মিথোলজি বলতে অধিকাংশের চোখে গ্রীক আর রোমানদের ছবি ভাসে। যারা আরেকটু ঘাটাতে চায়, তাদের বিচরণ নর্স, এজটেক এবং কেল্টিক সংস্কৃতি অব্দি। অথচ উপকথা চর্চার এই দুই স্তর পার হয়েও পাঠকের কাছে এশীয় সংস্কৃতির মিথ পৌঁছায় না। চৈনিক পুরাণ তো হনুজ দিল্লি দূর অস্ত অবস্থা। অথচ প্রাচীন পৃথিবীর যেকোনো সভ্যতার উপকথার চেয়ে চৈনিক উপকথা অনেকাংশেই বিশেষত্বপূর্ণ। তার অন্যতম প্রমাণ আদিদেবতা ফাংকু।
উপকথা অনুসারে, ফাংকু পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এবং প্রথম প্রাণশক্তি। মহাজাগতিক ডিম ফুটে তার উদ্ভব। সেই সাথে উদ্ভব গোটা সৃষ্টিজগতের। চুলে ঢাকা শরীর আর বৃত্তাকার শিং নিয়ে অঙ্কিত হয় ফাংকুর ছবি। মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত পৃথিবীর অন্যান্য মিথের সাথে তার সাদৃশ্য রয়েছে। বিশেষ করে নর্স পুরাণের ইয়োতুন ইমির এবং মেসোপটেমিয় পুরাণের তিয়ামাতের সাথে মিল বিস্ময়কর। বিশ্বজগতের অস্তিত্বশীল হবার একটা ব্যাখ্যার কৌতূহলে অবচেতন মন থেকে জন্ম নিয়েছে এই সব মিথ। ফাংকুর আখ্যান চৈনিক পুরাণের সবচেয়ে পুরাতন আখ্যানগুলোর একটা। ফলে আছে অনেক রকম বিবরণ।
ফাংকু
ফাং এবং কু দুটি আলাদা শব্দ। ফাং অর্থ কুণ্ডলি এবং কু অর্থ প্রাচীন। অভিধানগত দিক থেকে ফাংকু অর্থ ‘প্রাচীন কুণ্ডলি’। যখন মহাজাগতিক ডিমের ভেতরে বিশ্বজগৎ সম্ভাব্য শক্তি হিসেবে বিদ্যমান ছিল; জায়গা স্বল্পতার দরুণ ফাংকু সেখানে ঘুমিয়ে ছিলেন কুণ্ডলি পাকিয়ে। প্রাচীনতা আর অদ্ভুত জন্ম প্রক্রিয়ার জন্য তার একটা বিশেষ অবস্থান আছে।
চিত্রকলা এবং সাহিত্যে প্রায়শ ফাংকুকে আঁকা হয় খাটো আর চুলে ঢাকা আদিম প্রাণীর রূপে। মানুষের মুখ হলেও মাথায় বৃত্তাকার শিং। হাতে থাকে হাতুড়ি এবং বাটালি। কখনো কখনো ধরা থাকে চন্দ্র এবং সূর্য। স্কটিশ যাজক জেমস লেগ হংকং বসবাস করেছেন দীর্ঘদিন। তার বর্ণনায়-
“সাধারণ মানুষের কাছে ফাংকু প্রথম ব্যক্তি; যিনি আকাশ এবং মাটিকে সৃষ্টি করেছেন। তাওবাদের গ্রন্থগুলোতে আমি তাকে রোমশ, বেটে এবং হাতে হাতুড়ি ও বাটালি ধরা অবস্থায় দেখেছি। যার মাধ্যমে সে পাথর ভাঙছে।”
মহাজগতের প্রথম সত্তা হিসেবে তার কোনো পিতামাতা নেই। বৈবাহিক সম্পর্কে না জড়ানোর কারণে সন্তানও ছিল না। অবশ্য কতিপয় বর্ণনায় তার সাহায্যকারী হিসেবে দেখা যায় ফিনিক্স, ড্রাগন, কিলিন এবং কচ্ছপকে। কচ্ছপ অমরত্ব আর শক্তির প্রতীক। কেবল চীনই না; পৃথিবী সৃষ্টি সংক্রান্ত অনেক পুরাণেই কচ্ছপের দেখা মেলে। কিলিন হলো ড্রাগন ও ইউনিকর্নের মাঝামাঝি প্রাণী। বেশিরভাগ সময়েই নিয়তি ও মঙ্গলার্থে আবির্ভূত হয়। চাইনিজ ড্রাগন ক্ষমতার প্রতীক। প্রথম দিকের রাজারা বংশানুক্রমিক ড্রাগনের প্রতীক ব্যবহার করে গেছে। সবিশেষ ফিনিক্স বলতেই বুঝায় পুনর্জন্মকে।
