আমাদের চারপাশে লুকিয়ে আছে নানা রহস্য। কোনো কোনো রহস্যকে অনেক জটিল মনে হয়। আবার কোনো কোনো রহস্য এতটাই সরল যে, সেটি আমাদের চোখেই পড়ে না। যেমন এই নারকেলের কথাই ধরা যাক। ভাবছেন, নারকেলের আবার কীসের রহস্য? চলুন, জেনে নেয়া যাক।
নারকেল খুবই জনপ্রিয় একটি ফল। বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশ এবং সমুদ্র উপকূল কিংবা দ্বীপগুলোতে নারকেল গাছ দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। নারকেল গাছ এমন একটি গাছ, যার প্রায় প্রতিটি অংশই ব্যবহারযোগ্য। কচি নারকেল অর্থাৎ, ডাবের পানি অত্যন্ত সুস্বাদু এবং তৃষ্ণা নিবারণকারী পানীয়।
পরিপক্ব নারকেলের ভেতরে থাকা মাংসল অংশ বা শাঁস খাবার হিসেবে ব্যবহার হয়। এ শাঁস থেকে পাওয়া রসকে বলা হয় নারকেলের দুধ, যা রান্নায় ব্যবহৃত হয়। শাঁস শুকিয়ে তা থেকে তৈরি করা হয় নারকেল তেল। নারকেলের তেল সুপ্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। এই তেল ময়েশ্চারাইজার এবং প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হিসেবে খুবই প্রসিদ্ধ।
এরপর আসে নারকেলের শক্ত খোলস। এরও ব্যবহার আছে নানাবিধ। প্লাস্টিকের বোতাম তৈরির আগে নারকেলের এই খোলস থেকেই বোতাম তৈরি করা হতো। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে এর খোলস দিয়ে তৈরি করা হয় রান্নার উপকরণ।
নারকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি করা হয় দড়ি, যা বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। নারকেল গাছের পাতা থেকে জ্বালানি এবং পাতার শিষ থেকে তৈরি করা হয় দেশি ঝাড়ু। গ্রামাঞ্চলে ঘরবাড়ি তৈরিতে নারকেল গাছের কাঠের ব্যবহার খুবই প্রাচীন।
তো নারকেলের অনেক 'প্রশংসা' করা হলো। এবার মূল আলোচনায় ফিরে যাওয়া যাক।
নারকেল সকলের কাছে সুপরিচিত এবং প্রায় প্রত্যেকে নারকেলের শক্ত খোলসের সাথে পরিচিত। প্রতিবার নারকেলের এই খোলস দেখার সময় এর একপাশে তিনটি ডট বা খানিকটা গোলাকার চিহ্ন দেখা যায়। ব্যাপারটা অনেকেই দেখেছেন। তিনটির কমও নয়, আবার বেশিও নয়। মজার ব্যাপার হলো, এই তিনটি ডট দেখে মনে হয় কোনো দুঃখী মানুষের মুখের চিহ্ন।
কখনো কি মনে প্রশ্ন জাগেনি যে, নারকেলের গায়ে মানবমুখের আদলে তিনটি চিহ্নের সৃষ্টি হলো কেন বা কীভাবে? এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয়তো আছে, যা লেখার শেষে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তার আগে চলুন জানা যাক নারকেলের এই তিনটি চিহ্ন নিয়ে প্রচলিত কয়েকটি উপকথা।
মানাহিকি দ্বীপের কিংবদন্তি
নারকেলের মানবমুখের অবয়বের ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ একটি উপকথা পাওয়া মানাহিকি দ্বীপের কিংবদন্তীতে। মানাহিকি বা মানিহিকি দ্বীপ মূলত কুক দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত। এ অঞ্চলের অধিবাসীদের বলা হত মাওরি এবং এদের শরীরের বর্ণ ছিল তামাটে। তো মানাহিকি কিংবা মাওরি কিংবদন্তিতে নারকেলের উৎপত্তি বিষয়ক এক করুণ কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে।
