বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকুরিয়াম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম এক জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান এই দানবাকার অ্যাকুরিয়ামটি ছয় একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এর প্রতিটি তলায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের শুধু জলচর ও উভচর প্রাণীই নয়, বরং পৃথিবীর দুষ্প্রাপ্য সব প্রবাল, রেইন ফরেস্টের বিরল প্রজাতির উদ্ভিদেরও দেখা মিলবে। ৭৫০ প্রজাতির জলজ প্রাণীর জীবন্ত প্রায় সতের হাজারেরও বেশি নমুনা দিয়ে অ্যাকুরিয়ামটি গড়ে তোলা হয়েছে।
বাল্টিমোর অ্যাকুরিয়াম প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাস
বোস্টনের নিউ ইংল্যান্ড অ্যাকুরিয়াম থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ১৯৭০ সালের দিকে বাল্টিমোর শহরেও অ্যাকুরিয়াম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা শুরু হয়। বাল্টিমোর অন্তঃপোতাশ্রয় (ইনার হার্বার) পুনঃনির্মাণের অংশ হিসেবে শহরের তৎকালীন মেয়র উইলিয়াম ডোনাল্ড শেফার এবং আবাসন ও উন্নয়ন বিভাগের তৎকালীন কমিশনার রবার্ট সি এমব্রি অ্যাকুরিয়ামের ধারণাকে উসকে দেন।
কিন্তু শহরের কিছু বিজ্ঞজন এই পরিকল্পনার সমালোচনা করতে থাকেন। তারা পরিকল্পনাটিকে বাস্তবসম্মত নয় বলে মতামত দেন। এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে যে অ্যাকুরিয়ামটি তৈরি হবে, তা দর্শকদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হবে বলে তারা বিভিন্ন সভায় তুলে ধরতে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে প্রশাসনকে সরে আসার জন্য ক্রমাগত চাপও দিতে থাকেন। ফলে অ্যাকুরিয়াম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়।
১৯৭৬ সালে বাল্টিমোর অ্যাকুরিয়ামের বিষয়ে ভোটাভুটি হয়। শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা অ্যাকুরিয়াম তৈরির পক্ষে ভোট দেন। সেখান থেকেই পুরোদমে অ্যাকুরিয়াম প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়ে যায়। এর নকশার দায়িত্বে ছিলেন স্থপতি পিটার চার্মাইফ। ১৯৭৮ সালের ৮ আগস্ট নির্মাণকাজ শুরু হয়।
১৯৭৯ সালে মার্কিন কংগ্রেস থেকে বাল্টিমোরের নতুন অ্যাকুরিয়ামটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় অ্যাকুরিয়াম’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়। ৮ আগস্ট ১৯৮১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অ্যাকুরিয়ামের যাত্রা শুরু হয়।
অ্যাকুরিয়ামের সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণে নেওয়া বিশেষ উদ্যোগ
উদ্বোধনের পর থেকেই অ্যাকুরিয়ামটি দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। প্রথম বছর এই এর দর্শকসংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ লক্ষের মতো। এ দর্শকসংখ্যা প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে অ্যাকুরিয়ামটির দ্বিতীয় বিল্ডিংয়ের এবং ২০০৫ সালে ৬৫,০০০ বর্গ ফুট (৫,৫৭৪ বর্গ মিটার) কাচের তৈরি এক নতুন প্যাভিলিয়নের উদ্বোধন হয়।
২০০৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ন্যাশনাল অ্যাকুরিয়ামের সাথে বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকুরিয়াম যৌথভাবে কাজ শুরু করে। এই দুই অ্যাকুরিয়াম একটি চুক্তির মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যকার তথ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে একই ধরনের শিক্ষণীয় ম্যাটেরিয়ালগুলো তৈরি ও প্রদর্শনের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০১৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসির শাখাটি বন্ধ হয়ে গেলে সেখান থেকে প্রায় ১৭০০ নমুনা বাল্টিমোর অ্যাকুরিয়ামে স্থানান্তরিত হয়। ২০০৯ সালে জলজ বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষায় এখানে একটি সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
অ্যাকুরিয়ামটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
বিশ্বের জলজ সম্পদ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করাই হচ্ছে এই অ্যাকুরিয়ামের মূল উদ্দেশ্য। এখানকার সংরক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে সারা বিশ্বের জলজ প্রাণীর সংরক্ষণ, বংশবিস্তার এবং তাদের সুরক্ষার জন্য কাজ করে থাকে।
এছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেই সংরক্ষণের কাজকে আরও বেগবান করা হয়েছে। যেমন- চেসাপীক বে জলাভূমিকে দূষণমুক্ত করা, সমুদ্রের বিপন্ন প্রাণীদের রক্ষার বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া, সমুদ্র উপকূলে আটকে পড়া অসহায় ও আহত সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উদ্ধার করা এবং চিকিৎসা দিয়ে তাদেরকে আবার সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
কী আছে এই অ্যাকুরিয়ামে?
