Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্লেন্ডার ম্যান: মিম থেকে জন্ম নেওয়া ইন্টারনেটের প্রথম গ্রেট মিথ

স্লেন্ডার ম্যান সম্পর্কিত আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে আমাদের আরবান লেজেন্ড, ক্রিপিপাস্তা বা ডিজিটাল ফোকলোরের ব্যাপারে জানতে হবে। পৃথিবীর সকল অঞ্চলে, সকল ভাষাভাষী মানুষের মাঝে কিছু গল্প বা কথা প্রচলিত আছে। এসব গাঁথা বন্ধু থেকে বন্ধু, মা-বাবা থেকে ছেলে-মেয়েদের মাঝে, দাদা-দাদি থেকে নাতি-নাতনীদের মাঝে কিংবা কোনো বয়ষ্ক গুরুজন থেকে পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর ছড়িয়েছে। এসব কাহিনী উৎসারিত হয়েছে মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ, নীতি, প্রথা বা জাতির অতীত ইতিহাস থেকে। গল্প-কাহিনীর ছলে এগুলো প্রজন্মান্তরে ব্যাপন করেছে নীতিশিক্ষার বাণী, করেছে সমাজের প্রতি বক্রোক্তি। কেবল আসর জমানোর লক্ষ্যে বা ভৌতিক আবহ সৃষ্টির জন্যও এসব কাহিনী রচিত হয়েছে। যা অতীতের সাথে বর্তমানের শিকড়কে আরো সংহত করেছে। 

কুন্ডসেনের এডিটেড স্লেন্ডার ম্যান; Image Credit : bbc.com

এগুলো যাদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে, যাদের কর্ণ দ্বারা শ্রবণ করা হয়েছে— তারা এ সমস্ত কাহিনী বিশ্বাস বা অবিশ্বাস দুটোই করতে পারে। কালক্রমে ছড়িয়ে পড়া মৌখিক এ সকল লোককাহিনীকে বলা হয় কিংবদন্তি, লেজেন্ড বা আরবান লেজেন্ড। স্থানভেদে হয়তো এসব গল্পে কিছু পার্থক্য দেখা যেতে পারে। যখন লোককাহিনীর ব্যাপ্তিতে ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে বলা হয় ডিজিটাল ফোকলোর। অন্যদিকে ভৌতিক গল্প বা ‘ক্রিপ’ ছড়ানোর উদ্দেশ্যে যেসকল গাঁথা ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে, সেগুলোকে আমরা বলবো ক্রিপিপাস্তা। স্লেন্ডারম্যান বা স্লেন্ডার ম্যান এমনই একটি আরবান লেজেন্ড বা ক্রিপিপাস্তা। অন্যসব আরবান লেজেন্ডের সাথে এটির পার্থক্য হলো এটির জন্ম হয়েছে ইন্টারনেটের আগমনের পর। তাই এটিকে সবচেয়ে নবীনতম ক্রিপিপাস্তা বললেও ভুল হবে না। 

বলা হয়ে থাকে স্লেন্ডার ম্যান ৭ ফুট উঁচু মুখাবয়বহীন মনুষ্য সদৃশ একটি সত্তা। কালো কোট-টাই পরা, ধোপদুরস্ত এ জন্তুর হাতগুলোর দৈর্ঘ্য অস্বাভাবিক লম্বা। তার দেখা মেলে বিজন বন, পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি বা গোরস্তানের মত জনবিরল জায়গায়। ধীরস্থিরভাবে সে ওঁৎ পেতে থাকে শিকারের অপেক্ষায়। তার শিকাররা সাধারণত কম বয়সী ছেলে-মেয়ে হলেও, বুড়োরা তার হাত থেকে নিরাপদ; এ কথা বলা যায় না।