ধর্মীয় উত্তরাধিকার
ফাংকুকে স্মরণ করে প্রতিবছর কুয়াংতং রাজ্যের ফাংকু রাজা মন্দিরে উৎসবের আয়োজন করা হয়। চৈনিক লোকধর্মের গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র তিনি। তারপরেও অন্যান্য চরিত্রের মতো তিনি বিখ্যাত হতে পারেননি। পূর্বপুরুষের উপাসনা চীনা সংস্কৃতিতে বেশ আধিপত্য করেছে। এমনকি চীনের বৌদ্ধধর্মেও সেই প্রভাব বিদ্যমান। যেহেতু ফাংকু কারো পূর্বপুরুষ না; বোধ হয় সেটাই তার জনপ্রিয়তা হ্রাসের অন্যতম কারণ। কেবল বদান্য আর নিষ্পাপ দেবতা হিসেবে কারো কারো বিশ্বাসে তিনি আদৃত।
চীনের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে ফাংকু গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হিসাবে চর্চিত হয়। বর্তমানে তার ব্যাপারে প্রাপ্ত তথ্যাদির প্রধান উৎস শু চেং নামের প্রাচীন পণ্ডিত। এ বিষয়ের প্রথম লেখক হিসেবে তিন রাজ্যের যুগে জীবিত ছিলেন তিনি। তিন রাজ্যের যুগ বলতে ২২০ থেকে ২৮০ খ্রিষ্টাব্দ অব্দি বিস্তৃত সময়কে বুঝানো হয়; যখন চীন তিনটা রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইয়াংচির উত্তরে ওয়েই রাজ্য, দক্ষিণ-পশ্চিমে শু রাজ্য এবং দক্ষিণ-পূর্বে উ রাজ্য। এই বিশৃঙ্খলার যুগও বহু পণ্ডিত, বীর আর মেধাবী শাসকের জন্য স্মরণীয়।
মহাজাগতিক ডিম
তখনো মহাবিশ্বের জন্ম হয়নি। চারিদিকে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। ঠিক আঠারো হাজার বছরের বিবর্তনে অন্ধকার ঘনীভূত ও জমাটবদ্ধ হয়ে একটা ডিমের আকৃতি নিলো। সমগ্র উপাদান নিয়ে মহাবিশ্ব এখন ছোট্ট একটা স্থান। ডিমের ভেতরটা আস্তে আস্তে উত্তাল হতে থাকে। লাগাতার সংঘাতে লিপ্ত হয় দুই বিপরীত শক্তি ইন আর ইয়াং। চীনা ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় ইন এবং ইয়াং-এর আধিপত্য লক্ষ্যনীয়।
মহাবিশ্ব পরিচালিত হয় মহাজাগতিক দুই বিপরীত এবং পরিপূরক শক্তির মাধ্যমে। রাত-দিন, আলো-অন্ধকার, নারী-পুরুষ, শুষ্ক-আর্দ্র- এভাবে প্রকৃতির সমস্ত বিপরীত শক্তিই ইন বনাম ইয়াং সম্পর্কের প্রকাশ। একটা ছাড়া আরেকটা অসম্ভব। আলোর অস্তিত্ব ছাড়া অন্ধকার বুঝা সম্ভব না। একই কথা বিপরীতভাবেও প্রযোজ্য। এজন্য ইন আর ইয়াং এর মধ্যে ভারসম্য থাকাটা জরুরি। যাহোক, ডিমের ভেতরে ভারসম্য পৌছানোর আগে অব্দি চলতে থাকে এই দ্বন্দ্ব। ফাংকু গঠিত হয় সেই ইন ইয়াং প্রতীক হাতে ধরে।