সাগরতলের অজানা রহস্যগুলোকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছে বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকুরিয়াম। সাগরের বিভিন্ন প্রজাতির হাঙ্গর, ব্যাঙ, মাছ এবং ডলফিনগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার মজা দর্শকদের প্রতি মুহূর্তে রোমাঞ্চিত করে। অ্যাকুরিয়ামে পাঁচটি লেভেল আছে। একটি নির্দিষ্ট থিম নিয়ে একেকটি লেভেল গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রথম লেভেলে বিশ্বের দুই প্রান্তের প্রবাল প্রাচীরের হুবহু প্রতিরূপ তৈরি করা হয়েছে। প্রথমটি ‘ব্ল্যাকটিপ রিফ’, যা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে গড়ে ওঠা প্রবাল প্রাচীর ও অন্যটি উত্তর আটলান্টিক কোরাল রীফের এক নান্দনিক প্রদর্শনী। এই দুই অঞ্চলের প্রায় ৭০ প্রজাতির মাছ, ব্ল্যাকটিপ রিফ হাঙ্গর, সবুজ সামুদ্রিক কচ্ছপ থেকে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী এই লেভেলে দেখতে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় লেভেলের নাম দেওয়া হয়েছে 'মেরিল্যান্ড: মাউন্টেন টু দ্য সি’। এখানে মেরিল্যান্ড অঞ্চলের জলজ প্রাণীর জীবনযাত্রার নানা বৈচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। বুলফ্রগ, ছোট প্রজাতির কচ্ছপ ডায়মন্ড ব্যাক টেরাপিনের মতো নানা বৈচিত্রময় প্রাণীর দেখা মিলবে এখানে।
বিভিন্ন সময় প্রকৃতিগত পরিবেশের যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তার ফলে অনেক প্রাণীই সেই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর কিছু প্রাণী অভিযোজনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের প্রাণীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে অ্যাকুরিয়ামের তৃতীয় লেভেল, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'সার্ভাইভিং থ্রু অ্যাড্যাপ্টেশন'।
চতুর্থ লেভেলে রয়েছে আমাজন রিভার ফরেস্ট, সি ক্লিফস, কেল্প ফরেস্টের বহু বৈচিত্রময় উদ্ভিদ ও প্রাণীর সম্ভার। কৃত্রিমভাবে তৈরি সি ক্লিফসে অবাধে বিচরণ করা বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক পাখি, জলের তলার বৈচিত্রময় উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী এ লেভেলে দেখতে পাওয়া যাবে।
ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্টের দুর্লভ সব উদ্ভিদ, বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসভূমি হিসেবে পরিচিত এ ক্রান্তীয় অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাণী দিয়ে অ্যাকুরিয়ামের পঞ্চম লেভেল সাজানো হয়েছে। এখানে রয়েছে বিষাক্ত ব্লু পয়জন ডার্ট ফ্রগস, বিলুপ্তপ্রায় গোল্ডেন লায়ন ট্যামারিন, ভয়ঙ্কর ট্যারেন্টুলা, বিভিন্ন প্রজাতির হাঙ্গর এবং বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখির এক বিশাল সংগ্রহ। দর্শকদের কাছে এখানকার আরও এক আকর্ষণ শার্ক অ্যালি।
ছোট-বড় সব বয়সীদের কাছে অ্যাকুরিয়ামের 'পিয়ার ফোর প্যাভিলয়ন'টি চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। প্যাভিলয়নটিতে একটি পুল রয়েছে। দর্শকদের বিনোদনের জন্য পুলে ডলফিনের নানা খেলা দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। দিনের একটা বিশেষ সময়ে ডলফিনদের এ প্রদর্শনী হয়ে থাকে। অন্যসময় বিভিন্ন প্রজাতির ডলফিনদের পুলে খেলে বেড়াতে দেখা যায়। এছাড়া ডলফিনদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সেশনগুলোও কম দৃষ্টিনন্দন নয়!