প্রথমদিককার অপর একটি স্লেন্ডার ম্যান মিম; Image Credit : cbsnews.com

বর্তমানে আমরা যে স্লেন্ডার ম্যানের সাথে পরিচিত, তার জন্ম ২০০৯ সালের ১০ জুন সামথিং অওফুল নামক ওয়েব ফোরামে। সেখানে মানুষ ভয় পাবে এমন মডার্ন মিথ তৈরির জন্য আইডিয়া চাওয়া হয়েছিল। ভিক্টর সার্জ ছদ্মনাম ব্যবহারকারী এরিক কুন্ডসেন ঐ থ্রেডে দুটি এডিটেড ছবি পোস্ট করেন। ছবি দুটো ছিল সম্ভবত আশির দশকের, যেগুলোতে কিছু বাচ্চাকাচ্চার পেছনে একটি লম্বাটে, অশুভ সত্তাকে বিরাজমান অবস্থায় দেখা যায়। কুন্ডসেন স্লেন্ডার ম্যানের ছবি নির্মাণকালে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন এইচ পি লাভক্র্যাফট, স্টেফেন কিংয়ের মতো লেখকদের রচিত গল্প এবং অসংখ্য সিনেমা, মিথ, ভিডিও গেইম থেকে। ছবি পোস্টের পাশাপাশি তিনি কিছু অস্পষ্ট তথ্যও জুড়ে দেন। যাতে ছবির ১৪ জন বাচ্চাসহ ফটোগ্রাফার গায়েব হয়ে গেছে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। মিমের মাধ্যমে শুরু হওয়া কুন্ডসেনের কল্পিত চরিত্র নেটিজেনদের মাঝে নিয়ে আসে সৃজনীশক্তির দমক। সকলে স্লেন্ডার ম্যানকে নিয়ে নিজের মতো করে গল্প লিখতে আর ছবি ম্যানিপুলেট করতে শুরু করে। এভাবে নয়া জমানার কিংবদন্তিতে পরিণত হয় এ চরিত্র। যে প্রক্রিয়াকে বিশেষজ্ঞরা আখ্যা দিয়েছেন ‘ওপেন-সোর্সিং অভ স্টোরিটেলিং’ নামে। 

স্লেন্ডার ম্যানের মিথের বীজ বপন থেকে শুরু করে মহীরুহের মতো ডালপালা ছড়ানোর প্রক্রিয়াটি ইন্টারনেটে হলেও, প্রাচীন রূপকথায়ও তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ চরিত্রের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তার খোঁজে আমাদের যেতে হবে ষোড়শ শতকের জার্মানিতে। যেখানে অস্বাভাবিক দীর্ঘকায় একটি চরিত্রের ব্যাপারে জানা যায়। মুখাবয়বহীন এ চরিত্র বাচ্চাকাচ্চাদের অপহরণ করে নিয়ে যেত বনের ভেতর। তার নাম ছিল ‘ডের গ্রভমান’ বা ‘দ্য টল ম্যান’। কিছু কিছু জায়গায় বলা হয়েছে সে একজন মস্তকহীন নাইট। প্রাচীন জার্মানরা তাকে জন্ম দিয়েছিল ছোটদের একা একা বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানোর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে। এছাড়া কিছু প্রাচীন গুহাচিত্রেও স্লেন্ডার ম্যান সদৃশ প্রাণীর উপস্থিতি দেখা গেছে।

ডের গ্রভমান বা দ্যা টল ম্যান; Image Credit: medium.com

আধুনিক যুগের এই কিংবদন্তি কেবল আধিভৌতিক কোনো চরিত্র নয়, বলা হয়ে থাকে তার ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতাও রয়েছে। এসব ক্ষমতার ব্যাপারে বিভিন্ন ভাষ্য অনুযায়ী পার্থক্য দেখা যায়। তবে সকল বর্ণনাতে যেসকল সাধারণ ক্ষমতার ব্যাপারে জানা যায় সেগুলো হলো:

১. সিলেকটিভ ইনভিজিবিলিটি: এ ক্ষমতাবলে স্লেন্ডারম্যান, কে তাকে দেখতে পাবে আর কে পাবে না; তা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। 

২. টেন্টাকল আর্মস: অনেক বর্ণনায় বলা হয়েছে সে তার হাতকে কর্ষিকায় রুপান্তর করতে সক্ষম। যা দেখতে অক্টোপাসের হাত-পায়ের মতো দেখায়। কোথাও কোথাও তার পিঠ থেকে কর্ষিকা বের করার কথাও জানা যায়।

৩. অল্টারিং হাইট: স্লেন্ডার ম্যান তার উচ্চতা পরিবর্তন করতে পারে। নানা মতে বিভিন্ন সময় তার উচ্চতা ৬-১৫ ফুটের ভেতর বলে জানা গেছে। 

এগুলো ছাড়া বিভিন্ন সময় শিকারকে বাগে আনতে স্লেন্ডার ম্যান টেলিপ্যাথি, মাইন্ড কন্ট্রোল, ওয়েদার কন্ট্রোল, ইম্পার্সোনেশন, ক্যামোফ্লাজ ইত্যাদি শক্তির প্রদর্শন করেছে বলে শোনা যায়। 