হঠাৎ ফাংকু বুঝতে পারে সত্যিকার পরিস্থিতি। একটা ছোট্ট ডিমের ভেতরে কয়েদ অবস্থায় সে। নাড়াচাড়া করারও জো নেই। ফাংকু অস্বস্তিতে মোচর দিলো। নড়তে চাইলো মুক্তি লাভের জন্য প্রবল প্রচেষ্টায়। তাতে ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেল মহাজাগতিক ডিমটা। আলাদা হয়ে গেল কুসুম এবং সাদা আবরণ। সাদা আর পাতলা অংশ ভেসে উঠে তৈরি হলো মেঘ, নক্ষত্র এবং আকাশ। অন্যদিকে ভারি কুসুম অংশটুকু নিচের দিকে গিয়ে পরিণত হলো জমিনে। এভাবে আসমান ও জমিনের কাজ সমাপ্ত হলে দুই টুকরো হওয়া খোলস উপরের দিকে উঠলো। তারাই সময়ের ব্যবধানে রূপান্তরিত হলো চন্দ্র এবং সূর্যতে।
আকাশের উত্থান
আখ্যানের ভিন্ন একটা ধরনে আকাশ সৃষ্টির বিস্তারিত উদ্ধৃত হয়েছে। দুই বিপরীত শক্তি ইন আর ইয়াং এর মধ্যে সাম্যাবস্থা স্থাপিত হলো। ফাংকু দেখলো ডিমের ভেতরে নিজের বন্দীত্ব। হাতের কুঠার দিয়ে ভেতর থেকে ভাঙলো ডিমটা। মহাজাগতিক শক্তি পৃথক হতে শুরু করলো। ভাঙা ডিমের মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো সমস্ত গ্রহ এবং নক্ষত্র। ফাংকু ইন আর ইয়াংকে আরো আলাদা করলো। ইন থেকে জন্ম নিলো ভূমি; ইয়াং থেকে উপরের আকাশ।
যেকোনো সময় আসমান ও জমিন একত্রিত হয়ে যেতে পারে। বিলীন করে দিতে পারে মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু। অনেক ভেবে চিন্তে একটা উপায় বের করলো ফাংকু। যেহেতু প্রয়োজন ছিল ইন আর ইয়াংকে পরস্পর থেকে আলাদা রাখা। সেহেতু নিজের হাত দিয়ে মাথার উপরে আকাশকে ধরে রাখলো সে। প্রতিদিন ফাংকু তিন ফুট লম্বা হচ্ছিলে। সেই সাথে জমির পুরুত্ব বেড়ে উঠছিল দশ ফুট। এভাবে আঠারো হাজার বছরের ব্যবধানে আকাশ ও জমি বর্তমানের অবস্থায় পৌঁছে। পরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করে ফাংকু। তার চার অঙ্গ চারটি খামে পরিণত হলো; আকাশ সেই খামে ভর দিয়েই এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথিবীর আদ্যোপান্ত
আখ্যানের আরো একটি সংস্করণ পাওয়া যায়। সেখানে ফাংকু ছটফট করেও ডিম ভাঙতে ব্যর্থ হয়। বরং দীর্ঘ পরিশ্রমে ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যায়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ভাগ্যক্রমে।
সময়ের ব্যবধানে ক্ষয় হতে থাকে শরীর; আর সেখানেই নাটকের শুরু। ফাংকুর শেষ নিঃশ্বাস ঘনীভূত হয়ে পরিণত হয় মেঘে। হাড় রূপান্তরিত হয় পর্বতমালায়। বাম চোখ বিচ্ছিন্ন হয়ে সূর্য আর ডান চোখ বিচ্ছিন্ন হয়ে চন্দ্র তৈরি হলো। ফাংকুর শরীরের মাংস গলে গলে তৈরি করলো পৃথিবীর সমৃদ্ধ ভূমি। শিরা আর ধমনী রূপান্তরিত হয়ে জন্ম নিলো গিরিখাত এবং নালা। রক্ত নিঃসৃত হয়ে নদী আর সমুদ্র তৈরি হলো। চুলগুলো ঝরে গেলো শীঘ্রই; তাতে জন্ম নিলো নক্ষত্র, গ্রহ এবং মহাজাগতিক বিভিন্ন উপাদান। ফাংকুর দাঁত এবং হাড়গুলো খনিজ এবং মূল্যবান পাথরে পরিণত হলো। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো রূপান্তরিত হলো পৃথিবীকে ধরে রাখার চারটি খামে।