একসময়ে দেবতাদের সন্তানেরা মাঝে মাঝে পৃথিবীতে নেমে আসত। কেউ কেউ থাকত পৃথিবীতেই। ঠিক সে সময়ে মানাহিকি দ্বীপে থাকতো আবেদনময়ী, সুন্দরী এবং কুমারী এক মেয়ে, যার নাম ছিল হিনা। পুরো দ্বীপে হিনা তার লাবণ্য ছড়িয়ে ঘুরে বেড়াত চঞ্চল হরিণীর মতো। কিন্তু তখনো সে কাউকে তার ভালোবাসা দিয়ে আবদ্ধ করেনি বা কারো ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়নি।
তবে সময় অন্যরকম রূপ নিল। চঞ্চল হিনা আস্তে আস্তে যেন শোকে-দুঃখে গুটিয়ে যেতে শুরু করল। সারা দ্বীপের মানুষের কাছে সেটি হয়ে উঠল আরো রহস্যময়। মাউই, হিনার এক পাণিপ্রার্থী শেষ পর্যন্ত বের করল হিনার এহেন দুর্দশার কারণ।
মানাহিকি দ্বীপের মানুষ স্নানের জন্য নিকটবর্তী একটি হ্রদে যেত। হিনা সাধারণত সন্ধ্যায় স্নানের উদ্দেশ্যে যেত সেই হ্রদে। কোনো এক সন্ধ্যায় স্নানকালে সে হ্রদের পানিতে দেখা পায় টুনা নামক এক সুদর্শন যুবকের। চোখে চোখে তাদের মধ্যে ভালোবাসার বিনিময় হয়ে যায়। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় সমুদ্রের মাতাল হাওয়া আর স্রোতের মনোরম পরিবেশে তাদের মধ্যে মনের দেয়া-নেয়া হয়ে যায়। তারা একে অপরের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।
কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে টুনা ছিলো একজন মারম্যান বা মৎস্যপুরুষ, মতান্তরে ইল মাছ। টুনার পিতা টাঙ্গারোয়া ছিলেন মৎস্যজগতের রাজা এবং তার রাজ্যকালে টুনা ছিল সবচেয়ে সুদর্শন। কিন্তু সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে হিনা টেরই পেল না যে, টুনা একজন মৎস্যপুরুষ। টুনা হিনার থেকে এক প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে, হিনা কখনো টুনার অতীত বা তার অন্তর্ধান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না বা খোঁজ করবে না। হিনাও কথা দেয় টুনাকে।
প্রথমদিকে হিনা সুখে থাকলেও আস্তে আস্তে তার মধ্যে হতাশা বাসা বাধতে শুরু করে। কারণ টুনা সাধারণত রাতের বেলা তার সাথে দেখা করতে আসে। তাছাড়া আস্তে আস্তে হিনা আবিষ্কার করে যে, টুনা অন্য পুরুষদের মতো নয়। তার শরীর কেমন যেন ঠাণ্ডা আর চটচটে, মাছের শরীরের মতো।
হিনার এই হতাশা দ্বীপের মানুষের দৃষ্টি এড়ায়নি, বিশেষ করে তার পাণিপ্রার্থীদের। এমনই একজন ছিল মাউই। মাউই একদিন হিনার উপর নজর রাখতে গিয়ে আবিষ্কার করে যে, রাতের বেলা হ্রদ থেকে এক যুবক ভেসে ওঠে এবং হিনার সাথে দেখা করে। মাউইও ছিলো টুনার পিতা টাঙ্গারোয়ার প্রজন্ম। তাই সে সহজেই চিনে ফেলে টুনাকে।
টুনা চলে যাওয়ার পর মাউই যায় হিনার কুটিরে। হিনা এবং টুনার কথা তখনও মাউই ছাড়া আর কেউই জানেনি। তো মাউই হিনাকে ডেকে টুনা আর হিনার বিয়ের কথা জিজ্ঞাসা করে। হিনা মনে করে, মাউই কোনো এক দেবতা। মাউই নিজেকে দেবতা হিসেবেই পরিচিতি দেয় এবং বলে যে, হিনা তার স্বামীকে নিয়ে চিহ্নিত থাকে সবসময়। তাছাড়া টুনার শরীর যে ঠাণ্ডা ও চটচটে এবং সে দিনের বেলা আসে না; সেটিও জানাতে ভোলে না মাউই। ফলে হিনার আর সন্দেহ থাকে না যে, মাউই একজন দেবতা।