কীভাবে স্লেন্ডার ম্যান এসব ক্ষমতা পেয়েছে তা নিয়ে নেটিজেনদের আছে নানা তত্ত্ব। এগুলোতেও ভাষ্যভেদে ভিন্নতা রয়েছে। এগুলোর ভেতর যেগুলো বেশি জনপ্রিয়, সেগুলো হলো:

১. কোয়ান্টাম থিওরি: এ থিওরি অনুযায়ী স্লেন্ডার ম্যান হলো দেহসর্বস্ব একটি প্রাণী, কিন্তু তার পরমাণুর মতো আচরণের ক্ষমতা রয়েছে। থিওরিটির মূলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স থাকলেও এখন পর্যন্ত এর স্বপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। 

২. কোর থিওরি: এই মতবাদ অনুসারে স্লেন্ডার ম্যান একটি কাল্পনিক জীব। কিন্তু অগণিত ইন্টারনেটে ব্যবহারকারীদের মিলিত কল্পনাশক্তি তাকে দিয়েছে একটি ভিত্তি। এবং বর্তমানে তার সুসংহত উপস্থিতি রয়েছে আমাদের মনোজগতে।

৩. স্যুডো সায়েন্টিফিক থিওরি: এ থিওরির সমর্থকরা দাবি করেন, আমরা যে ত্রিমাত্রিক জগতে বাস করি; স্লেন্ডার ম্যান এসেছে তার বাইরের কোনো জগত থেকে। তাই আমাদের বিজ্ঞান দ্বারা তার কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। 

এসব তত্ত্ব অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘ। আর কিছু না হলেও এগুলো প্রমাণ করে একটি আরবান লেজেন্ডের অস্তিত্ব প্রমাণে মানুষ কত কিছু করতে পারে!

প্রাচীন গুহাচিত্রে স্লেন্ডার; Image Credit: rewritingchemistry.wordpress.com

পপ কালচারে বার বার দেখা গেছে এ চরিত্রকে। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু গেম, ডকুমেন্টারি ও সিনেমা। স্লেন্ডার ম্যানের জনপ্রিয়তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে মার্বেল হর্নেটসের। তারা এ মিথকে নিয়ে নির্মাণ করেন একটি ৮৭ পর্বের একটি ওয়েব সিরিজ। 

অনলাইনে এ ক্রিপিপাস্তা নিয়ে মাতামাতি পর্যন্ত বিষয়টি নির্দোষ বিনোদনের পর্যায়ে ছিল। কিন্তু কাল্পনিক এ চরিত্র অনুপ্রাণিত করেছে বাস্তব জীবনে অপরাধ সংঘটনে। বাস্তব অপরাধ সংঘটনে স্লেন্ডার ম্যানের যে প্রভাব; সেটিকে ব্যাখ্যা করা যায় তুলপা ইফেক্টের মাধ্যমে। তিব্বতীয় বৌদ্ধদের থেকে উদ্ভূত এ থিওরি মতে, যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক মানুষ কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করে, তাহলে সেটি বাস্তবে প্রকট হবে। মানে বিশ্বাস করলেই বস্তু মিলায়। এভাবে তুলপা ইফেক্টের মাধ্যমে স্লেন্ডার ম্যান ইন্টারনেটের দুনিয়া থেকে হাজির হয়েছে বাস্তবের জগতে। স্লেন্ডারের অস্তিত্ব বিষয়ক কোর থিওরিটি এসেছে তুলপার থিওরি থেকে।

স্লেন্ডার ম্যানের টেন্টাকল; Image Credit: wallpapersafari.com

২০১৪ সালের ৩১ মে উইসকনসিনের ওয়াকিশা নামক স্থানে দুই ১২ বছর বয়সী বালিকা তাদের এক সহপাঠীকে লুকোচুরি খেলতে বনে নিয়ে যায়। এবং সেখানে তার উপর ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। ঐ বছর পৃথকভাবে আরো দুই টিনেজ মেয়ে এমন কাজ করে। একজন মা আর ভাইকে রেখে ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এবং অন্যজন ছুরি হাতে অফিস ফেরত মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদের সকলে স্লেন্ডার ম্যান নিয়ে আচ্ছন্ন ছিল এবং পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে বলে স্লেন্ডার ম্যানকে তুষ্ট করতেই তারা এসব করেছিল। এমন অপরাধীদের বলা হয় প্রক্সি। তবে আশার খবর হলো- সম্প্রতি এরকম অপরাধ আর হতে দেখা যায়নি।

Related Articles