নর্স পুরাণে এই একই আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু দানব ইমির। দেবতা ওদিন ও তার ভাই ভিলি এবং ভে মিলি দানব ইমিরকে হত্যা করে। তার শরীরের মাংস দিয়ে তৈরি হয় মাটি এবং হাড়গুলো দিয়ে পাহাড় সৃষ্টি করা হয়। পাথর, বালু আর মার্বেলের সৃষ্টি হয় দাঁত থেকে। রক্ত আর ঘাম থেকে জন্ম নেয় নদী এবং সমুদ্র। ইমিরের মস্তিষ্ক থেকে মেঘ এবং মাথার খুলি থেকে রূপান্তরিত হয়েছে আকাশ। অন্যদিকে মেসোপটেমিয়া উপকথায় সমান্তরাল চরিত্র হিসাবে পাওয়া যায় তিয়ামাতের নাম। দেবতা মারদুক হত্যা করে তিয়ামাতকে। মৃতের শরীর দিয়ে তৈরি করে আসমান ও জমিন।
নর্স বা মেসোপটেমিয় মিথোলজির বর্ণনার সাথে প্রাচীন চীনের বর্ণনার অবাক করা এই সাদৃশ্যের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই। হতে পারে সভ্যতাগুলো কাছাকাছি মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। হতে পারে সেই প্রাচীনকালের যোগাযোগ।
অবশেষ
বিগ ব্যাং থিউরির আগমনে মহাবিশ্বের জন্ম ও বিবর্তন ব্যাখ্যার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু তার আগে মানুষ পৃথিবীর উৎস অনুসন্ধানে খাটিয়েছে মাথা। মহাজাগতিক ডিমের ধারণা খুব বেশি কাল্পনিক? শূন্য থেকে সৃষ্টি (এক্স নিহিলো) আর মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে সেই আদিম মস্তিষ্ক দ্বারা এর চেয়ে উত্তম উপায়ে প্রকাশ করা যেতো? বিভিন্ন সভ্যতার উপকথা এভাবেই নিজেদের বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম এবং অস্তিত্বচিন্তা অঙ্কন করে গেছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস আর উপাস্যের বৈচিত্র্যে চীন প্রাচীন কাল থেকেই সমৃদ্ধ। আর তাদের ঘিরে তৈরি হয়েছে অজস্র উপকথা। কখনো ব্যক্তিগত, কখনো সামাজিক। তারপরও ফাংকুর অবস্থান আলাদা। কারণ মানুষের তথাকথিত প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের প্রতিশ্রুতি নেই তার হাতে। আছে মহাবিশ্বের জন্মরহস্য। অস্তিত্বশীল সকল কিছুর অতীত।
This article is about Pangu, the creator god of Chinese mythology.
References:
1) The mythology of all races, Vol-12, Editor- Louis Herbert Gray, Boston, Marshall Jones Company, 1918,
2) Chinese Mythology: A Captivating Guide to Chinese Folklore Including Fairy Tales, myths and legends from ancient China, Matt Clayton, CreateSpace Independent Publishing Platform, 16 May 2018
3)https://mythopedia.com/chinese-mythology/gods/pangu/
4) https://www.ancient-origins.net/human-origins-folklore/pangu-and-chinese-creation-myth-00347
and which are hyperlinked.
Featured Image: Pangu and the creation of cosmos, taken from ancient-origins.net