এ সময়ে মাউই বলে যে, সে হিনার দুর্দশা লাঘব করবে। কিন্তু বিনিময়ে তাকে হিনার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। হিনা তখন তাকে সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করে, তবে মাউইকে তার দুর্দশা লাঘবের সুযোগও দেয়। কারণ তখনও সে জানতে পারেনি, আসলে কী হতে চলেছে।
অনুমতি পেয়ে মাউই বেরিয়ে পড়ে তার ক্যানো নৌকা নিয়ে এবং অপেক্ষা করতে থাকে টুনার। টুনাও বুঝে ফেলে যে, তার হয়তো আর রক্ষা নেই। তাই সেদিন রাতে হিনার সাথে দেখা করতে এসে টুনা বলে যে, তাকে হয়তো কেউ গলা কেটে হত্যা করবে। যদি তেমন কোনো কিছু ঘটে থাকে, তবে হিনা যেন তার মাথা নিয়ে তাদের মিলনস্থলে গিয়ে পুঁতে রাখে এবং চোখের জলে সেই জায়গা সিক্ত করে। সেখানে একসময় একটি গাছের জন্ম হবে, যার ফল খেয়ে হিনা এবং তাদের সন্তানেরা বেঁচে থাকবে।
সেদিন মাউই টুনার শিরশ্ছেদ করে। টুনার কথামতো হিনা তার মাথা নিয়ে পুঁতে রাখে এবং চোখের জলে সিক্ত করে। সেখানে জন্ম হয় নারকেল গাছের। আর প্রতিটি নারকেলে থেকে যায় টুনার দুঃখী মুখের অবয়ব এবং ছোবড়ার আকারে চুল। মাওরিদের বিশ্বাস, এভাবেই নারকেল এবং এর চোখ-মুখের সৃষ্টি হয়।
হিন্দু ধর্মীয় উপকথা
ভারতীয় সনাতন ধর্মেও নারকেলের উৎপত্তি বিষয়ক বর্ণনা পাওয়া যায়। মহাদেব শিবের ছিল তিনটি চোখ। শিবের কনিষ্ঠ পুত্র গণেশ শিবের এই তৃতীয় চোখের প্রতি আকৃষ্ট হন। শিব তার ধ্যানে বসলে গণেশ বারবার শিবের তৃতীয় নেত্র স্পর্শ করার চেষ্টা করেন। এতে শিবের ধ্যানে ব্যাঘাত হচ্ছিল। তাই তিনি গণেশকে তিন চোখের একটি বলসদৃশ বস্তু সৃষ্টি করে দেন। এ বলের গায়ে শিবের চুলের মত জটাও তৈরি দেন তিনি।
বালক গণেশ সেই বল নিয়ে খেলতে থাকেন কৈলাসে। কিন্তু খেলতে খেলতে হঠাৎ তার হাত থেকে সে বল পড়ে যায় পৃথিবীতে। এরপর জল-মাটি পেয়ে সেই বল থেকে জন্ম নেয় নারকেল গাছ।
আরেকটি বিশ্বাসমতে, নারকেল সৃষ্টি করেছিলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র। বিশ্বামিত্রের বন্ধু রাজা সত্যব্রত (মতান্তরে ত্রিশঙ্কু) ছিলেন সূর্য বংশের প্রতাপশালী রাজা। রাজা সত্যব্রত নশ্বর মানুষ হিসেবে স্বর্গলোকে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন, কেননা স্বর্গলোকে কোনো নশ্বর বস্তু বা ব্যক্তির প্রবেশাধিকার ছিল না। ফলে, স্বর্গরাজ ইন্দ্র তাকে আবার মর্ত্যে প্রেরণ করেন। রাজাকে সাহায্য করার জন্যই মহর্ষি বিশ্বামিত্র সৃষ্টি করেছিলেন নারকেল।
সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে নারকেল একটি পবিত্র ফল। একে সংস্কৃতে 'শ্রীফল'-ও বলা হয়ে থাকে। সংস্কৃত নারকেল শব্দটি এসেছে ‘নায়র’, যার অর্থ তৈল এবং ‘কলাই’, যার অর্থ বাদাম থেকে। নারকেল গাছকে বলা হয়ে থাকে ‘কল্পবৃক্ষ’, যে বৃক্ষের কাছে মানুষ যা চায়, তা-ই পায়। তাছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বেশিরভাগ পূজা-পার্বণে নারকেল অপরিহার্য উপাদান। কোনো শুভকাজের পূর্বে তাই নারকেল ভেঙে উদ্বোধন করা হয়।
এল কুকো নামক প্রেতাত্মা
এল কুকো (El Cuco) একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার অর্থ করলে দাঁড়ায় প্রেতাত্মা। স্প্যানিশ উপকথায় এল কুকো হচ্ছে কল্পিত প্রেতাত্মা। সাধারণত ছোট বাচ্চাদের এল কুকোর ভয় দেখিয়ে শান্ত রাখা হতো এবং ঘুম পাড়ানো হতো।
