২০০৮ সালে একদল জীবাশ্মবিদ পোল্যান্ডের লিসোবিৎসাতে খুঁজে পায় প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছরের পূর্বের ডাইনোসরের মতো দেখতে একটি প্রাণীর জীবাশ্ম। তখন তারা এর নাম দিয়েছিল ‘ড্রাগন অব লিসোভিৎসা’। তখন তারা ধারণা করেছিলেন, এই প্রাণীটিই হয়তো একসময়ের বিখ্যাত Tyrannosaurus rex ডাইনোসরের পূর্বপুরুষ। তাদের ধারণা যে একবারে অবান্তর ছিল না, তা কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারবেন। দ্বিপদী প্রাণীটির যে অংশগুলো পাওয়া গিয়েছিল, আকারে ছোট হলেও সেগুলোর সাথে ডাইনোসরের গঠনের যথেষ্ট মিল রয়েছে। পরবর্তীতে ডাইনোসরের মতো এই প্রাণীটির নাম দেওয়া হয় Smok wawelski।
Smok wawelski, দ্বিপদী এই শিকারি প্রাণীগুলো পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে T. rex ডাইনোসরেরও প্রায় ১৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে। Smok শব্দটিকে পোলিশ ভাষায় অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় ড্রাগন। এই প্রাণীদের ব্যাপারে সম্প্রতি যে তথ্যটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তা জানলে অবাক না হয়ে উপায় নেই। শিকারকে খাওয়ার সময় এরা পুরো চিবিয়ে খেত, এমনকি বাদ যেত না হাড়ও। হাড় চিবিয়ে খাওয়া বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীটির বিষ্ঠার ফসিল পরীক্ষা করার পর নতুন এই তথ্য উন্মোচন করেছেন সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
শুরুতে এই প্রাণীটিকে অ্যালোসরাসের (Allosaurus) পূর্বপুরুষ মনে করা হলেও, পরবর্তীতে এদের উল্লেখ করা হয় নতুন বড় শিকারি আর্কোসর হিসেবে। যদিও এই ধারণাটিকে সাধারণ ও প্রাথমিক একটি বিবৃতি বললে অত্যুক্তি হবে না। আর্কোসরিয়া মেরুদণ্ডী প্রাণীদের একটি দলের সমষ্টি, যেখানে ক্রোকোডাইলিয়ান, ডাইনোসর এবং আরও অন্যান্য বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীরাও জড়িত। Smok wawelski কুমিরের সাথে বেশি সম্পর্কিত নাকি বিখ্যাত ডাইনোসরের সাথে, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিল পার্কার ও অন্যান্য কয়েকজন গবেষক মনে করেন, ডাইনোসরের চেয়ে বরং কুমিরের সাথে এই প্রাণীটির বেশি মিল রয়েছে। জেগৎস নিৎভিয়াস্কি, মার্টিন ও আহলবার্গের গবেষণাপত্রে বিস্তারিত ফলাফলের সাথে যুক্ত করা হয়েছে বিখ্যাত ডাইনোসরের সাথে ঠিক কতটা মিল বা সম্পর্ক রয়েছে আলোচিত আর্কোসরের।
Smok ছিল বড় আকারের দ্বিপদী আর্কোসর প্রজাতির প্রাণী, এই আর্কোসরের দলে অবশ্য ডিম দেওয়া প্রাণী থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের পাখি ও কুমিররাও অন্তর্ভুক্ত। আধুনিক আর্কোসররা যদিও আস্ত শিকার হাড়সহ গিলে খায়, তবে Smok wawelski শিকারের হাড় চিবিয়ে ভেঙে নির্দিষ্ট আকারে নেওয়ার পর গিলে নিত। আপসালার গবেষকরা এই প্রাণীটির ১০টি বড় আকারের কপ্রোলাইট (Coprolite) বা ফসিল হয়ে যাওয়া বিষ্ঠা পরীক্ষা করেছেন, যেগুলো পাওয়া গিয়েছে পোল্যান্ডে। এই পোল্যান্ডই ছিল প্রাগৈতিহাসিক ট্রিয়াসিক (Triassic) যুগের বিশালাকার এই প্রাণীদের আবাসস্থল, যেখানে ২৫১ মিলিয়ন থেকে প্রায় ১৯৯ মিলিয়ন বছর পূর্বে দাপিয়ে বেড়াতো Smok wawelski।
উচ্চ ক্ষমতার এক্স-রে ব্যবহার করে দেখা গেছে, এই আর্কোসরদের কপ্রোলাইটে ৫০ ভাগই বিভিন্ন প্রাণীর হাড় বিদ্যমান! গবেষকদের মতে, কড়মড় করে চিবিয়ে খাওয়া হাড়গুলো পরীক্ষা করলে হয়তো খাদ্য শৃঙ্খলার প্রায় সব প্রাণীদের হাড়ই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এদের খাদ্য তালিকায় মাছ, উভচর, স্তন্যপায়ী-তৃণভোজী ধরনের ডাইসিনোডনটরাও (Dicynodont) ছিল। হাড় চিবিয়ে খাওয়ার ব্যাপারে এই প্রাণীগুলো এতটাই একাগ্র ছিল যে, অতিরিক্ত শক্ত হাড় খেতে গিয়ে হয়ত ক্রমাগত দাঁত ভেঙে যেত এদের এবং তাদের কপ্রোলাইটে ধারালো ভাঙা কিছু দাঁতের অংশও পাওয়া গিয়েছে। এই দাঁতের অংশগুলো সম্ভবত হাড়ের সাথে পেটে চলে গিয়েছিল নিয়মিত খাদ্যের সাথে।
