবার মন ও মেজাজ দুটিই খারাপ হয়ে গেল। কী ভেবে তিনি তার থলে থেকে সুঁই-সুতো বের করে আনলেন। এবার কিছু বলার আগেই তিনি লোকির ঠোঁট দুটো সেলাই করে দেন। যত নষ্টের গোড়া লোকির এই দুই ঠোঁট। কথা বলে তিনি যেকোনো কিছু হাসিল করতে পারেন। তাই মাথা না পাক, অন্তত ঠোঁট দুটো বন্ধ করে শান্তি পাওয়া যাবে। ব্রকের এই কান্ড দেখে দেবতারা অনেক মজা পেয়ে যান।

এভাবেই নর্ডিক দেবতারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সরঞ্জাম ও হাতিয়ার লাভ করেন। থর তার হাতুড়ি মিওলনির সবসময় নিজের কাছে আগলে রাখতে শুরু করে। ওডিনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এটি তাদের নানা যুদ্ধে জয়ী হতেও সাহায্য করে। উপকথায় মিওলনির নামক হাতুড়িটি তাই অনেক বেশি জনপ্রিয়। আর এটির ক্ষমতা নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই।

This bengali article is about the origin and creation of the hammer of  the god of thunder Thor. Neil Gaiman's 'Norse Mythology' book (page no. 28 - 38) was used as main reference. Other reference have been hyperlinked within the article.

Feature Image Source: 1920x1080hdwallpapers.com

Related Articles