Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে প্রাণীটি হারানো পা পুনরূৎপাদনে সক্ষম!

ব্যাঙ আমাদের সকলের পরিচিত একটি উভচর প্রাণী। এদের জীবন চক্রের কয়েকটি দশার একটি হচ্ছে ব্যাঙাচি দশা। ডিম ফোটার পরপরই আসে এই ব্যাঙাচি দশা। এই দশায় এরা মাছের মতো ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য পরিচালনা করে। এরা পানিতে সাঁতার কাটে, খাদ্য গ্রহণ করে ও আকারে বড় হতে থাকে। এই সময়ে এদের পুচ্ছদেশে লেজ থাকলেও কোনো পা থাকে না।

ব্যাঙের জীবনচক্র; Source: coloringpageland.com

অপরদিকে ব্যাঙাচি দশা কিছুদিন পর অনেকটা বড় হয়। সে সময় এদের পা সৃষ্টি হতে থাকে। মাথার অংশও স্পষ্ট হতে থাকে। তবে এই সময়েও এরা ফুলকার সাহায্যে শ্বাস নেয় ও লেজ থেকেই যায়। আরেকটু বড় হলে এদের দেখতে অনেকটা পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙের মতো দেখায়। এই সময় এরা ফুলকার পরিবর্তে আমাদের মতো ফুসফুস দিয়ে শ্বাসকার্য পরিচালনা করে। এছাড়াও লেজ আস্তে আস্তে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সামান্য কিছু অংশ থাকে। এভাবেই একটি ব্যাঙ পূর্ণাঙ্গরূপ প্রাপ্ত হয়। পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙের লেজটি শরীর দ্বারা সম্পূর্ণ শোষিত হয়ে যায়।

ব্যাঙাচির মতো একটি প্রাণী অ্যাক্সোলসল, Source: nnationalgeographic.com.au

একটি ক্ষুদ্র ব্যাঙাচি যখন পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে রূপান্তরিত হয় তখন নানাবিধ পরিবর্তন সাধিত হয়। সে সময় ব্যাঙাচির সাথে আর মিল খুঁজে পাওয়া যায় না বললেই চলে। ব্যাঙাচির মতো দেখতে স্যালাম্যান্ডার জাতীয় একটি প্রাণী হচ্ছে অ্যাক্সোলসল। এই প্রাণীটিও উভচর স্বভাবের। এদেরও ব্যাঙাচির মতো লেজ থাকে, ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়। তবে এদের এসব আর কখনই পরিবর্তিত হয় না। অর্থাৎ বলা চলে এই প্রাণী কখনই শিশু থেকে পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রাপ্ত হয় না। পূর্ণাঙ্গরূপ প্রাপ্ত না হলেও কিন্তু যথাসময়ে বাচ্চা উৎপাদনের জন্য উপযোগী হয়। আজকের লেখায় এই বিস্ময়কর প্রাণীটি সম্পর্কে জানাবো।

অ্যাক্সোলসলের নিকটাত্মীয় টাইগার স্যালামান্ডার, Source: oaklandzoo.org

অ্যাক্সোলসল এর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Ambystoma mexicanum। মাংশাসী এই প্রাণীটি গড়ে ১০-১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এরা দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে অ্যাক্সোলসলকে মেক্সিকান ওয়াকিং ফিস বলা হয়। যদিও এরা মাছ নয়। দেখতে স্যালামান্ডারের মতো হওয়ায় অনেকে গিরগিটির মতো সরীসৃপ বলে থাকেন। কারণ স্যালামান্ডারকে আবার গিরগিটির মতো দেখা যায়। কিন্তু স্যালামান্ডার এবং অ্যাক্সোলসল কোনোটাই গিরগিটির মতো সরীসৃপ নয়। এরা উভচর স্বভাবের প্রাণী।