অ্যাকুরিয়ামে দর্শকদের জন্য আরও রয়েছে 'অ্যানিমেল প্ল্যানেট অস্ট্রেলিয়া'। এই স্থানে অস্ট্রেলিয়ার নদী এবং নদী তীরবর্তী এলাকায় পাওয়া যায় এমন প্রাণী, যেমন- বিরল প্রজাতির কচ্ছপ, কুমির, মাছ, সাপ, টিকটিকি, মুক্ত উড়ন্ত পাখি এবং উড়ন্ত শিয়াল প্রভৃতির সন্ধান পাওয়া যাবে। অ্যাকুরিয়াম দেখতে আসা ছোট বাচ্চাদের পছন্দের জায়গা এই অ্যানিমেল প্ল্যানেট অস্ট্রেলিয়া।
এখানকার জেলিফিশ ইনভেনশন লেভেলটিও বেশ চমকপ্রদ। এই লেভেলটিতে বিভিন্ন প্রজাতির অদ্ভুত, রহস্যময় ও প্রাগৈতিহাসিক সময়ের জেলিফিশদের এক আশ্চর্য সুন্দর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে।
রয়েছে ডিজিটাল প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা
অ্যাকুরিয়াম জুড়ে রয়েছে টাচ স্ক্রিনে নানা প্রাণীর প্রদর্শন। অ্যাকুরিয়াম জুড়ে থাকা টাচ স্ক্রিনে জলজ প্রাণী সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে। ডিজিটাল প্রদর্শনীর মাধ্যমে দর্শনার্থীরা অ্যাকুরিয়ামে থাকা বিভিন্ন প্রাণী সম্পর্কে জানতে এবং তাদের সম্পর্কে নানা ভিডিও দেখতে পারেন। সারাদিন জুড়ে বেশ কয়েকবার অ্যাকুরিয়ামের বিভিন্ন প্রদর্শনী ও কার্যাবলি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়ে থাকে।
দর্শকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অ্যাকুরিয়ামে প্রচুর কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য ডলফিন ডিসকভারি লেভেলের পাশেই সামুদ্রিক প্রাণীদের পুতুল নিয়ে খেলার বিশেষ ব্যবস্থা রাখা আছে।
এই অ্যাকুরিয়ামে শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্র দেখানোর জন্য ফোর-ডি মুভি থিয়েটারও রয়েছে। এই থিয়েটারে বিশেষ করে বাচ্চাদের উপযোগী চলচ্চিত্র, যেমন- হ্যাপি ফিট বা পোলার এক্সপ্রেস এর মতো অ্যানিমেটেড মুভি দেখার জন্য ছোট-বড় সবাই উৎসুক থাকে।
বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকুরিয়ামে এক বিস্তৃত এলাকা নিয়ে অবস্থিত। অ্যাকুরিয়ামের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো অ্যাডভেঞ্চার, আর তাতে পুরোপুরি সামিল হতে চাইলে পুরো একটি দিন লেগে যাবে। তা-ও মনে হবে অসম্পূর্ণ থেকে গেলো!
পৃথিবীর তিনভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। সেই জলের তলার যে অপার রহস্য তার কতটুকুই বা আমরা জানি! সে অজানাকে জানার কাজটি কিছুটা হলেও সম্ভব করে দিয়েছে এই বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকুরিয়াম। এই অ্যাকুরিয়ামের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিখ্যাত আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী লোরেন আইজলির একটি উদ্ধৃতি:
“যদি এই গ্রহে কোনো ম্যাজিক থাকে, তবে তা রয়েছে শুধুমাত্র জলে।”
সেই ম্যাজিকের সন্ধানে বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকুরিয়ামে তাই আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ।
This article is in Bengali language. This story tells A brief history of the National Aquarium in Baltimore. Baltimore National Aquarium has become Maryland’s largest tourist attraction. All the sources are hyperlinked inside the article.
Featured Image: aqua.org