এল কুকোর কাহিনীর মূল পাওয়া যায় পর্তুগিজ এবং গ্যালিসিয়ান উপকথায়। প্রকৃতপক্ষে নারকেলের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘কোকোনাট’ এসেছে এই জটা চুলের এল কুকো প্রেতাত্মার নাম থেকে। যখন পর্তুগিজরা সারা বিশ্বে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করছিল, তখন তারা এই নারকেলকেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেয়। সেই সাথে পৌঁছে দেয় এর কাহিনী।
এল কুকো-র সঠিক চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি। পিতামাতা তাদের নিজেদের মতো করে এল কুকোর চেহারা বর্ণনা বাচ্চাদের শান্ত রাখতেন। যেহেতু নারকেলের ইংরেজি নাম এসেছে এই এল কুকো থেকে, কাজেই নারকেলকে এল কুকো প্রেতাত্মার চেহারা কল্পনা করে নিতে পারেন!
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ
বৈজ্ঞানিকভাবে নারকেলের তিনটি বিশেষ চিহ্নের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কেবল হাইপোথিসিসের উপর নির্ভর করতে হবে আমাদের। তবে এখানেও দুটি মতবাদ আছে। একটি বিবর্তনকে নির্দেশ করে, অপর মতবাদটি নারকেলের ফুলের গর্ভপত্রের উপর ভিত্তি করে দেয়া হয়েছে।
নারকেলকে পাম গোত্রের সহোদর বলা চলে। বিবর্তনিক বা অভিব্যক্তিক মতবাদ অনুসারে, কোনো এক সময় নিষেকজনিত কারণে তিনটি পাম ফল একটি খোলসের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায়। বিষয়টা মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর জোড়া সন্তান জন্মদানের মতো। এই তিনটি পাম ফলের তিনটি চিহ্নই একসাথে থেকে যায় এবং নারকেলের জন্ম হয়। কিন্তু এই মতবাদের দ্বারা এটি জানা যায় না যে, কেন দুটি চিহ্ন সংকীর্ণ এবং একটি চিহ্ন পরিপূর্ণ হয়েছে।
অপর মতবাদ অনুসারে, নারকেলের তিনটি চিহ্নের জন্য দায়ী এর ফুলের তিনটি গর্ভপত্র। নারকেলের এই তিনটি চিহ্ন আসলে নিষেক ছিদ্র। কিন্তু এই তিনটি ছিদ্রে মধ্যে কেবল একটি ছিদ্রই নিষেকযোগ্য এবং বাকি দুটি বন্ধ্যা। ফলে একটি ছিদ্র দিয়ে নিষেক হয় এবং এটি সম্পূর্ণ গোলাকার ছিদ্র হিসেবে দেখা যায়। বাকি দুটিতে নিষেক না হওয়ার দরুন সংকীর্ণ হয়ে যায়।
সাধারণ অনেক জিনিসের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে নানা রহস্য। নারকেল এবং এর তিনটি চিহ্ন প্রায় সকলেই দেখেছেন, কিন্তু কেন এগুলো সৃষ্টি হয়েছে বা কীভাবে হয়েছে, হয়তো জানতেন না অনেকেই। অথবা জানতেন না নারকেলের এই তিন ছিদ্র নিয়ে রয়েছে নানা উপকথাও। সত্যিই, পৃথিবী রহস্যময়!
This article is in Bengali Language. It describes the myth and scientific explanations about the human face like indentation on the husk of coconut. Necessary references are listed below.
১) Ahuja S. C., Ahuja S., Ahuja U., Coconut – History, Uses and Folklore, Asian Agri-History Vol. 18, No. 3, 2014 (221–248)
২) CULTURE: Dominican Monsters & Mythical Creatures
৩) Why does a coconut have exactly three holes?
৪) THE ORIGIN OF THE COCONUT — A LEGEND OF MANAHIKI ISLAND
৫) Why does a coconut have exactly three “holes”?
Featured Image: boingboing.net