অ্যাক্সোলসলকে মেক্সিকো শহরের নিকটস্থ সোসি মিলকো হ্রদে পাওয়া যায়। এই প্রাণীকে দেখতে মেক্সিকার স্যালামান্ডারের মতো দেখায়। স্যালামান্ডারের মতো দেখা গেলেও অ্যাক্সোলসল সারা জীবন পানিতে কাটিয়ে দেয়। অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে অ্যাক্সোলসল পূর্ণাঙ্গ আকারপ্রাপ্ত হয় ও পানি থেকে উপরে উঠে আসতে পারে। তবে সাধারণত এরা সোসি মিলকো হ্রদ এবং খালের তলদেশেই সারাটি জীবন কাটিয়ে দেয়।

অ্যাক্সোলসলকে টাইগার স্যালামান্ডারের নিকটাত্মীয় ধরা হলেও এটি আকারে টাইগার স্যালামান্ডারের চেয়ে কিছুটা বড় হয়। এরা সম্পূর্ণ কালো, সবুজাভ বাদামী কিংবা নানা ধরনের বাদামী দাগযুক্ত হতে পারে। লিউসিজমের প্রভাবে সাদা বর্ণেরও অ্যাক্সোলসলের জন্ম হতে পারে।

খাবার শিকারে ব্যস্ত অ্যাক্সোলসল; Source: imgur.com

অ্যাক্সোলসলের মুখ বৃহৎ ও প্রশস্ত হয়ে থাকে। এদের খাদ্যাভ্যাস মাংশাসী স্বভাবের। শিকারকে ধরে মুখে নেয়ার জন্য পানি চুষে নেয়। সেসময় পানির সাথে শিকারী খাবার মুখে প্রবেশ করে। এ উপায়ে এরা বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, ছোট মাছ ইত্যাদি খায়। পূর্ণবয়স্ক অ্যাক্সোলসল জীবিত এবং মৃত উভয় প্রকার খাবার খায়। এদের দাঁতও সারা জীবন অপরিণত থাকে। তাই খাবারকে আঁকড়ে ধরতে পারলেও কামড় দিতে পারে না ও ছিড়ে ফেলতে পারে না। তাই এরা সাধারণত সম্পূর্ণ খাবারকে গিলে খেয়ে ফেলে। এ কারণে এদের মুখের আকারের সাথে সামঞ্জস্য হয় এমন সব ধরনের খাবারই খেতে পারে। এই প্রাণীকে গবেষণাগারে কিংবা অ্যাকুয়ারিয়ামেও পালন করা যায়। আবদ্ধাবস্থায় এরা প্রস্তুতকৃত খাদ্য, মাছের খাদ্যের অনুরূপ পিলেট খাবারও খায়। এছাড়াও হিমায়িত অথবা জীবিত ব্লাডওয়ার্ম, কেঁচো, ওয়াক্সওয়ার্ম ইত্যাদিও খেয়ে থাকে।

জলজ উদ্ভিদের সাথে আটকানো অ্যাক্সোলসলের ডিম; Source: momciclemania.com

অধিকাংশের মতে, অ্যাক্সোলসলের প্রজননের জন্য উপযুক্ত সময় ডিসেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত। তবে তারা বছরের যেকোনো সময়েই প্রজনন করতে পারে। প্রজননের শুরুতে উভয় প্রাণীই একে অপরের জননাঙ্গে চাপ প্রয়োগ করে। উভয় প্রাণীই বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। অতঃপর পুরুষ অ্যাক্সোলসল স্ত্রী অ্যাক্সোলসলের জননাঙ্গে স্পার্মাটোফোর জমা করে। স্পার্মাটোফোর হচ্ছে কোণাকৃতির জেলির মতো পদার্থ যার মাথায় শুক্রাণু থাকে। মিলনের পর ১০০-৩০০টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো জলের মধ্যে কোনো মাধ্যমের সাথে আটকে রাখে। ১০-১৪ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বাচ্চাগুলো ফোটার পরপরই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে থাকে। বাচ্চাগুলো ২-৩ মাস বয়সে শুক্রাণু উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। তবে শুক্রাণুগুলো ভাস ডেফারেন্সে পৌঁছাতে সক্ষম হতে আরও ২-৩ মাস সময় লাগে।

পর্যাপ্ত আয়োডিন পেলে টাইগার স্যালামান্ডারের মতো হয় অ্যাক্সোলসল; Source: nationalgeographic.com