S. wawelski আকার মোটামুটি ৫-৬ মিটার এবং ইউরোপে ট্রিয়াসিক যুগের শেষের দিকে এরাই ছিল সবচেয়ে বড় শিকারি আর্কোসর। এদের শারীরিক গঠনের সাথে অবশ্য ডাইনোসরদের বেশ মিল রয়েছে। যা-ই হোক, যে ফসিল বিষ্ঠাগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল, সেগুলো দৈর্ঘ্যে ৮৭-২৫০ মিলিমিটার এবং প্রস্থে ৩০-৫০ মিলিমিটার ছিল। প্রাপ্ত বেশিরভাগ হাড়ে দাঁতের কামড়ের দাগ ছিল, যেগুলো S. wawelski’দের দাঁতের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। এমনকি, প্রাপ্ত কিছু হাড়ে তরুণ ডাইসিনোডনটের একটি মাথার কিছু অংশও পাওয়া গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি হাড় পাওয়া গিয়েছে অবশ্য ডাইসিনোডনটদের, এরপর যথাক্রমে আর্কোসর ও টিমনোস্পন্ডাইলদের (Temnospondyl)। প্রায় প্রতিটি কর্পোলাইটে দাঁত বা ভাঙা দাঁতের অংশ পাওয়া গিয়েছে। একটি নমুনায় বড় ১টি ও ২টি ছোট দাঁতের ভাঙা অংশ প্রায় অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান ছিল। প্রায় প্রতিটি কর্পোলাইটে দাঁতে অংশ পাওয়া প্রমাণ করে, হাড়সহ শিকার খেতে গিয়ে প্রায় নিয়মিতভাবে দাঁত হারাতে হত এই আর্কোসরদের। নিজেদের দাঁত পাওয়ার পর, গবেষকরা অবশ্য ক্যানিবালিজমের ধারণাও একেবারে বাতিল করে দেয়নি।
হাড় ও দাঁত ছাড়াও আরও যা পাওয়া গিয়েছে এগুলোর কর্পোলাইটে, সেগুলো হলো- সম্ভাব্য কয়লার টুকরো, প্রাণী ও গাছের তন্তু, কোয়ার্টজসহ আরও অন্যান্য খনিজ পদার্থ। ধারণা করা হচ্ছে, গোলাকার থেকে কোণাকৃতির যে দানাগুলো পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে পেটে চলে গিয়েছিল।
উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, হাড়ের অংশ সাধারণের তুলনায় বেশি পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তার খোঁড়াক যোগায়। সময়ের সাপেক্ষে খাবারের বিভিন্ন অংশ জমা হওয়ার পাশাপাশি S. wawelski’দের হজম শক্তিও ব্যাপারেও প্রশ্ন থেকে যায়। যদিও খাবারের ধরন, পরিবেশ ও খাবারের সহজলভ্যতার উপর অনেক কিছুই নির্ভরশীল, তবুও মনে করা হয়, হজমের ক্ষেত্রে এরা কিছুটা ধীরগতি ছিল। বর্তমান যুগে আর্কোসররা অবশ্য প্রায় না চিবিয়েই শিকার পেটে পুরে নেয় এবং শিকারের হাড়ও সম্পূর্ণ হজম করতে সক্ষম। এদিক থেকে প্রাগৈতিহাসিক আর্কোসরের সাথে বর্তমানের আর্কোসরের সাথে পার্থক্য লক্ষ্যণীয়।
শিকারের হাড় চিবিয়ে খাওয়ার ব্যাপারে S. Wawelski’দের সাথে অবশ্য দারুণ মিল রয়েছে ডাইনোসরদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ও বিখ্যাত T. rex-দের। বিশাল আকৃতি এই ডাইনোসরদের দাঁত ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও উচ্চমাত্রার কামড় দেওয়ার বল প্রয়োগের মতো বিবর্তিত। তাছাড়া, কর্পোলাইটে হাড়ের যে আকার ও দাঁতের যে কামড়ের দাগ রয়েছে, সেগুলোর সাথে এই ডাইনোসরদের কর্পোলাইটে পাওয়া হাড়ের সাথে দারুণ মিল রয়েছে। এমনকি, এই দুই প্রাণীর কর্পোলাইটে প্রাপ্ত হাড়ের পরিমাণও প্রায় সমান।
এই আর্কোসরদের আকার T. rex ডাইনোসরের তুলনায় বেশ ছোট হলেও, নিজেদের সময়ে এরা অন্যতম প্রধান শিকারি প্রাণী ছিল। নিজেদের সময়ে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানোর সময়ের বিশাল পার্থক্য থাকলেও, শিকারের ব্যাপারে এই দুই প্রজাতির মধ্যে মিল লক্ষ্যণীয়। গবেষকরা মনে করছেন, মেসোজোইক ডাইনোসরদের সাথে আর্কোসরদের সম্ভাব্য যোগসূত্রের প্রাথমিক ধারণার সূচনা হতে পারে এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য থেকে।
This article is in Bangla language. It is about 210 million old predator Smok wawelski ate bones and its own teeth. Necessary references have been hyperlinked.
Feature Image: Jakub Kowalski