অ্যাক্সোলসলের নতুন জন্মানো বাচ্চা কখনই পূর্ণাঙ্গ বয়স্ক হয় না। আজীবন শিশুই থেকে যায়, যা পূর্বেই বলা হয়েছে। এদের পালকের মতো ফুলকা থাকে, যা দিয়ে আজীবন শ্বাসকার্য পরিচালনা করে। সাধারণত আয়োডিনের ঘাটতিজনিত কারণে এরা টাইগার স্যালামান্ডারের মতো হয় না। যদি প্রচুর পরিমাণ আয়োডিন সরবরাহ করা যায়, তবে এরা টাইগার স্যালামান্ডারের মতো হয়।

সবচেয়ে অবাক করা কথা হচ্ছে, এরা হারানো অঙ্গ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পুনরূৎপাদন করতে পারে! বিজ্ঞানীরা দেখেন, যদি কোনো কারণে অ্যাক্সোলসলের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে তা আবার জন্মে থাকে। গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, ম্যাক্রোফেজ নামক রোগজীবাণু ভক্ষণকারী ও ক্ষতস্থান নিরামায়কারী কোষ এই বিচ্ছিন্ন পা পুনরূৎপাদনের জন্য দায়ী। গবেষকরা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ অ্যাক্সোলসলের শরীরে প্রবেশ করান। এর ফলে ম্যাক্রোফেজ নামক কোষগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয় বা সংখ্যায় কমে যায়।

অ্যাক্সোলসলের পা পুনরূৎপাদনের পদ্ধতি; Source: sitn.hms.harvard.edu

দেখা যায়, যে সকল অ্যাক্সোলসলের শরীর থেকে ম্যাক্সোফেজ কোষ ধ্বংস করা হয়, সেগুলো নতুন পা জন্মাতে পারে না। বরং কাটা পায়ের স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্কার-টিস্যু বা কলা জন্মায়। স্কার-টিস্যু হচ্ছে আমাদের কেটে যাওয়া অংশে জন্মানো কোষ ও কলার মতো। গবেষকরা রাসায়নিক পদার্থ প্রবেশ করিয়ে ফলাফল পাওয়ার পর, পুনরায় অ্যাক্সোলসলের শরীরে ম্যাক্রোফেজের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন। এতে দেখা যায়, অ্যাক্সোলসল আবারও নতুন পা জন্মাতে পারছে। সুতরাং বলা যায়, অ্যাক্সোলসলের ক্ষতস্থান নিরাময়ে ম্যাক্রোফেজের গুরুত্ব অনেক।

অ্যাক্সোলসলকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে আলোচনার শেষ নেই। এ নিয়ে প্রচুর গবেষণাও হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশা করেন, হয়তো অ্যাক্সোলসলের মতো মানুষেরও হারানো পা পুনরূৎপাদন করা সম্ভব হবে। যদিও বিষয়টি এখনও অনেক কঠিন। মানুষের পা পেশী, হাড়, রক্তনালী, স্নায়ুকোষ ইত্যাদি জটিল উপকরণের সমন্বয়ে গঠিত। তাই এই গবেষণা এখনও আলোর মুখ দেখা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবুও নানা কারণে গবেষণাগারে প্রচুর সংখ্যক অ্যাক্সোলসল ব্যবহৃত হচ্ছে।

অ্যাক্সোলসলকে শিকার করার মতো প্রাণীর সংখ্যা খুবই কম। এদের প্রধান শত্রু হচ্ছে তেলাপিয়া এবং কার্প জাতীয় মাছ। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারাও আক্রান্ত হয়ে থাকে। মানুষের খাদ্য তালিকায় যুক্ত থাকাও এই মাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত হয়। এছাড়াও ক্লোরিনযুক্ত পানিও এদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ২০০৬ সালে International Union for Conservation of Nature (IUCN) প্রাণীটিকে মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান দিয়েছে। বর্তমানেও এদের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

ফিচার ইমেজ – sitn.hms.harvard.edu

Related Articles